নারায়ণগঞ্জের খুনের আসামিদের ধরতে প্রশাসনের মধ্যে ব্যাপক দ্বিধাদ্বন্দ্ব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নিহত নজরুলের শ্বশুর শহীদ চেয়ারম্যান যদি হত্যাকা- সম্পর্কে বিবৃতি না দিতেন তাহলে এ ঘটনা আসলেই প্রহসনে পরিণত হতো কিনা। এবং নজরুলের শ্বশুর শহীদ চেয়ারম্যান ৭ জনের হত্যাকা- সম্পর্কে না বলার আগে পর্যন্ত দেশের মানুষ অন্ধকারে ছিল। আসলে একটা প্রহসন তৈরি করার চেষ্টা হয়েছিল। যা সম্ভব হয়নি শহীদ চেয়ারম্যানের কারণে। তারপর এখন বিচারবিভাগীয় নির্দেশ দেয়ার পরও কেন আসামিদের এখনও ধরা হচ্ছে সেটা রহস্যজনক।
এ কারণে একটি প্রশ্ন বার বার মনে হচ্ছে- আসামিদের ধরা প্রশাসনের জন্য কি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতেই পারে। তারা ৩ জনই সেনা ও বিমান বাহিনীর অফিসার।
গত রবিবার অ্যাডভোকেট চন্দন কুমার সরকার ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাত খুনের ঘটনার পর অবসরে পাঠানো র্যাবের তিন কর্মকর্তাকে অবিলম্বে গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা নিতে পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজি) নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। দ-বিধি বা বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকলে সেই অভিযোগে গ্রেপ্তার করতে বলা হয়েছে। আর অভিযোগ না থাকলে তাদের ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারের আদেশ দেওয়া হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর তাদের ডিবির কাছে হস্তান্তর করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অন্তবর্তীকালীন এ আদেশের পাশাপাশি রুল জারি করেছেন আদালত। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাইকোর্টের আদেশ ও আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন,কাউকে যেন ছাড় না দেওয়া হয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও হাইকোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও রবিবার থেকে মঙ্গলবার এমন একটি চাঞ্চল্যকর ইস্যুতে কাউকে গ্রেপ্তার করতে না পারা বিস্ময়কর।
একটি বিষয় মনে রাখতে হবে এসব অফিসার এবং তাদের মূল সংস্থা রাষ্ট্রের উর্ধ্বে নয়। যদি কোন সংস্থার কারণে অপরাধীদের ছেড়ে দেয়া হয় কিংবা কোন ধরনের সুযোগ দেয়া হয় তাহলে সেটা রাষ্ট্রের জন্য অপমানজনক ও অসম্মানের। তাদের যে ধরতে এতদিন দেরি করা হচ্ছে এতেই জনগণ অনিরাপদ ও রাষ্ট্রের দায়িত্বজ্ঞান সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়ছে। তাহলে খুনিদের মাথায় তুলে রাখার মতই দেখা হবে।
অতীতের ঘটনায় র্যাবের অভিযুক্তদের বিচার হলে নারায়ণগঞ্জে র্যাবের অফিসাররা এতবড় নির্মম হত্যাযজ্ঞ ঘটাতে পারত না। গুম, অপহরণ ও তথাকথিত ক্রস ফায়ারের নামে হত্যার অভিযোগ এ বাহিনীর বিরুদ্ধে এন্তার। তবু দেশের জনগণ খুব একটা প্রতিবাদী হয়নি কারণ জনগণ মনে করেছে র্যাব হওয়ার ফলে অপরাধের অনেকটা লাগাম টানা সম্ভব হয়েছে। নিশ্চয়ই এই বাহিনীর সুনাম গড়ে না উঠলে এটি এতদিন টিকত না। আইন শৃঙ্খলা রক্ষার এ সংগঠনটি এখন সত্যিকার অর্থে পচে গেছে। এটা একটা ভয়ঙ্কর বিষয়। একদিনেই শীতলক্ষা নদীতে ভেসে উঠেছে ৬টি লাশ। এদেশে কোন অপরাধী বা অপরাধী গোষ্ঠি কিংবা কোন পেশাদার কিলারগ্রুপের পক্ষেও সাম্প্রতিক কালে এত বড় নৃশংস হত্যাকা- সংঘঠিত করা সম্ভব হয়নি। এরপরও পেশাদার হত্যাকারী তাদের অনেক কৌশল থাকে। এক সাথে ৭ জনকে এক রাতেই হত্যা ভয়ঙ্কর নির্মমতা। তাও আবার প্রকাশ্যে লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয় নদীতে। কি দুঃসাহস তাদের। রাষ্ট্রের সমস্ত লক্ষ্যকে বিসর্জন দিয়ে কিভাবে সম্ভব এত বড় কিলিং মিশন সম্পন্ন করা। যা একটি কিলারগ্রুপের পক্ষে সম্ভব নয়। তার মানে র্যাব কি কোন কিলার গ্রুপের মত অপরাধ সংঘটিত করছে রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় থেকে। হত্যা, গুম অপহরণই তাদের কাজ। খুব সম্প্রতি দেশে অনেক অপহরণ হয়েছে। বিশেষ করে চাঞ্চল্যকর ছিল চট্টগ্রামের এক স্বর্ণ ব্যবসায়িকে অপহরণ করা। কারা অপহরণ করেছে সেটা আজও জানা যায়নি। তার অপহরণের পর কিছুটা সময় অন্তত পাওয়া গিয়েছিল। স্বর্ণ ব্যবসায়িরা একত্রিত হওয়ায় তাকে পাওয়া যায়। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের ৭ জনকে ধরে নিয়ে আর কোন সময় দেয়নি হত্যাকারিরা। তাদের অপহরণের বিষয়টা মানুষ আঁচ করতে পারেনি। কারণ ক্রাইমজোন নারায়ণগঞ্জে এই ঘটনার জন্যে অনেকে শামীম ওসমানকে সন্দেহ করেছে। এসব ক্ষেত্রে আরও একটি সমস্যা ঘটনা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ধীরগতি। এই ধীরগতির কারণে অনেক সমস্যাই আরও জটিল হয়ে উঠে। মানুষের জীবনের সংশয় থাকলে সেখানে এ ধরনের শম্বুক গতি সত্যিই ভয়ঙ্কর।
র্যাবের গুলিতে লিমনের পা হারানোর কথা আমরা কেউ ভুলতে পারিনা। যা ছিল অত্যন্ত নির্মম। এবং র্যাব এসব ঘটনাকে কোনভাবেই এ বাহিনীর স্খলন হিসাবে গুরুত্ব দেয়নি। এমনি আরও অনেক ঘটনাই আছে। যা র্যাব গুরুত্ব দেয়নি। প্রকৃত অর্থে আজকের ৭ খুন তার ধারাবাহিক ফলাফল। আগে যদি র্যাবের ওই সকল অপরাধীদের বিচার হত তাহলে আজকে র্যাবকে তাদের অস্তিত্ব শঙ্কায় পড়তে হত না। অনেকে অনেক জায়গা থেকে বলছে র্যাব বিলুপ্ত করার জন্য। কথাটা আগেও বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন বলেছিল। কিন্তু কেউ তা গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। কারণ আমরা নিজেরাই নিজেদের সংশোধনের কোন উদ্যোগ নিতে পরেনি। যা থেকে এ ধরনের হত্যা ও গুম বন্ধ করার জন্য জোরদার আইনি ও সংস্থাটির নিয়ম কানুন মেনে চলার বিষয়টা নিশ্চিত করা জরুরি ছিল। কিন্তু র্যাব একের এক পার পেয়ে গেছে। যার ফলে নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের মত বিশাল একটি ঘটনা ঘটে গেছে।
আগে দেশের বাইর থেকে র্যাব বিলুপ্তির কথা শোনা গেলেও এখন দেশের ভেতর থেকে সংস্থাটিকে বিলুপ্ত করার কথা উঠছে।
এসব কথা সঙ্গত কারণেই বলা হচ্ছে। কারণ যারা এটির নিয়ন্ত্রণে আছে তারা এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এটাকে প্রশাসনিক ব্যর্থতা বলা যায়না। এটা মূলত রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা। সরকারের ব্যর্থতা। কারণ বারবার একই পরিস্থিতি উদ্ভব হলেও সরকার বিষয়টিকে সহজভাবে নিয়েছে। জনগণের কিংবা সুশীল সমাজ ও বিভিন্ন বিদেশি সংগঠনের সমালোচনাকে কোন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এদেশের সরকারগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বড় ধরনের কোন অঘটন না ঘটা পর্যন্ত কোন কোন তথ্য উপাত্ত বা যুক্তিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না।
এই ঘটনার পর প্রমাণ হচ্ছে র্যাবের দায়িত্বে যিনি আছেন তার পক্ষে এ দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের শক্তিতে মদমত্ত র্যাবের সদস্যরা ক্ষমতাকে পুঁজি করে নিয়েছে। বিশেষ করে হত্যাকারীদের একজন যিনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রীর মেয়ের জামাই। যিনি নারায়ণগঞ্জের র্যাবের দায়িত্বে। তার নেতৃত্বেই এ খুনের মিশন পরিচালিত হয়েছে। তার এই দুঃসাহসের বড় কারণ হিসাবে দেখা হচ্ছে মায়া চৌধুরীর ক্ষমতা এবং তিনি র্যাবের কর্মকর্তা দুটিই। র্যাবের সাধারণ কোন সদস্য হলে তার পক্ষে সম্ভব না খুনের এতবড় মিশন পরিচালনা করা। তাই ক্ষমতা একটা ফ্যাক্টর। এখানে সেটাই সমস্যা। ক্ষমতা প্রয়োগ করে অসাধ্যকে সাধন করা, অসম্ভবকে সম্ভব করা। চরম অন্যায় ও অপরাধ সংঘটিত করা। র্যাবের ওই কর্মকর্তা তিনি ব্যক্তিগতভাবে যদি র্যাবে চাকরি না করতেন তাহলে কোন সমস্যা ছিল না। যদি তিনি পেশাদার কিলার হতেন। কিন্তু আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর শপথ নিয়ে তারা যা করেছেন তা পেশাদার খুনীকেও হার মানায়।
সরকারের আরও ব্যর্থতা হচ্ছে খুনের অনেকদিন পরও জনগণকে অন্ধকারে রাখা। কিংবা নিজেদের মধ্যে কোন সমন্বয় না থাকা। নজরুলের শ্বশুরের পক্ষ থেকে যদি ঘটনার কোন বর্ণনা পাওয়া না যেত তাহলে আমরা জনগণকে আরও অনেকদিন অন্ধকারে রাখত। একইভাবে এ ঘটনাকে অন্যদিকে প্রবাহিত করার একটি সুযোগ পাওয়া যেত।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১৪ রাত ১১:৫২