“কোনোদিন জাগিবে না আর
জাগিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম অবিরাম ভার
বহিবে না আর”
(জীবনানন্দ দাশের কবিতা, ধরা যাক কোনো কবরফলকে উৎকীর্ণ)
: ওরে চড় দিছিলাম বইলা নাখোশ হৈছিলা! তুমি হৈলে কি করতা?
কবরস্থান পাহারা দেয় যে ছেলেটা, তার প্রসঙ্গ তুইলা আব্বারে জিজ্ঞাস করি। তিনি কোনো জবাব দেন না। একচিলতে কবরটার ভেতর পাশ ফিরে শোন, যাতে কড়ুই গাছের আড়ালটা ভালমত পাওয়া যায়, এবং তাতে আমার মুখটা আর দেখতে না হয়। উঠন্ত একটা কড়ুই গাছের অতটা ছায়া হয় না, বিশেষত এই গনগনে দুপুর একটায়। ফলে, আমি মাথাটা ইঞ্চিখানেক সরায়া আবার তারে দেখতে পাই, শেয়াল-খোঁড়া গর্ত দিয়া রোদ তার চোখেমুখে লাগতেছে। নিচু গলায় গজগজ করেন তিনি। আমি আবারও বলি:
: তোমারে মাটি দিয়া যাওয়ার পরের শুক্রবারই টাকা খাওয়ার লাইগ্যা ওই ব্যাটা আমারে থ্রেট করল, কইল, ভাইজান, মরা মাইনষের থাকার জায়গা খুব কম, উপরাউপরি নতুন কবর পইরা যাইতে পারে। আত্মীয়রা কইল, ঘিঞ্জি কবরস্থান, তাড়াতাড়ি একটা পাথর লাগাও। আমার তো চোখের পানিই শুকাইতেছিল না। ঝাপসা ঝাপসা দেখি সবকিছু। তুমিই বল টাকাপয়সার ডিলিংস কি সবসময় ভাল লাগে? ওরে দুইটা চড় বসায়া মনটা অনেক ঠান্ডা হৈছিল তখন।
আব্বা চুপ কৈরা থাকেন।
কবরস্থানের ইঁট-বাঁধানো রাস্তাগুলো দুপুরের সামান্য বাতাসে একটু-একটু দোল খায়। এসময়টা বেশ ঝিমঝাম। দুয়েকটা তক্ষক ডাকে এই ডাল ওই ডাল থেইকা, তাতে আগে-পরের নৈঃশব্দ্য আরো ভারী হয়া উঠে। ঢোকার মুখে যে বাঁধানো চাতালমত আছে, তার নিচে কিছু হেরোয়িনখোর মানুষ সারাদুপুর মড়ার মত ঘুমায়। ঈর্ষা ছড়ায নিঘুম কবরবাসীদের মাঝে।
আমি রুমাল দিয়া ঘৈষা শাদা মার্বেল পাথরের কবরফলকটা চকচকে করি। আমার প্রতিদিনের কাজ। স্পষ্টতই এতে আব্বার বিরক্তি বাড়ে। শুইয়া শুইয়া ঝাল ঝাড়েন তিনি কড়ুই গাছটার হতভম্ব শেকড়টার ওপর। রসের খোঁজে বেচারা মাটি ছাইড়া কবরের ভিতর ঢুইকা গেছিল। শেকড়টা টান দিয়া ছিঁড়া ফালান তিনি, যেমন কৈরা অনেক বছর আগে আমার কবিতার খাতাটা ছিঁড়া ফেলছিলেন । চোখের কোনা দিয়া তার মুখের অভিব্যক্তি দেখার চেষ্টা করি। কথা বলি না। খাতা ছিঁড়ার পরও বলি নাই। দুনিয়া কি আগাইল একটু?
: দুনিয়া আগায়া যাইতাছে, তোমার পোলারে ওর কবিতার খাতার ওপর ফালায়া রাইখা।
আব্বা বাসায় ফিরা প্রত্যেকদিন এই কথা দিয়া আম্মার সাথে শুরু করতেন। এইটা ছিল ভূমিকা। তারপর মূল আখ্যান। একেকদিন একেকটা।
: সালেক আইসা ওইদিন সব হাওলাতি টাকা একবারে দিয়া গেল আর মিষ্টিমুখ করায়া গেল। ওর আর চিন্তা নাই, পোলাটা ম্যাজিষ্ট্রেট হয়া গেছে।
আম্মার চোখে বৈকালিক ঘুমের আমেজ। টেবিলে ঠান্ডা ভাত। ঠান্ডা তরকারি। সালেকের পোলার চাকরিপ্রাপ্তি তার ভাবান্তর ঘটায় না। এতে আমি বাঁইচা যাই। পরের তুফান যথারীতি যায় আম্মার ওপর দিয়া।
: তোমারে আর কৈয়া লাভ কি। তুমিই তো আস্কারা দিছ। কত কৈলাম পোলারে বিদ্যাসাগর না বানায়া দোকানে পাঠাও। সিমেন্টের ডিলারশীপ আমি একলা একলা সামলাইতে পারুম না। এখন কেমন হৈল, লাখ লাখ টাকা লোপাট কৈরা দিল নিমকহারামের বাচ্চা কর্মচারিরা।
উপসংহার। পাশের ঘরে শুইয়া শুইয়া আমি শুনতাম। সারা বিকাল। ফাঁকে ফাঁকে হেডফোন দিয়া শুনতাম বব ডিলান: হে মিস্টার টামবরিন ম্যান, প্লে অ্যা সঙ ফর মি....
পাথর ঘষতে ঘষতে এরকম অনেক কথা।
: বেড়া লাগাইবি কবে? খালি ভুইলা যাস।
নিরবতা ভাঙ্গেন আব্বা। কবরটার চারপাশে বেড়া দেয়ার কথা এখন তিনি প্রতিদিনই স্মরণ করায়া দেন। আমিও এমনভাবে শ্রাগ করি যেন ভুইলাই গেছিলাম। ডানে-বাঁয়ে দুই-দুইটা ধাড়ি শেয়ালের গর্ত দেখা যায়। মনে হয় রাতবিরাতে জ্বালায় খুব, আমি অবশ্য জানতে চাই না। কিন্তু এরকমই হৈয়া আসতেছে, নাকি? বায়োডাইভারসিটি চেইন ভাঙ্গবার আমি কেডা? তোমার দেহ তো আজ ধরিত্রীর খাদ্য, আব্বা! তোমার হৃদয় আজ ঘাস।
: সকালের দিকে দেখলাম আরেকটা কবর পড়ল। আগেরটার কাফনের কাপড়টা পর্যন্ত এক্সপায়ার হয় নাই। বেড়া থাকলে আরেকটু সময় নিরিবিলি থাকা যাইত।
হায় অমরতা!
: পাওনাদারদের বিদায় করতে করতেই জান কাবার হয়া যাইতেছে। যা দেনা রাইখা গেছ, চুকাইতে মনে হয় বাজারের ভিটাটাই বেইচা দেওয়া লাগব।
এইভাবে বলি। বেচাবেচির প্রশ্নে আব্বা নিদারুণ কষ্ট পান, জানি আমি। তার কষ্টমাখা চেহারা দেইখা আমার নিষ্ঠুর আনন্দ হয়। তারিয়ে তারিয়ে দেখি। তার দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া গরিবি অমরতার বাসনা। দীর্ঘসময় আবার চুপ কৈরা থাকেন তিনি। কি যেন ভাবেন আর পা নাড়ান।
: তোর মা কী কয়?
: তার কথা কৈয়া লাভ নাই। দুইদিন ধইরা বলতেছে, চশমা নাকি ঝাপসা হয়া গেছে, পাওয়ার বাড়াইতে হবে। আর যেইই আসে তার কাছেই বলে, আমার স্বামী গেছে, পোলাপানগুলা একটুও কথা শোনে না। আমারে একটুও দেখে না।
: এইরকম হওয়ার তো কথা ছিল না।
ছিল না। কিন্তু রাইশর্ষের ক্ষেত সকালে উজ্জ্বল হয়, দুপুরে বিবর্ণ হয়া যায়। আমি কিছুই বলি না।
: এখন সব ছাইড়া ব্যবসাটা ধর বাপ। কবিতা তো অনেক লিখলি, শেষমেষ আমার কবরে পর্যন্ত।
: ঐ টা আমার লিখতে হয় নাই। জীবনানন্দ বাবুই লেইখা রাখছিলেন।
মনে পড়ে, আব্বার লাশ যখন গোসল করায়া আবার বিছানায় শোয়ানো হৈল, আমি কাছে বৈসা ছুঁইয়া ছুঁইয়া দেখছিলাম। কী ঠান্ডা! উত্তাপহীন, বেদনাহীন। কে যেন আইসা কানে কানে বলল, দেখেন দেখেন -- ঘামতেছে। হার্ট অ্যাটাকের বডি, দম পুরাপুরি গেছে কিনা কে জানে? আমি চমকায়া উঠি। হাত দেখি, বুক দেখি, কানের পিছ দেখি। খবরটা এইঘর ওইঘর ছড়ায়, অনেকে আইসা দেইখা যায়। পৃথিবীতে মানুষ দশহাজার বছর ধৈরা মরতেছে, তবু আজও মরণ নানান সংশয় নিয়া হাজির হয়। একজন একটা টেবিল ফ্যান নিয়া আসে। ঘামতেছে মানুষটা, একটু মরণোত্তর সেবা! চাচাকিসিমের আরেকজন কৈল, ডাক্তাররে আবার ডাক, কী জানি আল্লাহর কী কুদরত। ডাক্তার আসেন বিরক্ত মুখে, সংশয়ী সমাবেশটাকে তিনি একমিনিটে উড়ায়া দেন। বলেন, হার্টের চার চারটা ভেইনে নাইনটি পারসেন্ট ব্লক নিয়া বাঁইচা থাকাটাই মিরাকল ছিল উনার। কিন্তু আমার তো ধন্দ ঘোচে না, বুঝলাম ঘুচবেও না কোনোদিন। সেই প্রথম আমারে উদ্ধার করেন জীবনানন্দ দাশ। আব্বার এপিটাফ লেইখা দিয়া। কিন্তু সেইটা লাগায়াও ঝক্কি কম হয় নাই।
: আচ্ছা, সেই ঘটনার কী হৈল, মুসল্লিরা পরে আর কিছু কইছিল?
শুইয়া শুইয়া আব্বা আমার থটরিড করেন।
: না। খালি খুঁতখুঁতে কিসিমের একজন কইছিল, রেফারেন্সটা পাথরে লেখা থাকলে ভাল হৈত।
আমি অন্যমনস্ক ধরনে বলি। সেইটা আব্বা মারা যাওয়ার দুয়েকমাস পরের ঘটনা। গুজগুজ ফিসফাস চলতেছিল অনেকদিন ধৈরাই। দুয়েকটা মসজিদে বাদ-মাগরিব আলোচনাও কিছু হৈল। আমি লোকমুখে এসব শুইনাও না-শোনা হয়া থাকতাম। শেষে একদিন মুসল্লিরা সদলবলে আইসা হাজির। আমি এখানেই ছিলাম, আমায় আস্তে করে ডাইকা নিয়া একজন বললেন, বাবা, সবাই বলাবলি করে তুমি নাকি তোমার আব্বার কবরে হিন্দু লোকের কবিতা টাঙ্গাইছ? আমি তাদের চেহারা ভাল কৈরা দেখি। জঙ্গীপানা নয়, সহমর্মী মানুষেরই মুখ। বললাম, চাচা, আপনেরা কি কোরান শরীফটাও ঠিক কৈরা পড়েন নাই? কাজ হয় তাতে। দুইদিন পর ওরাই জানাইলেন সুরা বাকারা’র সেই আয়াতগুলার কথা। প্রশংসা করলেন আমার ‘পদ্যানুবাদের’, তারপর প্রশংসা করলেন মহান কোরান শরীফের, এমন একটি সর্বব্যাপী জ্ঞানের উত্তরাধিকার হওয়ার সৌভাগ্যে প্রশংসা করলেন নিজেদের। এখন শুনি কখনো কখনো কারো কারো কবরে এই ‘পদ্যানুবাদ’ দিয়া ফাতেহার কাজও চলে।
: মিছামিছি ঐটা না করলে কি হৈত না?
: মিছা কোনটা আব্বা? কোরানে তো সবই আছে, নাকি?
রোদ পড়ে আসে। পিচ্চি কড়ুইটা এতক্ষণে বেশ লম্বা একটা ছায়ার মালিক হয়া উঠে। তাকায়া দেখি, মাথার উপরে একটা মশার দঙ্গল ঘুরতেছে। শিরীষের ডালে প্যাঁচা ঝাপটানি দিতেছে, আর একটু পরেই ওদের আর চশমা লাগবে না। শেষ বিকাল নাকি ম্যাগনিফায়িং টাইম, কে জানি বলছিল, এই সময়ে ছোটরে বড় লাগে আর বড়রে অবিশ্বাস হয়। কবরস্থানে সন্ধ্যা আসে নির্ধারিত সময়ের আগে। আমি উইঠা পড়ি, পা-প্যান্ট ঝাইড়া ডেঁয়ো পিপড়াগুলি ভাগাই।
: আর কিছু কইবা, আব্বা?
: নাহ্, কী কমু, আমার মরণের দিন থেইকা তোর বয়স আর একদিনও বাড়ল না, এইটাই ভাবি।
একটু যেন ক্ষোভও ঝরে তার গলা থেকে। আমার আব্বা, যিনি ফুটন্ত কড়াইয়ের মাঝে পয়ষট্টি বছর লম্বা একটা জীবন কাটায়া গেছেন, জীবন থেকে নিষ্কৃতি পাইছেন প্রায় দুই বছর আগে, তার রাইখা যাওয়া সংসারের ক্রমবর্ধমান দুর্দশার বয়ানের শুনানি থেইকা তারে আমি এক মুহূর্তের জন্যও নিষ্কৃতি দেই না। তাতে আমার ভারবহনের কাঁধ চওড়া হয় না সত্য, তবু তারে অবিবেচকের মত একটা চিরকালীন শোকাচ্ছন্নতার মাঝে আটকায়া রাখি। প্রতিদিনের উদ্বেগ ও দুর্ঘটনাগুলো আমি প্রতিদিনই নিয়া আসি এই ঘিঞ্জি কবরস্থানে, আর তিনি তার চিলতে কবরটার মধ্যে ব্যথা ও বেদনায় এপাশ ওপাশ করেন। স্নিগ্ধ মরণের দেশে তার কোনোদিনই যাওয়া হয় না।
১৮-২১ মার্চ ২০০৫
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০১২ সকাল ১০:৩৭