একটু আগে একটা দাওয়াত থেকে ফিরলাম। দাওয়াতের উদ্দেশ্য সুইট সিক্সটিন। অর্থাৎ, যিনি দাওয়াত দিয়েছেন, তাঁর মেয়ের বয়স ষোল বছর পূর্ণ হলো। মেয়ের জন্যে ষোলতলা কেক বানানো হয়েছে। ডমপেনের কেক। খুবই সুস্বাদু। মেয়েকে একটা মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি উপহার দিয়েছেন তার বাবা-মা। দাওয়াতে প্রায় শ'দুয়েক আতিথি এসেছে। আলিশান বাড়ির সামনে অতিথিদের সারি সারি গাড়ি। হ্যাঁ, পাঠক, আমি বলছি আমেরিকার বাঙ্গালী কমিউনিটিতে আমার দাওয়াতের অভিজ্ঞতার গল্প।
আমি ইদানিং নিমন্ত্রণ পেলে খুব জরুরী কাজ না থাকলে সাধারণত: দাওয়াত মিস করিনা। এর কারণ হলো, নিমন্ত্রণের সুস্বাদু খাওয়া থাকলে কে কষ্ট করে রান্না করতে যায়? তবে এটা ঠিক যে, সব পার্টিতেই যে খাবারের মান ভালো হবে, তা কিন্তু নয়। আবার বিভিন্ন ধরণের দাওয়াতে বিভিন্ন রকমের গিফট আইটেম কেনার একটা যন্ত্রণাও থাকে। সবাই যা করে, আমিও তার ব্যাত্ক্রিম নই। অর্থাৎ, এই দেশে প্রায় সময়ই বিভিন্ন সেল চলতেই থাকে। কমদামে সেলের বিভিন্ন জিনিসপত্র আগে থেকেই কিনে রেখে দেই। ব্যাস, ঝামেলা শেষ।
আমার ধারণা, আমেরিকা কিংবা কানাডা'র বাঙালী কমিউনিটির দাওয়াতগুলো আসলেই খুব টিপিক্যাল। যে কমিউনিটির কিছু বাংলাদেশী মানুষের সাথে আপনি নিয়মিত পার্টি করবেন, সোশ্যাল যোগাযোগ রক্ষা করে চলবেন, কালক্রমে সেই কমিউনিটির প্রত্যেকটা মানুষকেই কমবেশি চেনা হয়ে যায়। এর মধ্যে আবার বিভিন্ন রকম দলাদলি আছে। কেউ আওয়ামীপন্থী, আবার কেউ জামাত বা বিএনপিপন্থী। একজন হয়তো আর একজনের সাথে ব্যবসায় বাটপারি করে অপর ব্যাক্তিকে ল্যাঙ্গ মেরে দিয়েছে। অতএব, একজন আর একজনের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। পার্টিতে গেলে সালাম-কালাম পর্যন্ত নেই। কারও আবার ফ্যামিলি ড্রামা। অর্থাৎ, পারিবারিক কলহের কারণে দুই পরিবারের মানুষের মাঝে কথা বলাই বন্ধ। আবার কোন এলাকায় সাউথ সাইডের লোকরা নর্থ সাইডের লোকদের দাওয়াত দিবেনা। কারণ তারা সাউথ গ্রুপ, এরা নর্থ গ্রুপ। কত যে কাহিনী। বলে শেষ করা যাবেনা।
দাওয়াত খাওয়ার কথা বলছিলাম। এখন যেমন মুখস্থ হয়ে গিয়েছে যে, ফরিদা আন্টিদের বাসায় দাওয়াত মানেই খাবার নিম্ন মানের হবে। অধিকাংশ খাবারেই লবণ থাকবেনা অথবা থাকলেও কম। আবার নাহিদ আন্টির বাসায় টেবিল উপচে মুখরোচক সব খাবারের আয়োজন।
একটা সত্যি কথা স্বীকার করবো? দাওয়াতে গেলে খাওয়াটাই আমার কাছে সব কিছু। কেউ কেউ হয়তোবা ভাবতে পারেন, "কি খাদক রে বাবা! খাওয়া ছাড়া কিছুই বুঝেনা।" আমি বলবো কি জানেন? পার্টি বা দাওয়াতে যাওয়া মানুষগুলোর মাঝে যেসব আলোচনা হয়, সেগুলোও এখন আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। নতুন করে এগুলো শোনার আর কী-ই বা বাকী আছে বলুন? বিশ্বাস হচ্ছেনা? তাহলে পার্টিতে পুরুষদের মধ্যে যে আলোচনা হয়, তার কয়েকটি নমুনা দিচ্ছি।
সামাদ আঙ্কেলের ছয়টা গ্রোসারী দোকান। তিনি সাত নম্বর দোকানটা খুব শীঘ্রই উদ্বোধন করবেন। কিভাবে করবেন, কি প্ল্যান, সেটা পার্টিতে সবাইকে হাতে কলমে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। ডাক্তার ফয়সাল একটা গাড়ি কিনবেন। টেসলা গাড়ি। এই গাড়ির শুধু ব্যাটারীর দামই নাকি ত্রিশ হাজার ডলার। এখন তিনি পার্টির জনগণের একাংশকে টেসলা গাড়ির ইতিহাস, ফাংশন এবং কেনো এই গাড়ি সবার কেনা উচিত, সেটি সবিস্তারে বর্ণনা করছেন। মিস্টার বাতেন বাড়ি বিক্রি করেন। তার ধান্ধা কিভাবে এই পার্টি থেকে দুই একটা ক্লায়েন্ট বের করা যায়। আর একটা গ্রুপ আছে যাদের কাজ হলো কোথায় সস্তায় কাঁচা বাজার করা যায়, কিভাবে সরকারী বেনিফিট নেওয়া সম্ভব, কোথায় পিঁয়াজের সেল চলছে - এগুলো নিয়ে পার্টিতে অন্য সবার সাথে রিসার্চ করা।
এবার আসি পার্টিতে মহিলা এবং আন্টিদের আলোচনাতে। ধনকুবের ইয়াসমিন আন্টির মেয়ের বিয়ে। শেরাটনে কিভাবে গায়ে হলুদ করবেন, আটলান্টা থেকে কিভাবে শপিং করবেন, দীর্ঘ তিনমাস ব্যাপী কিভাবে মেয়ের বিয়ের প্রোগ্রাম সাজিয়েছেন, সেগুলো মহিলা সমাজে বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলছেন। রাজকীয় ব্যাপার স্যাপার। আর তার চারপাশ ঘিরে আছে আরও কিছু প্রজাসদৃশ আন্টি এবং মহিলা। তারাও ঢোলে বাড়ি বেশ জোরেই দিচ্ছেন। পারুল আন্টি তার অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে বিভিন্ন পার্টিতে খাবারের আয়োজন এবং খাবারের নিম্নমানের কোয়ালিটি নিয়ে ছোটখাটো একটা লেকচার দিচ্ছেন। মিসেস কাওসার পারহেজগার নারী। সামনে হজ্জে যাবেন। কিভাবে যাবেন, কি করবেন, সেগুলো নিয়ে পার্টিতে জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় ব্যাস্ত। শাহরিন আপা তার ফিগার আর সৌন্দর্য্য কিভাবে এই পঞ্চান্ন বছর বয়সেও ধরে রেখেছেন, সেগুলো উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করে চলেছেন। কোন ব্র্যাণ্ডের কোন মেক-আপ কেন ব্যবহার করবেন, তার সাইড-ইফেক্ট কি, কিভাবে সাত দিনে দুইশো পাউণ্ড ওজন কমিয়ে ফেলবেন, এগুলোতে শাহরিন আপা ওস্তাদ। ডাউনটাউনে আম্বরী ভাবীর নিজের বুটিকের দোকান। কোন কোন নতুন মাথা নষ্টকরা থ্রি-পিস দোকানে উঠিয়েছেন, কিভাবে তিনি কমদামে পরিচিতদেরকে দিবেন, কেন সেগুলো এখনই সবার কেনা ফরজ এগুলোর সবিস্তার বর্ণনা চাক্ষুস দেখলে বোঝা যায় যে, তিনি জাত ব্যবসায়ী। ওদিকে টুম্পা আন্টি তার হাতের ক্যামেরা, আইফোন আর হ্যাণ্ডিক্যাম দিয়ে সমানে সবার ছবি তুলছেন আর ভিডিও করে বেড়াচ্ছেন। তাঁকে দেখলে মনে হবে, পার্টিতে সবার প্রতি সেকেণ্ডের ছবি তুলতে না পারলে বিশাল কোন লস হয়ে যাবে। একবার তার তোলা ছবি দেখতে চেয়েছিলাম। এর থেকে আমার পোষা কুকুর 'লেপার্ড'-ও মনে হয় ভালো ছবি তুলতে পারবে।
পার্টিতে কিছু পিচ্চি ছেলেপেলে থাকে যাদের বয়স চার থেকে দশের মধ্যে। এদের মধ্যে ঠিক একটা থাকে চরম বান্দর প্রকৃতির। এই বান্দরটাই অন্যগুলোকে নিয়ে পার্টিতে দৌড়ে বেড়াবে। মানুষজনকে উৎপাত করবে। খাবারের প্লেট মাটিতে ফেলে চারপাশ নোংরা করবে আর ঘরময় দাপাদাপি করে বেড়াবে। দেশে থাকলে এই নেতা বান্দরটাকে চড়-থাপ্পড় মেরে সাইজ করা যেতো। আমেরিকা বলে করা যাবেনা।
এবার আসি পার্টিতে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের আলোচনা নিয়ে। এদের বয়স পনের-ষোল থেকে বিশ-বাইশ। দু:খের বিষয় হলো, এদের আলোচনাগুলো আমি কোনকালেই ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। এরা ইংরেজিতে বিড়বিড় করে কীসব বলে। সব কথাই আমার মাথার ওপর দিয়ে যায়। তাই আমি আর ওদের কথা কোনদিন বুঝতেও চাইনা।
এরকম আরও কত কাহিনী পার্টিতে চলছে। পাঠক হয়তোবা ভাবছেন, পুরুষদের কথা নাহয় আমি পুরুষ হয়ে জানলাম। কিন্তু মহিলাদের কিংবা উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের আলোচনাগুলো কিভাবে শুনলাম? উত্তরে এতটুকুই বলতে চাই যে, আমার দু'টি গুণ আছে। আমি খুব ভালো দর্শক এবং মনোযোগী শ্রোতা।
পার্টি শেষে হরিলুটের একটা ব্যাপার আছে। এটা একটু সংক্ষেপে বলতে চাই। একটা রিয়েল টাইম উদাহরণ দিলেই পুরো ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হবে। আমি যে বাংলাদেশী কমিউনিটির সাথে মিশি বা দাওয়াত রক্ষা করে চলি, সেখানে প্রায় প্রতি পার্টি শেষেই বাড়িতে খাবার নিয়ে যাবার জন্যে অতিথিদের কাগজের খালি বাক্স দেয়া হয়। জেরিন আপার একমাত্র মেয়ে মিথিলা'র প্রথম বার্থডেতে এরকম বাক্স দেয়া হলো। পার্টি শেষে যখন বাসার পথে পা বাড়াবো, তখন দেখি মৌসুমী ভাবী তার শাশুড়ীকে বলছে, "মা, বাক্স ঠেসে এমনভাবে খাবার নিয়ে নেন যেন আগামী একমাস আমাকে রান্না না করতে হয়।" আবার ওই পার্টিতেই নাহার আন্টি টেবিলে যত ট্রে মিষ্টি ছিল, শাড়ীর আঁচল কোমরে গুঁজে নিয়ে সবগুলো ট্রে এক হাতেই নিজের গাড়িতে তুলে নিলেন। ওদিকে রুমানা ভাবীসহ আরও পাঁচ-সাতজন ভাবী যখন বাক্স হাতে খাশীর মাংসের বড় দু'টি ট্রে খুঁজে বেড়াচ্ছেন, ততক্ষণে দুই ট্রে খাশীর মাংস কে যেন দিনে দুপুরে গায়েব করে দিয়েছে। এভাবেই পার্টিতে হরিলুট চলে। যারা করে, তারা বিশ ডলারের একটা ওয়ালমার্টের 'গিফট কার্ড' গিফট করে ঠিকই কিন্তু যাবার সময় দুইশো ডলারের খাবার লুট করে নিয়ে যায়।
এগুলো দেখতে দেখতে চুল পেকে গেল। কিন্তু এভাবেই চলছে দিনের পর দিন। আমিও তাই এখন আর খাওয়া ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে জানতে বা শুনতে আগ্রহী নই। শরীর স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হলে নিয়মিত দাওয়াত অবশ্যই খেতে হবে। কাজেই পার্টি বা দাওয়াতে গিয়েই আমার প্রথম এবং একমাত্র কাজ খাওয়া। এছাড়া অন্যকোন দিকে তাকানো কি ঠিক? আপনারাই বলুন?
ফেসবুকে আমি