somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: স্বাধীনতার গেটে থমকে আছে লালপরির স্বপ্ন

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১১ বিকাল ৩:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





০১.

পানা ঢাকা পুকুরের পানি এখনো শুকোয়নি।
দেবদারু গাছের আড়ালে নাম না জানা বুনো পাখির কলরবে মুখরিত দ্বীপ্রহর। বাঁশঝাড়ের কোন এক পাশে ঝোপের ধারে সাদারঙ বক দাড়িয়ে একটু জিড়িয়ে নিচ্ছে। এ বেলা ঘর থেকে বের হওয়া যায়না; রোদ ঝাপটে ধরে যখন শরীরটাকে; তিক্ততা তখন স্থিমিত করে দেয় সব কাজকে।
পানা ঢাকা পুকুরের পাশেই রয়েছে ছোট ছোট খুপরি ঘরওয়ালা একটা বস্তি। এবেলা যদি খেতে পায় ওরা ও বেলা থাকে উপোস। উপোস থাকা মানুষ গুলোর বুকে আছে সাহস আর ধৈর্য্যের মহাপাশ। বস্তির পাশেই রয়েছে বড় পুকুর কলোনি; বস্তির লাগোয়া উঁচু দেয়াল ঘেরা বাড়িটাই কলোনীর শেষ বাড়ি আর বস্তির শেষ খুপরিটা হলো ঘরওয়ালীর। উপোস থাকা মানুষগুলো উচু দেয়াল ঘেরা এ বাড়ির ভেতরে আসেনা। চোখ ওদের ঠেকে যায় দেয়ালে অবদিই।
মরচে ধরা লোহার গেট পেড়িয়ে ওদের পা খুব বেশি একটা পড়েনি। ভেতরের পরিষ্কার ঝকঝকে পথে পড়ে থাকে চুপসানো ফুল; গেটের ফাক থেকে শুধু মাঠ ফুল আর ঘাট দেখা যায়। ঘরওয়ালীদের ক্ষিদের যন্ত্রনা ভুলে থাকার এক মুক্ত বিনোদন হলো এই বাড়ির মধ্যেকার নিত্যদিনের রোজনামচা।

এ বাড়ির লোকজন গোটা দশেক।
তিন বছরের সুপ্তি সহ আরও এক জোড়া আট-দশ বয়সী ছেলে মেয়ে আছে ওদের। উপোস থাকা ছোট্ট ঘরওয়ালীদের আছে আট পায়ের নর-নারী আর ছোট্ট একটা লালপরি। ক্ষিদের পেটেও ওরা স্বপ্ন দেখে আগামী দিনগুলোতে ভালো করে খেয়ে পড়ে বেচে থাকার। ওরা অক্টোপাশের মতো হাত পা মেলে একপাশে থাকে।
উচু দেয়ালে বাড়ির নুপুর ম্যাডাম রোজ কলেজে যায়। জয়ন্ত তার লাভার। অর্ধ যুগের প্রেম! কিন্তু, এখনো হয়নি বাঁধানো ফ্রেম।
ফ্রেম বাধাঁই হবে কাল।
আজ গেছে গায়ে হলুদ।
ফুলপরিদের পেটে তাই খিচুরি পড়েছে সন্ধ্যে বেলা। আহা রোজ যদি এমনি করে বিয়ে কিংবা গায়ে হলুদ হতো কারো; নিজেদের ভাষায় ওরা সংলাপ বলেই চলে; দেশের কথা ভাবতে গেলে ক্ষিদেটা মাথাচাড়া দেয়; পরনে ভালো কাপড় জোটেনা; ওরা ভাবে সরকার বোধহয় অন্ধ নয়তো গরিব; দেশের লোক যে খেতে পায়না সেটা ভাববার সময় বুঝি খুব কম।

০২.

নুপুর বিছানায় শুয়ে ভাবছে অবশেষে বিয়েটা হচ্ছে তাহলে। ভালোবাসার পূর্নতার আর বাকী নেই ........
দেশের অবস্থা ভালো না। বড় আয়োজন করা গেলনা। তাই অনেককেই বলা হয়নি। জয়ন্ত গ্রামের বাড়ী থেকে কাল আসছে না; আসবে হল থেকে। গ্রামের বাড়ী থেকে ওদের সবাই মিরপুরে মামার বাড়ীতে উঠেছে। বিয়েটা হয়ে গেলেই গ্রামে চলে যাবে।
নুপুরের চোখ কি যেন খুজে; থমকে যায়। দেয়ালর টিকটিকি মুখ নাড়িয়ে কি যেন বলতে চায় ? বস্তির বাসী খাবারের মাছি চুপ হয়ে আছে আজ। ক্লান্তি নয় শান্তি নেই মনে।
রাত তখন নিশুতি।
হাওয়া আছে থমকে। পরিবেশ নিস্তব্ধ।
নুপুরের চোখে ঘুম নেই; ঘুম আসবে বলে সেই যে কখন চোখ থেকে উবে গেছে আর আসছে না।
পাশ ফিরতে যাবে আচমকা গুলির শব্দ !! কেপে উঠলো ঘর!!
বসে উঠল নুপুর। গুশির শব্দ এক নাগারে বেড়েই চলেছে।
বিছানা থেকে গড়িয়ে নামে ও হাত বাড়ায় দরজায়।
বাড়িময় আতংক গেটের বাইরে আর্তনাদ।
ছোট কাকু , তিতলি মাসী, রঞ্জু, সবাই উঠোনে এসে জড়ো হয়েছে।

পাশের বস্তিতে আগুন জ্বলছে।
বিভিন্ন রকমের গুলির শব্দ। চারদিক প্রকম্পিত।
তিতলী মাসী আর রঞ্জু গেট পেড়িয়ে বাইরে আসার আগেই জলন্ত নগরী ঢাকার অবর্ননীয় দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে যায় ওরা। চারপাশ থেকে বৃষ্টির মতো গুলি আসছে। সেই সাথে হাহাকার কান্না।
কাল নুপুরের বিয়ে তাই পুরো বাড়িময় আলোকসজ্জা। আজ এ বাড়িতে পটকা ফুটবে তার বদলে সারা শহরের বারুদ ফুটছে।
বাড়ির কুকুর গুলো থমকে গেছে গুলির তান্ডবে। ওরা হতবাক চোখে দাড়িয়ে আছে।
ঝোপের পাশে জোনাকি ছিল তাও এখন নেই। আওয়াজে আওয়াজে সরগরম এ কলোনি। শুধু মাটি ফেটে আসা কঠিন শব্দ।
চাঁদ রেখে আকাশে, কান পেতে বাতাসে দু পেয়ে উপোসী মানুষ গুলো ঘুমিয়ে ছিল; ছিল সারাদিনের ক্লন্তির মাঝে একটু ঘুম।
একটা দিন কাজ না পেলেই হলেও পেটের জলুনি বাড়ে ওদের সেখানে কদিন পর পর হরতাল হয়েই আসছে।
খিদে লাগা চাঁদ; কালকেশী রাত; ওদের অভাবের আয়নায় শুধু পেটের ক্ষুদা ভাসে।
উপোসী ঘরওয়ালীরা ভাবে এই রাতে উচু পাঁচিল ঘেরা মানুষ গুলো কি করছে কে জানে। কি করছে নুপুর ম্যাডাম।

০৩.

সেবার রঞ্জুর কেক কাটার দির ওদের খিচুরী খাইয়েছিল। মশলা আর স্বাদ লেগে আছে এখনও । আরও কত কি ভাবতে গেল ঘরওয়ালী হঠাৎ গুলির শব্দ !! পটকা ফুটলো কি নুপুরদের বাড়ি !! উঠে বসবার আগেই উড়ন্ত বারুদ আচমকা দরজা ঠেলে আগুন নিয়ে এলো।
আর্তচিৎকার- মাইরা ফেললো রে.. রমিজার ঘরে আগুন লাগসে রে...... আমার মাইয়ারে নিয়া গেল কুত্তার বাচ্চারা; তোরা ওরে ধর
সংলাপে সংলাপে বারুদ গন্ধে আর আগুন শিখায় ভরে আসছে সব। বস্তির মানুষ স্বপ্ন বুনতে বুনতে মৃত্যুকে ডেকে নিচ্ছে; বর্বর ভাবে বন্দুকের আঘাতে জান পাখি উড়ে যাচ্ছে। মানুষ আজ খাচার পাখি।
হায়েনার দল সারি বেঁেধ পুরো শহরময় মানুষ মেরে বেড়াচ্ছে; মানুষ কিভাবে মানুষ মেরে ফেলে সেটাই ভাবা দ্বায়। জগন্নাথ হলের চারপাশে গুলির আওয়াজে সব ধোয়াময় ঘুমিয়ে থাকা প্রাণ গুলো হতবাক না হয়ে পারেনি এতোটা কঠিন হবে সেটা বুঝে উঠতে পারেনি।

০৪.

ছোপছোপ আধারের ভোর। কান্নার ভোর। রক্তে মেশানো রাজপথের ভোর। পড়ে থাকা লাশের স্তুপের ভোর।
এই ভোরেই রঞ্জু চোখফাটা কান্না নিয়ে গেট পেরুল।
নুপুর ছুটে এলো রঞ্জু জয়ন্তর খবর কি ? কেমন আছে ও ?
রঞ্জুর মুখ যেন ভাস্কর্য হয়ে গেছে। কথা আটকে গেছে। কি বলবে ....
নুপুর হাত ধরে ঝাকুনি দিয়ে বলল ; বল না
রঞ্জু মাথা নিচু করে বললো জয়ন্ত দা আর নেই : রাতেই গুলি লেগে মারা গেছে।
-জয়ন্ত মরতে পারে না; তুই ভুল দেখেছিস; ওর লাশ কোথায় আমি দেখবো।
ছুটে পালালো নুপুর।
রাজু পথ আটকালো এখন বাইরে বের যাস নে ওরা তোকেও মেরে ফেলবে; তোকে ও গুলি করবে।
-করুক : জয়ন্ত নেই ; আমিও থাকবোনা। আচমকা মাটিতে গড়িয়ে পড়ে নুপুর। সবাই ভেতর বাড়িতে নিয়ে যায়। গুলি এখনো থামেনি; কান্নার যেন হাট বসেছে আজ।
ভোর থেকে সকাল হয়ে আসছে। মরিচা পড়া গেটের পাশে দাড়িয়ে আছে; উপোসী ঘরওয়ালীর লালপরি।
ওর অসহায়ত্বটা আজ হাজার হাহাকারের মাঝে মিশে গেছে।
২৫ মার্চের কালরাত কেড়ে নিয়েছে জয়ন্ত কে; দিয়ে গেছে একাকীত্ব। গেটের বাইরে দাড়ানো পিতৃমাতৃ সহায় সম্বলহীন লালপড়িকে কি দিয়ে গেল এই কালরাত্রী ?
রক্তের দাগ মুছবে কি ? স্বাধীনতা মিলবে কি হাজার লাশের স্তুপের বিনিময়ে। নাকি ফুটপাতের ঘুটে কুড়ানি হয়ে যাবে বেবুশ্যে লালপরি।


---------------------------সমাপ্ত---------------------------------------
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:৪২
১০টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×