কাদা মাখা শৈশব
আমার ফুটবলের পায়ে খড়ি হয়েছিল গ্রামের আট-দশটা শিশুর মত। গ্রামের দুরন্ত শিশু-কিশোরদের কাদা মা্খানো গোলাকার বস্তু নিয়ে ছোটাছুটি দেখে ভীষণ ইচ্ছে করত সেইটায় একটু পা লাগাতে । একটা লাথি না মারতে পারলে জীবনটাই যেন বৃথা হয়ে যায়। একবার তীব্র উত্তেজনা আর আনন্দের কাছে হার মানল শহুরে পোশাকে দাড়িয়ে থাকা ইতস্ততঃ শৈশব। 'খেলবা?- অচেনা এক কিশোরের শরীরে কাদা মাখানোর সেই ডাক ছিল আসলে জীবন রাঙানোর ডাক। সত্যিই! এই দাগ থেকে দারুন কিছুই তো হয়েছিল। সেই চাকচিক্যহীন নোংরা বলের উপর কয়েকজন একসাথে ঝাপিয়ে পড়ার যে উত্তেজনা তার সাথে কি ব্রাজিল বেলজিয়াম অথবা ফ্রান্স আর্জেন্টিনা ম্যাচের তুলনা হয়?
বিশ্বকাপ
১৯৮৬ সাল। বাসায় তখনও টিভি আসেনি। ক্লাসের বন্ধুদের কাছে ম্যারাডোনার জাদুকরী পায়ের গল্প(এবং হাত!) শুনে নিজেকে বড়ই হতভাগা লাগতে লাগল। আমার বড়ভাইকে দেখতাম খেলা দেখতে বন্ধুর বাসায় চলে যেত। জার্মানীর সাথে ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা ফাইনালে উঠল। যত রাতই হোক আমার খেলাটা দেখতেই হবে। ভাইয়ার কাছে আবদার জানিয়ে রাখলাম আমাকে তার সাথে নিতে। ভাইয়ার হাত ধরে মাঝরাতে গেলাম খেলা দেখতে। ঘরভর্তি দর্শক। তুমুল উত্তেজনা। রুগেরি,বুরুচাগা,রুমেনিগে,ম্যারাডোনা নামগুলো স্মতির মণিকোঠায় অটুট এখনও। ৮৬ তে বেশি ছোট ছিলাম। ফুটবল ক্রেজ বুঝলাম ৯০ তে এসে। রজার মিলা,গয়কোচিয়া আর বিশেষ করে ম্যারাডোনার ওরা আমাকে এত মারে কেন লেখা ভিউকার্ড। আছে ম্যারাডোনা,লোথার ম্যাথিউসের বা ব্রাজিল দলের ভিউকার্ড। সাদাকালো টিভিতে দেখা তাদের সেই অনন্য পাসিং ফুটবলেই জন্ম নিল কোন খেলার প্রতি আমার প্রথম প্রেম। আর ব্রাজিলের প্রেমে পড়া তো অবশ্যম্ভাবী ছিল যখন বিটিভিতে ৮২ বা ৮৬ র ব্রাজিলের।
এই ফুটবল প্রেমিক ছেলের জন্য আমার বাবা একবার একটা ৩ নম্বরী ফুটবল কিনে আনলেন যা কিনা একটু বেশি পাম্প দিলেই ডিমের মত হয়ে যেত।সমবয়সীরা ততদিনে যেখানে ৪ নম্বর ফুটবল দিয়ে খেলছে তখন একসাইজ ছোট ডিম্ব-ফুটবল লইয়া আমি কি করিব।আমার সেকি মন খারাপ। ওটা দিয়েই খেলতে শুরু করলাম। দিনে খেলতাম আর রাতে স্বপ্ন দেখতাম। বিশ্বকাপে সাব্বির,কায়সার হামিদ,আসলামদের সাথে নিয়ে পেলে ম্যারাডোনার মত ৪/৫ জনকে কাটিয়ে গোল দিয়ে দিচ্ছি। স্টেডিয়াম ভর্তি লাল সবুজের পতাকা! বিশ্বকাপটা পেয়েছিলাম কিনা তা অবশ্য মনে নেই।
৮ ইঞ্চি শীল্ড
রুয়েটের বিশাল মাঠটা ফুটবলের দখলেই থাকত বিশ্বকাপ এর সময়। সেখানে ছোট-বড় বা বুড়ো নির্বিশেষে ৪/৫ টা দলের খেলা চলত একসাথে। মাঝে মাঝে এ পাড়া বনাম ওপাড়ার মধ্যে খেলা চলত। কারো সাথে খেলা দেয়ার পূর্বশর্ত ছিল কমপক্ষে ৬ ইঞ্চির একটা শীল্ড। খেলার আগে কত ইঞ্চি বা কয়টা শীলের (তখন শাপলার ছাপ বসানো কালো 'শীল্ড' যাকে আমরা ছোটরা শীল বলতাম) খেলা হবে বা খেলায় ফাউল থাকবে কিনা ইত্যাদি বিষয় কনফার্ম করে রাখা হতো যেন পরে ঝামেলা না হয়। একেকটা ম্যাচের জন্য চাঁদা তুলে কিনতাম সবচেয়ে ছোট ৬ বা ৮ ইঞ্চি শীল্ড । কোন টীম আমাদের মত গরীব হলে আবার দাম ভাগাভাগি করে একটা শীল্ডেই খেলা হত। হলুদ , আকাশী জার্সি এখনকার মত এত সহজলভ্য ছিলনা বা সেগুলো কেনার সামর্থও আমাদের সামর্থ্যও আমাদের ছিল না। তখন বাড়ি বাড়ি লেইস ফিতাওয়ালা আসত। একবার এক এরকম ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কয়েক গজ হলুদ ফিতা কিনলাম। জার্সি নাইতো কি? গায়ে হলুদ জার্সির বদলে সবার মাথায় হলুদ ব্যান্ড । আমার অভিনব এই আইডিয়াতে সঙ্গিরা চমৎকৃত হয়ে গেল। পরে একজন বুদ্ধি দিল খেলার সময় যেহেতু পায়ের দিকে বেশি চোখ থাকবে তাই এই ফিতা হাফপ্যান্টের নীচে হাটুর কাছে বাঁধা ভাল হবে। দলের জন্য সেরা গোল দাতার জন্য আছে পিতলের/তামার মেডেল। সারা শরীর কাদায়-ধুলোয় ডুবিয়ে কখনও সেই 'শীল' হাতে আবার কখনও শুন্যহাতে বিফল মনোরথে বাড়ি ফিরতাম। শীলগুলো হারিয়ে গেছে। দু'একটা মেডেল এখনও আছে। কখনো কখনো মনে হয় এই শীল বা মেডেলই আমার বিশ্বকাপ, এ অর্জন ম্যারাডোনা,রোমারিও বা লোথার ম্যাথিয়াসের হাতের সেই বিশ্বজয়ের চেয়ে কোন অংশে কম না।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:১৬