মিন্টুদা,
আমার চিঠি পেয়ে হকচকিয়ে গেলে তো? ভাবছ কাল রাতেও যার সাথে কথা বললে সে আবার আজ চিঠি লিখতে গেলো কেনো? হোটাস্যাপে মেসেজ দিলেই তো হোতো? বলছি গো, সব বলছি! তুমি শুধু চিঠি টা পড়ো।
তুমি, সজল, মিলন তোমরা আমার কেউ নও। আবার তোমরাই আমার এখন সব। আর কেউ অন্তত এই দুনিয়ায় নেই । মাত্র বছরখানেক তোমাদের সাথে এই এক বেড রুমের ফ্ল্যাটে শেয়ার করে থাকছি, তাতেই তোমরা আমায় আপন করে নিয়েছ। যাক কাজের কথায় আসি।
তোমরা তো জানোই ইরাবতীকে নিয়ে আমি কতোটা সিরিয়াস। ঠিক কতোটা তার পরিমাপ বলতে পারবো না। তবে একটা ঘটনা বলি যা আগে বলিনি। একবার সে শপিং করে ফেরার পথে আমার সাথে দেখা করতে এসে বললো ' আজ দারুণ মজা পেয়েছি জানো। বিল তো ঠিক দিয়েছে কিন্তু ক্যাশে পেমেন্ট করেছি তো ,ব্যালান্স দেওয়ার সময় হিসেবে ভুল করে পুরো পাঁচশ কম নিয়েছে। 'আমি তাকে টাকাটা ফেরত দিতে বলেছিলাম , কিন্তু সে রাজি হয়নি।
আমি হতবাক হয়ে গেছিলাম।কেনো জানো?হয়ত আন্দাজ করতে পারছো । তবুও বলি । তুমি আমাকে আস্তাকুড়ের ছেলে বলতে পারো। আমার জীবনের পথ নির্মম, নিষ্ঠুর। আমার মাতাল বাবা রোজ মা'কে পেটাত। একদিন এমন মারলো অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার মা , মরে গেলো আর তার সাথে অনাগত ভবিষ্যৎও । তাদের দুজনের রক্ত মাটির মেঝে শুষে নিল। আমি এতোই ছোটো ছিলাম যে বাঁচাতে পারিনি। রাস্তায় প্লাস্টিক বোতল কুড়াতাম। এমনও দিন গেছে খিদের চোটে মুখ থেকে যখন তেতো উঠেছে তখন কুকুরদের সাথে লড়াই করে আস্তাকুড়ের থেকে খাওয়ার তুলে খেয়েছি। কত মানুষের বাড়ি কুকুর বিড়ালের নোংরা , টাকার বিনিময়ে পরিস্কার করে দিয়েছি। সেই সাথে লোকে কখনো পুরোনো জামা কি খাওয়ার দিলে দয়া মনে হয়নি, মনে হয়েছে পারিশ্রমিক। তবু কখনো চুরি করিনি জানো।
আমাদের ওখানকার সেলিমদা বলত যে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খাওয়া,পরা আর থাকার জায়গা ছাড়াও আর একটা জিনিস দরকার। তা হোলো ইমান। ইমান যাদের নেই তারা মনুষ্যত্বহীন। তাই কখনো যেন চুরি না করি। চোর নিজেই নিজের দিকে তাকাতে পারে না। লোকটা পড়াশুনো জানত না। বিড়ি বাঁধত।কিন্তু কথা বলতো খুব ভালো।
আর ইরাবতী সম্ভ্রান্ত ঘরের শিক্ষিত মেয়ে তার এমন মনোবৃত্তি দেখে কষ্ট পেয়েছিলাম। যেহেতু তাকে ভালোবাসতাম সেজন্য ঘৃণা করতে পারিনি।এটায় কি পরিমাপ বোঝাতে পারলাম ?
তবে সৎপথে থাকলে উপরওয়ালার কতোটা নেক নজরে থাকা যায় জানি না । তবে , কিছু ভালো মানুষের দৃষ্টিতে আসা যায়। মেধা ছিল আমার। এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আমাদের ওখানে আসত পথশিশুদের পড়ালেখা শেখাতে। আমার আগ্রহ দেখে তারাই আমাকে একটা মিশনারিজ স্কুলে পাঠায়। তাই আজ লেখাপড়া শিখে চাকরী করছি।
তোমায় তো কয়েকদিন ধরেই বলছিলাম ইরা, ফোন রিসিভ করে না, মেসেজের রিপ্লাই দেয় না। তুমি তো বললে বিয়ে কর, ফ্ল্যাটর ব্যবস্থা কর। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা তোর সাথে আছি। ধন্যবাদ দেবো না। তবে এই সাহসটার খুব দরকার ছিল আমার। কাল সকালে তোমায় বলেছিলাম না একজায়গায় যাচ্ছি, ফিরে এসে বলবো। যদিও বলিনি কিছু। এখন শোনো।
এসব নিয়ে আলোচনা করবো বলে ইরাকে অনেক কষ্টে দেখা করার জন্য রাজি করিয়েছিলাম। সে এসেও ছিল। খুব সুন্দর লাগছিল তাকে। কিন্তু আমি মুগ্ধ হতে পারিনি তাকে দেখে। উল্টে কেমন যেন আশঙ্কিত হয়ে গেছিলাম। কারণ তার সৌন্দর্য্যে ছিল অহংকার। যেন সেই অহংকারে সবকিছু ছারখার হয়ে যাবে। তবুও আমি শুরু করলাম।কিন্তু , বিয়ে - শব্দটা শুনে সে একটা তাচ্ছিল্য মাখানো হাসি হেসে বললো ' আমায় , বিয়ে করবে তুমি? আমার বাড়িতে তোমার কি পরিচয় দেবে? অজ্ঞাতকূলশীল? নাকি মার্ডারআরের ছেলে? আর আমাকে রাখবে কোথায়? ভাগাড়ে? '
শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম । তবু , কোথা থেকে যেন জোড় জুটিয়ে একটু দৃঢ় গলায় বললাম ' এভাবে কেনো বলছো ইরা? আমার অধিত শিক্ষা, আমার চাকরী, এগুলো কি আমার আজকের পরিচয় নয়? আর তোমায় ভাগাড়ে কেনো রাখবো? তুমি তো জানো, এখন আমরা কয়েকজন বন্ধু শেয়ার করে একটা ফ্ল্যাটে থাকি। তবে তোমার জন্য আপাতত একটা ছোটো ফ্ল্যাট কেনার চেষ্টা করছি। দেখো, খুব তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা হয়ে যাবে। '
এবার ইরা তির্যক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো ' আমার এই সালোয়ারস্যুট টার দাম ছয়, হাজার, এই হ্যান্ড ব্যাগ আড়াই হাজার আর জুতোর দাম শুনলে তো তোমার মাথা ঘুরে যাবে । '
কি যেন একটা দলা পাকিয়ে আসলো আমার কাছে। বুঝলাম আমি ভেঙে পড়ছি। আমি হাত বাড়িয়ে ইরার হাত দুটো ধরতে গেলাম। সে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে বললো ' করছোটা কী? এটা ম্যানিকিওর করা হাত। মাসে, আমার পার্লার খরচ জানো? সেটা দেওয়ার পর তোমার স্যালারির আর কিছু থাকবে? '
অথচ , ওই হাত, মিন্টুদা, নাহ থাক! তুমি দাদা....
যাক, এরপরও আমি অবশিষ্ট সমস্ত শক্তিটুকু সঞ্চয় করে তার কাছে অনুনয় করলাম ' আমি তো আগে যাইনি । তুমি সবকিছু জেনেই আমার কাছে এসেছিলে। তবে আজ এরকম কেনো বলছো? কোনো কারণে আমার উপর রেগে থাকলে বলো আমি তাহলে.....
সে আমাকে থামিয়ে গর্জে উঠলো ' কী? দুদিন এক সাথে ঘুরেছি বলেই, প্রেমে পড়েছি নাকি? যতো সব ইমোশনাল ফুল। আর এটা পাবলিক প্লেস। এখানে কোনো সিন কোরো না প্লিজ '
এরপরই সে সেখান থেকে চলে গেলো। একবারও পিছন ফিরে তাকালো না।
আর আমি? সে মুহূর্তে পৃথিবী তার সমস্ত মাধ্যাকর্ষণ দিয়ে যেন শুধু আমাকেই টেনে রেখেছিল। আমি নড়তে পারলাম না।
ভাবছো, এই তো গল্প শেষ। তবে, আরো এতো কি লেখা আছে? না গো, গল্পের এই শুরু।
জানো, জীবনের এতো ভয়ঙ্কর রূপ দেখেছি তবু জীবনটাকে বড্ড ভালো বাসতাম। তাই অসম লড়াই লড়েও একটা পরিচ্ছন্ন জীবন গড়ার চেষ্টা চালিয়েছি। কিন্তু ভালোবাসাকে চিনতে পারিনি। ইরাবতী আমায় ভালোবাসা চিনিয়ে দিয়ে গেল।
আমাদের ঝুপড়িতে একটা মেয়ে থাকতো । নাম টুসকি। সে যে ওখানকার মেয়েদের থেকে হাজারগুণ সুন্দরী ছিল তা ওই ছোটোবেলাতেই টের পাওয়া যেত। কিন্তু কেনো জানি না তাকে আমি এড়িয়ে চলতাম। সে তবু আমার সাথে কথা বলতে চাইত। তার মা'কে লুকিয়ে আমার জন্য খাওয়ার নিয়ে আসত। আমি কখনো তা নিতাম, কখনো বা নিতাম না।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাজে আমি আমার সেই পুরোনো এলাকায় মাঝে মাঝে যেতাম। একদিন দুপুরবেলা সেখানে যাওয়ার কিছু আগে , পথে আমি বাইক স্কিট করে পড়ে গেলাম। বেশ ভালো মতো লাগলো। হাতটা থেকে এতো রক্ত বের হচ্ছিল মনে হোলো যেন স্টিচ দিতে হবে ।
এই রাস্তাটা নির্জন। রাস্তার পাশে একটা বহু পুরোনো পার্ক আছে। নেশাখোরদের আড্ডা।
আর হাতে গোনা দু-একটা ঝুপড়ি। তার কিছুটা দূরে এলাকা শুরু। হঠাৎ দেখি কোথা থেকে টুসকি ছুটে আসছে। এসেই বলে ' ইশ, বড্ড লেগেছে। তুই এই পার্কে এক মিনিট বস। আমি ওষুধ নিয়ে আসছি। ' আমাকে কিছু বলতে না দিয়েই সে দৌড়লো। ভাবলাম, বিপদে পড়া গেলো। কতক্ষণে আসে তার ঠিক নেই ।
কিন্তু মিনিট খানেকএর মধ্যেই টুসকি হাজির।
হাতে এন্টিসেপ্টিক অয়েন্টমেন্ট, তুলো আর পরিষ্কার খানিকটা কাপড়।
"তাড়াতাড়ি লাগিয়ে নে।' সে হাঁফাতে হাঁফাতে বললো। আমি কিছুটা অবাক গলায় জানতে চাইলাম ' কোথা থেকে আনলি? ' সে আঙুল তুলে দেখাল ' ওই তো আমার ঘর। ' ক্ষত মুছতে মুছতে , আমি কিছুটা আনমনে বললাম তুই , সবার থেকে এতোদূরে থাকছিস কেনো? জায়গাটা তেমন নিরাপদ নয়।
সে হাসি মেশানো গলায় উত্তর দিল ' আমার মতো জিনিসের আবার নিরাপত্তা! ' এবার, আমি তার দিকে মুখ তুলে তাকালাম কিন্তু চুপ থাকলাম। সে নিজেই আবার শুরু করলো ' কী রে রাগ করলি? ইশ , একেই তুই আমায় পছন্দ করিস না । আমি বুঝি ! আমার ভাষায়ই এমন! কি করবো বল? আসলে আমার মা তো সবসময় বলে যে ভালো জিনিসের দামটাও ভালো লাগবে। হ্যাঁ রে, আমার মা । নিরাপত্তার কথা যে বললি না, তবে শোন।আজ কিছু কথা তোকে বলতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে । আমার মা, ছোটো থেকে সবসময় আমাকে বলতো যে , আমার বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে । কিন্তু আমরা মা, মেয়ে চিরকাল দুজনে দুজনকে দেখবো। একদিন , মা বললো আমায় নিয়ে একটা কাজের জায়গায় যাবে। ঠিকঠাক কাজ করলে টাকা পাবো। টাকার বড্ড অভাব ছিল তো । তখন আমার চোদ্দ বছর। তবু মায়ের হাত ধরে গেলাম সেখানে। আর কাজ শেষ হলে দেখলাম কী জানিস ? রক্ত, রক্ত, রক্ত!আমার মনে, আমার শরীরে! হাতের মুঠোয় পাঁচ' শ টাকা। আমার রক্তের। না 'রে। কাজের দাম! ' কথাগুলোয় যে আমি খুব একটা বিচলিত হলাম তা নয় যদিও , তবু পরিবেশটা একটু হাল্কা করার জন্য বল্লাম' কেমন আছিস ? ' এবার সে হাসলো! তারপর যোগ করলো ' যখন, খুব অভাব ছিল তখন ভাবতাম, যদি আমাদের টাকা থাকত তবে খুব ভালো থাকতাম। আজ তো আমার টাকার অভাব নেই, তাই ভালো আছি! জানিস, আমার কাছে না দুবাই যাওয়ার অফার ছিল। গেলে তো আরও অনেক টাকা হোতো। কিন্তু যাইনি।
আমি, তাচ্ছিল্যর স্বরে জিজ্ঞেস করলাম ' তা, গেলি না কেনো? সে নীচুস্বরে জবাব দিল ' তোর জন্য যাইনি রে। ' এবার আমি রাগত স্বরে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম ' কি বলতে চাস? '
সে ঈষৎ কেঁপে উঠল। বোধহয় চোখগুলো ছলছল করছিল ' কিছুই চাই না রে! এই যে তুই যখন এখানে আসিস তখন তোকে দূর থেকে দেখি। শুধু এইটুকু! কাপড়টা পরিষ্কার । বাঁধতে পারিস। ' খুব শান্ত ভাবে বললো।
ততক্ষণ আমার ওষুধ লাগানো হয়ে গেছে । আমি তেতো গলায় ফেটে পড়লাম ' সে তো দেখতে পাচ্ছি। '
সে আলতো গলায় বললো ' একবার তুই সংস্থার একজনকে বলেছিলি সো ডার্টি প্লেস । পথস্কুলে, আমিও তো কিছুদিন পড়েছি ! তাই !
যাক, তোর এক হাত দিয়ে বাঁধতে অসুবিধা হবে জানি, তবু তুই একাই বেঁধে নে! তাতে রক্ত বন্ধ হবে। কারণ আমি তোকে ছুঁতে পারবো না রে! আর একটা কথা, তুই এখন খুব ভালো বাসায় থাকিস বল ?
তার কথা মতো, আমি ভালো বাসায় থাকতে সক্ষম হয়েছিলাম। কিন্তু ভালোবাসাকে চিনতে পারিনি! এই টুসকি কে জানো? কয়েকদিন আগে নিউজএ দেখাচ্ছিল, হোটেলের রুমে একটা মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে। মেয়েটি নিজে কোনোকিছুর সাথে যুক্ত না থাকলেও, গ্যাংওয়ারের শিকার। তোমরা আবার বললে যে এসব মেয়েদের সাথে এরকমটাই হয়! সেই ছিল টুসকি। আমি তোমাদের পরিচয় দিতে পারিনি গো ।
মিন্টুদা আমি দার্শনিক নই। তবে, চিরকালই বিশ্বাস করেছি যে ভালোবাসা খুব দামী। টুসকির কাছেও নিশ্চয় খুব দামী ছিল। তাই , তার ভালোবাসা অপবিত্র হয়ে যেতে পারে, সেই ভয়ে সে আমায় সামান্য স্পর্শও করেনি। আর ইরাবতী যখন আমার বাইকে বসেছে বা আরো.... কিছু সময়ে মনে হয়েছে, আমার লোহিত কণিকার আর এক নাম - প্রেম, ভালোবাসা । যা আমার শরীরে বইছে। কিন্তু , তখন তাকে চিনতে পারিনি। আর আজ যখন তাকে চিনতে পারলাম তখন বুঝলাম সে আর আমার আর শরীরে বইছে না। এখন তুমিই বল, যদি কোনো মানুষর রক্ত থেকে লোহিত কণিকা বের হয়ে যায়, আর না থাকে, তবে সে কিভাবে বাঁঁচবে? তাই আমিও আর বাঁচতে পারবো না গো। এই দুনিয়ায়, এই জীবনে তো টুসকিকে ভালোবাসতে পারিনি। দেখি, অন্য কোনোখানে তার জন্য একটা ভালো বাসা বানাতে পারি কিনা!
চাকরীতে কাল ইস্তফা দিয়ে দিয়েছি। অল্প যা কিছু তা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার এক্যাউন্টে জমা করেছি।
তোমরা , আমার আর কোনো খোঁজ কোরো না।জানি , আমাদের দেশের পুলিশ আমার মতো একটা মানুষের জন্য কর্মপ্রিয় হয়ে উঠবে না। তবু, মেইল বা হোটাস্যাপে ডকুমেন্ট থেকে যায় । তাতে, আর কিছুই না , তোমাদের অনর্থক খানিকটা ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট হতে পারতো। তাই কাগজেই চিঠি লিখলাম।
সবাই খুব ভালো থেকো।
শুভেচ্ছাসহ
রাজু।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ১০:০৫