somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কবি বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের স্মরণে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ।।

১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৫:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কবি বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম এর স্মরণে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ।
*********** বিস্তারিত লিংকে ******
Click This Link

স্মরণ : বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম (Video)


ফারুকুর রহমান চৌধুরী :: আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম জীবদ্দশায় দীর্ঘ প্রায় ছয় দশক অফুরন্ত সাধনা ও ত্যাগ স্বীকার করে সমগ্র দেশে হয়ে উঠেছেন আলোচনার বিষয়বস্তু। তাঁর রচিত ভাটিয়ালী, মুর্শিদী, দেহতত্ত্ব, গণসঙ্গীত ইত্যাদি অসংখ্য গান দেশের সীমানা পেরিয়ে বহির্বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। পেয়েছেন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রিয় সম্মাননা “একুশে পদক” সহ অসংখ্য সম্মাননা সংবর্ধনা । সৃজনশীল সৃষ্টি কর্মের উজ্জল নক্ষত্র শাহ আবদুল করিম মৃত্যুর পরও রয়েছেন জনপ্রিয়তা, আলোচনা, সমালোচনার শীর্ষে । সাম্প্রতিক সময়ে যাদের গান দেশ বিদেশে জনপ্রিয় তাঁদের মধ্যে শাহ আবদুল করিম উল্লেখযোগ্য । সেপ্টেম্বর মাসের ১২ তারিখ শাহ আবদুল করিমের মৃত্যুবার্ষিকী । দিনটিকে কেন্দ্র করে দেশ বিদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচার করা হয় শাহ আবদুল করিমের জীবনী ও গান ।
বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম

বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম

বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম স্বীয় সাধনা বলে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিতি লাভ করেছেন । তাই নতুন করে তাঁর পরিচিতি তুলে ধরার কোন প্রয়োজন নেই । তবুও মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে শাহ আবদুল করিমের প্রতি আমাদের এই শ্রদ্ধা নিবেদন ।

আমার নাম আবদুল করিম উজান ধল ঠিকানা
পোস্ট অফিস ধলবাজার দিরাই হলো থানা ।
মহকুমা সুনামগঞ্জ সিলেট জেলায় ।
জন্ম আমার হাওর মাতৃক ভাটি এলাকায় ।।
মাতার নাম নাইয়রজান বিবি লই পদধুলি
পিতার নাম মোহাম্মদ ইব্রাহীম আলী ।।
তেরোশো বাইশ বাংলায় জন্ম আমার ।
মা বলেছেন ফাল্গুন মাসের প্রথম মঙ্গলবার ।।

শাহ আবদুল করিম যখন জন্ম নিয়েছিলেন তখনকার সময় জন্ম সন লিখে রাখার কোন প্রচলন হাওরাঞ্চলে ছিল না । তাই শাহ আবদুল করিমের জন্ম সনও লিখা ছিল না । তিনি তাঁর মায়ের মুখে শুনেছেন তেরোশে বাইশ বাংলার ফাল্গুণ মাসের প্রথম মঙ্গলবার শাহ আবদুল করিমের জন্ম । সে হিসেবে শাহ আবদুল করিম ১৯১৬ খ্রিঃ ১৫ই ফেব্র“য়ারী জন্ম গ্রহণ করেছেন । দিরাই উপজেলার তাড়ল ইউনিয়নের অন্তর্গত ধল আশ্রম গ্রামে জন্ম নেয়া শাহ আবদুল করিমের পিতার নাম ইব্রাহীম আলী, মাতার নাম নাইওরজান বিবি। সাধারন কৃষক পরিবারের ছেলে শাহ আবদুল করিমের আদি নিবাস ছিল ধলআশ্রম গ্রামে । তাঁরা সেখান থেকে ১৯৫৭ সাল ধলআশ্রমের পাশ্ববর্তী পাড়া উজানধল গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। ইব্রাহীম আলীর ছয় সন্তানের মধ্যে শাহ আবদুল করিম ছিলেন সবার বড়-

গরিব কৃষক পরিবারে জন্ম নিলাম ।
পিতা-মাতার প্রথম সন্তান ছিলাম ।।

শাহ আবদুল করিমের এক দাদা (পিতামহের ছোট ভাই) নসিব উল্লাহ লাউ বাজিয়ে গান করতেন । নসিব উল্লা ফকিরি লাইনে চলতেন বিধায় তাঁর কাছে সাধু-ফকিররা আসতেন । শাহ আবদুল করিম যখন ছোট, অবিবাহিত নসিব উল্লার তখন বার্ধক্য । মা নাইওর জান বিবি সংসারের কাজ কর্মে ব্যস্ত থাকতেন তাই শাহ আবদুল করিম সারাদিন দাদা নসিব উল্লার সাথে সাথে থাকতেন । তখন নসিব উল্লার কন্ঠে গাওয়া একটি গান কিশোর আবদুল করিমের মনে প্রভাব ফেলেছিল-

“ভাবিয়া দেখ মনে
মাটির সারিন্দা রে বাজায় কোন জনে”

শাহ আবদুল করিম সময়ে-অসময়ে মনের সুখে এই গানটি গাইতেন এবং অবসর সময়ে দাদার সাথে আড্ডা দিতে দিতে একতারাতে আঙুল চালানো শিখতেন। আস্তে আস্তে শাহ আবদুল করিম বড় হতে লাগলেন । শাহ আবদুল করিমের পিতার সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকে । অনাহার অর্ধাহারে দিনাতিপাত করেতেন থাকেন তাঁরা। তাই অভাবের সংসারের হাল ধরতে শাহ আবদুল করিম গ্রামের এক গৃহস্থের বাড়িতে গরু রাখালের চাকরি নেন।

আমার ছোটো বোন তারা হলো পাঁচজন
সংসারে আসিল তখন অভাব অনটন ।।
সম্পদ বলতে অল্প কিছু বোরো জমি ছিল ।
ঋণের দায়ে তাহা মহাজনে নিল ।।
গরিব হলে আপনজনে বাসে তখন ভিন
ভরণ-পোষণে দুঃখ বাড়ে দিন দিন ।।
ভারণ-পোষণে তখন অক্ষম ছিলেন ।
পিতা-মাতা আমাকে চাকরিতে দিলেন ।।
শিক্ষা নয় চাকরি করি পেটে নাই ভাত ।
কী করে বেঁচে থাকা যায় ভাবি দিনরাত ।।
বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম

বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম

শাহ আবদুল করিম ৩/৪ বছর রাখালের কাজ করার পর ধল বাজারের এক ভূসিমালের দোকানে চাকরি নেন । সারা দিন কাজ করেন এবং রাতে টো টো করে নিজ গ্রামের আশপাশের গ্রামগুলোতে ঘুরে বেড়িয়ে যাত্রা, পালা, কবিগান ও বাউল গান শুনতেন । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে শিক্ষানুরাগী তৈমুর চৌধুরীর বড়িতে স্থাপিত নৈশ বিদ্যালয়ে মাত্র আট রাত পড়ালেখা করেছিলেন আবদুল করিম। মাত্র আট রাত্রির লেখা পড়া ছিল তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হাতে-খড়ি। সে সময় গুজব উঠে যারা এই বিদ্যালয়ে পড়বে তাদের সবাইকে ব্রিটিশরা যুদ্ধ করতে নিয়ে যাবে। সেই ভয়ে ছাত্র ছাত্রীরা বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দেয়, বিধায় তাঁরও বিদ্যালয়ে যাওয়া হয়নি।

তখন ব্রিটিশ শাসন এই দেশে ছিল ।
বড়দের শিক্ষার জন্য রাত্রে স্কুল দিল ।।
তৈমুর চৌধুরী তখন মাস্টারি নিলেন ।
নিরক্ষর সবাইকে জানিয়ে দিলেন ।।
সুযোগ পেয়ে আমি সেই স্কুলে ভর্তি হই ।
বিনা মূল্যে দিল একটি বড়দের বই ।।
পরে শুনি এই স্কুলে শিক্ষা যারা পাবে ।
নাম দস্তখত শিক্ষার পরে যুদ্ধে নিয়ে যাবে ।।
এই মিথ্যা গুজব-বাণী গ্রামে যখন এলো ।
পড়িতে কেউ আসে না আর স্কুল বন্ধু হলো ।।

নৈশ বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলেও বিদ্যালয় হতে প্রাপ্ত অক্ষরশিক্ষার বইটি শাহ আবদুল করিম সঙ্গে সঙ্গে রাখতেন এবং তা থেকে শিক্ষা অর্জনের চেষ্টা করেন । যেটুকো বুঝতেন পড়তেন আর যেটুকো বুঝতেন না সেটুকো শিক্ষিতদের কাছ থেকে বুঝে নিতেন । এভাবে তিনি মোটমোটি পড়তে ও লিখতে শিখেন ।

বড়দের বই আমার হয়ে গেল সাথি ।
প্রয়োজন আছে তাই পড়ি দিবারাতি ।।
অক্ষরজ্ঞান আমার হলো তাড়াতাড়ি ।
পুঁথি পুস্তক তখন পড়তে আমি পারি ।।
জানার জন্য বিভিন্ন বইপুস্তক পড়ি
গান গাই আর উপস্থিত রচনা করি ।।

এক সময় নিজেই গানের ভূবনে জড়িয়ে যান শাহ আবদুল করিম। নিজের গ্রামসহ আশপাশের গ্রামে বাউল, মুর্শিদি ও যাত্রাগানে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন এবং বেশ সুনাম অর্জন করেন। সঙ্গীত সাধনায় স্বগ্রামবাসী করম উদ্দিনকে ওস্তাদ মান্য করেন এবং তাঁর কাছে সঙ্গীত বিষয়ে ধারণা নেন। পরে নেত্রকোনার সাধক রশীদ উদ্দিনের গভীর সান্নিধ্যে সঙ্গীতাশ্রয়ী বাউলতন্ত্রে পূর্ণ দীক্ষা গ্রহণ করেন।

গানের উস্তাদ করম উদ্দিন, ধল আশ্রমে বাড়ি
পরে সাধক রশীদ উদ্দিন, উস্তাদ মান্য করি।

আবদুল করিম যখন পরিপূর্ন যুবক তখন বাউল, মালজোড়া, ভাটিয়ালি, মুর্শিদিসহ নানা ধরনের গান গেয়ে চষে বেড়াতেন পুরো এলাকা। তাঁর চমৎকার গানের গলার সুরমাধুর্যে মুগ্ধ হতে থাকে পার্শ্ববর্তী থানাসমূহের মানুষ। তাই বিভিন্ন গ্রাম এবং থানা থেকে গান গাওয়ার আমন্ত্রণ আসতে থাকে। আবদুল করিম গান গেয়ে সুনাম অর্জন করতে থাকেন। এভাবে গান গাইতে গাইতে শাহ আবদুল করিম সত্যিকারের একজন চারনকবি হয়ে উঠেন। তিনি বাউল গান রচনা পরিবেশনার মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে স্থান করেন নেন।

বিভিন্ন আসরে গান গাইতে যাই
বিভিন্ন মহাজনের গান তখন গাই
সকল মহাজনের গানে একই কথা বলে
পির-মুর্শিদ ভজিতে হয় আপন জানতে হলে

শাহ আবদুল করিম সুনামগঞ্জ সদর থানার উকারগাঁও গ্রামে মৌলাবক্স মুন্সীর দেখা পেয়ে তাঁর মুরীদ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন । তাই পিতা-মাতার অনুমতি নিয়ে মৌলাবক্স মুন্সীর সঙ্গে দেখা করে এবং তাঁর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে মৌলাবক্স মুন্সির মুরিদ হন । একসময় শাহ ইব্রাহিম মাস্তানকে পীর হিসেবে গ্রহণ করেন ।

মুর্শিদ আমার মৌলা বক্স মুন্সী দয়ার ঠাকুর
পীর ইব্রাহিম মস্তান মোকাম শ্রীপুর ।।

শাহ আবদুল করিম তাঁর মুর্শিদের নির্দেশে এবং বাবা-মায়ের আনুমতিক্রমে ১৯৪৮ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

মুর্শিদ যে দিন ধার্য করেছিলেন ।
সময়ে কাজ সম্পন্ন করে দিলেন ।
গরিব কৃষকের মেয়ে কুঁড়েঘরে ছিল ।
জীবনসঙ্গিনী রূপে এসে যোগ দিল ।।
সরল শান্ত শুদ্ধমতি সে হলো সুজন ।
অশান্ত চঞ্চল আমি হলেম অভাজন ।
সৎচরিত্র মন-পবিত্র ছিল তার গুণ ।
সরল বলেই নাম হলো তার সরলা খাতুন ।।

শাহ আবদুল করিম সঙ্গীত সাধনার মাধ্যমে সাধারন মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন । বিভিন্ন স্থানে প্রচার হয়েছে গানের সুনাম তৈরী হয়েছে অসংখ্য ভক্ত ¯্রােতা । তাই জীবদ্দশায় বিভিন্ন রাজনৈতিক মঞ্চে গণসঙ্গীত গেয়ে গণ জোয়ার সৃষ্টি করেছেন । গণসঙ্গীতের মাধ্যমে শাহ আবদুল করিম উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন । ইতিহাসে যত বড় বড় আন্দোলন সংগটিত হয়েছে তার প্রায় সব আন্দোলনেই তিনি গণসঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে গণজোয়ার সৃষ্টি করেছেন। যেমন- স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে দেশ প্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে শাহ আবদুল করিম লিখেছিলেন-

ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যখন
আসে স্বদেশী আন্দোলন
ভারতবাসী সবাই একই দাবি করে
ব্রিটিশ যাইবে ভারববর্ষ ছেড়ে।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ মুসলিমলীগের বিরুদ্ধে বৃহত্তর সিলেটে গণসংযোগে আসতেন তখন তাঁদের সফর সঙ্গী হতেন শাহ আবদুল করিম। তিনি অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একান্ত রাজনৈতিক সহকর্মী ছিলেন। ১৯৫৫ সালে সিলেটের ঐতিহাসিক রেজিষ্ট্রিরি ময়দানে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর সিলেট আগমন উপলক্ষ্যে জনসভায় শাহ আবদুল করিম গণসঙ্গীত গেয়েছিলেন। ১৯৫৭ সালে শেখ মুজিবুর রহমান, শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে যান মওলানা ভাসানীর কাগমারী সম্মেলনে। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেন মৌলনা ভাসানীর সাথে। সেদিন শাহ আবদুল করিমের গান শুনে মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তাঁর পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, “তুমি ভবিষ্যতে গণমানুষের মহান শিল্পী হবে”। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্র“য়ারী শাহ আবদুল করিম নেত্রকোণায় একটি মঞ্চে গান গাইছিলেন। ঠিক সেই মুহুর্তে খবর এলো ঢাকায় ভাষার দাবিতে মিছিলে গুলিবর্ষণ করা হয়েছে, গুলিতে অনেকেই মারা গেছেন। এ কথা শুনার পর শাহ আবদুল করিম তাৎক্ষনিকভাবে বাংলা ভাষা আদায়ের পক্ষে গান বেঁধেছিলেন-

মুখের বোল কাইড়া নিবে
রাষ্ট্রভাষা উর্দূ হবে
আমরা মায়ের ভাষায় কথা বলবো
প্রয়োজনে রক্ত দেবো
জীবন দিয়ে বাংলা রাখবো
ঢাকার বুকে রক্ত দিছে বাংলা মায়ের সন্তান
আমরা রাখবো তাদের মান।derai

শাহ আবদুল করিম নেতাদের বক্তব্য মঞ্চে গণসঙ্গীত পরিবেশন করে ইতিহাসে স্বাক্ষর রেখে গেছেন। একাধিক বার শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মৌলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছেন, এবং বিভিন্ন মঞ্চে গণ সংগীত পরিবেশন করেছেন। ১৯৫৭ সালে টাঙ্গাইলের ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন এসময় তাঁর গানে মুগ্ধ হয়ে মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৮৫ টাকা পুরষ্কার প্রদান করেছিলেন এবং আশির্বাদ করেছিলেন। ১৯৬৭ সলে তৎকালীন পাকিস্তানের দুর্নীতিদমন মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সুনামগঞ্জ সফরে আসেন। সেদিন কোন এক কারনে তৎকালীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী সুনামগঞ্জের মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে শীর্ষস্থানীয় নেতারা বঙ্গবন্ধুর জনসভা বর্জন করেন। ফলে জনসভা স্থলে লোক সমাগম নেই বললেই চলে। এসময় এগিয়ে আসেন শাহ আবদুল করিমসহ হাতেগোনা কয়েকজন নেতাকর্মী। লোক সমাগম নেই দেখে আবদুল করিম ভিন্ন পথ ধরলেন। তিনি গান ধরলেন। তাঁর গান শুনে জনসভাস্থল পরিপূর্ন হয়ে উঠে। আবদুল করিমের গান শুনে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে ১১০০ টাকা দিয়ে বলেছিলেন “আমি যতই করিম ভাইকে দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। আপনার মতো শিল্পীকে উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া হবে। এ দেশের উন্নয়নে আপনারমতো গুণী শিল্পীর প্রয়োজন অনেক”। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবুর রহমান পুনরায় সুনামগঞ্জ আসেন। এসময় সুনামগঞ্জ জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে অনুষ্ঠিত সভামঞ্চে শাহ আবদুল করিম গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন। তাঁর গণসঙ্গীত শুনে আবেগে আপ্লুত হয়ে শেখ মুজিবুর রহমান মাইকে দাড়িয়ে বল্লেন- “শেখ মুজিব বেঁচে থাকলে করিম ভাইও বাঁচবে” এসময় তিনি শাহ আবদুল করিমকে পাঁচশত টাকা উপহার দেন। শাহ আবদুল করিম কোন এক সময়ে বাংলাদেশ আওয়ামিলীগ সুনামগঞ্জ মহকুমার সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন। তিনি সমাজ কল্যাণ মূলক বিভিন্ন কর্মকান্ডেও জড়িত ছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে গানের মাধ্যমে সাধারন মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্য উদ্বোদ্ধ করেছিলেন। তিনি যে সমস্ত গানের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধে যাবার জন্য মানুষকে উদ্বোদ্ধ করতেন সেগুলোর মধ্যে একটি গানের কয়েক লাইন নিম্নরূপ-

বাঙালি যুবকের দল
চল্ মুক্তির সংগ্রামে চল্
তোরাই দেশের সহায় সম্বল
পাছে হটার সময় নয়।
ধরো ধরো অস্ত্র ধরো
বাংলা মোদের মুক্ত করো
মনের দুর্বলতা ছাড়ো
আমাদের জয় সুনিশ্চয়।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুনামগঞ্জে আসেন। বালুর মাঠে অনুষ্ঠিত জনসভায় শাহ আবদুল করিম গনসঙ্গীত পরিবেশন করেন। তিনি সেদিন যে গান পরিবেশন করেছিলেন সেই গানের কয়েকটি লাইন নিম্নরূপ-

পূর্ণ চন্দ্রে উজ্জল ধরা,
চৌদিকে নক্ষত্র ঘেরা,
জনগণের নয়ন তারা,
শেখ মুজিবুর রহমান,
জাগোরে জাগোরে মজুর কৃষান।

শাহ আবদুল করিম পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তান বেতারে কিছু দিন গান গেয়েছেন। সেখানে স্বাধীন ভাবে গান গাওয়া যায় না তাই তিনি ক্ষুদ্ধ হয়ে বেতারে গান গাওয়া ছেড়ে দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সাল থেকে সিলেট বেতারে নিয়মিত গান গাইতেন। এসময় ঘোষনায় বলা হতো “শাহ আবদুল করিম ও তাঁর দল”। পরবর্তীতে সিলেট বেতার থেকেই তাঁর নাম ঘোষনা করা হয় “শাহ আবদুল করিম”। শাহ আবদুল করিম বাংলাদেশ টেলিভিশনে বেশ কয়েকবার গান গেয়েছেন। তাঁর দীর্ঘ জীবনে ১৯৬৪, ১৯৮৫ ও ২০০৭ সালে লন্ডনে প্রবাসী বাঙ্গালীদের আমন্ত্রণে গান গাইতে গিয়েছেন। ১৯৮৬ সালে হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযানে ভাটি অঞ্চলে শেখ হাসিনার সফর সঙ্গী হয়েছিলেন শাহ আবদুল করিম। ১৯৯৫ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দিরাই সফরে আসেন এই সফর উপলক্ষ্যে দিরাই উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের মাঠে জনসভা অনুষ্ঠিত হয় জনসভায় শেখ হাসিনা, শাহ আবদুল করিমকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন- ‘আমার বাবা যার গানের গুনমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন, আমি তাঁকে অবশ্যই উপযুক্ত সম্মান দেবো। বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম গরিব মেহনতি মানুষের সুখ-দুঃখ জনসমক্ষে তুলে ধরা জন্য এবং সকলের বাঁচার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে “বাঁচতে চাই” নামে একটি সংগঠনও প্রতিষ্ঠা করেন। এ নিয়ে তিনি একটি গানে লিখেছেন।

আমরা সবাই মিলে বাঁচতে চাই
আমার মতো গরিব যারা
আমি তাহাদের গান গাই।।

শাহ আবদুল করিম এই সংগঠনের প্রধান উপদেষ্ঠা ছিলেন । তিনি উজান ধল গ্রামে নিজ বাড়িতে “শাহ আবদুল করিম সংগীতালয়” প্রতিষ্ঠা করেন। শাহ আবদুল করিমের কন্ঠে গাওয়া গান মূলত ভাটি বাংলা আলোড়ন সৃষ্টি করে পঞ্চাশ দশকে। তিনি দীর্ঘ প্রায় ছয় দশক সাধনা করে সমগ্র দেশে হয়ে উঠেছেন বিষয়বস্তু। তাঁর এ সাফল্যের পিছনে রয়েছে অফুরন্ত সাধনা ও ত্যাগ। তাঁর রচিত ভাটিয়ালী, মুর্শিদী, দেহতত্ত্ব, গণসঙ্গীত ইত্যাদি অসংখ্য গান দেশের সীমানা পেরিয়ে বহির্বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। হাওর অধ্যুষিত সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার ধল গ্রামে জন্ম নেয়া সৃজনশীল সৃষ্টি কর্মের উজ্জল নক্ষত্র, অসাধারন প্রতিভার অধিকারী বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম এই পৃথিবীর মাহামুহ ত্যাগরে ২০০৯ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর সিলেট শহরস্থ নুরজাহান পলি ক্লিনিকে মৃত্যুবরন করেন। জীবদ্দশায় তাঁর ছয়টি গানের বই প্রকাশিত হয় – ১) আপ্তাব সঙ্গীত, মুদ্রনে- রায় প্রেস, সুনামগঞ্জ, ২) গণসঙ্গীত, প্রকাশকাল- ১৯৫৪ খ্রিঃ, ভিন্নমতে ১৯৫৭ খ্রিঃ, মুদ্রনে রায় প্রেস, সুনামগঞ্জ, ৩) কালনীর ঢেউ, প্রকাশ কাল- ১৯৮১ খ্রিঃ, মুদ্রনে- মেহেরাবাদ প্রেস, সিলেট, ৪) ধলমেলা, প্রকাশ কাল- ১৯৯০ খ্রিঃ, চারুমুদ্রণ, তালতলা, সিলেট, ৫) ভাটির চিঠি, প্রকাশকাল- ১৯৯৮, স্টেশন ক্লাব, সিলেট, ৬) কালনীর কুলে, প্রকাশকাল- ২০০৬, লোকচিহ্ন প্রকাশনী। এছাড়াও ২০০৯ সালের মে মাসে প্রকাশিত করেছে- শাহ আবদুল করিম রচনা সমগ্র । এটি প্রকাশ করেছে খান বাহাদুর আবু এহিয়া ওয়াকফ এস্টেট, সিলেট । এতে তাঁর আপ্তাব সঙ্গীত গ্রন্থের গান এবং অপ্রকাশিত কিছু গান ছাপা হয়নি। শাহ আবদুল করিম রচনাসমগ্র ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে । বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ৬৭৫ টাকা ।

শাহ আবদুল করিম জীবদ্দশায় দেশ বিদেশ থেকে বহু পদক, সম্মাননা, ও সংবর্ধনা এবং বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন কর্তৃক শ্রদ্ধাঞ্জলি, সনদপত্র পেয়েছেন । তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য সম্মাননা হচ্ছে :- ১) রাগিব রাবেয়া সাহিত্য পুরষ্কার- ২০০০, ২) একুশে পদক- ২০০১, ৩) লেবাক এওয়ার্ড- ২০০৩, ৪) মেরিল প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা-২০০৪, ৫) সিটিসেল চ্যানেল আই মিউজিক এওয়ার্ড আজীবন সম্মাননা- ২০০৫, ৬) সিলেট সিটি কর্পোরেশন নাগরিক সংবর্ধনা- ২০০৬, ৭) জাতিসংঘ সমিতি সম্মাননা পুরষ্কার- ২০০৬, ৮) অভিমত সম্মাননা- ২০০৬, ৯) বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী সম্মাননা- ২০০৮, ১০) খানবাহাদুর এহিয়া সম্মাননা পদক- ২০০৮, ১১) এনসিসি ব্যাংক- ২০০৯, ১২) হাতিল এওয়ার্ড সম্মাননা- ২০০৯ । আমরা মরহুম বাউল স¤্রাট শাহ আবদুল করিমের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি ।

*

সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১১:৫৫
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পিরিতের সংস্কৃতিওয়ালা তুমি মুলা’র দিনে আইলা না

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৬


---- আমাদের দেশে ভাষা, সংস্কৃতি এবং সামাজিক সমুন্নয়ন তলানিতে। তেমন কোন সংস্কৃতিবান নেই, শিরদাঁড়া সোজা তেমন মানুষ নেই। সংস্কৃতির বড় দান হলো ভয়শূন্য ও বিশুদ্ধ আত্মা। যিনি মানবের স্খলনে, যেকোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসরায়েল

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮

ইসরায়েল
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

এ মাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বাবাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
নিরীহ শিশুদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এই বৃ্দ্ধ-বৃদ্ধাদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ ভাইক হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বোনকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
তারা মানুষ, এরাও মানুষ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

গ্রামের রঙিন চাঁদ

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১২


গ্রামের ছায়া মায়া আদর সোহাগ
এক কুয়া জল বির্সজন দিয়ে আবার
ফিরলাম ইট পাথর শহরে কিন্তু দূরত্বের
চাঁদটা সঙ্গেই রইল- যত স্মৃতি অমলিন;
সোনালি সূর্যের সাথে শুধু কথাকোপন
গ্রাম আর শহরের ধূলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১৭



পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষঃ
পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপালদেব অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন।১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই বিশাল কীর্তি আবিষ্কার করেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরবাসী ঈদ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৩

আমার বাচ্চারা সকাল থেকেই আনন্দে আত্মহারা। আজ "ঈদ!" ঈদের আনন্দের চাইতে বড় আনন্দ হচ্ছে ওদেরকে স্কুলে যেতে হচ্ছে না। সপ্তাহের মাঝে ঈদ হলে এই একটা সুবিধা ওরা পায়, বাড়তি ছুটি!... ...বাকিটুকু পড়ুন

×