সাপ্তাহিক ছুটির দিন বলে আজ দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছিলাম। ঘুম থেকে উঠেই ছুটলাম কাঁচাবাজারে। ফিরতে না ফিরতে জুমআর নামাযের আযান শুনতে পেলাম। প্রস্তুত হয়ে গেলাম মসজিদে।
ফিরে স্বভাবশতঃ টিভিতে খবর দেখতে দেখতে খেতে বসলাম। কিন্তু টিভি সংবাদের শিরোনাম শুনে খাবার গলায় আটকে গেল। আমার প্রিয় 'মানুষ' হুমায়ূন আহমেদ নাকি নেই! চিৎকার করে কাঁদতে পারছি না- গলায় কি যেন দলা পাকিয়ে গেছে। আমার স্ত্রী জিজ্ঞেস করল- কি ব্যাপার! নাক টানছো কেন? আমি বললাম- বোধহয় ঠান্ডা লেগেছে...
কে ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ? একজন লেখক- যার বই পড়ে ভাল লাগে? একজন নাট্যকার- যার নাটক দেখে মজা পাই? একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা- যার সিনেমা দেখে আবেগে আপ্লুত হই? নাকি আরও বেশি কিছু?
তিনি আসলেই আমার কাছে ছিলেন এর চেয়ে অনেক বিশাল। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। শৈশব-কৈশোরে আমাদের বিনোদনের মূল মাধ্যম ছিল বিটিভি। আজ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়- শৈশবে-কৈশোরে ভাল লাগা কয়েকটি নাটকের নাম বলত- আমি যে কয়েকটি নাটকের নাম বলতে পারব তার প্রায় সবই হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টি। এইসব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি, হঠাৎ একদিন, অয়োময়, কোথাও কেউ নেইয়ের মত নাটকগুলি আমার শৈশবের মধুর স্মৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ! যেদিন বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হল, কিংবা যেদিন অয়োময়ের ছোট মির্জা সব ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালেন- সেদিন এই ক্ষুদ্র হৃদয়টিও ভেঙ্গে খান খান হয়ে গিয়েছিল!
শুধু তাই নয়- আজ যারা বাংলা নাটকের উজ্জলতম নক্ষত্র- সেই গুণী অভিনেতাদের অনেকেরই খ্যাতির মূলে রয়েছে হুমায়ূন আহমেদের নাটক। আসাদুজ্জামান নূর, আবুল হায়াত, হুমায়ুন ফরিদী, আলী যাকের, সুবর্ণা মুস্তাফা, তারানা হালিম, সারা যাকের, ডলি জহুর, ড. ইনাম আহমেদ, লাকি ইনাম, জাহিদ হাসান, বিপাশা হায়াত, ড. এজাজ আহমেদ প্রমুখ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রতিভার পরিচয় পাই হুমায়ূন আহমেদের নাটকেই।
সিক্সে উঠার পর ধীরে ধীরে রূপকথার ছেড়ে শুরু করি সেবা প্রকাশনীর বই পড়া। আমার বইয়ের প্রতি তীব্র আকর্ষণ তৈরি করেছিল সেবা প্রকাশনী। অবধারিতভাবেই একসময় হাতে আসে হুমায়ূন আহমেদের বই। প্রথম কোন বইটি হাতে পেয়েছিলাম মনে নেই- তবে সেটা 'এলেবেলে' হওয়ারই সম্ভবনা বেশি। মূলত রম্য ম্যাগাজিন উন্মাদে তাঁর লেখাগুলোর সংকলনই হচ্ছে 'এলেবেলে ১, ২'। কেউ যদি এখনও এই বই দুটি না পড়ে থাকেন, তাহলে আমি বলব সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা রম্য সংকলন এই দুইটি বই না পড়লে হুমায়ূন আহমেদের তীক্ষ্ণ জীবনদর্শন সম্পর্কে অনেক কিছুই অজানা থেকে যাবে। ধীরে ধীরে হুমায়ূন আহমেদের জগতে প্রবেশ করতে শুরু করি। একে একে পড়ে ফেলি প্রায় সব লেখা। আমার স্কুলের পাশেই একটি বইয়ের দোকানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় যেতাম। দোকান মালিকের সাথে ভাল খাতিরের সুবাদে নতুন আসা হুমায়ূন আহমেদের প্রায় প্রতিটি বই সবার আগে পড়ে আবার ফেরত দিতাম। খেয়াল রাখতাম- বইয়ে যাতে কোন ভাঁজ না পড়ে। নন্দিত নরকে, ময়ূরাক্ষী, দ্বৈরথ, নিশিথীনি, দারুচিনি দ্বীপ সহ অনেক বই তো হারিয়ে যাওয়ার পর আবার কিনেছি, পড়েছি কয়েকবার। সায়েন্স ফিকশনের ভিতর কুহক, ফিহা সমীকরণ, অনন্ত নক্ষত্রবীথি আমার প্রিয় কয়েকটি বই। আমার ছাত্রছাত্রীদের উপহার হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের শিশুদের জন্য লেখা বইগুলো দিতাম।
বর্তমানের ডিজ্যুস জেনারেশন হুমায়ূন আহমেদ বলতে বোঝে 'হিমু'র সৃষ্টা। কিন্তু আমার কাছে হিমু বিষয়ক বেশিরভাগ বইই শুধু একটা নির্দিষ্ট পাঠকশ্রেণীর মনোরঞ্জনের জন্য লেখা মনে হয়। তবে মিসির আলিকে নিয়ে লেখাগুলো অবশ্যই গভীর। মিসির আলি চরিত্র নিয়ে একটি নাটকের কথা মনে পড়ছে যেটাতে এক সদ্য বিবাহিতা নারী তাঁর জীবনে অন্য কারো উপস্থিতি কল্পনা করতেন- তাঁর কাছে একটি রহস্যময় ফোনকল আসে- রাতে বিছানায় পাওয়া যায় একটি কদম ফুল... (নাটকটির নামে কি কদমফুল আছে?) । ঐ নাটকে মিসির আলির ভূমিকায় ছিলেন আবুল হায়াত। আমার কাছে এখনও কল্পনায় মিসির আলি মানেই আবুল হায়াত। হুমায়ূন আহমেদের আরেকটি নাটকের কথা মনে পড়ছে যেটাতে আসাদুজ্জামান নূর ছিলেন চোর। ধরা পড়ার পর খেজুর কাঁটা দিয়ে তাঁর চোখ উপরে ফেলা হবে- সঙ্গে তার ছোট্ট একটি ছেলে। এছাড়া 'খাদক' নাটকে খাদকরূপী প্রয়াত মোজাম্মেল হকও অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন।
হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্রের নতুন ধারা সৃষ্টি করেছিলেন। শঙ্খনীল কারাগার, নন্দিত নরকে, আগুনের পরশমণি, শ্রাবণ মেঘের দিন, চন্দ্রকথার মত কিছু কালজয়ী চলচ্চিত্রের সৃষ্টা ছিলেন তিনি। চন্দ্রকথার সেই গানটি শুনলে এখনও মনটা আকুল হয়ে ওঠে.. চাঁদনী পসরে কে আমায় স্মরণ করে/ কে আইসা দাঁড়াইছে গো আমার দুয়ারে..... কিংবা শ্রাবণ মেঘের দিনের.... একটা ছিল সোনার কন্যা মেঘ বরণ কেশ/ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ।
হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন এক অসামান্য প্রতিভাবান মানুষ। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলা সাহিত্যের তথা গোটা শিল্পাঙ্গনের কান্ডারী। গত প্রায় চার দশক কোন লেখক, কোন নাট্যকার, কোন বুদ্ধিজীবী তার প্রতিভার ধারের কাছে ঘেষতে পারেনি। সবাইকে এক পাল্লায় রেখে অন্য পাল্লায় হুমায়ূন আহমেদকে রেখে বিচার করলেই তিনিই নিঃসন্দেহে জয়ী হবেন।
আমার শুধু একটাই আক্ষেপ- হুমায়ূন আহমেদ তাঁর নিজের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। গত প্রায় একযুগ ধরে তিনি যেন নিজের ঔজ্জ্বল্যকে নিজেই ঢেকে ফেলছিলেন। আমার ধারণা- তাঁর বইয়ের প্রকাশক, টিভি চ্যানেল, দ্বিতীয় স্ত্রী- এমনকি এক শ্রেণীর পাঠকও তাকে সোনার ডিম পাড়া হাসে পরিণত করেছিল। আমাদের সেই কিংবদন্তিতুল্য হুমায়ূন আহমেদকে কক্ষচ্যুত করে ফেলার পিছনে এদের সবাইকে আমি দায়ী মনে করি।
আমার মত কোটি কোটি বাঙ্গালী হুমায়ূন আহমেদকে এত ভালবাসেন মূলত মনে হয় তাঁর অকপট চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে। তিনি ভণিতা জানতেন না- তিনি অনেকবার স্বীকার করেছেন- তিনি লিখেন বা নাটক-চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন নেশা থেকে, নিজের ভাল লাগে তাই। আজও টিভি খুলে দেখুন- কত তথাকথিত লেখক, বুদ্ধিজীবী কত বিচিত্র, কত কঠিন কঠিন ভাষায় তাঁর বন্দনা করছেন- কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন এদের সবার বিপরীত। তাঁর চরিত্রের এই সহজ সরল দিকটিই তাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল।
হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে বলতে গেলে থেমে যাওয়া অসম্ভব। ঈদে অসংখ্য টিভি চ্যানেলে বস্তাপঁচা নাটকের ভীড়ে একমাত্র বিনোদন ছিল হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত নাটক। বইমেলায় যাওয়ার আগে খোঁজ নিতাম কোন স্টলে পাওয়া যাবে হুমায়ূন আহমেদের বই। তার নাটকের কোন সংলাপ কোনদিন একঘেয়ে ছিল না- তার কোন বই একবার শুরু করে শেষ না করে উঠতে পারিনি। তিনি আমার অনেক রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন যাদুমন্ত্রের মত!
হুমায়ূন আহমেদের প্রতিটি কাজ ছিল আমাদের কাছে চমক! আজকের প্রজন্ম যেমন মোবাইল ফোনের নতুন মডেলে চমক খোঁজে- আমরা তেমন হুমায়ূন আহমেদের নতুন নাটক, নতুন বইয়ে চমক খুঁজে পেতাম। হুমায়ূন আহমেদ কখনও আমাদের নিরাশ করেননি।
ঈদে আর কোনদিন হয়ত সব আয়োজন ফেলে নাটক দেখার জন্য আকুলতা থাকবে না- বইমেলায় যাওয়ার কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
হুমায়ূন আহমেদ আর কোনদিন ফিরবেন না- বাংলাদেশ আর কোনদিন আরেকজন হুমায়ূন আহমেদকে পাবে না। দিনে দিনে মানুষগুলো কেমন যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে- আগামীর মানুষগুলো হৃদয় দিয়ে হুমায়ূন আহমেদকে ধারণ করতে পারবে না নিশ্চিত। আমাদের সন্তানরা কোনদিন বুঝবে না কে ছিলেন তিনি।
এমন প্রিয়জনকে হারিয়ে আজ গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে! অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে তাঁর জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছি- তিনি যেন আমাদের প্রিয় এই মানুষটিকে জান্নাতবাসী করেন।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১২ ভোর ৪:০১