somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কালো রঙের কালিমা থেকে আমরা কবে মুক্ত হবো ?

০৪ ঠা জুলাই, ২০১৮ রাত ৮:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




দেবী শক্তির দশ মহাবিদ্যা বা দশ রূপের প্রথম রূপ দেবী কালী। একদিন দেবী কালীর মনে হোলো শিব তাঁকে উপহাস করে 'কালী', 'কালী' বলে ডাকছেন। তাই তীব্র অভিমান ও ক্ষোভে দেবী গৃহত্যাগ করলেন। ঠিক করলেন সাধনা করে সুন্দরী হবেন। কঠোর তপস্যা করে তিনি হলেন গৌর বর্ণা ত্রিভুবন মোহিনী দেবী ষোড়শী। এই রূপের অনেক ব্যাখ্যা আছে। তবে প্রধান বর্ণনা হোলো গৌরবর্ণা ।
তারমানে বোঝা গেলো কালো রূপ অসুন্দর!তাই যুদ্ধ জিতে অসুর নিধন করেও কালী সুন্দর হতে পারেননি। উত্তরটা খুঁজতে এবার সমাজের দিকে তাকানো যাক । দেখা যাবে একনিষ্ঠ কালী উপাসকও মায়ের পায়ে পূজা দিয়ে ফর্সা ছেলের বৌ খুঁজতে ছোটেন!
কেনো? সেটা ভাবলে দেখা যায় শুধু এই একটা পুরাণ কথা নয় । মেয়েদের সুন্দরী বোঝাতে গৌর বর্ণের দিকে ঝোঁকা হয়েছে। সীতা তো কাঞ্চন বর্ণাই , রাধাও তাই। মেঘবরণ কৃষ্ণর পাশে রাধাকে বিদ্যুতের সাথে তুলনা করা হয়েছে । আর দ্রৌপদী হলেন তপ্তকাঞ্চনবর্ণাভ। এখনে কবি বলেননি সোনাটা ভস্মীভূত বা ঠিক কতটা গরম। সোনা গরম হলেই কালো হয় না। বাদামী বলা যেতে পারে। কৃষ্ণর সখি বলে তিনি কৃষ্ণা। আবার শ্যামা রঙের ব্যাখ্যা একেকজন একেকরকম দিয়েছেন। যার কোনোটার মানে কালো নয়। মেঘদূতর ' তম্বী শ্যামা শিখরদশনা'র অর্থ ব্যাখ্যা করা হয়েছে , - যে নারীকে স্পর্শ করলে শীতে উষ্ণ আর গরমে শীতল লাগে । শুধু এসব কাব্য বা মহাকাব্য নয় রূপকথা থেকেই সৌন্দর্য্যের একমাত্রিক ধারনা তৈরী করা হয়। সচেতন বা অসচেতন ভাবে ঢোকানো হয় বর্ণবিদ্বেষ এমনকি শ্রেণী বিদ্বেষও।
ছোটো বেলায় আমার মাসীমনি আমাকে রাগানোর জন্য বলতো তুই দুষ্টুমি করলেই গল্পে কালো আর বিচ্ছিরি রাজপুত্র চলে আসবে। আমি আবার ছোটো থেকেই দমবার পাত্রী নই। আশাবাদী। তাই বলতাম সে তো ফ্রগপ্রিন্স। পরে সুন্দর হয়ে যাবে। তাও যখন মাসীমনি বলে যেতো এই রাজপুত্রটা কালো আর বিচ্ছিরি থাকবে তখন নাকি আমি কাঁদতে শুরু করতাম। কালোর ভয়ের আরেকটা উদাহরণ দেই। ছোটোবেলায় সাজুনিও ছিলাম খুব। আর লিপস্টিক তো অবসেশন ছিল। অল্পে পোষাতো না লাউড করে লাগানো চাই। এটা থেকে আমাকে যখন বিরত করা যাচ্ছিল না তখন বলা হয়েছিল ছোটোরা বেশী লিপস্টিক লাগালে কালো হয়ে যায়। ব্যস সাথে সাথে ওষুধে কাজ হয়েছিল !
এই দুটো ব্যক্তিগত উদাহরণ দিলাম ঠিকই তবে আমার মনে হয় এধরনর অভিঙ্গতা অনেকের আছে। এর থেকে বোঝা যায় সমাজ সৌন্দর্য্যের মাপকাঠি ঠিক করে দিয়েছে। ভাবছেন, আমাদের সমাজ আর কিবা পারে! এবার একটু পাশ্চাত্যর কথা ভেবে দেখুন । সেখানে তো এই বৈষম্য আরও প্রকট। সেখানে বেশীর ভাগ সময়ে গল্পে বা সিনেমায় নেগেটিভ চরিত্র মানেই সে তিমিরবরন হয়ে যায়।
ব্রিটিশরা তো আমাদের ব্ল্যাকি বা কালা আদমি বলত। আর আমরা তো চিরকালই বিভাজন প্রিয় । তাই তখন একজোট হয়ে প্রতিবাদ না করে কালা আদমির শ্রেণী বিন্যাস করেছি। গৌর বর্ণ, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ এবং 'কালো' - নয়কো মোটেই ভালো। সেই ট্র‍াডিশন সমানে চলছে।শুধু শব্দ গুলো বদলেছে। এখন তো আমার গ্লোবাল। তাই বলি ফেয়ার, ব্রাউনি, ডাস্কি। তো এহেন সমাজের পরিত্রাতা হয়েছে এখন ফেয়ারনেস বা যে কোনো ফেয়ারনেস কসমেটিক্স। হ্যাঁ ব্যস একটু খানি লাগান আর আপনার চাকরী পাওয়া, বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড জোটানো আটকায় কে? তিনিই সকলের ভরসা । তাই , মেয়েদের সাথে ছেলেরাও পাল্লা দিয়ে এইসব প্রোডাক্টের স্মরণাপন্ন হচ্ছেন । এখন একটু খোঁজ করলেই দেখা যাবে যে বাড়িতে চালও পরিমাপ মতো নেই সেই বাড়িতেও ফেয়ারনেস ক্রিমের একটা ছোটো টিউব আছে ।

আর যারা এই পরিত্রাতার জয়জয়কার করেন সেইসব মর্তের দেবীরা গাটেরকড়ি খরচা করে থুড়ি তপস্যা করে কেমন হয়েছেন এবার একটু দেখে নেই।






কাজল - আগে ও এখন




এক টিভি শো-তে শোনা গিয়েছিল পিগি চপসকে নাকি ব্রাউনি শব্দটা শুনতে হয়েছিল । তাই তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন । :(
সেই দুঃখেই বোধহয় পুরোপুরি ফেয়ার হয়ে গেছেন ।



দীপিকার ত্বকের বর্ণ তফাতের কারণ জানা নেই





শিল্পাও একই পথের পথিক





গৌরবর্ণা না হলে কী তিনি স্বপ্ন সুন্দরী হতে পারতেন ? সেটা আপনারা বলবেন । তবে যারা তাঁর স্বপ্ন দেখেন এই সুন্দরী আবার তাঁদের খুব খেয়াল রাখেন। তাই তাঁর দ্রুত গতির গাড়ির ধাক্কায় দুবছরের কন্যা আহত হলে তিনি সেই মরনাপন্ন কন্যাকে লিফট না দিয়ে নিজের সৌন্দর্য্য রক্ষা করতে চলে যান । ঠিকই! উনি স্বপ্নকন্যা। উনি কুৎসিত হয়ে গেলে এতো মানুষের স্বপ্নের কি হবে? আহা রে! কতো বড়ো মন ওনার!



শুনেছি বিপাশা নিজের ত্বকের বর্ণ নিয়ে খুব গর্ব করতেন । তারপর একদিন চুপচাপ নিজেকে বদলে নিলেন

আর লিস্ট বাড়াবো না । শুধু এটা বলতে চাই এনারা কেউই ফর্সা হওয়ার ক্রীম ফেয়ার হননি। প্রত্যেকেই ক্লিনিক্যালি মেলানিন ট্রিটমেন্ট করিয়েছেন।সেই সাথে এটাও মনে করাতে চাই যে , মীনা কুমারী , মধুবালা থেকে মাধুরী দীক্ষিত , করিণা বা ক্যাটরিনা প্রত্যেকেই নিজের দক্ষতায় খ্যাতি অর্জন করেছেন । কেউই শুধু গৌরবর্ণা বলে সফল হননি ।


তাই ভাবার সময় এসেছে যে , কালো রঙের কালিমা থেকে আমরা কবে মুক্ত হবো ?

যেসব ছেলেরা গৌরাঙ্গ হওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন তাঁদের জন্য পরিশেষে আর একবার মহাকাব্যের দিকে ফিরে তাকাই । মহাভারতে অর্জুন মহাবীর ছিলেন । তবে অর্জুন শব্দের অর্থ শ্বেত হলেও তিনি কৃষ্ণবর্ণ ছিলেন । যদিও তাঁকে সুপুরুষ বলে বর্ণনা করা হয়েছে ।কিন্তু হ্যান্ডসাম হওয়ার দরুন মনিপুরের রাজকুমারী চিত্রঙ্গদার সাথে একবছরের কনট্র‌াক্ট ম্যারেজ করা ছাড়া কোনো সুবিধা পাননি । মেহনত করে তাঁকে বীরত্ব অর্জন করতে হয়েছিল । পান্ডবদের মধ্যে সবথেকে হ্যান্ডসাম ছিলেন সহদেব । তবে তাঁকে মহাকাব্যের পার্শ্বচরিত্র হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে । আর মহাভারতে গৌরবর্ণ সুপুরুষ ছিলেন কর্ণ । কিন্তু রূপ তাঁকে কোনো সাফল্যই দেয়নি । জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে তাঁকে হিরো হতে হয়েছিল ।

আর মেয়েদের তো অবশ্যই মনে রাখা উচিত যে গৌরী- দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন বলেই তিনি পূজনীয়া। সেরকমই দেবী কালী রূপেও তিনি রক্তবীজ নামক অসুরকে নিধন করেছিলেন । সেটাও একইরকম কৃতিত্বের । তাই কালী রূপে যদি একজন মহাদেবের মন পাওয়া না যায় তাতে কী কিছু যায় বা আসে ?

ছবি সৌজন্য - ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০১৮ রাত ১০:২৭
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×