somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যান্ত্রিক সভ্যতার কাছে আমরা যা যা হারিয়েছি।

২৩ শে আগস্ট, ২০১৪ সকাল ৯:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মানুষের চেষ্টা সব সময় এগিয়ে যাওয়া সামনের দিকে। সেই এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় পেছনে ফেলে আসতে হয় পূর্ব-পুরুষদের জীবনযাত্রার সাথে জড়িয়ে থাকা অনেক কিছু। অনেক কৌশলগত হাতিয়ার- যেগুলো এক সময় আমাদের জাতীয় অগ্রগতিকে তরান্বিত করেছে। কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষ হয়ে পড়েছে অধিক থেকে অধিকতর যন্ত্রনির্ভর। তার কারণ, প্রতিযোগীতামূলক বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে হবে আমাকেও। কম সময়ে সহজ উপায়ে বেশী ও টেকসই ফল লাভ করা এখন আমাদের লক্ষ্য। সেজন্য যান্ত্রিকতার উপর নির্ভর না করে উপায় নেই আমাদের। সেই নির্ভরতার কাছে সঁপে দিতে হয়েছে আমাদের পূর্বপুরুষদের অ-যান্ত্রিক আটপৌরে জীবন যাপনের অনেক কিছু। আসুন না একটু মনে করতে চেষ্টা করি আজকের যান্ত্রিক সভ্যতার কাছে আমাদের হারিয়ে যাওয়া সেই উপকরণগুলো কি কি ?


১) লাঙ্গল ঃ খুব ভোরে দু’মুঠো পান্থা মুখে দিয়ে লাঙ্গল-জোয়াল কাঁধে কৃষকের মাঠে যাবার সেই দৃশ্য আজ আর দেখা যায়না আমাদের গ্রামাঞ্চলে। সেই দৃশ্য যারা দেখেছেন, তারা একই সাথে আর একটি দৃশ্যের কথা স্মরণ করতে পারবেন খুব সহজে। সেটা হলো স্বামীকে লাঙ্গল-জোয়াল কাঁধে বিদায় দিয়ে কিষাণ বধূর দেউড়ি ধরে দাঁড়িয়ে থাকা স্বামীর পথ পানে চেয়ে, যতক্ষণ না তার স্বামী চলে গেছে দৃষ্টির আড়ালে। এই দৃশ্যের অন্তরালে ছিল আরও একটি দৃশ্যপট। স্বামীর প্রতি ভালবাসায় তার মঙ্গল কামনা আর স্বামীর কর্ষিত জমি থেকে ঘরে ফসল তোলার প্রতীক্ষীত বাসনা। আজ এসব কিছুই হারিয়ে গেছে যান্ত্রিক সভ্যতার কাছে। ভোরবেলা লাঙ্গল-জোয়াল কাঁধে কৃষকের মাঠে যাওয়া আর তার কিষাণ বধূর দেউড়ি ধরে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য আজ কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। কারণ, লাঙ্গল-জোয়ালের জায়গায় আজ এসেছে কলের লাঙ্গল, ধান মাড়াই মেশিন।



২) পালকী ঃ বধূ বাপের বাড়িতে নায়র যাবে কিংবা বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়িতে নায়র আসবে, একমাত্র বাহন পালকী। আর যাদের বাপের বাড়ি অত্যন্ত কাছে তাদের এই পালকীতে চড়ারও সৌভাগ্য হতনা। পায়ে হেঁটেই নায়র করতে হতো। এই পালকীর আবার বিভিন্ন রকমফের ছিল। কোনটা ছিল অতি সাধারণ। বাঁশের পাটাতন, দুইপাশে বাঁশের ছাটাইয়ের বেড়া এবং দুইপাশ খোলা। এই দুইপাশ প্রবেশদ্বার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এটাকে আমাদের দেশে বলা হতো মাফা। বধূ চড়ে বসার পর শাড়ি বা চাদর দিয়ে পুরোটা ঢেকে দেয়া হতো। এতে চড়ার খরচ ছিল সবচেয়ে কম। তাই অতি সাধারণ ঘরের বউরা এগুলোতে চড়ে নায়র করত। আর আমাদের দেশে পালকী যেগুলোকে বলা হতো সেগুলো ছিল কাঠের তৈরী, দরজা লাগানো। কোন কোনটা আবার বাইরের দিকে কারুকাজ করা। একটু অবস্থাসম্পন্ন ঘরের বউরা এগুলোতে চড়ে নায়র করত। আমরা ছোটকালে দেখেছি গাঁয়ে এক ধরনের পরিবার বাস করত, তাদেরকে সানাই বলা হতো। তাদের পেশা ছিল এটা। তাদের বাড়িতে পালকী বা মাফা থাকত। তারা নিজেরাই সেগুলো ভাড়ায় বহন করত। অনেক অবস্থাপন্ন বাড়িতে নিজেদেরই বাহারী পালকী থাকত। দরকারের সময় সানাইদের ডেকে আনা হতো। আর রাজা-রাজরাদের পালকী তো আমরা অহরহই নাটক-সিনেমায় দেখে আসছি।



কিন্তু যান্ত্রিক সভ্যতার এই অগ্রগতির যুগে হারিয়ে গেছে আমাদের সেই গ্রামীণ ঐতিহ্য। আজ প্রত্যন্ত গ্রামেও রিকশা, টেম্পু, বটবটি আরও কত কি নামে যানবাহন চলাচল করছে। বধূর পালকী চড়ে বাপের বাড়ি যাবার দৃশ্য আজ শুধুই কল্পকাহিনী।

B-)

৩) ঢেঁকি ঃ জানিনা ধান ভানার এই যন্ত্রটার কথা কয়জনের মনে আছে বা কয়জন দেখেছেন। যারা দেখেছেন তারা একটু স্মৃতিচারণ করে দেখুন। এক সময় আমাদের গ্রামাঞ্চলের প্রায় প্রতি ঘরে ছিল এই ঢেঁকি। ধান সিদ্ধ করে শুকিয়ে চাল বানাবার জন্য এছাড়া আর কোন উপায় ছিলনা গৃহস্থ বাড়িতে। গাঁয়ের বধূদের নৈমিত্তিক কাজের এটি ছিল একটি অংশ।



অবস্থাপন্ন গৃহস্থরা নিজেরা ঢেঁকিতে ধান ভানত না। তবে তাদের বাড়িতেও থাকত ঢেঁকি। গরীব কৃষক গৃহিনীরা তখন বাড়ি বাড়ি এই ঢেঁকিতে ধান ভানার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে। প্রতি বাড়িতে ঢেঁকিঘর বলে একটি আলাদা ঘর থাকত। সেখানেই ঢেঁকি পাতা থাকত, ধান ভানা হতো। কুলায় ঝেড়ে তুস-কুড়া-চাল আলাদা করা হতো। সে ছিল এক মহাযজ্ঞ। আজ কোথায় হারিয়ে গেছে সেই দিনগুলো! আজকাল গ্রামে গেলে আর ঢেঁকিতে ধানা ভানার শব্দ শুনতে পাওয়া যায়না। কৃষাণ বধূদের মহাযজ্ঞের এই কাজটা চলে গেছে ধানভাঙ্গা কলের কাছে।







৪) চরকা ঃ মাহাত্মা গান্ধীর চরকায় সূতা কাটার এই দৃশ্য কোন বিলাসী দৃশ্য নয়। এটা এক সময় ছিল অতি সাধারণ দৃশ্য। শুধু ভারতে নয়। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রা প্রণালীর সাথে চরকায় সূতা কাটার কাজটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। সেই সময় প্রায় প্রতি ঘরে চরকা ছিল। চরকায় সূতা কেটে জীবিকা নির্বাহ করত এক শ্রেণীর মানুষ। কেউ কেউ নিজের চরকায় সূতা কেটে সেই সূতা দিয়ে পরনের কাপড়ও তৈরী করত। আমি ছোটকালে আমার নানীকে দেখেছি চরকায় সূতা কাটতে। সেই সূতা দিয়ে উনি বিভিন্ন ধরনের নকশী কাঁথা সেলাই করতেন। আজ আমরা বহু পেছনে ফেলে এসেছি চরকায় সূতা কাটার দৃশ্য। আজকাল আর সচরাচর চোখে পড়েনা এই দৃশ্য। তা সত্ত্বেও গত ২০১১ সালে টাঙ্গাইলের করটিয়ায় এক বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে এক দরিদ্র মহিলাকে আমি চরকায় সূতা কাটতে দেখে অবাক হয়েছি। জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম সে ঐ সূতা সরবরাহ দেয় তাঁতীদের কাছে। কিন্তু তার অতি পুরাতন চরকায় সূতা বারবার কেটে যাচ্ছিল। দেখে আমার মনে হচ্ছিল আমাদের জীবন-যাত্রার সাথে জড়িয়ে থাকা এই ঐতিহ্যটা এভাবে কেটে যেতে যেতে একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।


৫) কলের গান ঃ অয়োময় নাটকের কথা আমরা অনেকেই আশা করি ভুলিনি। সেই নাটকে মির্জা সাহেবের খান্দানী কায়দায় কলের গান শুনার দৃশ্যপট নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। অয়োময় নাটকের এই দৃশ্যপট কিন্তু এক সময় আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল। আজকাল তো ইচ্ছেমতো গান শুনার কত সহজলভ্য উপায় আমাদের হাতের কাছে পাওয়া যায়। এসবই আমাদের যান্ত্রিক অগ্রযাত্রার ফসল। কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে এসব ছিল কল্পনাতীত। বনেদি পরিবারের সৌখিন অভ্যাসের একটা অংশ ছিল তখন গান শোনা। কারণ, গান শোনার আয়োজন অতটা সহজ ছিলনা। কলের গান সম্পর্কে আমরা যারা জানি তারা অতি সহজেই এটা অনুমান করতে পারব। আর আজকাল গ্রামের ঘরে ঘরে অহরহ গান শুনতে পাওয়া যায়, সেটা তো যান্ত্রিক সভ্যতারই ফসল।


৬) যাঁতা ঃ জানিনা এ সম্পর্কে কার কতটুকু স্বচ্ছ ধারণা আছে। তবে আমার আছে। কারণ, আমি ছোটকালে আমাদের বাড়িতে দেখেছি যাঁতায় কলাইয়ের খোসা ছাড়াতে। তখন গ্রামের প্রায় প্রতি বাড়িতেই যাঁতা দেখা যেত। খেসারী বা মসুর কলাইগাছ ক্ষেত থেকে তুলে এনে শুকিয়ে কলাই আলাদা করা হতো। তারপর সেই কলাই পরিস্কার করে ভাল করে শুকিয়ে যাঁতায় পিসে খোসা ছাড়িয়ে তবে খাওয়ার উপযোগী ডাল পাওয়া যেত। দুটো বড় গোলাকৃতির প্রায় চার ইঞ্চি উঁচু লোহার চাকতি একটার উপর একটা বসানো হতো। উপরেরটায় দুটো বড় ছিদ্র থাকত। একটা ছিদ্র তে কলাই দেয়া হতো। আর অন্য ছিদ্রটাতে শক্ত মোটা লাঠি ঢুকিয়ে দুহাতে ঘুরানো হতো। দুই চাকতির মাঝখানে পড়ে কলাইয়ের খোসা ছেড়ে গিয়ে ডাল বের হয়ে আসত। আজকাল আমরা কত সহজে হাতের কাছে ডাল পেয়ে যাই। কল্পনাও করতে পারিনা সেই দিনের যাঁতায় কলাইয়ের খোসা ছাড়িয়ে ডাল বের করে আনার কথা।

৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×