আজকে প্রথম আলোতে দু'টো খবর দেখলাম। ঈদযাত্রায় সড়ক, রেল ও নৌপথে ২৬৫ জনের মৃত্যু আর বাড়ির ভেতর বাস ঢুকে কেড়ে নিল ঘুমন্ত স্বামী–স্ত্রীর প্রাণ! নিহত দম্পতির ছোট ছোট তিন ছেলে মা-বাবাকে হারিয়ে পথের ধারে বসে কাদছে!
আমাদের যোগাযোগ মন্ত্রীও সংবাদ সম্মেলনে বলছেন, পাখির মত, মাছির মত সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে! মহাসড়কে (যদিও বাংলাদেশে প্রকৃত অর্থে কোন মহাসড়ক নেই, আছে মৃত্যু ফাদ!) নামলেতো এখন শুধু আল্লাহ আল্লাহ করি, যাতে জান নিয়ে ঘরে ফিরতে পারি। তা এই পরিস্থিতি থেকে কি আমাদের মুক্তি নেই?
একটা দুঃখজনক সত্য কথা, যেটা আমরা আসলে চিন্তাই করি না, গাড়ী দুর্ঘটনা হলেই আমরা চালককে দোষ দিয়ে আমাদের মনের ঝাল মিটিয়ে নেই (আমাকে ভুল বুঝবেন না, চালকের ভুল হতেই পারে), কিন্তু এর পরে আমরা আমাদের মাথা আর খাটাই না! অনেকগুলো সমস্যা আছে যেগুলোর সঠিক পরিকল্পনার অভাবে আমাদের দুর্ঘটনাজনিত ক্ষয়- ক্ষতি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
১। দুনিয়ার আর কোন দেশে মহা সড়কের ঠিক পাশেই ঘর বাড়ি আছে কি না সন্দেহ! এটা সুস্পষ্ট পরিকল্পনার অভাব।
২। মহাসড়কের ডিজাইন হতে হবে বিপজ্জনক বাক মুক্ত। বিপজ্জনক বাক পাহাড়ী এলাকায় থাকতে পারে, সমতলে নয়।
৩। মহাসড়ক হতে হবে ২ থেকে ৩ লেইন প্রতি পাশে, মাঝখানে ডিভাইডার থাকতে হবে। পাশে সার্ভিস এরিয়া থাকতে হবে যেখানে গাড়ী নষ্ট হলে বা কোন জরুরী প্রয়োজনে পার্ক করা যাবে।
৪। গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে (শহরের কাছাকাছি এলাকগুলোতে বিশেষ করে) সড়ক বাতি থাকতে হবে।
৫। মহাসড়কে নির্ধারিত গতি উল্লেখ থাকতে হবে, স্পিড ক্যামেরা থাকতে হবে যার মাধ্যমে উচ্চ গতির গাড়ীকে জরিমানা করা হবে।
৬। সিট বেল্ট পড়া বাধ্যতামূলক করতে হবে, মহাসড়কে একটু পর পর এ সংক্রান্ত নির্দেশনা থাকতে হবে।
৭। মহাসড়কে সুস্পষ্ট রোড সাইন থাকতে হবে।
৮। দ্বিমুখী চলাচলের মহাসড়কে ওভারটেকিং নিষিদ্ধ এলাকার সুস্পষ্ট রোড মার্কিং থাকতে হবে।
৯। চালকদের যথাযথ পরীক্ষার মাধ্যমে ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে হবে যাতে তারা ট্রাফিক সাইন বোঝে এবং সেটা মেনে চলার যোগ্যতা রাখে। শুধু গরু ছাগল চিনলে হবে না।
১০। মহাসড়কে পথচারীরা শুধু মাত্র ফুট ওভার ব্রিজ দিয়ে রাস্তা পার হবেন। শহরের মধ্যে পথচারী ফুট ওভার ব্রিজ ছাড়া নির্ধারিত জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হতে পারেন।
১১।পথচারীর মধ্যে এই সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, হঠাৎ করে লাফ দিয়ে রাস্তা পারাপার নয়। নির্ধারিত ফুট ওভার ব্রিজ/জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হতে হবে। দ্রুত গতির একটি গাড়ীকে হঠাৎ ব্রেক করা সম্ভব হয় না। এজন্য প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে।
১২। চালককে বোঝাতে হবে, জেব্রা ক্রসিং দিয়ে যখন কেউ রাস্তা পার হতে চাইবে, তখন চালককে গাড়ীর গতি কমাতে হবে বা ব্রেক করে থামাতে হবে। এজন্য প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে।
এরপরেও চালকের ভুলেও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, কারণ তারা রোবট নয়, মানুষ। কিন্তু উপরে আমি যা উল্লেখ করেছি, সেটাই হল মহাসড়কের নূন্যতম স্ট্যান্ডার্ড যেটা আমাদের দেশে কোথাও নেই। আর সেকারণে দুর্ঘটনা ঘটলে তার ইমপ্যাক্টটা হয় বেশী। আমি ওপরে যা বলেছি সেটা যদি কার্যত আমাদের দেশে থাকত, তাহলে দুর্ঘটনাজনিত ক্ষয়ক্ষতি অনেক অনেক কম হত। এছাড়া বাস কোম্পানির মালিকরা তাদের চালকদের কিভাবে ব্যবহার করছেন, সেটাও বিবেচ্য বিষয়। তারা কি তাদের পর্যাপ্ত বিশ্রাম দিচ্ছেন কিনা সেই সচেতনতা বাস মালিকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারের সংস্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অডিট টিম থাকতে হবে, যারা এই ব্যাপারগুলো পরীক্ষা নিরিক্ষা করবে মাঝে মাঝে।
আমি বিশ্বাস করি না, মহাসড়ক নির্মানের সামর্থ্য আমাদের নেই। যেটা আছে সেটা হল আমাদের কর্তাব্যাক্তিদের সদিচ্ছার অভাব। তারা নিজেরা দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ান, কিন্তু নিজের দেশকে উন্নত করার ইচ্ছে তাদের অধিকাংশেরই নেই, দুঃখজনক হলেও সত্য।
আমি ওপরে যা উল্লেখ্য করলাম, সেগুলো বাস্তবায়ন না করে আমরা যতই গলা ফাটাই, এই পরিস্থিতির উন্নতি কখনোই হবে না। আমরা শুধু কেদেই যাব, পত্রিকা/ব্লগ ভরে ফেলব আলোচনা সমালোচনায়, কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হবে না...
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৪:৩৮