নয়া উপনিবেশের কড়ি-বর্গার ঐতিহাসিক বিকাশঃ
বাঙলায় ব্রিটিশ উপনিবেশের প্রথম সহযোগী কারা ছিলেন? শুরুতেই যেইসব নাম উঠে আসে তার মধ্যে আছেন মীর জাফর, জগৎশেঠ, রায় দূর্লভ, রাজবল্লভ, উমিচাঁদ প্রমূখ। মীর জাফর এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি হলেও তিনি ছিলেন দাবার ঘুটিমাত্র, সিরাজ উদ্দৌলা’র বদলে নবাব হিসাবে সিংহাসনেও মানিয়ে যায় আবার নিজেদের সুবিধামতো চালানোও যায়। ইংরেজ বনিকদের সাথে ঘনিষ্ট ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল মারোয়ারি ব্যাংকার জগৎশেঠ ফতেহ চাঁদএর, ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে কাড়ি কাড়ি টাকাও তিনিই ঢালেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এইসব ঘনিষ্ট বন্ধুদের ব্যবসায়িক লাভের সম্পর্কের মাঝখানে সিরাজ উদ্দৌলা ছিলেন গলার কাটা, তাকে সরিয়ে মীর জাফরকে বসালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং জগৎ শেঠদের মিলঝুলের বানিজ্য ভালো হয়। অবশ্য বাংলার আদি ব্যাংকার সুবর্ণ বনিকদের পতনের পর প্রায় ১০০ বছরের অধিক কাল জগৎশেঠএর পরিবারের যেই আধিপত্ত্ব ছিল বাংলার ব্যংকিং জগতে তার বিলুপ্তি ঘটে ঠিক ইংরেজদের ব্যংকগুলোর আবির্ভাবের সাথে সাথেই।
উপনিবেশের প্রথম সহযোগী শ্রেণী ব্রিটিশ উপনিবেশের বিস্তারের সাথে সাথে নিজেরাই বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই বিলুপ্তি ঘটে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সার্বভৌম শাসন প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ার ভেতর। বাঙলার নিজস্ব অর্থ ব্যবস্থা, নিজস্ব স্থানীয় শিল্প এবং শিল্প কারখানা ইত্যাদি ধ্বংস করে একেবারে বিলুপ্ত করে দেয়া ছিল এই শাসনের শুরুর ভাগের উল্লেখযোগ্য কৌশল। ধান, গমের জমিতে নিজেদের মনমতো আফিম এবং নীল চাষ করিয়ে নিয়ে নিজেদের লাভ তুলে নিয়ে আর বাঙলার কৃষকদের দুর্ভিক্ষ উপহার দিয়ে ব্রিটিশ শাসন শুরুতেই নিজের শোষন শাষন কায়েম করে। তবে এই শোষন তারা নির্বিঘ্নে কায়েম করতে পারেনাই। শুরুতেই তাদের বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়ায় এ অঞ্চলের নিজস্ব বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মধ্যে শুরুতে ফকিরী এবং পরে সন্যাসীরা এবং আরো পরে এই দুই একসাথে, উপনিবেশ বিরোধী প্রথম এই মুক্তিসংগ্রামের নেতা ছিলেন ফকির মজনু শাহ। দুর্ভিক্ষ পিড়িত বাঙলায় অনেক কৃষক, মেহনতি মানুষ এবং সাবেক সৈনিক যোগ দিয়েছিলেন তখন এই মুক্তি সংগ্রামে। ১৭৭৩ থেকে শুরু করে প্রায় ১৮০০ সাল পর্যন্ত ছড়িয়ে পরে একের পর এক দাবানলের মতো বিদ্রোহ। এইসব বিদ্রোহে ব্রিটিশদের কাছে একটা ব্যপার পরিস্কার হয়যে শুধুমাত্র রাজ সিংহাসন আর অর্থনীতির উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে বাঙলায় নিজেদের শাসন তারা সুসংহত করতে পারবেনা, এই এলাকার নিজস্ব চিন্তা জগৎ আছে, রাজা/নবাবএর বাইরেও ফকির-মানুষ-ভাবএর নিজস্ব ক্ষমতা কাঠামো আছে।
নিজেদের শাসন সংহত করতেই ইংরেজরা এইসময় সুপরিকল্পিত ভাবে নিজেদের সহযোগী শ্রেণী গড়ে তোলার কাজে হাত দেয়। শুরুতেই এই সহযোগী শ্রেণীর মধ্যে ছিলেন হিন্দু জমিদাররা, ফকির সন্যাসী বিদ্রোহ দমনের সময়ই এরা ব্রিটিশদের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসাবে আবির্ভুত হন। শুরু হয় নয়া উপনিবেশের কড়ি-বর্গা’র নির্মানের প্রথম ধাপ, উপনিবেশের দালালী করা এবং উপনিবেশকে সংহত করা প্রথম শ্রেণীর আবির্ভাবটা এসময়ই ঘটে।
তবে এটা বোঝা জরুরি যে উপনিবেশ শুধুমাত্র একটা উচ্চবর্গিয় দালাল শ্রেণীর মাধ্যমেই নিজেদের শাসন সুসংহত করে নাই। এর জন্যে দরকার ছিল বাঙলার গনমানুষের গোটা জ্ঞানচিন্তাতেই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, পুরনো জ্ঞান, ঐতিহ্য, নৈতিকতা ইত্যাদি ভেঙে দিয়ে সেইখানে ঔপনিবেশিক শাসনের পক্ষের, শোষনের জন্যে দরকারি জ্ঞানভাষ্য তৈরি করার। সোজাকথা ঔপনিবেশিক ডিসকোর্স তৈরির মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের বৈধতার হেজিমনি প্রতিষ্ঠা করার। এই হেজিমনি বিষয়টাকে পরিস্কার ভাবে না বুঝলে কড়ি-বর্গা নামক কাঠামোটা আমাদের ঠিকঠাক বোঝা হবেনা। ইতালিয় মার্ক্সিস্ট দার্শনিক এন্তনিয় গ্রামসি এই শব্দটাকে প্রথম ব্যবহার করা শুরু করেন ইতালির গনমানুষের উপর ক্ষুদ্র একদল মানুষের শাসন শোষনের প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করার জন্যে। গ্রামসি আবিস্কার করেন যে শুধুমাত্র বাহুবল দিয়া এই ক্ষুদ্র একদল মানুষ আপামর জনসাধারণের উপর কর্তৃত্ব করছেনা বরং আপামর জনসাধারণের উপর তাদের শাসন এবং শোষন তারা বৈধ করিয়ে নিচ্ছে এই শাসন শোষনের পক্ষে বেশকিছু ধারণা, প্রোপাগান্ডা ইত্যাদির প্রচার, প্রসার করে এবং তা টিকিয়ে রেখে। হেজিমনি প্রতিষ্ঠার এই প্রক্রিয়া মূলত সাংস্কৃতিক, হেজিমনির আরেক নাম বলা যায় সাংস্কৃতিক আধিপত্য। গ্রামসি’র ভাষায়, “রাজি করিয়ে আধিপত্ত্ব করার কায়দা, প্রভাবশালী ক্ষুদ্র একটা গোষ্ঠি যেটা করে গনসমাজের উপর; এর মূলে থাকে সর্বব্যাপী সাংস্কৃতিক আধিপত্য বা হেজিমনি (প্রিজন নোটবুকস)
ঔপনিবেশিক শাসন সুসংহত করতে নিজেদের সাংস্কৃতিক আধিপত্ব বা হেজিমনি প্রতিষ্ঠা করা তাই ব্রিটিশদের জন্যে জরুরি ছিল, যাতে সল্পসংখ্যক লর্ড এবং সৈন্যদের নিয়েও তারা কোটি কোটি উপনিবেশিত জনগণকে তারা শাসন করতে পারে। আর এই কাজটা তারা শুরু করে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার নামে ব্রিটিশ শাসনের জন্যে দরকারী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে। ভারতবর্ষে প্রথম আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার কারিগর লর্ড ম্যাকলে এই শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন –
““আমাদের সীমিত ক্ষমতা দিয়ে গোটা জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করা অসম্ভব। আপাতত আমরা দোভাষী-ব্যাখ্যানকারের এমন একটা শ্রেণী তৈরি করব যারা হবে আমাদের এবং আমাদের শাসিত মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের মধ্যকার দোভাষী। রক্তে বর্ণে এরা হবে ভারতীয়, কিন্তু রূচি, মতামত, নৈতিকতা আর বোধ বুদ্ধিতে ইংরেজ। এদের ওপর আমরা ছেড়ে দেবো উপ-মাতৃ ভাষাগুলো পরিমার্জনের ভার, পশ্চিমা শ্রেনীকরণবিদ্যা থেকে ধার করা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দিয়ে সেই সব ভাষা সমৃদ্ধ করার দায়িত্ব”।
লর্ড ম্যাকলে তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিস্কার ছিলেন। উপনিবেশ টিকিয়ে রাখার জন্যে তার দরকার ছিল এই ভুখন্ডেরই কিছু মানুষ, যারা উপনিবেশকএর সাথে উপনিবেশিত জনগণের সম্পর্ক রক্ষা করবে। সেইসাথে রক্ত বর্ণে স্থানীয় হলেও রূচি এবং বুদ্ধিতে এরা হবে ইংরেজ। নিজের মাটি, ঐতিহ্য আর জ্ঞানএর সাথে সম্পর্কচ্ছিন্ন হওয়া ঔপনিবেশিক শিক্ষায় শিক্ষিত এই শ্রেণীটাই করবে বিরাট সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার জন্যে জরুরি ছোটখাট প্রাশাসনিক, দাপ্তরিক এবং করনিক কাজ।
এইখানে এই ‘হেজিমনি’ জিনিসটাকে আরো গভির ভাবে আমাদের বুঝা দরকার। গ্রামসি হেজিমনি ধারণার আবিস্কার করলেও এর বিভিন্ন আঙ্গিক নিয়া আলোচনা করেছেন রেমন্ড উইলিয়ামস। উইলিয়ামসএর মতে হেজিমনি শুধুমাত্র মতাদর্শের প্রভাবই না, বরং হেজিমনি নিজেই মতাদর্শ তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ, কোন কর্তৃত্বশীল শ্রেণীর মতাদর্শের প্রভাবেই হেজিমনি শুধু তৈরি হয়না বরং সেই হেজমনি নিজেই আবার মতাদর্শ তৈরি করতে পারে। ব্রিটিশরা নিজেদের মতাদর্শের যেই হেজিমনি আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করেছে সেই হেজিমনিই আবার আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালির মতাদর্শ গড়ে দিয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালির এই মতাদর্শ হলো ঔপনিবেশিক দাসত্ব মেনে নেয়ার মতাদর্শ। আর এই প্রক্রিয়াতেই সৃষ্টি হয় উপনিবেশের দ্বিতীয় সহযোগী শ্রেণী, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত্ব। এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত্ব বিশ্বাস করতো গাত্র বর্ণে সাদা চামড়ার অধিকারী পশ্চিমারা জ্ঞান, গরিমা, ইতিহাস, ঐতিহ্য সবদিক থেকেই আমাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, সেই হিসাবে আমাদের শাসন করার বৈধতা এদের আছে। আর উপনিবেশের এই বৈধতা তারা বৈধ করার কাজ করে গেছে এই ভুখন্ডের নিন্মবর্গের মানুষের মনে, জীবনের বাস্তবতায়। এই শ্রেণীটাকেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভু আদর এবং অবজ্ঞা সহকারে ডাকতো ‘বাঙালি বাবু’ বলে। ঔপনিবেশিক প্রভুদের শ্রেষ্ঠত্বের এই হেজিমনি তৈরি না হলে দুইশত বছরের ঔপনিবেশিক শাসন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতোনা, সম্ভব হতো না ঔপনিবেশিক শোষন আর লুটপাটের মধ্য দিয়া শিল্পন্নত ঐশ্বর্যমন্ডিত ব্রিটিশ সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখা। আর এইখানেই আমাদের মনে রাখা দরকার যে ঔপনিবেশিক শোষন টিকিয়ে না রাখতে পারলে এখনো পশ্চিমা পুজিবাদী দুনিয়ার ভোগবাদী শিল্পন্নত ঐশ্বর্য টিকিয়ে রাখা সম্ভব না। আমাদের অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে এককালে আমাদের কৃষকের চাষের জমির উপর ঔপনিবেশিক কর্তৃত্বের বৈধতা তারা প্রতিষ্ঠিত করেছিল জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের হেজিমনি প্রতিষ্ঠা করে, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিতে নিজেদের সার্বভৌম আধিপত্ব দাবি করে। এখনো আমাদের ভুমির জ্বালানি সম্পদের উপর ঔপনিবেশিক আধিপত্ব সবচেয়ে শক্তিশালীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে পশ্চিমাদের এই শ্রেষ্ঠত্বের হেজিমনির টিকে থাকার মাঝেই। আর এইকারনেই সকল যুক্তি উপেক্ষা করে বাংলাদেশের নিজস্ব মালিকানায় জ্বালানি সম্পদ উত্তোলনের বদলে তাতে ঔপনিবেশিক কর্পোরেশনের শ্রেষ্ঠত্বকেই বৈধতা দেয়া হচ্ছে।
ঔপনিবেশিক প্রভুর শ্রেষ্ঠত্বের এই হেজিমনির ব্যপ্তি এবং গভিরতা অত্যন্ত ব্যাপক। অথচ চোখে আঙুল দিয়া না দেখালে অধিকাংশ সময়ই আমরা হেজিমনি’র অস্তিত্ব অস্বিকার করতে চাই। ফ্রাঞ্জ ফানো নিজের মাতৃভূমি মার্টিনিকএর একটা বিশেষ ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন তার পুস্তক ‘ব্লাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক’এ। ফানো যেই ঘটনার বর্ণনা দেন তা হলো যে তার জাতির ‘কালো’ চামড়ার মানুষেরা বিশেষ উৎসবে সাদা মুখোশ পরে নিজেদের সাদা চামড়ার প্রভুদের অনুকরণ করে। পেশাগত দিক থেকে ফানো ছিলেন একজন মনরোগ বিশেষজ্ঞ। এই বিষয়টাকেও তিনি দেখেছেন মনরোগ বিশেষজ্ঞের চোখ দিয়াই। ফানো দাবি করেন যে উপনিবেশ এই কালো চামড়ার শোষিত নিপিড়িত জনতার মনে ‘সাদা’ চামড়ার ইউরোপিয়দের শ্রেষ্ঠত্বের যেই হেজিমনি প্রতিষ্ঠা করেছে তা এই কালো চামড়ার মানুষদের হিনমন্য করে তোলে। প্রাণপনে তারা এই সাদা চামড়ার প্রভুদের অনুকরণ অনুসরণ করতে চায়, ভালো মন্দ সবদিক থেকেই। বাংলাদেশের কালো আর বাদামি চামড়ার মেয়েদের বিয়ের সময় সাজিয়ে গুজিয়ে যতটা সম্ভব ‘সাদা’ চামড়ায় পরিণত করার যে সাধ্যমত প্রচেষ্টা চলে তার কারন অনুসন্ধান করতে গেলেও যে উপনিবেশিতের দাসত্বের বোধ উঠে আসবে তাতে কোন সন্দেহ নাই। আমাদের ভুখন্ডের নারী পুরুষ নির্বিশেষে নানান কসমেটিক্স ব্যবহার করে সাদা থেকে আরো সাদা হয়ে ওঠার যেই পাগলা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত তাতে শ্রেষ্ঠত্ব বলতে অথবা সুন্দর বলতে আমাদের ভুখন্ডের মানুষের মনে গভির ভাবে সেটে থাকা যেই ঔপনিবেশিক দাসত্বের বোধ সেই বোধ পশ্চিমা সাদা চামড়ার শাসন আমাদের উপর বৈধ করে তোলে।
নয়া উপনিবেশের কড়ি-বর্গা নামক ক্ষমতা কাঠামোর বিকাশ আরেকটু চুলচেরা বোঝার জন্যে আমাদের ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি হওয়া মধ্যবিত্ত্ব শিক্ষিত শ্রেণী এবং এর প্রতিনিধিত্বকারী তৎকালিন তথাকথিত বাঙালি রেনেসা’র শ্রেষ্ঠ মনিষিদের বিচার বিবেচনা করে দেখা দরকার, একেবারেই নির্মোহ ভাবে।
হেথায় আর্য, হেথা অনার্য
হেথায় দ্রাবিড়, চীন--
শক-হুন-দল পাঠান মোগল
এক দেহে হল লীন।
পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার,
সেথা হতে সবে আনে উপহার,
দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে
যাবে না ফিরে,
এই ভারতের মহামানবের
সাগরতীরে।
.......................................
এসো হে আর্য, এসো অনার্য,
হিন্দু মুসলমান।
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ,
- শ্রী রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর
রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর নিজেই জমিদার ছিলেন, ব্রিটিশ উপনিবেশের প্রথম সহায়ক গোষ্ঠির মানুষ ছিলেন তিনি। আবার একিসাথে শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত্বের শিক্ষা, রূচি আর সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব্ব করতেন। রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর বাঙলার সর্বকালের অন্যতম প্রতিভাবান মনিষি সন্দেহ নাই, আধুনিক বাঙালির বেরে ওঠা, আধুনিক বাঙলা ভাষার বিকাশেও তার অবদান পাহাড়সম। কিন্তু এই বিকাশে পশ্চিমা শ্রেষ্ঠত্বের হেজিমনির বিকাশও যে অঙ্গাঙ্গী বিষয় সেইটা অস্বিকার করার উপায় নাই। যেই ব্রিটিশ উপনিবেশ নিজের লাভের আশায় এক ধাক্কায় ১ কোটি বাঙলার অধিবাসীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে, যেই ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতবর্ষ থেকে সম্পদ লুট করে নিজেদের ঐশ্বর্যের পাহার গড়েছে আর সেই ঔপনিবেশিক বানিজ্য সুনিশ্চিত করার জন্যে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ পদ্ধতির শিক্ষা, লুটের মালামাল বহন আর বিদ্রোহীদের দমন করার জন্যে রেল লাইন ও অন্যান্য আধুনি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছে সেই ব্রিটিশদেরই রবীন্দ্রনাথ স্বাগতম জানাচ্ছেন। ঔপনিবেশিক শোষনকে তিনি দেখছেন মেলবন্ধন হিসাবে, শাসন কার্যের সহায়ক জ্ঞান আর প্রযুক্তির আমদানিকে দেখছেন তিনি উপহার হিসাবে। পৃথিবীর ইতিহাসে মাইগ্রেশন খুব সাভাবিক ঘটনা। ভারত বর্ষেই শুধু বহু জাতির আগমন ঘটেছে এবং মিশ্র জনগোষ্ঠি তৈড়ি হয়েছে এইটা একটা ডাহা মিছা কথা, পুরাপুরি কলোনিয়াল ডিসকোর্স। সারা দুনিয়াতেই এইটা হয়েছে। ভারতবর্ষের চেয়ে অনেক ছোট ভুখন্ড ব্রিটেনেই বিভিন্ন সময়ে সেল্ট, এংলো, সেক্সন, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠি পাড়ি জমিয়েছে, মিলে মিশে ইংলিশ হয়েছে। ইংল্যান্ড শব্দটাই এসেছে জার্মান জাতি এংলোদের দেশ বুঝাতে এঙ্গল লেন্ড থেকে। এই এংলোরাও আবার ব্রিটেনের আদি অধিবাসী না, জার্মানি থেকে ব্রিটেনের মূল ভুখন্ডে মাইগ্রেট করা জাতি। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তেও ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে বহুজাতির আবির্ভাব ঘটেছে। হুন, শক, চৈনিক, পাঠান, মুঘোল এরা সবাই এই ভুখন্ডে এসে এই ভুখন্ডের মানুষে পরিণত হয়েছে। রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর এদের সাথে কেনো ঔপনিবেশিক ইংরেজদের পার্থক্য ধরতে পারলেন না সেইটা নিয়া আমরা বড়জোর আফসোস করতে পারি, কিন্তু কারন আমাদের কম বেশি উপরের আলোচনায় জানা হয়ে গেছে।
কবিতার কথা বাদ দিলে সরাসরি ব্রিটিশ শাসন, শোষনের সমালোচনা গোছের প্রবন্ধ রচনাতেও রবীন্দ্র নাথ যেই পরিমান ব্রিটিশ ভক্তি প্রকাশ করেন তাও আমাদের বর্তমান সময়ের জন্যে অস্বস্তিকর মনে হতে পারে অনেকের কাছে। উদাহরণস্বরূপ ‘ইংরেজ ও ভারতবাসী’ প্রবন্ধে তিনি লিখেন-
“বৃহত্ কার্য, মহত্ অনুষ্ঠান কবে সহজ সুসাধ্য হইয়াছে৷ এই ভারতজয়-ভারতশাসনকার্যে ইংরাজের যে-সকল গুণের আবশ্যক হইয়াছে সেগুলি কি সুলভ গুণ৷ সে সাহস, সে অদম্য অধ্যবসায়, সে ত্যাগস্বীকার কি স্বল্প সাধনার ধন৷ আর পঞ্চবিংশতিকোটি বিদেশীয় প্রজার হৃদয় জয় করিবার জন্য যে দুর্লভ সহৃদয়তাগুণের আবশ্যক তাহা কি সাধনার যোগ্য নহে৷”
ব্রিটিশ গুনাবলী, সুবিশাল উপনিবেশ শাসনে তাদের যোগ্যতার প্রতি রবীন্দ্র নাথের এই ভক্তি বাঙালি মধ্যবিত্ত্বের ব্রিটিশ ভক্তি তথা সাদা চামড়ার পশ্চিমাদের শ্রেষ্ঠত্বের হেজিমনরিই প্রতিনিধিত্ব করে।
তবে এই রবীন্দ্র নাথই আবার জালিওয়ানওয়ালাবাগে হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে নাইট উপাধি বর্জন করেন, তিনিই আবার কঠোর ভাষায় ব্রিটিশ শাসনকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসাবে দাবি করেন। আর এইখানেই আমাদের আশাবাদের কিছুটা জায়গা তৈরি হয়। রবীন্দ্র নাথএর সাথে ব্রিটিশ উপনিবেশকদের আর্থিক স্বার্থের সম্পর্ক ছিল সন্দেহ নাই। কিন্তু হেজিমনি দিয়া প্রতিষ্ঠা করা ভক্তিতে ভাঙন ধরলে উপনিবেশ বিরোধী প্রতিবাদ তৈরি হয়, বি-উপনেবিশায়নের রাস্তা তৈরি হয়। তবে আমাদের নৈরাশ্যের জায়গা এই যে জালিওয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের এতবছর পরে ফুলবাড়ির জনগণকে নিজেদের জমি এবং জ্বালানি সম্পদের অধিকারের জন্যে ঔপনিবেশিক কর্পোরেট কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়া কোন সাদা চামড়ার ব্রিটিশের গুলিতে নিহত হতে হয়নাই, তাদের তাবেদার দেশীয় দালালদের গুলিতে নিহত হতে হয়েছে।
ঔপনিবেশিক হেজিমনি তার সহযোগি শ্রেণীর মনে যেই হিনমন্যতার বোধ আর ঔপনিবেশিক প্রভুকে অনুকরণ অনুসরণ করার আকাঙ্খা তৈরি করে ঔপনিবেশিক শাসনকে টিকিয়ে রাখার জন্যে তা আরো সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে। ব্রিটিশ উপনিবেশের অধীন ভারতবর্ষের অত্যন্ত প্রভাবশালী একজন সাহিত্যিক এবং একজন রাজনীতিবিদের উদাহরণ দিয়া বিষয়টা আমরা বুঝার চেষ্টা করতে পারি।
আমাদের প্রথম আলোচ্য ব্যক্তি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধায়। বাঙলা এবং গোটা ভারতবর্ষেই বঙ্কিম চন্দ্র নিজ সময়ে আধুনিক সাহিত্যিক হিসাবে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত্ব শ্রেণীর গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি ছিলেন, তার সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত ডিসকোর্সের প্রভাবও বাঙলা এবং ভারতবর্ষে সুদুরপ্রসারী। বঙ্কিম চন্দ্র প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আধুনিক গণতন্ত্রের অন্যতম মহান! দার্শনিক ‘জেমস মিল’ সম্বন্ধে সামান্য আলাপ করা দরকার। উপযোগবাদী দার্শনিক জেমস মিল গণতন্ত্র আর মানবতার যেই বূলি প্রচার করে গেছেন সেইটা সীমাবদ্ধ ছিল শুধু ইউরোপিয় পুরুষ মানুষের জন্যে। বাঙলা অথবা ভারতের অন্যকোন ভুখন্ডের মানুষকে তিনি গণতন্ত্রের উপযুক্ত গণ্য করেন নাই। বর্ণবাদী এই ব্যক্তি মনে করতেন ভারত বর্ষের ইতিহাস হইল ‘শুন্য পাতা’, আর এই শুন্য পাতা ভরাট করার মহান দায়িত্ব ব্রিটিশদেরই পালন করতে হবে। ১৮১৮ সালে প্রকাশিত তার পুস্তক “ দি হিস্ট্রি অফ ব্রিটিশ ইন্ডিয়া”তেই তিনি প্রকাশ করেন এই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি। সেই সময় অত্যন্ত জনপ্রিয় এ পুস্তক পরবর্তি সময়ে বিবেচিত হয়েছে ভারতীয় ইতিহাসের অন্যতম রেফারেন্স পুস্তক হিসেবে, ইউরোপিয় এমনকি অনেক ভারতীয় ইতিহাসবিদের কাছেও। বঙ্কিম চন্দ্র এই ‘শুন্য পাতার ডিসকোর্সে আক্রান্ত ছিলেন বলে মনে হয়। তাই তিনি আফসোস করে বলেছিলেন যে, ‘বাঙালির ইতিহাস নাই’। আজও কেউ কেউ এই আফসোসটা করে থাকেন। বাঙালির ইতিহাস নাই এইটা মিছা কথা। প্রথমত, ইতিহাসের যেইসব মুসলমানি সূত্র ছিল সাম্প্রদায়িক বঙ্কিম চন্দের তা পছন্দ হয়নাই, কারনে সেগুলায় মুসলমানের বিরত্বের কাহিনী লিখা। দ্বিতীয়ত, ব্রিটিশরা তৎকালিন ভারতবর্ষের যেই ইতিহাস রচনা করেছে তাও মুসলমান সূত্র থেকে নেয়া, এবং উপকথা রূপকথা সব মিলিয়ে জেমস মিল বয়ানে তা ‘সাদা পাতা’। তা এহেন ইতিহাস হীনতার হীন্যমনতা বঙ্কিম কি উপায়ে কাটানোর চেষ্টা করেছেন সেইটা আমরা খুজে পেতে পারি নিন্মোক্ত উদ্ধৃতি থেকে-
“. . . বাস্তবিক একদিন বাঙ্গালীরা আর কিছুতে হউক না হউক, ঔপনিবেশিকতায় এথিনীয়দিগের তুল্য ছিলো। সিংহল বাঙ্গালী কর্তৃক পরাজিত এবং পুরুষানুক্রমে অধিকৃত ছিলো। যবদ্বীপ ও বালিদ্বীপ বাঙ্গালীর উপনিবেশ, ইহাও অনেকে অনুমিত করেন। তাম্রলিপ্তি ভারতবর্ষীয়ের সমুদ্রযাত্রার স্থান ছিলো। ভারতবর্ষীয় আর কোন জাতি এরূপ ঔপনিবেশিকতা দেখান নাই। . . . যে জাতি মিথিলা, মগধ. কাশী, প্রয়াগ, উৎকলাদি জয় করিয়াছিলো, যাহার জয়পতাকা হিমালয়মূলে, যমুনাতটে, উৎকলের সাগরোপকূলে, সিংহলে, যবদ্বীপে এবং বালিদ্বীপে উড়িত সে জাতি কখনো ক্ষুদ্র জাতি ছিলো না। (বঙ্কিম, ১৯৯১; ৩৩১)
অর্থাৎ উপনিবেশিতের হীন্যমনতার বোধ থেকে মুক্তি পেতে বঙ্কিম বাঙালিকেই উপনিবেশক হিসাবে দেখতে চেয়েছেন। উল্লেখ্য, বাঙালির উপনিবেশী যুগ নিয়া বঙ্কিম যা লিখেছেন তার তথ্যসূত্র মোটেই নির্ভরযোগ্য না, অনেককিছুই আবার নেহায়েত পুরাকাহিনীকে রঙ মেখে হাজির করা। কিন্তু বাঙালিও এককালে উপনিবেশ বিস্তার করেছে এই প্রমান করে বঙ্কিম নিজের হীন্যমনতা থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছেন যেমন তেমন এই পাঠে তার পাঠক বাঙালি মধ্যবিত্ত্ব শিক্ষিত শ্রেণীও নিজের হীন্যমনতার বোধ থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আদতে এই প্রচেষ্টা উপনিবেশ নামক অন্যায় শোষনকেই বৈধ করে মাত্র। এবং দিনশেষে জয়টা হয় ব্রিটিশ উপনিবেশের প্রতিষ্ঠিত হেজিমনিরই।
(আগামী পর্বে সমাপ্য) প্রথম পর্ব এইখানে]
(লেখাটা শেষ করেছিলাম আরো অনেক আগেই, কিন্তু আইলসামী কইরা ব্লগে দেয়া হয়নাই। আজকে দিনমজুর ভাইয়ের পোস্টটা দেইখা মনে হইলো তারাতারি বাকি দুই পর্ব দিয়া ফেলা দরকার।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০১২ রাত ২:১২