somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নৈতিক অবক্ষয়: হুমকির মুখে পারিবারিক ও সামাজিক নিরাপত্তা

০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



নৈতিকতা বা মূল্যবোধের অবক্ষয় বর্তমান সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা। প্রতিটি মানুষ এটা স্বীকার করলেও মানছেন না সিংহভাগই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি আলোচনায় আসি; তাহলে আমরা দেখবো, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয়সহ যত অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে তার প্রায় সবগুলোই নৈতিক স্খলন ও মূল্যবোধের অবক্ষয়জনিত কারণে হচ্ছে। বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবার-সমাজ। আহত হচ্ছেন উন্নত মূল্যবোধে বেড়ে ওঠা কিছু মানুষ। ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে আম জনতা। অপর দিকে অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, স্বজন কেন্দ্রিক ক্ষমতায়ন, দলান্ধ সুবিধা দান, বাহ্যিক চাকচিক্যের প্রতি টান ইত্যাকার সমস্যা মিলিয়ে আমাদের পরিবার ও সমাজ প্রায় ধ্বংসের মুখোমুখি!

ব্যক্তির যখন নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় শুরু হয়, তখন অবধারিতভাবে সে সংস্কৃতিক বিকলাঙ্গে ও আধ্যাত্মিক দেউলিয়ায় পরিণত হয়! তার কাছ থেকে বিদায় নেয় লজ্জা, মানবিকতা, আদব-আখলাকসহ যাবতীয় সুন্দর আচরণ। সেই ব্যক্তি তখন নিজের অবস্থানটাকেই মূখ্য মনে করে। তার চারপাশ হয়ে যায় কেবল আমিময়। সকল দায়বোধ থেকে মুক্ত ভাবে নিজেকে। সমাজ, পরিবার ও সামাজিক সুনীতিগুলোকে তার কাছে মনে হয় সেকেলে, অবাস্তব, অপ্রয়োজনীয় ও জঞ্জাল! নিজের অপরিণত বিবেক আর বুদ্ধি যা সায় দেয় তাই তার কাছে সিদ্ধ মনে হয়। নিজস্বতা বলতে তখন তার আর কিছু থাকে না। সে হয়ে যায় প্রবৃত্তির দাস। তার মনোজগতে চলতে থাকে অস্থিরতার সুনামি! ছোট ছোট অপরাধ করতে করতে একসময় বড় অপরাধের দিকে ধাবিত হয় সে। পরিবিার, আত্মীয়-স্বজন ও নিকটজনের উদ্বেগ উৎকণ্ঠার কোন মূল্য থাকে না তার কাছে। চলতে থাকে সামাজিক ও পারিবারিক অশান্তি। একসময় তা বিরাট পারিবারিক ক্ষতির কারণ হয়। কখনো বা খুন পর্যন্ত গড়ায়। নাড়িয়ে দেয় দেশ-সমাজ-রাষ্ট্র-সরকারের আদর্শিক ভিত! প্রমাণ পাওয়া যাবে ২০১৩ সালের মধ্য আগস্টের ১৬/১৭ তারিখের পত্রপত্রিকায়। আমরা দেখতে পাই পুলিশ দম্পত্তি মাহফুজুর রহমান ও স্বপ্না রহমান নিহত হন স্বীয় কন্যা ঐশির হাতে। যে ঘটনাটি আহত করেছিল আমাদের।

নৈতিক ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সূচনা কোত্থেকে, কীভাবে শুরু হয়? এটা প্রাথমিকভাবে পরিবার থেকে শুরু হলেও পূর্ণতা পায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ত্র“টিপূর্ণ ব্যবস্থাপনার কারণেই। এরপর রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। এক সময় নতজানু প্রশাসন, অর্থলোভী কর্মকর্তা, শীথিল পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, দলীয় প্রভাব, পারিবারিক শক্তি, এলাকা ভিত্তিক লালন-পালন, কোন প্রভাবশালী নেতার দলে ভীড়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে কেউ কেউ আরো আস্কারা পায়। কেউ কেউ হয়ে যায় ত্রাসের অপর নাম। চলতে থাকে পারিবারিক ও সামাজিক অশান্তি। চরম উদ্বেগে থাকে সমাজের সাধারণ মানুষ। আর সেই অবক্ষয় স্থান-কাল-পাত্রভেদে চলতেই আছে আমাদের সমাজে। ব্যক্তির অবস্থান আর ক্ষমতার প্রেক্ষিতে সমাজের সবচেয়ে ছোট প্রতিষ্ঠান, পরিবার থেকে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানেও সংক্রমিত হচ্ছে দিন দিন। মানুষ হিসেবে কমে যাচ্ছে আমাদের অনূভূতি। কমে যাচ্ছে আবেগ, ধর্মাচারের আগ্রহ। বেড়ে যাচ্ছে চাহিদা, শ্রেষ্ঠত্বের আকাক্সক্ষা, বিলাসি জীবনের ইচ্ছা, অনুকরণের ভয়াবহ স্রোত, বেয়াদবির মাত্রাসহ নানা অনাকাঙ্ক্ষিত উপসর্গ।

প্রথমত দেখি, পরিবার থেকে কীভাবে শুরু হয় সেই অবক্ষয়টা? একেবারে খুব ছোট বেলা থেকে যদি দেখি তাহলে দেখা যায়, বর্তমানে আমরা খুব অসহিষ্ণু হয়ে যাচ্ছি আমাদের সন্তানদের বেলায়। গ্রাম কিংবা শহরে সব জায়গায় আজকাল নিজের সন্তানের দোষ-ত্র“টির প্রতি ভ্রুক্ষেপ করতে দেখা যায় কম জনকেই। সন্তানের প্রতি যদি কেউ অভিযোগ করে তাহলে সেটার মিমাংসা হয়ে যায় তার সামনেই। এক্ষেত্রে অধিকাংশ অভিভাবকই নিজের সন্তানের নির্দোষিতার প্রমাণে সচেষ্ঠ থাকেন। আবার ক্লাসে শিক্ষক কোন কারণে তাকে যদি একটু-আধটু গালমন্দ করেন অথবা ডর-ভয় দেখান তখন সন্তান মা-বাবার কাছে নালিশ করে। মা-বাবা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সন্তানের সামনেই শিক্ষকের সাথে খারাপ আচরণ করছেন। একটু উচ্চবিত্ত হলে তো কথাই নেই! সমাজের আর কাউকে মানুষ মনে করার শিক্ষাটা পর্যন্ত দেওয়া হয় না! কোন কোন ক্ষেত্রে। শ্রমিক শ্রেণি, দরিদ্র পরিবার, দিন মজুর পরিবারসহ এমন পরিবারের অবক্ষয় শুরু হয় মা-বাবার ঝগড়া, প্রতিবেশির সাথে ঝগড়ায় অশ্লীল বাক্য প্রয়োগ আর গালি থেকে। কখনও কখনও পবিারের নিজস্ব নৈতিক অবক্ষয় থেকে।

মধ্যবিত্ত ও নিু মধ্যবিত্ত পরিবারের অবক্ষয়টা শুরু হয় পারিবারিক প্রতিযোগিতা, কাজের চাপে সন্তানের খোঁজ খবর না নেওয়া, মা-বাবা উভয়ের চাকরি করার জন্য কাজের লোকের কাছে বেড়ে ওঠা, সন্তানের শিক্ষাকে বিনিয়োগ মনে করা, আদরের প্রাবল্য, অন্যের সন্তান থেকে নিজের সন্তানকে বেশি ভাল মনে করা, সন্তানের প্রতি অতি আত্মবিশ্বাসের কারণে কোন অভিযোগকে পাত্তা না দেওয়া, যে কোন মূল্যে সাফল্যের চেষ্টাকে বাধা না দেওয়া ইত্যাদি। যেমন: পরীক্ষায় নকল করা; আজ পর্যন্ত কোন মা-বাবাকে দেখিনি সন্তানকে বলছেন যে নকল করে যদি পরীক্ষা দিস তাইলে বাড়িতে জায়গা নাই। কিন্তু শুনেছি; রেজাল্ট ভাল না হলে বাড়িতে আসবি না। দেখেছি একটু সুবিধা লাভের আশায় নিজ সন্তানের সীট যেন ভাল ছাত্রছাত্রীর সাথে পড়ে তা নিয়ে অভিভাবকদের ইঁদুর দৌড়। সম্প্রতি দেখেছি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে সেই খবরে অভিভাবকদের কী ছুটাছুটি! প্রশ্নপত্রটা পেতেই হবে। যেসব সন্তান মা-বাবার এই অবস্থান প্রত্যক্ষ করে বড় হচ্ছে সেই সন্তানকে কীভাবে তারা আখলাকে হসানার সবক দিবেন?

আছে আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন। আমরা আমাদের সন্তানদের এখন আর সাহাবীদের কাহিনী, মনীষীদের কাহিনী শুনাই না। তাদের হাতে তুলে দেই রিমোট কন্ট্রোল! একসাথে বসে দেখি সিনেমা, নাটক আর নানা অনুষ্ঠান। আজকালের নাটক সিনেমা যৌনতা, আর অপরাধ প্রবণতা ছাড়া হয় না। নায়কের ভালমানুষির ভেতরও থাকে প্রেম প্রেম খেলার নষ্টামি। আর বাঙ্গালি সবসময় মন্দটাকে নিতে পছন্দ করে। ফলে ভিলেনের চরিত্রটাই আমাদের সন্তানদের উপর প্রভাব ফেলে বেশি। আর মেয়েদের উপর প্রভাব ফেলে নাটক সিনেমার নায়িকাদের ফ্যাশনেবল পোষাক-আষাক। বর্তমানে উটকো ঝামেলা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ইন্ডিয়ান সিরিয়াল। আমাদের মা-মেয়েদেরকে দেদারছে শেখাচ্ছে পরকিয়া আর কীভাবে স্বামী-ভাই-বাবাকে ফাঁকি দিয়ে ডেটিং করা যায়। শিশু কিশোরদের শেখাচ্ছে ইচরে পাকামু, বেয়াদবি, ঔদ্ধত্য, কল্পনাবিলাশী হওয়ার মন্ত্র আর হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব। আর এই সব বিষয়ের কূফল আমরা ইতোমধ্যেই দেখছি আমাদের সমাজে। একটা ঘটনা উল্লেখ করছি যাতে কীভাবে হিন্দু ধর্মের সংস্কৃতি প্রবেশ করছে আমাদের সমাজে-
“মেয়েটির নাম মাইশা। বয়স সাত। বাবা অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। কিন্তু মাইশা একটি বড় থালায় একটি ঝাড়– নিয়ে বাবার সামনে দাড়ায়! বলে ‘‘বাবা তোমারে আরতি দিয়ে দেই। তাইলে কোয়ি প্রোবলেম নেহি হোগি!” তখন এই বাসায় আমি ছিলাম টিউশনির প্রয়োজনে। কিন্তু ঘটনাটি আমাকে সারা জীবনের একটি শিক্ষা দিয়েছে; তা হলো বাংলাদেশের মুসলমানদের সন্তানের অন্তর থেকে ইসলামকে মুছে দেওয়ার কঠিন ষড়যন্ত্র নিয়ে মাঠে নেমেছে বাতিল শক্তি। প্রশ্ন হতে পারে এই ঘটনার সাথে নৈতিকতার কী সম্পর্ক? অনেকেই করেছেনও! জবাবটা হলো যে মানুষটি মুসলিম সমাজে এইরকম শিরক আদর্শ আর চেতনা নিয়ে বড় হবে তার পক্ষে ইসলামের মাহন আদর্শ আর উন্নত নৈতিকতা ধারণ করা সম্ভব হবে না।

উভয়ে চাকরিজীবি ও এক সন্তানের কোন কোন একক পরিবার সন্তানের নিসঙ্গতাকে কাটানোর জন্য বাসায় নিয়ে আসেন নানা ধরণের বিনোদন সামগ্রী। তাতে আছে কম্পিউটার, টিভি ও ডিশ লাইনের সংযোগ। ফলাফল, শিশু-কিশোররা মেতে থাকে কার্টুন আর গেমস নিয়ে। একটু বড়রা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আছে নানা এডাল্ট সাইট আর পর্নো নিয়ে। নারীদের বড় একটা অংশ মেতে থাকে কলকাতা আর ইন্ডিয়ান সিরিয়াল নিয়ে। একসময় সবকিছু থেকেই তাদের মজা নষ্ট হতে থাকে। শুরু হয় নেশার জগতের প্রথম ধাপ। কেউ কেউ আবার সংগী সাথীদের সাথে ধুমপান করতে করতে মাদকাসক্ত হয়ে যায়।

কারো কারো সন্তান মানুষ হয় কাজের লোকদের সহায়তায়। স্কুলে আনা নেওয়ার কাজটাও হয় ড্রাইভার অথবা কাজের লোকের মাধ্যমে। যদি কাজের লোকেটি মানুষ ও সৎ হয় তাহলে তো বাঁচা গেল। যদি তা না হয়। ক্ষেত্র বিশেষ দেখা যায় সন্তানের চরিত্রে সেই কাজের লোকের চরিত্রের প্রভাব পড়ছে।

শিক্ষাঙ্গনের অবস্থা আরো ভয়াবহ! যারা আশা করেন যে, বাড়ির বা বাসার পরিবেশ হতে বিদ্যালয়ে গিয়ে একটু উন্নত মানসিকতা ও নৈতিকতা নিয়ে বড় হবে তাও আজকাল আর সম্ভব নয়। শুরু সেই কিন্ডারগার্টেন থেকে! ভর্তির পর প্রথমেই একটি শিক্ষার্থী দেখতে পায় কোচিং আর প্রাইভেট নিয়ে শিক্ষকদের অনৈতিক অবস্থান। কিছু দিন পর চলে আসে টার্ম পরীক্ষা, তখন শুরু হয় সাজেশান্সের নামে প্রশ্ন আউটের উৎসব। এরপর আসে ভাল স্কুলে ভর্তির সংগ্রাম। চলে টিউটর, কেচিং ও অভিভাবকের নানা কসরত। কোথাও কোথাও অর্থের আদান প্রদান। কোচিং আর টিউটর নিয়ে চলে দড়ি টানাটানি। আর এর সবই অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয় শিক্ষার্থীর সামনেই। তারপর আবার পরীক্ষার রাতে প্রশ্ন ফাঁসের প্রচেষ্টা তো আছেই। তারপর যদি আসি সরকারি প্রাইমারি স্কুলের কথায়। সেখানে আছে উপবৃত্তির আরেক লীলাখেলা। কত যে অনৈতিক খেলা চলে এই উপবৃত্তির জন্য তার কোন হিসেব নেই। এর পর আছে শিক্ষকদের দায়সারা কাজ কারবারের নানা অভিযোগ। ছাত্রদের অধিকাংশই কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি থাকায় নেই জবাবদিহিতা। ফলে প্রাইমারির একটা ছাত্র প্রায় সময়েই ওঠে আসে চরম অবহেলা আর অমনোযোগ নিয়ে। শিক্ষা ও জ্ঞানের যথার্থ অভাবের কারণে তাকে একসময় পরীক্ষা পাশের জন্য নিতে হয়ে অসদুপায়ের অবলম্বন।

এরপর আসে হাইস্কুল অথবা আলীয়া মাদ্রাসায়। সেখানেও চলে প্রাইভেট আর কোচিং নামের বাণিজ্য। দেখা যায় শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ার কারণে প্রশ্নের উত্তর না দিয়েও নম্বর পেয়েছে। আবার প্রাইভেট না পড়ার কারণে যথাযথ উত্তর করেও কাক্সিক্ষত নম্বর পায়নি। ময়মনসিংহ জিলাস্কুলের আমার এক ছাত্র পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশের পর সখেদে বলেছিল, “স্যার একজন শিক্ষক যিনি আমাদের মানুষ বনানোর কাজ নিয়ে এই পেশায় এসছেন, তিনি যদি তার কাছে প্রাইভেট না পড়ার কারণে আমাকে কম নম্বর দেন। তাহলে আমরা কি শিখলাম যে, আমি যখন পাশ করে উচ্চ পদে চাকরিতে যাবো, তখন যদি এই শিক্ষক পেনশনের কারণে অথবা অন্য কোন কারণে আমার কাছে যান তাইলে আমি তার কাছ থেকে ঘুষ নিবো?” একজন শিক্ষক হিসেবে আমি তখন নিজেকে খুবই লজ্জিত মনে করেছিলাম। ছাত্ররা যখন একজন শিক্ষকের নানা ভনিতা ধরে ফেলে তখন সেই শিক্ষকের উপদেশ, আদেশ, আর আদর্শ সেই ছাত্রটিকে আর টানে না। ফলে সেও নিজের মত নিজের জীবন ব্যবস্থা তৈরি করে নেয়।

আরো আছে সেই সব বিদ্যালয়ের অযোগ্য, লম্পটটাইপ শিক্ষকদের (?) নষ্টামি। আমরা পরিমল, তারক আর পান্না মাষ্টারের প্রাইভেটের নামে ছাত্রীদের সাথে কুকীর্তির কথা মিডিয়ার কল্যাণে জানতে পেরেছি। এমন আরো কত যে আছে তার হিসাব কে রাখে? ফলে শিক্ষার্থীদের নৈতিক মান ও আদর্শিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়াটা অনেক কঠিন হয়ে গেছে।

এবার আসি ভার্সিটি ও কলেজের কথায়। সেখানেও আছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, অর্থনৈতিক আত্মসাৎ, শিক্ষকদের দলাদলি অধ্যাপক-ভিসির দলান্ধ আদর্শ, ছাত্রদের ছাত্র রাজনীতির নামে দলীয় লেজুড়বৃত্তি, স্যেকুলারিজমের নামে ধর্ম ও সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে বিষোধাগার, প্রগতিশীলতার নামে ইসলাম ও মুসলমানের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অধিকার হরণের নির্লজ্জ কূটচাল ইত্যকার নানা সমস্যা। ফলে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা নেওয়ার পরও একজন মানুষ সত্যিকারের মানুষ হতে পারছে না। শিক্ষিত কোন রাজনৈতিক নেতাও আসছেন না; যিনি বদলে দেবেন আমাদের সমাজের খোলনলচে। অন্যদিকে সমাজের শিক্ষিত শ্রেণি ও সৎ মানুষেরা ক্রমেই রাজনীতি বিমুখ হচ্ছেন। সেই জায়গা দখল নিচ্ছে একদল গোয়ার, অশিক্ষিত, লোভী এবং সুযোগ সন্ধানী মানুষ নামের অমানুষ। আমরা পাচ্ছি একটি অনিশ্চিত আগামীর স্বদেশ। পাচ্ছি আগত প্রজন্মের জন্য এক আকাশ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। তৈরি হচ্ছে একদল সরকারি আমলা আর চাকুরে। তৈরি হচ্ছে কেরানি আর শোষক। রাষ্ট্রের পরতে পরতে, ধাপে ধাপে এখন চলছে ঘুষের বাণিজ্য। চলছে সুদের উৎসব। আর এইসব ঘুষ আর সূদের কারবারিদের মধ্যে শিক্ষিত ও সমাজের উপর তলার মানুষই বেশি। যারা সমাজটাকে আলোকিত করবেন তারাই এখন অন্ধকারের সারথি। কে দেবে আলোকের সন্ধান? কোথায় পাবো আশার সঞ্জিবনী শক্তি। চারপাশের বাতাস ও পরিবেশ এখন বিষাক্ত! মানুষের কেন্দ্রীয় কমান্ড ভেঙ্গে পড়েছে মনে হয়!

সমাজের প্রতিটি সেক্টরে আজ সুদখোর আর ঘূষখোরে প্রতাপ। মসজিদ-মাদ্রাসার কমিটিতেও একজন না একজন ঘুষখোর আছেই। নৈতিকতার কোন বালাই নেই; আজকের সরকারি চাকুরেদের মধ্যে। ইয়া লম্বা দাঁড়ি, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে পড়ছেন নিয়মিত। কিন্তু সেই নামাজ ও সুন্নাত তাকে বাঁচাতে পারছে না ঘুষ থেকে। কারণটা কী? কোথায় এই সমস্যার উৎস? এর একটাই কারণ, ভেঙ্গে গেছে আমাদের মূল্যবোধের দেয়াল। ছিড়ে গেছে নৈতিকতার চাদর। দিন দিন মানুষের হতাশা বাড়ছে। বাড়ছে অপরাধের খতিয়ান। দুর্বল ঈমান আর ঈমানী আদর্শহীন মানুষ অন্যায় করেই যাচ্ছে। একদল তা সয়েও যাচ্ছে। অপর দিকে যারা আদর্শিক মানে উন্নত তারাও আছে অনেকটাই বেখবর। তাদের মাঝেও আছে নানা মত-পথ আর অনৈক্যের সাতকাহন। ফলে একটা দেশ জাতীয়ভাবে ঘূষ আর দূর্নীতির কাছে হেরে যাচ্ছে। হেরে যাচ্ছে ইসলামের আদর্শের অনুগত একদল মানুষও।

হাজার হাজার মাদ্রাসা, মসজিদ, খানকাহ আর দাওয়াতের মারকাজের কাজেও রাষ্ট্রের কোন পরিবর্তন আসছে না। ব্যাক্তিক পরিবর্তন আর কতকাল চলবে? এখন তো সামাজিক পরিবর্তন আর রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনের সময়। একেবারে ধ্বংস হয়ে গেলে কোত্থেকে হবে তার উত্থান? চূড়ান্ত ধ্বংসের আগেই আমাদের জাগতে হবে। সমাজের প্রতিটি পরতে পরতে পৌঁছে দিতে হবে ইসলামের মহান আদর্শের নৈতিক চেতনা। সযতেœ বাঁচিয়ে রাখতে হবে ইসলামী মূল্যবোধের মশাল। অন্যথায় অবক্ষয় বাড়তেই থাকবে, ভাঙ্গতেই থাকবে সামাজিক নিরাপত্তা আর পারিবারিক শান্তির ঠিকানা। মানুষ একসময় চলে যাবে আধ্যাত্মিক ও আদর্শিক শুন্যতার চূড়ান্ত সীমানায়। দেশ ও জাতির সৎ মানুষের জন্য রাষ্ট্র হয়ে যাবে আগুনের কারাগার। স্বেচ্ছা নির্বাসন ছাড়া কোন বিকল্প থাকবে না আদর্শিক জীবন চর্চায় অভ্যস্ত মানুষদের!

আদর্শ, মূল্যবোধ আর নৈতিকতার অবক্ষয় রোধে কার্যকর যেসব ব্যবস্থা ইসলাম দিয়েছে তার কোনটাই আর আমাদের সমাজে অবশিষ্ট নেই। হাদীসে ইরশাদ হচ্ছে, “যার মুখ ও হাত থেকে তার প্রতিবেশি নিরাপদ নয় সে মুমিনই নয়।” কিন্তু আজকের সমাজের দিকে তাকিয়ে কী মনে হয়? আমরা কি কেউ কারো হাত ও মুখ থেকে নিরাপদ আছি? সামাজিক, রাজনৈতিক কোনভাবেই আমরা একজন অন্যজনের হাত ও মুখ থেকে নিরাপদ নই। রাসূল (সা.) বলেন, “একজন মুমিনকে গালি দেওয়া ফাসেকি আর হত্যা করা কুফরি।” কিন্তু আমরা কী দেখছি আমাদের সামাজে। মানুষকে মেরে ফেলা বর্তমান সমাজে কোন ব্যাপারই মনে হচ্ছে না। আর গালি তো চলছে দেদারছে। মতের মিল হয়নি শুরু গালি। চিন্তার মিল হয়নি দাও গালি। অবৈধ সুবিধা পাই নি শুরু হলো গালি। আজকের সমাজে গালি এখন প্রায় শিল্পের পর্যায়ে চলে গেছে। এইসব গালি এখন নাটক সিনেমায়ও চর্চা হয়। একদল কবি-সাহিত্যিকও তাদের রচনায় গালির চর্চা করেন। তাদের যুক্তি বলতে পারলে লেখা যাবে না কেন? কিন্তু এত কী হচ্ছে রাসূল (সা.) ভাষায় সমাজে ফাসেকের সংখ্য বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন। রাজনৈতিক হানাহানি, সামাজি জেদ, পারিবারিক কোন্দলের কারণে মানুষ খুন হচ্ছে প্রদিদিন। সামাজে বাড়ছে কুফরি কর্মকান্ডও।

ইসলামী নৈতিকতার আরেকটি শিক্ষা হলো, নিজেরে পছন্দটা যেন অন্যের জন্যও পছন্দ হয়। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, “তুমি মুমিন হবে না যতক্ষণ না তুমি নিজের জন্য যা পছন্দ তা অন্যের জন্য পছন্দ করো।” যদি আজকের শিক্ষালয় আর আমাদের পরিবারে এই হাদীসের চর্চা হতো তাহলে সামাজিক সমস্যার অধিকাংশই সমাধান হয়ে যেতো। তাহলে কেই কাজের মেয়েকে গরম লোহা দিয়ে সেক দিতে পারতো না। কাজের লোকের জন্য কমদামের কাপড় কিনতে পারতো না। শ্রমিকের বেতন নিয়ে গড়িমসি করতে পারতো না। যাকাতের কাপড়ের নামে আলাদা ব্যবহারাযোগ্য কাপড়ের উদ্ভব হতো না। পলে আমারা সামাজিক নিরাপত্তা বেশি পেতাম। দরিদ্রমুক্ত সমাজ হয়ে যেতো যাকাতের সঠিক ব্যবহারের ফলে। কাজের লোকজনও মালিকের আন্তরিকতার কারণে ফাঁকির চিন্তা করতো না। ফলে অনৈতিকার বৃত্তায়নও হতো না এই সমাজে। নেমে আসতো শান্তি আর সুখের ঝর্ণাধারা।

সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইমের মতে, “সামাজিক বিশৃঙ্খলার অর্থ ব্যক্তির ওপর সামাজিক রীতিনীতির প্রভাব হ্রাস পাওয়া।” আর একটি বিশৃঙ্খল সমাজে নিরাপত্তার বালাই থাকে না। সমাজ যখন নিরাপত্তাহীন হয়ে যায় তখন একটি পরিবার অবধারিতভাবেই অনিরাপদ হয়ে যায়। শুরু হয় চারপাশে অস্থিরতা। বাড়তে থাকে সামাজিক ও পারিবারিক অপরাধের পরিধি। ফলে সমাজে চলতে থাকে নানাবিধ সমস্যা আর অপরাধের রাজত্ব।

একটি সমাজ যখন তার নৈতিক অবস্থান হারায় তখন সেই সমাজে ধেয়ে আসে নানা অপরাধের সুযোগ। সমাজের আবাল-বুদ্ধ-বণিতা হয়ে যায় অপরাধ প্রবণ। আইন তখন আর সেই সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সবাই খুঁজতে থাকে আইনের ফাঁকফোকর। সেইসব ফাঁকফোকর গলে অপরাধিরা সহজেই মুক্তি পায়। মুক্তির পর শুরু করে আরো বেশি। ফলে সমাজে বাড়তে থাকে ইভটিজিং, মাদকাসক্ত, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, কিশোর অপরাধ, ধর্ষণ, হত্যা, গুম, মিথ্যা মামলা, নারী নির্যাতন, যৌতুকের ভয়াবহতা, এসিড নিক্ষেপ, অপহরণ, চিনতাই, হাইজ্যাক, কিডন্যাপ, উৎকোচ ইত্যাদি অপরাধ। বাড়তে থাকে রাজনৈতিক সহিংসতা। মানুষের জীবনে নেমে আসে স্তবিরতা। জনজীবনে আসে অনিশ্চিত আগমীর পদধ্বনি। ভাঙ্গন ধরে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে। তৈরি হয় বিভেদের দেয়াল ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের, প্রতিবেশীর সাথে প্রতিবেশির। বন্ধুর সাথে বন্ধুর।

নৈতিক আর আদর্শিক ঐশ্বর্য না থাকলে চিন্তাগত ও আদর্শগত মতানৈক্যের কারণে শত্র“তার বীজ বুনে যায় যে কেউ। বর্তমানে আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার দলনীতিতে তাই দেখছি। পরমত সহিষ্ণুতা চলে যায় শূন্যে। সমালোচনা হয়ে যায় শত্রুতা। প্রতিবাদ হয়ে যায় যুদ্ধ। ক্ষমতার জন্য মানুষ হয়ে যায় অন্ধ।

সুতরাং পরিবার ও সমাজকে বাঁচিয়েই রাষ্ট্রকে বাঁচতে হবে। আর রাষ্ট্রকে বেঁচে থাকতে হলে তাকে তৈরি করতে হবে সুনাগরিক। সুনাগরিকের অন্যতম শর্ত হলো তারা হবে নৈতিক মানে উন্নত। সামজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধে উজ্জিবীত।আদর্শিক চেতনায় সুদৃঢ়। কর্ম প্রচেষ্টায় নিয়মিত।

এখন যদি আমরা পরিবার, সমাজ আর রাষ্ট্রকে নিয়ে সফল হতে চাই তাহলে অবশ্যই আমাদের নৈতিক মানে উন্নত হতে হবে। আর এই মান উন্নয়নের জন্য, পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সবাই এক একযোগে কাজ করতে হবে। নিতে হবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। চেষ্টা চালাতে হবে সম্মিলিত। একক প্রচেষ্টায় এই দেশের নৈতিক, আদর্শিক, আধ্যাত্মিক দেউলিয়াত্বের শেষ করা যাবে না। এক্ষেত্রে শিক্ষক, সুশীল সমাজ, রাজনীতিক ইমাম ও আলেম সমাজের এগিয়ে আসতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে সমাজের আরো সৎ মানুষকে সাহসি ও নির্ভিক চেতনা নিয়ে। তাহলেই আমরা পাবো একটি নিারাপদ পারিবারিক ও সামাজিক বাংলাদেশ।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:০৬
১২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×