somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বামপন্থী মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের বামপন্থী চেতনা - ১

০২ রা অক্টোবর, ২০১৩ দুপুর ১:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অনলাইন গনমাধ্যম ইতিহাস চর্চার জন্যে অত্যন্ত বিপদজনক একটি জায়গা। ইতিহাসের বদলে প্রোপাগান্ডা চর্চা অনলাইন গনমাধ্যমে অনেক সহজ। অনলাইন আওয়ামীলীগ এই বিষয়টায় এতটাই দক্ষতা অর্জন করেছে যে তা মোটামুটি শিল্পের পর্যায়ে উন্নিত হয়েছে। বাংলাদেশের অনলাইন গনমাধ্যমগুলোতে সবচেয়ে বড় ইতিহাসবীদ যিনি তিনিই আবার অনলাইন বাঙলার সবচেয় বড় প্রোপাগান্ডা বিশারদদের একজন। এইটা অত্যন্ত চমৎকার কিন্তু ভয়ঙ্কর একটা সত্য। একটা মিথ্যা কথা বারবার বলতে বলতে কিভাবে সত্যে পরিনত করা যায় তার একটা উদাহরন বলি। ইদানিং প্রায়ই অপেক্ষাকৃত কম বয়সী অনেককে ব্লগে অথবা ফেসবুকে মন্তব্য করতে অথবা চ্যাটবক্সে বলতে শুনেছি বাংলাদেশের বামপন্থীরা নাকি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে। এর মধ্যে যারা একটু পন্ডিত তারা জানে যে মস্কোপন্থীরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং চীনপন্থীরা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিল। মাওবাদী তথা চীনপন্থী বামপন্থীরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে এই কথাটা এখন অনলাইনে মোটামুটি সত্যের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চীনা বাম, চীনা বাদাম অথবা চিঙ্কু এজাতীয় কিছু শব্দ ব্যবহার করা হয় এবং বোঝানো হয়যে এরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি। এখন, মাওবাদী ভাষা সৈনিক আবদুল মতিনকেও তারা স্বাধীনতা বিরোধী বলার সাহস দেখাবে কিনা সেই প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। কিংবা, শহীদ হাসান ইমাম রুমী, যাকে বিক্রি করে অনলাইন আওয়ামীলীগের অনেকে বড় ইতিহাসবীদ হয়েছেন, তার সাথে মাওবাদীদের সম্পর্কের তারা কি জবাব দেবেন? এখানে উল্লেখ্য যে মুক্তিযুদ্ধের এই মহান গেরিলা যোদ্ধার সাথে যে রাজনৈতিক সংগঠনটির সম্পর্ক পাওয়া যায় তা হলো পিকিংপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন। মুক্তিযুদ্ধের সময়টাতে রুমী এই সংগঠনটিকে তার গাড়ি দান করেন, যেই গাড়িটি পুরো একাত্তর সালেই শিবপুরের মাওবাদী মুক্তিযোদ্ধাদের বাহন হিশাবে ব্যবহার হয়েছে। রুমীর ক্র্যাক প্লাটুনের সহযোদ্ধা এবং ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই ছিলেন মাওবাদী। অনলাইন আওয়ামীলীগ এদের স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি বলবে কিনা সেটা একটা প্রশ্ন। শাহবাগ আন্দোলনে শহীদ রুমী স্কোয়াডকে নেহাত আওয়ামী নিয়ন্ত্রনের রাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান নেয়ায় চিঙ্কু ও স্বাধীনতা বিরোধী ট্যাগ খেতে হয়েছে। কবে খোদ রুমী এই ট্যাগ খাবেন তা এখন দেখার বিষয়।

অবশ্য চিঙ্কু অথবা চিনাবাদাম শব্দের ব্যবহারে অনলাইন আওয়ামীলীগ বিশেষ বাছবিচার করে তা না। আমি বিভিন্ন সময়ে তাদের কাছে চীনাবাদাম, মাওবাদী অথবা চিঙ্কু ট্যাগিং পেয়েছি। অথচ চীনপন্থা দূরে থাক, মস্কোপন্থার সাথেও আমার সম্পর্ক নাই। আমাকে বড়জোর একজন লেফট উইং ন্যাশনালিস্ট বলা যায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্রলীগের ভেতরে লেফট উইং ন্যাশনালিজম বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। মাওবাদের সাথে আমার দুরতম সম্পর্ক হতে পারেযে বামপন্থী চিন্তা ভাবনার ক্যাটাগোরিতে আমি কম বেশি থার্ড ওয়ার্ল্ডিস্ট, আর মাওবাদও থার্ড ওয়ার্ল্ডিজমের ক্যাটাগোরিতে পরে। এইসব বিষয়ে তাদের জানাশোনা নাই, থাকার কথা না। তাদের কাছে চিঙ্কু বাম হলো সেই বাম যে আওয়ামীলীগের বিরোধীতা করে। এবং আওয়ামীলীগের বিরোধীতা করে বলেই তাদের কাছে সে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির এই সংজ্ঞা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাসের উপর আওয়ামীলীগের একাধিপত্যের ফলাফল। অথচ এমন হওয়ার কথা ছিলনা। কিন্তু হয়েছে। ফলে দেখা যাচ্ছে তারা সিপিবি ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের চিঙ্কু বলে গালি দিচ্ছে, যে সিপিবি ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের সারা জীবন মাওবাদীদের কাছে আওয়ামী দালাল গালি খেতে হয়েছে। তারা বাসদের কর্মীদের চিঙ্কু বলে গালি দিচ্ছে, যেই বাসদের জন্ম জাসদ থেকে। যে জাসদ মূলত ছিল আওয়ামীলীগ থেকে বের হয়ে আসা বামপন্থীদের সংগঠন।

এইসব প্রোপাগান্ডার শুরুটা আমরা নিজেদের চোখের সামনে দেখেছি। ঠিক যখন থেকে অনলাইন বামপন্থীরা ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের নানান সমালোচনা ও বিরোধীতা করতে শুরু করে তখন থেকেই এই ‘চিঙ্কু’ প্রোপাগান্ডার শুরু। অনলাইন আওয়ামী পন্ডিত ও ইতিহাসবীদরা ফতোয়া দিল যে যারা এইসব বিরোধীতা করছে তারা হলো চীনপন্থী বাম, এরা মুক্তিযুদ্ধের সময়ও আওয়ামীলীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে, এখনো করছে। মোটকথা, ডানপন্থী ছাগুর পাশাপাশি, বামপন্থীদের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি হিশাবে ট্যাগ দেয়ার উদ্দেশ্যেই এই ফতোয়া জারি করা হয়। সমস্যা হলোযে বাংলাদেশে চীনপন্থী বাম রাজনীতি অনেকদিন আগেই তার গুরুত্ব হাড়িয়েছে। হার্ডকোর মাওবাদীদের এখন খুঁজে পাওয়াও দুস্কর। তাই দেখা গেলোযে সিপিবির বাকী বিল্লাহকে তারা চিঙ্কু ট্যাগ দিচ্ছে, একি ট্যাগ দিচ্ছে একেবারেই নন পার্টিজান নেহায়েত বামঘেসা মুক্তমনা আসিফ মহিউদ্দীনকে, একি ট্যাগ দিচ্ছে বাসদের রাজনীতি করে আসা নিলয়দের। অথচ বাংলাদেশের চীনপন্থী বামদের সবচেয়ে বড় সংগঠন সাম্যবাদী দল হলো আওয়ামীলীগের মহাজোটের পার্টনার, যে দলটির নেতাকে তারা নিজেদের মন্ত্রী পর্যন্ত বানিয়ে রেখেছে। অনলাইন আওয়ামীলীগের কাছে মহাজোটের বাইরে যারা বাম, যারা আওয়ামীলীগ সরকারের সমালোচনা ও বিরোধীতা করে তারা সকলেই চিঙ্কু। দিনশেষে যা দাঁড়ায় তা হলোযে বাম মাত্রেই চিঙ্কু, এবং সকল বামপন্থীই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি। এটাকে সত্যের বিকৃতি বলার উপায় নাই, এটা হলো দিনে দুপুরে ডাহা মিথ্যাচার।

সত্য হলো যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের বড় অংশই সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে। সত্য হলোযে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে বামপন্থী রাজনীতি ও চিন্তা ভাবনা ছিল ওতপ্রতভাবে জড়িত। সত্য হলোযে বামপন্থাকে উহ্য রাখলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পূর্ণ হবেনা। সত্য হলোযে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চরিত্রগত ভাবেই ছিল বামঘেসা, এবং এই মুক্তিযুদ্ধের একটি বামপন্থী চেতনাও ছিল। আজকে আমরা প্রায় ভুলতে বসেছিযে মুক্তিযুদ্ধের এই বামপন্থী চেতনা এমনকি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মূলধারার চেতনায় পরিনত হয়েছিল, যার প্রমাণ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের প্রধান চার নীতির একটি ছিল ‘সমাজতন্ত্র’। হয়তো শুদ্ধ কোন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথ ধরে তা হয় নাই, হয়তো তা ছিল মূলত সিপিবির কূটনীতির ফসল, কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সেসময় যারা একটা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হিশাবে দেখেছে বা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে পরিনত করার যারা চেষ্টা করেছে তাদের মধ্যে মস্কোপন্থী, পিকিংপন্থী এবং সেইকালের বামঘেসা আওয়ামীলীগও ছিল। নাইলে জগতের কোন কুটনীতিই একটা স্বাধীন দেশের সংবিধানের মূলনীতিতে সমাজতন্ত্রের হাজিরা করতে পারেনা।

বামপন্থীদের কেউ কেউ মুজিবনগর সরকারের পক্ষে ছিল, এরা মুক্তিবাহিনীতে থেকে যুদ্ধ করেছে। যারা মুজিবনগর সরকারের পক্ষে ছিলনা তারা আলাদা যুদ্ধ করেছে। তাদের বিরুদ্ধে কট্টর আওয়ামীলীগারদের যে মুজিব বাহিনী তৈরি হয়েছিল তাদের বড় অংশও বামপন্থীই ছিল। এই ধারাবাহিক লেখার মধ্য দিয়া এসব ইতিহাসের কিছু অংশ তুলে আনার ইচ্ছা রাখি। সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাসের মূলধারা থেকে বামপন্থীদের বিচ্যুতিতে নেহায়েতই তাদের বিরোধীদের প্রোপাগান্ডা মেশিনই দায়ী নাকি এদেশের বামপন্থীদেরও বড় ধরণের দায় আছে তা নিয়াও কিঞ্চিত আলোচনা করার ইচ্ছা রাখি।

(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০১৩ দুপুর ১:৩০
৫টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×