somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শাশ্বতকে দেখে এলাম আজ

০৭ ই জুন, ২০০৮ রাত ৮:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কপোতাক্ষ প্রভাতী থেকে আজ ৭ জুন সকাল ৮টার দিকে নাটোরের লালপুর উপজেলার আজিমনগর রেল স্টেশনে নামতেই সাদা শার্ট পড়া কাঁচা-পাকা চুলের এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে মামুন স্যারকে নমস্কার জানালেন। বুঝেই গেলাম উনি শাশ্বত সত্য’র বাবা। বললেন, চলুন, রিকশা রেডি আছে। স্টেশনের পেছনে গেলাম আমরা। আগে থেকেই চারটি রিকশা সেখানে রেখেছেন শাশ্বত’র বাবা। আমার রিকশায় চড়ে মিনিট দশেক যেতেই পেলাম ওদের বাড়ি। নর্থ বেংগল সুগার মিলসের ‘ডি’ ক্যাটাগরির একটি ছোট্ট টিনশেড কোয়ার্টারে থাকে শাশ্বত’র পরিবার। প্রথমেই আমরা ঢুকলাম শাশ্বতর ঘরে। ছোট্ট ঘরে ছোট্ট খাটে পিঠের নিচে দুটো বালিশ দিয়ে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে ছিলো শাশ্বত। আমাদের দেখে শুধু তাকিয়ে থাকলো কিছুসময়। নড়তে পারলো না। একটু পরে হেসে বসতে বললো। আমরা বসলাম ওর পাশে। জানলাম ওর বর্তমান পরিস্থিতি।

শাশ্বত'র বর্তমান পরিস্থিতি: আগের চেয়ে শরীরের অবস'ার অবনতি হয়েছে। সারা শরীরে ব্যাথা। ওর গায়ে হাত দিতে দেয়না কাউকে। বলে, ‘দাদা, দয়া করে হাত দেবেননা। আমার খাটটা একটু নড়লেও প্রচন্ড ব্যথা লাগে।’ প্রতিদিন ৫০০ এমজি’র দুটি করে পেইন কিলার খাচ্ছে ও ব্যাথার জন্য। বামপাশের অসি'সন্ধি ২০০৬ সালেই নষ্ট হয়েছিলো। ডানপাশটাও এখন প্রায় নষ্ট। কোন দিকেই ভর দিয়ে শুতে পারেনা ও। আধশোয়া হয়ে সারাদিন থাকে ছেলেটা। রাতে চিৎ হয়ে শোয়ার চেষ্টা করে। কিন' মেরুদণ্ডের ব্যাথায় বেশিক্ষণ পারেওনা। রাতে ঘুমাতে পারেনা ও। আগে যখর বাম পাশটায় সমস্যা ছিলো তখন ডান কাত হয়ে ঘুমাতে পারতো। এখন তাও পারেনা। নির্ঘুম রাত কাটে ওর। দিনের বেলায় এজন্য ক্লানিত্ম আসলেও ঘুম আসেনা অসহ্য ব্যাথায়। শাশ্বত বলল, ‘দাদা, রাতে হালকা তন্দ্রার মতো আসে। গভীর ঘুম হয়না। তন্দ্রার মধ্যে শুনতে পারি শব্দ, পাখির ডাক।’ ইদানিং শাশ্ব-প্রশ্বাসের সমস্যাও হচ্ছে। বুকের রিবস্‌গুলো জোড়া লাগতে বসেছে। অ্যাসিডিটির সমস্যাতো আছেই। সবমিলিয়ে দিন-রাত ঘরের ভেতর বন্দী আমাদের শাশ্বত সত্য। গতমাসে রাজশাহী থেকে বাড়ি ফিরে বিছানায় পড়েছে সে। মাঝে মাত্র দুদিন বাড়ির অন্য রম্নমে যেতে পেরেছে সে ছেঁচরিয়ে।

অসহায় বাবা-মা-বোন: শাশ্বত’র বাড়ির পাশেই নর্থ বেংগল সুগার মিল। এখানকার হিসাব সহকারী হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন ওর বাবা অরম্নণ সত্য। ওখানকার ট্রেড ইউনিয়নে একনাগারে ১৮ বছর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ভদ্রলোক। তার সহকর্মীরা জানালেন, ‘সারাজীবন তার হাতদুটো ছিলো পবিত্র। অনেক সিবিএ নেতার কোটি কোটি টাকার সম্পদের কথা আমরা পড়ি পেপারে। কিন' অরম্নণ বাবুর এককাঠা জমিও নেই। মিলের দেয়া এই বাড়িটি নিয়ে নিলে পথে দাঁড়ানো ছাড়া তার কোন গতি থাকবেনা তার।’ কয়েক বছর আগে মিল থেকে অবসর নিলেও তার অবস্থা বিবেচনা করে এখনো বাড়িটি কেড়ে নেয়নি। বর্তমানে তিনি মিল হাই স্কুলের শিক্ষক হিসেবে চাকরি করছেন। তিন মাস পরপর তাকে বাড়িয়ে নিতে হয় এই চাকরির মেয়াদ। শাশ্বত’র চিকিৎসার খরচ জোগাতে শুধু ভারতেই তাকে যেতে হয়েছে ২০ বার। খরচ হয়েছে প্রায় ১১ লাখ টাকা। প্রভিনেন্ট ফান্ডের টাকাও শেষ করে ফেলেছেন। সব হারিয়েও এখনো তিনি স্বপ্ন দেখেন ছেলের সুস্থ্য হবার।
শাশ্বত’র মা বহ্নিশিখা সত্য ব্যস্ততা হয়ে আমাদের আপত্তি উপেক্ষা করে আপ্যায়নের জন্য ছুটোছুটি করলেও প্রতি পদক্ষেপে তার দীর্ঘশ্বাস কানে ঠেকছিলো আমাদের। একসময় বলেই ফেললেন, ‘শরীরের ব্যাথায় ওর যে আর্তনাদ তা আমার বুকটা ভেঙে দেয় বাবা। দিনের পর দিন ছেলের এসব সহ্য করতে করতে আমরা এখন পাষাণ হয়ে গেছি।’ এসময় শুকনো দেখাচ্ছিলো ওর ছোট বোন শান্তা সত্য’র মুখটিও।

কৃষিপ্রেমী-প্রকৃতিপ্রেমী শাশ্বত: অরম্নণ সত্য জানালেন, কৃষিতে ওর খুব আগ্রহ। তিনবার জেলা কৃষি মেলায় কৃষি পণ্য প্রদর্শন করে পুরষ্কৃত হয়েছে সে। বাড়ির বারান্দায় দেখলাম ওর যত্নে বেড়ে ওঠা টুনটুনি, দোয়েল পাখির বাসা। বাড়ির আঙিনায় সুস'্য অবস'ায় ওর লাগানো চন্দন গাছসহ নানান গাছ দেখলাম। ওর বাবা দেখালেন ২০০২ সালে গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নেয়া মেধাবী শাশ্বত’র সনদ।

‘আমি পড়াশোনাটা শেষ করতে চাই’:শরীর চলেনা। কিন' ওর মাথা থেকে পড়াশোনার নেশা কাটেনি। আমার কাঁধে মাথা রেখে আসেত্ম আসেত্ম ও বলছিলো, ‘দাদা, ইন্ডিয়া থেকে ফিরেই আমি কিন' ক্লাশে যাবো। হুইল চেয়ারে হলেও যাবো। আর সেপ্টেম্বরে ইয়ার ফাইনালটাও দেবো।’ মামুন স্যার এটা শুনে বললেন, আগে সুস' হও। তারপর ফিরো। প্রয়োজনে ইয়ার ড্রপ দিয়ো।’ কিন' রাজি না শাশ্বত। বললো, ‘আমি ঘরের বাইরে যেতে চাই, দাদা। পিস্নজ, ব্যবস্থা করেন। আমি উঠে দাঁড়াতে চাই, দাদা। পড়াশোনাটা শেষ করতে চাই।’ কথাগুলো বলতে বলতে জলে আটকে আসে ওর কণ্ঠ।

১০ জুন ভারতে যাচ্ছে শাশ্বত: ট্রাভেল ট্যাক্স এখনো দেয়া হয়নি ব্যাংকে। তাই ৯ জুন যাওয়া হচ্ছেনা। ১০ জুন বাবার সঙ্গে ভারতে যাবে শাশ্বত। ২১ জুন ওর চেকআপ। ফিরতে ফিরতে ৬ জুলাই। ওখানে চিকিৎসকদের নির্দেশনা অনুযায়ী ওর চিকিৎসার পরবর্তী ধাপ শুরু হবে।

সবার মুখে শাশ্বত: একফাঁকে সুগারমিলে ঢুকেছিলাম আমরা। মিলের মহাব্যবস্থাপক এসএম সুদর্শন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী গোলাম মোর্তুজাসহ মিলের অনেক কর্মচকর্তা-কর্মচারীও বললেন শাশ্বত’র কথা। তারা আমাদের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে দেশের সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।

শেষ দৃশ্য, বড় কষ্ট: শাশ্বতর বর্তমান অবস্থা দেখে সকাল থেকেই কুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। ওর আর ওর বাবা-মা’র পিড়াপিড়িতে দুপুরের খাওয়া শেষ করে যখন বিদায় নিচ্ছিলাম তখন দেখতে হলো বড় কষ্টের দৃশ্যটি। খাট থেকে দুহাতে ভর দিয়ে নামলো শাশ্বত। বললো, বাথরম্নমে যাবো। আমরা ধরতে গেলাম। ও নিষেধ করলো। হাতের ওপর ভর দিয়ে ছেঁচড়িয়ে ছেঁচড়িয়ে বাথরুমের দিকে এগুলো। খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে বাথরুম সেরে আবার ছেঁচড়িয়ে ছেঁচড়িয়ে খাটের দিকে এলো। এসময় আমাদের বুকের ভেতরে কষ্টে খচখচ করছিলো। ভাবলাম, ওর বাবা-মা-বোন কী করে এতদিন কত কষ্ট করে এই দৃশ্য হজম করে আসছেন? এরপর হাত দুটো খাটের ওপর চাপ দিয়ে বিছানায় উঠে একেবারে গা এলিয়ে দিলো। মাত্র কয়েক মিনিটের এই পরিশ্রমে ঘেমে একেবারে নেয়ে গেলো ছেলেটা। হাসফাঁস করছিলো শাশ্বত। এমন দৃশ্য কি সহ্য করার মতো?
বিদায় নেবার সময় একেবারে নিশ্চুপ শাশ্বত। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলো আমাদের দিকে। আমার ওর হাত ধরে বললাম,‘চিন্তা করোনা, শাশ্বত। তুমি আবার উঠে দাঁড়াবে। আমরা আছি তোমার পাশে।’ তখনও নিশ্চুপ তাকিয়ে ছিলো শাশ্বত সত্য।


বিশেষ বাণী: আরো অনেক কিছু লেখার ছিলো। দ্রম্নত বস্নগারদের শাশ্বতর আপডেট তথ্য জানাবার জণ্য দ্রম্নত লিখলাম। বাকি কথা অন্য দিন লেখার আশা রইল।
-বস্নগার
২০টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×