somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কবিতা: পবিত্র শব্দসঙ্গম এবং বিমূর্ত ভাবকল্প

২৮ শে মে, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



কবিতা- এই ধ্বনিচক্রে আটকে গেছে পৃথিবীর সব আলো। সব নন্দন। সব অনুভূতি। কবিতার হাত ধরেই ভাষা পায় প্রাণ। বেঁচে থাকে ভাষা। যে ভাষায় কবিতা লিখা হয় না সে ভাষা মরে যায়। হারিয়ে যায় কালের পরতে। প্রতিটা ভাষাকে সমৃদ্ধ করে কবিতা। কবিতার আঁচলে রূপময় হয়ে নান্দনিক হয়ে ওঠে মানুষের ভাবনা, অনুভূতি, আবেগ-অনুরাগ, প্রেম-ভালবাসা, দ্রোহ, চিৎকার, কান্না, ভাব-ভাবাবেগ আর হৃদয়ের কথকতা। যুগ যুগ ধরে শত শত সন্নাসী, ঋষি-মুনি আর দরবেশ-আউলিয়া এই কবিতার ভাষায় এঁকে গেছেন তাদের প্রভুপ্রেমের শব্দমানচিত্র। কবিতার প্রেমে অনেকেই হয়েছেন সংসার ত্যাগী। কবিতার দেহে দৃষ্টি রেখে বহু বাউল জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। আর কবিরা! কবিতার দেবীকে আপন করতে হয়েছেন বাউণ্ডেলে, ভবঘুরে এবং সমাজের আটপৌরে জীবনের ভেতরেই এক অন্য জীবনের কারিগর।

কবিতা উদিত হয়। নেমে আসে। হৃদয়ের কুঠুরিতে নিঃশব্দে প্রবেশ করে কবিতারা। চাইলেই কেউ পায় না কবিতার বাসর। সাধনার পর সাধনা করেও কেউ কেউ অনন্ত বিরহে পুড়ে মরে। কিন্তু কবিতা রয়ে যায় তার নাগালের বাইরে। তাই, কবিতা অলোক। কবিতা ঐহিক। কবিতা ঈশ^রের ইশারা। কবিতা হৃদয়ের ষুসুপ্ত অনুভূতি। কবিতা সাধকের সাধনার ঊর্ধ্বে। যার কাছে কবিতা ধরা দিয়েছে সে হয়েছে যুগের নকীব। কালের ঈর্ষান্বিত মহামানব। কবিতার নন্দনে জয় করেছে মানবের ভেতর-বাহির আর সদর-অন্দর। শব্দ আর ভাবের মিথস্ক্রিয়ায় নির্মাণ করেছেন অনিবার্য চিত্রকল্প, ভাবকল্প আর বাক্যবাণী। যার পরশে মানবাত্মা পায় প্রেমের সবক, জীবনরহস্যের সন্ধান এবং অবিবৃত কথার সরব কথোপকথন। কবিতার মোহজালে আটকে কিংবা কবিতার মায়াসুরে আচ্ছন্ন হয়ে কষ্টের নোনাজলকে বাতাসে উড়িয়ে সুখের স্নিগ্ধজলজ সরোবরে স্নাত হয় পাঠকের মনোজগত। একসময় কবিতা হয়ে যায় ভাবুকের, ভাষার অবিচ্ছেদ্য জীবন।

তাইলে প্রশ্ন জাগে কবিতা কী? কবিতা হলো, হৃদয়ের তন্ত্রীতে বেজে ওঠা ঐশী আওয়াজ। পবিত্র সব্দসঙ্গম এবং বিমূর্ত ভাবকল্প। শব্দের পিঠে শব্দ সাজিয়ে তৈরি করা ঘোর জগত। বাক্যের বুকে বাক্য রেখে গড়ে তোলা হৃদয়ের মহাকাশ। অনুভূতির অচিন অতলে জাগিয়ে তোলা অপার্থিব সূর। অবিচ্ছেদ্য ধ্বনিচক্রের সমন্বয়ে ভাবের ক্যানভাসে আঁকা অপার বিস্ময়। কবিতা মানে, কবির বিস্ময়ের তাজমহল। যেখানে কবি রাজা আর শব্দরা প্রজা হয়ে গড়ে তোলে অনিন্দ্য সংসার। কবিতা মানে কল্পনার ছবিতা। কবির নিজের নিকট নিজের নির্মাণই অবিশ্বাস্য হয়ে ওঠা। শব্দোত্তর অতিরেক। অর্থের ভেতরে অর্থের ভজঘট। অপার রহস্যের শব্দনিনাদ। চপল কিশোরীর অবোধগম্য অট্ট হাসি। অষ্টাদশীর কামনার চাহনি কিংবা কোমল গালের টোল। কবিতা কখনও প্রেমের বাইবেল, কখনও দ্রোহের দাবানল, কখনও বাতাসহীন বিকেলে নদীর শান্ত স্রোত, কখনও পান খাওয়া যুবতীর রক্তাভ ঠোঁট। কবিতা ভাষার ঔরসে ভাষার জীবন। শব্দের ভেতরে শব্দের প্রাণ। বাক্যের শরীরে বাক্যের সৌন্দর্য। কবিতা জীবনের অনিবার্য চাহিদায় জেগে ওঠা অক্ষরের মানচিত্র আর ধ্বনির টেরাকোটা। কবিতা কৃষ্ণকুন্তলধাম। কবিতা নারীর মন। কবিতা মানুষের মানুষ হয়ে থাকার বিরল উপাদান। কবিতা অনুভূতিকাতর জীবনের বেঁচে থাকার গ্যারান্টি। কবিতা গঠিত বাক্যের বহুমাত্রিক অর্থ সম্ভাবনা, পাঠকভেদে বোধচাহিদার চিত্রকল্প, সময়ের পাটাতনে সময়ের কথন। কবিতা নাই; ভালোবাসা নাই, প্রেম নাই, অনুরাগ নাই, আবেগ নাই, নাই মনোজগতের আঘাতে অক্ষিযুগলে অশ্রুর রেখাপাত। কবিতাই পৃথিবী, কবিতাই জীবন, কবিতাই কথা, কবিতাই বাণী, কবিতাই আলাপ, কবিতাই মহাপ্রলয়ের প্রতিবন্ধক।

কবিতা ভাষার আদিম নিদর্শন। আদি সাহিত্য। কবিতার হাত ধরেই ভাষার উদ্ভব। প্রতিটি ধর্মগ্রন্থের বাণীই শ্লোক ও ছন্দনির্ভর। প্রাচীনকালে পদ্য ছাড়া ভাষার কোন লিখিত রূপ ছিল না। লেখ্য ভাষা মানেই কবিতা। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ বা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনও কাব্যে রচিত। সুতরাং ভাষা ও মননের জন্য শীল্প বা আর্টের জন্য কবিতাই চূড়ান্ত। কবিতাই সাহিত্যের অভিজাত অঙ্গ। কবিতাই শীল্পের দামী শাখা।

কবিতাকে সঙ্গায়িত করার কসরতে মগ্ন হয়েছেন পৃথিবীর তাবৎ কবি আর সাধক। কিন্তু সবশেষে কবিতা কারও সংজ্ঞার সীমানায় আটকে থাকেনি। আসলে কবিতা বহুরূপি, বহুবর্ণিল আর রকমারি কাজলের চোখ। যেখানে কোন বন্ধন নেই, বাঁধা নেই। সুতরাং পণ্ডিতের সংজ্ঞার বৃত্ত ভেঙ্গে ‘কবিতা’ সজ্ঞা-উত্তর এক পবিত্র ধ্বনিমানচিত্র। যার ভেতরে আছে রহস্য, রোমাঞ্চ, থ্রিল, ফিল আর সুগভীর ভাবনার রসদ। কবিতাকে শব্দের সীমানায় ধরতে গিয়ে কবি আল মাহমুদ লিখেছেন ‘কবিতা এমন’ নামক এক কালজয়ী কবিতা। আবার কবিত্ব নিয়ে বলেছেন, “পাখির নীড়ের সাথে নারীর চোখের সাদৃশ্য আনতে যে সাহসের দরকার তাই কবিত্ব।” কবিতাকে শব্দের ঘেরটোপে আটকাতে গিয়ে রুদ্র আবার নিজেই পড়েছেন সংশয়ে। তিনি বলেন, “যে লেখাটি সমকালের স্মৃতি বা স্বপ্নকে তুলে আনতে সক্ষম এবং একই সাথে সমকালকে অতিক্রমণের যোগ্যতা রাখে তাকেই বোধ হয় কবিতা বলা যেতে পারে।” শেলীর বক্তব্য আরোও জটিল, “কবিতা হল পরিতৃপ্ত এবং শ্রেষ্ঠ মানের পরিতৃপ্তি এবং শ্রেষ্ঠ মুহূর্তের বিবরণ।” কেউ কেউ বলেন, “মন আত্মা ও অনুভূতির চমকপ্রদ প্রকাশই কবিতা। মন ও আত্মা যখন এক হয়ে অনুভূতিতে পরিণত হয় তখনই সৃষ্টি হয় কবিতা।”

কালের বিবর্তনে কবিতার দেহ বা শরীরে এসছে পরিবর্তন। কবিতার আঙ্গিকেও নেমেছে বহুবর্ণিল অবয়ব। এক সময় কবিতা মানেই ছিল কবিয়ালের কণ্ঠে সূর করে গেয়ে ওঠা কিছু ছন্দিত পংক্তি। ছন্দ আর অন্ত্যমিলের নৃত্যরত শব্দসফরকেই কবিতা হিসেবে মান্য করে এসেছে মানুষ বহুকাল। অনুপ্রাস আর ধ্বনি সঙ্গে ধ্বনির সমতাই ছিল কবিতার মুন্সিয়ানার মানদ-। ছিল মহাকাব্য আর আখ্যান কাব্যের জয়জয়কার। ফেরদৌসীর শাহনামা, রুমীর মসনবী, হয়ে অধুনাকালের কিছু আগে মাইকেল মধুসুদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ এবং কায়কোবাদের ‘মহাশ্মশান’ হলো মহাকাব্যের অন্যতম নিদর্শন। সময়ের পালাবদলে বাংলা কবিতার অঙ্গণে নেমে আসলেন মাইকেল। শুরু হল ছন্দবৃত ও অন্ত্যমিলের চক্র মুক্তির ইতিহাস। অমিত্রাক্ষর ছন্দ দিয়ে কবিতার মুক্তির পথ করে দিয়েছেন মাইকেল। এরপর সমিল পয়ারের যুগ শেষে এল অমিল পয়ারের যুগ। এল শব্দনৃত্তের কসরত ফেলে ভাবকল্পের গাম্ভীর্য। গদ্যকবিতার মিছিলে বাংলা কবিতা পেল আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতার পিরান। এখনো চলছেই কবিতার ভেতর বাহির আর আঙ্হিক নিয়ে ভাঙা-গড়ার খেলা। হয়তো সামনে এমন কবিতার দিন আসবে যে কবিতার কথা আমরা কেউই কোনদিন কল্পনাই করিনি। কিন্তু, যতই আসুক কবিতার বিবর্তন। কবিতার আন্তর্গত আবেদনের কোন তারম্য কোনকালেই বদল হবে না। কবিতা কবিতা হয়ে মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে জাগিয়ে যাবে নন্দনিকতার মিছিল। নন্দনের কল্পদৃশ্য। শিল্পের চেতনা।

০৫. ০২. ২০১৬

ছোটকাগজ 'ফেস্টুন'-এ প্রকাশিত।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৫৭
১৪টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

দুলে উঠে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৬

দুলে উঠে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

মন খুশিতে দুলে দুলে ‍উঠে
যখনই শুনতে পাই ঈদ শীঘ্রই
আসছে সুখকর করতে দিন, মুহূর্ত
তা প্রায় সবাকে করে আনন্দিত!
নতুন রঙিন পোশাক আনে কিনে
তখন ঐশী বাণী সবাই শুনে।
যদি কারো মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তরে নিয়ে এ ভাবনা

লিখেছেন মৌন পাঠক, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩০

তরে নিয়ে এ ভাবনা,
এর শুরু ঠিক আজ না

সেই কৈশোরে পা দেয়ার দিন
যখন পুরো দুনিয়া রঙীন
দিকে দিকে ফোটে ফুল বসন্ত বিহীন
চেনা সব মানুষগুলো, হয়ে ওঠে অচিন
জীবনের আবর্তে, জীবন নবীন

তোকে দেখেছিলাম,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×