শিরোনামটি দেখে অযথা খেপে না গিয়ে আশাকরি আগে দয়া কোরে ধৈর্য সহ পুরোটা পড়বেন।
কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী মি. চাং-হং উন পদত্যাগ করেছেন। ৪৭৬ জন যাত্রী সমেত একটি ফেরী ডুবির ঘটনা ও তার উদ্ধার তৎপরতার ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে তিনি এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এতে ১৮৮ জনের প্রাণহানী ঘটে এবং ১৪৪ জন নিখোঁজ হন, যাদের অধিকাংশই বিদ্যালয়ের ছাত্র। যদিও এই দুর্ঘটনার সাথে সরাসরি তার কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু তারপরও প্রশাসনিক ব্যর্থতার দায় থেকে তিনি নিজেকে মুক্ত ভাবতে পারেন নাই। সে কারণেই নিখোঁজদের আপন আত্মীয়দের মত তাকেও নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়েছে। নিজ দেশের জনগণ, যাদের ভোটে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন তাদের প্রতি কতটা দায়িত্ববোধ ও মমত্ববোধ থাকলে এতবড় ত্যাগ স্বীকার করা যায় তা বোঝার মত মগজ আমাদের আছে কি?
এই খবর শুনে আমাকে একজন প্রশ্ন করলেন- কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী কি কুকুর খান না?
তার মতে আমরা হালাল খাদ্য গরু, ছাগলের গোস্ত খাই। কিন্তু তারপরও তো কুকুর খাওয়াদের মত হতে পারলাম না। আসলেই কি কুকুর খাওয়া হারাম?
সেই মূহুর্তে আমি কি বলব তা ভেবে পাচ্ছিলাম না। তাই একটু চিন্তা করে উত্তর দেবার জন্য খবরের কাগজে চোখ বুলানোর ভান করতে লাগলাম। যদিও এ খবরটি আমি আগেই দেখেছিলাম।
সে মূহুর্তে পবিত্র কোরআনের ১৮ নং সূরা কাহফ এর ১৮ নং আয়াতের কথাই আমার বার বার মনে পড়ছিল। যেখানে হিংস্র বাঘ কিংবা সিংহ নয়, বরং গুহাবাসিদের পাহারাদার হিসেবে একটি কুকুরের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে-
সূরা কাহফ (মক্কায় অবতীর্ণ)
(১৮:১৮) অর্থ- এবং তুমি তাদেরকে জাগ্রত ভাববে, অথচ তারা নিদ্রিত। আমি তাদেরকে পার্শ্ব পরিবর্তন করাই ডান দিকে ও বাম দিকে। তাদের কুকুর ছিল সামনের পা দুটি গুহা-দ্বারে প্রসারিত করে। যদি তুমি উঁকি দিয়ে তাদেরকে দেখতে, তবে পেছন ফিরে পলায়ন করতে এবং তাদের ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়তে।
আমি যতটুকু জানি সে অনুসারে পবিত্র কোরআনে মৃত, টাটকা রক্ত, মাদক ও শূকরের মাংস খাওয়া হারাম বলা হয়েছে। তবে সংকটের সময় কিছুটা ছাড় দেয়া হয়েছে। কিন্তু কুকুরের মাংস হারাম করা হয়েছে হাদিছ অনুসারে। কারণ কোরআনে সকল পবিত্র জিনিস খাবার ব্যাপারে নির্দেশ এসেছে এবং চতুষ্পদ গবাদি পশু খাবার কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ জন্তুর মধ্যে যেগুলো চতুষ্পদ ও তৃণভোজী সেগুলো খাবার কথাই বলা হয়েছে। আবার এই চতুষ্পদ ও তৃণভোজী প্রাণীকে যদি কোন হিংস্র প্রাণীতে খায় এবং এগুলো যদি জবেহ করা পর্যন্ত জীবিত থাকে তাহলে জবেহ করার পর এগুলো খেলে সমস্যা নেই। যেহেতু সরাসরি হিংস্র প্রাণীর মাংস খাওয়ার বিষয়ে আল-কোরআনে কিছু বলা হয়নি। কিন্তু আবার হাদিছ অনুসারে দেখা যায় যে এগুলো খাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে। তাই মুসলিমদের জন্য খাদ্য হিসেবে এগুলোর মাংস গ্রহণযোগ্য নয়। কুকুর যেহেতু তৃণভোজী প্রাণীদের অন্তর্ভূক্ত নয়, আবার এর মাঝে হিংস্রতাও রয়েছে। সম্ভবত সে কারণেই স্বাভাবিক অবস্থায় এর মাংস খাওয়া উচিত হবে না। তাছাড়া রাসূল (সাঃ) কিংবা সাহাবাগণ কখনও এটি খেয়েছেন বলেও প্রমাণ পাওয়া যায় না। আবার অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে কুকুর যেহেতু প্রভুভক্ত ও উপকারী প্রাণী এবং আল-কোরআন ও হাদিছ অনুসারে পাহারা ও শিকারের কাজে এগুলো ব্যাবহার করার নির্দেশনা আছে। তাই খাওয়ার উদ্দেশ্যে কুকুর মারতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে এটা ঠিক যে, শূকরের মাংস খাওয়ার ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে যেভাবে সরাসরি হারাম বলা হয়েছে, এগুলো সেই পর্যায়ভুক্ত নয়। সেইদিক থেকে বিবেচনা করলে ইচ্ছে করে ও নিয়মিতভাবে মৃত, টাটকা রক্ত, মাদক ও শূকরের মাংস খেলে অবশ্যই গোনাহ হবে অর্থাৎ ইহকালীন ও পরকালীন ক্ষতি ও জবাবদিহিতার হাত থেকে রেহাই নেই। কিন্তু নিয়মিতভাবে হিংস্র প্রাণীর মাংস খেলে পরকালে জবাবদিহি করার হাত থেকে রেহাই মিললেও পার্থিব শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হবার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া ঠিক হবে না। এরূপ বিশ্বাস করা ও প্রাত্যহিক জীবনে তা পালন করার ব্যাপারে একজন সাচ্চা মুসলিমের ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করার কোন অবকাশ নেই। কিন্তু তাই বলে কুকুর মাত্রই ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখা মোটেই ঠিক হবে না।
এখন প্রশ্ন হলো কোরিয়ার জনগণ কি গণহারে কুকুরের মাংস খেতে অভ্যস্ত? আমার জানা মতে দক্ষিণ কোরিয়ার খুব কম সংখ্যক মানুষই নিয়মিতভাবে কুকুরের মাংস খেয়ে থাকেন। জরিপে দেখা গেছে মোট জনসংখ্যার ৫% থেকে ৩০% মানুষ জীবনে এক বা একাধিকবার কুকুরের মাংস খেয়েছেন। অপরদিকে আবার একটি বড় অংশ তো কুকুরের মাংস খাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য সরকারের উপর চাপও দিচ্ছেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ না হলেও এই অভ্যাস ত্যাগ করার জন্য অন্তত সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠছে। নিশ্চয় এটির এমন কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া তাদের নজরে পড়েছে যার কথা বিবেচনা করেই হয়ত তাদেরকে এরূপ নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। অথচ আমাদের রাসূল (সাঃ) অনেক আগেই এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন এবং যা সারা বিশ্বের মুসলিমরা পালন করছেন।
এবার আসল প্রসঙ্গে আসা যাক। কুকুরের মাংস ভক্ষণ করার ব্যাপারে আমার বক্তব্য আমি আগেই তুলে ধরেছি। আমার বা আপনার মনোভাব যেমনই হোক না কেন- তা সার্বজনীন নয়, বরং একান্তই ব্যক্তিগত। অনেক কাল আগে থেকেই যে এই ভূপৃষ্ঠে বসবাসরত মানুষেরা কুকুরের মাংস খেতে অভ্যস্ত ছিল কোরিয়া সহ আরও বেশ কয়েকটি দেশে তাদের উপস্থিতি সেই সাক্ষ্যই বহন করে। যে কোন খাবারই অতিরিক্ত গ্রহণ করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কুকুরের মাংস কি পরিমাণে খেলে কতটা ক্ষতি হবে তা এখনও পরিষ্কার নয়। মহান স্রষ্টা সর্বজ্ঞ। তিনি যা জানেন, আমরা তার কানাকড়িও জানিনা। অজ্ঞতা বশত আমরা অনেক কিছুকেই অচ্ছুত ভাবতে পারি। কিন্তু স্বয়ং স্রষ্টার কাছে এর কোন মূল্য নেই। তাই তিনি অযথা কোন বিষয়কে সরাসরি হারাম বা হালাল সাব্যস্ত করেন না। তাছাড়া তিনি অযথা মানুষের উপরে কাঠিন্য আরোপ করেন না। ভাল ও মন্দের ব্যাপারে তিনি সরাসরি সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। আর যা এ দু’য়ের মধ্যবর্তী, সে সম্পর্কে নীরব থাকেন কিংবা সাবধানতা অবলম্বনের জন্য কিছুটা ইংগিত দিয়ে দেন। অতঃপর মানুষের পর্যবেক্ষণ ও গবেষণায় যদি এই মধ্যবর্তী জিনিসগুলো থেকে কোন কিছু ক্ষতিকর ও অগ্রহণযোগ্য প্রমাণিত হয়, তাহলে তা ব্যক্তি বিশেষে বা সমষ্টিগতভাবে আংশিক বা পরোপুরি বর্জন করতেই পারেন। কিন্তু তাই বলে সার্বজনীনভাবে এই মধ্যবর্তী বিষয়গুলোকে হারাম বা হালাল সাব্যস্ত করার এখতিয়ার কাউকেই দেয়া হয় নাই।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী মহোদয় কুকুর খান কিনা তা তার ব্যক্তিগত অভিরূচি। সে বিষয়ে নাক গলানো মোটেই উচিত হবে না। আর যদি খেয়েও থাকেন- তারপরও তিনি আল-কোরআনের বিধান মতে সরাসরি হারাম খান বলে প্রমাণিত হয় না।
নিশ্চয় মৃত, টাটকা রক্ত, মাদক ও শূকরের মাংস খাওয়া হারাম এবং হারাম জুয়া খেলা। আর হারাম খোর তারাও- যারা মানুষকে ট্র্যাপে ফেলে ঘুষ খায়, মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ঋণ দেয় এবং চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়ে তাদেরকে সহায় সম্বলহীন বানিয়ে পথে বসায়, যারা জনগণের নামে বরাদ্দ অংশ থেকে পারসেন্টেজ খায়, যারা চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসার ফাঁদ পেতে নিরীহ ও অসুস্থ মানুষকে নিয়ে ব্যবসা করে টাকা কামায়, চুরি, ডাকাতি, খুন ছিনতাই, অবৈধ ব্যবসা কোরে যারা টাকার পাহাড় গড়ে, অপরাজনীতির পথে নীতি বিবর্জিত হয়ে জনাতার সাথে জোচ্চুরি করে,,যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে ছদ্মবেশে মানুষকে বোকা বানায় ও স্বল্পমূল্যে আল্লাহর বাণী নিয়ে ব্যবসা করে।
জাতীয় ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমাদের দেশের অবস্থা চিন্তা করলে কুকুরের মাংস ভক্ষণ সে হিসেবে কোন অপরাধই নয়। বরং আসাহাবে কাহফের কুকুর সঙ্গির মত রক্ষক সঙ্গি পেলে আমরা ধন্য হব।
আর দেরি নয়। খুবই অল্প সময় আছে আমাদের সুপথে আসার।
|নেটে দেখলাম দামেস্কের ইয়ারামুক শরণার্থী শিবিরে অবস্থানরত ফিলিস্তিন ভাই-বোন ও শিশুরা খাদ্যের অভাবে কুকুর ও বিড়ালের মাংস খেতে বাধ্য হচ্ছে। যদিও তারা হারাম খাচ্ছেন না। কিন্তু তারপরও খুব মজা কোরে যে খাচ্ছেন তাও তো নয়। আসুন আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব, অপচয় ও বিলাসিতা ছেড়ে নিরীহ ও অত্যাচারিত মানুষের সাহায্যে হস্ত প্রসারিত করি।
ধন্যবাদ-
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ৯:৫৯