ছুটি খুবইছোট একটি বাক্য । কিন্তু এর প্রভাব সেই শিশুকাল থেকে মৃত্যু অবধি আমাদের জীবনে প্রচন্ডভাবে প্রভব বিস্তার করে আছে। না এটা লিখতে আমি বহুবচন ব্যাবহার করবো না।কারন আর সবার উপরে এর প্রভাব এতো ব্যাপক না ও হতে পারে। তাই শুধু নিজের কথাটা লেখাই সবচেয়ে ভাল।।
মনে পড়ছে সেই ছোটবেলার যখন প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হবার কথা। কারন ছুটি কথাটার মাহাত্য এর আগে কখনো বুঝি নি বা দরকারও পরে নি।স্কুলে ভর্তি হবার পরই বুঝলাম এটা নিত্যদিনের গতবাধা সাময়িক এক মুক্তির নাম। এইদিনগুলিতে নেই সময়মত স্কুলে যাওয়া, পড়ার তেমন ঝামেলা নেই। নেই মাষ্টারদের চোখ রাঙ্গানীও। শুধু খেলা আর বেড়ানো।।
সবাই ঢাকা থাকতাম বলে এই দিনগুলিতে বিশেষ করে জৈষ্ঠ-বৈশাখ মাসে ছোটমামাকে মেঝমামা পাঠাতেন আমাদের নানাবাড়ীতে নেওয়ার জন্য। তখন লঞ্চে ছিল প্রায় ২ঘন্টার পথ।লঞ্চের একটানা কান ফাটানো আওয়াজও তখন সুরেলা লাগতো।উপরে বসে দেখতাম লঞ্চটা কিভাবে নৌকা এবং পাশের গাছপালায় ছাওয়া ঘরগুলিকে কি সুন্দর পিছনে ফেলে যাচ্ছে।মাঝে মাঝে ভোউউ ডাক।আর আব্বা দাদার একমাত্র সন্তান বিধায় দাদাবাড়ি শুধু ঠিকানাতেই সীমাবদ্ধ। তাই সেই বাল্য এবং কৈশরের সব আনন্দ ভীড় করে থকতো নানাবাড়িতে। মামাতো আর বেড়াতে আসা অন্যান্য খালাতো ভাইবোন মিলে যেন হৈচৈ,খেলা আর হুটোপুটির হাট বসতো। আর মামা-খালাদের দেখতাম গোল হয়ে বসে কি যেন গল্পপ করছে আর মাঝে মাঝেই হেসে উঠছে। তখন ভাবতাম খেলা আর হৈচৈ ফেলে কি এমন আনন্দ থাকতে পারে?আমগাছ গুলি দুদিনেই ন্যাড়া হয়ে যেত।কাঠাল পাকে নি কি হয়েছে?মুচি ভর্তা করে খাবো।(কাঠলের কঁচি রোয়া পেড়ে তাতে শুকনো মরিচ পুড়ে মাখানো)। ফলাফল কয়েকদিনের মাঝেই কাঠাল গাের অবস্থাও আমের মতই হতো। মাঝে মাঝে দেখতাম মামা হাট থেকে টুকরী ভরে আম র কাঠল নিয়ে এসেছে।এতো কি আর খাওয়া যায়? খাওয়ার চেয়ে নষ্ট হতোই বেশী। আর কাঠালের কষ আর আমের রসে পুরো চেহারা যা হতো না, তা সেসময় না বুঝলেও আজ বড়দের সেসময়ের মুচকি হাসি মনে করিয়ে দেয়।রাতে উঠানে মাদুর-খ্যাতা বিছিয়ে নানা-নানী সম্পর্কের কারো চারপাশে গোল হয়ে শুয়ে-বসে ভুত-রাক্ষস-পরী-আর রাজকন্যাদের গল্প শুনতে শুনতে সেখানেই ঘুমে ঢলে পড়া।
তারপর ধীরে ধীরে মামাদের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা ছোট খাল দিয়ে অনেক পানি বয়ে গেল। আমরাও বড় হলাম। কলেজে ভর্তি হলাম।ভাইবোনরা কেউ ভার্সিটিতে,কারো বিয়ে হয়ে গেল।ছোটরা কেই প্রাইমারী কেউ বা হাইস্কলে।কোন মাই তার একজন সন্তনকে রেখে বেড়াতে চায় না।স্বভাবতইঃ আমাদের কারোরই আর দেশের বাড়ী যাওয়ার সময় হয়ে উঠে না।আর বড় হওয়ার পরে সবার ইচ্ছে-বদলও একটা কারন। এই দিনগুলিতে কখনো বড়বোনদের বাড়ীতে যাওয়া বা তাদের নিয়ে আসা । কখনো বা বাড়ির অনুমতি নিয়ে কোন বন্ধুর বাড়িতে যাওয়া।সোজা কথায় পরিবেশ পরিস্থিতির কারনে রুচি বদল হওয়া।কিন্তু ছুটির সেই আমেজ আগের মতই রইলো। এই আনন্দের মাঝে কিছু এলো না বাধ সাধতে। শুধু বদলে গেল সময় আর পছন্দ।
তারপর এলো চাকুরী জীবন। বিশেষ করে আমাদের মত প্রবাসীদের। আমাদের কাছে তো ছুটি একটা বরাট ব্যাপার। বিয়ের মতই পাত্র-পাত্রী দেখা মানে সিদ্ধান্ত নেয়া,কবে যাব। তারপর শুরু হয় টিকেট কাটা থেকে শুরু করে প্রিয়জনদের চাহিদা মাফিক কেনা-কাটা। যে যতই কৃপন হোক না কেন এইসময়ে সেও চেষ্টা করে সবার জন্য কছু না কিছু কেনার জন্য।বন্ধু-বান্ধবদের চাহিদাকেও সন্মান দেখায়।আমি এমন অনেককে দেখেছি যারা কিনতে কিনতে প্রায় খালি হাতেই দেশে যায়। কিন্তু মুখে থাকে সবার চাহিদা মেটানোর পরিতৃপ্তির অনাবিল হাসি।বোকা না হয়েও বোকর মত সুন্দর ভাবে হেসে বলে ভাই কিনতে যেয়ে হাত খালি হয়ে গেল।কি করবো,সবাইকেতো কিছু না কিছু দিতে হবে-তাই না।
নিজেরা ব্যাবহার না করলেও স্ত্রী বা সন্তান,ক্ষেত্রবিশেষে ভাইবোনদের জন্য আইফোন,স্যামসুং এস সিরিজ বা হুয়াই,কিনে ফেলে দরাজ হাতে। কেউ কেউ কম্পিউটারও।খোজ নিলে দেখা যাবে এসবের বেশীর ভাগই হবে অপচয়। কিন্তু প্রবাসী,এতো কিছু ভাবে না আর ভাবতেও চায় না।
বলাই বাহুল্য আমিও যে এর ব্যতিক্রম নই।ঘুম,নির্ঘুম হয়ে যায় কয়েকদিন আগের রাত থেকে।কিভাবে পৌছুবো?মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখি ট্রেন মিস করার মত প্লেনটাও আমাকে ফেলেই চলে যাচ্ছে। কিন্তু এটা সুধুই স্বপ্ন,বাস্তব নয়।
আর একটা ছুটির কথা এখন বেশ মাঝে মাঝেই মনে পড়ে।তা হলো সব কিছু ছেড়ে একেবারেই ছুটি। থাকবে না কোন মায়া,থাবে পিছুটান। ছুটি শেষ হলে কাজে যোগ দেয়ারও প্রয়োজন হবে না।একা, একেবারে একা ঘুমিয়ে থাকবো অনন্তের মাঝে।।
বিঃদ্রঃ ঈদের ছুটি শুরু হলো আজ থেকে। একটানা নয় দিন।সবাইকে ঈদের আগাম শুভেচ্ছা।।