somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জ্ঞান-বিজ্ঞানের রাজ্যে মুসলমানঃ উত্থান ও পতন পর্ব-৭

২৪ শে মার্চ, ২০১০ রাত ১০:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চিকিৎসাবিজ্ঞান আর রসায়নবিজ্ঞানে মুসলমান বিজ্ঞানীদের অনন্য অবদানের আলোচনায় কেটে গেল তিন-তিনটি পর্ব। এবার, পদার্থবিজ্ঞানের দিকে নজর দেয়া যাক।

পদার্থবিজ্ঞান(Physics) হচ্ছে পদার্থ ও তার গতির বিজ্ঞান, যা গ্রীক φύσις (ফুসিস-প্রকৃতি) এবং φυσικῆ (ফুসিকে-প্রকৃতি সম্পর্কিত জ্ঞান) থেকে এসেছে। অত্যন্ত বিমূর্তভাবে বলতে গেলে, পদার্থবিজ্ঞান হল সেই বিজ্ঞান যার লক্ষ্য আমাদের চারপাশের বিশ্বকে বোঝার চেষ্টা করা। এটি জ্ঞানের প্রাচীনতম শাখাগুলির একটি, যদিও পদার্থবিজ্ঞান বলতে বর্তমানে যাকে বোঝানো হয় তার জন্ম ষোড়শ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক বিপ্লবোত্তর কালে, যখন এটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণকারী একটি বিজ্ঞানে পরিণত হয়। তবে, এটির সবচেয়ে প্রাচীন উপশাখার আধুনিক নাম জ্যোতির্বিজ্ঞান(Astronomy)। প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা মানুষের আদিমতম কাজের একটি, তবে তার আগে প্রকৃতি নিয়ে গবেষণার সাধারণ নাম ছিল প্রাকৃতিক দর্শন (Natural Philosophy), যাকে ঠিক বিজ্ঞান বলা যায় না। মুসলমানরা পদার্থবিজ্ঞানের দুইটি শাখায় সবিশেষ অবদান রাখেন যার একটি সেই প্রাচীনকাল হতে চলে আসা জ্যোতির্বিজ্ঞান(Astronomy), আর অন্যটি একরকম মুসলমানদের হাতেই শুরু হওয়া আলোকবিজ্ঞান(Optics)।

প্রথমেই আলোকবিজ্ঞান দিয়েই শুরু করা যাক আর সেক্ষেত্রে অবধারিতভাবে যাঁর নাম এসে যায় তিনি হলেন ইব্‌নুল হাইছাম(Ibn Al-Haytham)। তবে, তাঁরও দেড় শতক আগে এক্ষেত্রে পথ চলা শুরু করেন আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবন্‌ ইস্‌হাক আল-কিন্দি(أبو يوسف يعقوب إبن إسحاق الكندي; ৮০১-৮৭৩)। দর্শনে বিশ্বজোড়া অবদান রাখা এই দার্শনিকের চিকিৎসাবিজ্ঞানে অবদানের কথা আমরা আগেই জেনেছি। তিনিই সম্ভবতঃ আলো এবং এর পেছনের বিজ্ঞান সম্পর্কে মুসলমানদের আগ্রহী করে তোলেন। আলো সম্পর্কে অ্যারিস্টটল এবং ইউক্লিডের আপাত বিপরীতধর্মী মতবাদের মাঝে তিনি সামঞ্জস্য আনার প্রচেষ্টা চালান। অ্যারিস্টটল বিশ্বাস করতেন, দেখার জন্য চোখ আর বস্তুর মধ্যবর্তী স্বচ্ছ মাধ্যমটি আলোয় পরিপূর্ণ থাকতে হবে। অন্যদিকে, ইউক্লিড মনে করতেন, চোখ হতে আলো গিয়ে কোন বস্তুর উপর পড়লেই দর্শন(View) সম্ভব। কিন্দী তাঁর ‘কিতাবুল সুয়াআত’(Book of the Rays) গ্রন্থে এর সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেন। এছাড়া, তিনি এসব ক্ষেত্রে পরীক্ষালব্ধ প্রমান ছাড়াই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য পূর্ববর্তী বিজ্ঞানীদের সমালোচনাও করেন।

কিন্দির পরে অন্যেরাও এ বিষয়ে কিছু কিছু কাজ করেন, যদিও সে সবের হদিস পাওয়া যায় না। এজন্য, সে সব কাজে মৌলিকতার অভাব এবং ইব্‌নুল হাইছামের আবির্ভাব- এ দু’টোকেই দায়ী করা যায়। এদের মাঝেও আলী ইবন্‌ সাহল রাব্‌বান আল-তাবারী(أبو سعد العلاء ابن سهل; ৯৪০-১০০০) উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। গোলীয় দর্পণ(Spherical Mirror) এবং লেন্সে(Lens) আলোর গতিপথের ব্যাপারে তাঁর কাজ রয়েছে। কিন্তু, তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে আলোর প্রতিসরণের দ্বিতীয় সূত্রের(Second Law of Refraction) আবিষ্কার। ৯৮৪ খৃষ্টাব্দে তিনি সূত্রটি প্রকাশ করেন যা, ১৬২১ খৃষ্টাব্দে ডাচ্‌ বিজ্ঞানী উইলব্রোর্ড স্নেলীয়াস্‌(Willebrord Snellius; ১৫৮০-১৬২৬) এবং ১৬৩৭ খৃষ্টাব্দে ফরাসী বিজ্ঞানী রেনে দেকার্তে(René Descartes; ১৫৯৬-১৬৫০) কর্তৃক পুনরাবিষ্কৃত হয় এবং বর্তমানে বিজ্ঞানের জগতে স্নেলের সূত্র(Snell’s Law) নামেই পরিচিত!

ইবন্‌ সাহলের প্রতিসরনের দ্বিতীয় সূত্র আবিষ্কার, এখন সেটি স্নেলের সূত্র

আবু আলী আল্‌ হাসান ইবন্‌ আল হাসান ইবন্‌ আল হাইছাম(ابو علي، الحسن بن الحسن بن الهيثم; ৯৬৫-১০৩৯) ছিলেন দশম শতকের বিজ্ঞানের জগতের বড় বড় মহারথীদের একজন। তাঁর অবদান একাধারে চিকিৎসা, শারীরবিদ্যা, গণিত, প্রকৌশল, দর্শন ও মনস্তত্ত্বের মত বিষয়গুলোতে বিস্তৃত ছিল। কিন্তু, সব কিছু ছাড়িয়ে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে, আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে আলোকবিজ্ঞানে তাঁর অপরিসীম অবদানের জন্য অমর হয়ে আছেন। মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানে যেমন ইবন সীনা, রসায়নে আল-রাজী, তেমনি এক্ষেত্রে ইবনুল হাইছাম।

চোখের গঠন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আলোকবিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন নাকি আলোকবিজ্ঞানে কাজ করতে গিয়ে ইবনুল হাইছাম চোখের গঠন অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন, তা জনা যায় না। যতটুকু জানা যায় তা হচ্ছে, তাঁর এই অনুসন্ধিৎসায় চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং পদার্থবিজ্ঞান উভয়ই সমৃদ্ধ হয়েছে। চোখের লেন্সের গঠনকে তিনি মসুরের ডালের সাথে তুলনা দেন, যার আরবী পরিভাষা ‘আদাসা’(عدسة)। ল্যাটিন অনুবাদে তা ‘Lenticulam’ হয়ে বর্তমানে ইংরেজীতে ‘Lens’ শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে। আলো(Light) নিয়ে তাঁর অন্ততঃ ১১টি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। তাঁর এসব গ্রন্থে আলো নিয়ে প্রকাশিত মৌলিক ধারনাগুলো আধুনিক আলোকবিজ্ঞানের অনেক কাছাকাছি। তিনিই সম্ভবত আলোর সরলপথে গমনের(Straight Line Travelling) ব্যাপারে প্রথম ধারনা দেন। আলোর প্রতিফলন(Reflection) এবং প্রতিসরনের(Refraction) সূত্রসমূহ তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন। ‘রিসাতুল ফিশ্‌শফক’(Courses on Twilight) গ্রন্থে তিনি বায়ুমন্ডলের উর্ধ্বসীমা নির্ণয় করেন। ‘মালাকাতে ফি কাউস ফাজ্‌হিন ওয়াল হালাত’(Memior on the Rainbow and the Halo) গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে রঙধনু, বস্তুর ছায়াপাত এবং ‘মাকালাতু ফিল মারাইয়াল মুহ্‌রিকা বিল কুতুওয়া’(Memoir on the Conical Burning Mirrors) গ্রন্থে তিনি আলোর প্রতিফলন, প্রতিসরণ ও প্রতিবিম্বের স্বরূপ এবং এদের সমস্যাসমূহ আলোচনা করেছেন। কিন্তু, এতগুলো কাজের কোনটাই তাঁর মূল অবদান নয়! আলোকবিজ্ঞানে তাঁর অমরত্বের পেছনের দুইটি কারনের একটি হচ্ছে, চোখের দৃষ্টি সম্পর্কে তাঁর প্রস্তাবিত তাত্ত্বিক মতবাদ। এর আগের হাজার বছর ধরে বিজ্ঞানীদের মাঝে প্রচলিত ধারনার(এদের মাঝে অ্যারিস্টটল, টলেমী, ইউক্লিডের মত বিজ্ঞানীরাও ছিলেন) বিপরীতে এসে তিনিই প্রথম বলেন ‘বস্তু হতে আলো এসে আমাদের চোখে পড়লে, তবেই আমরা দেখতে পাই, অন্যথায় নয়।‘ এই মতবাদ আলো সম্পর্কে বিজ্ঞানের ধারাকেই উলটে দেয় এবং এটি আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য। অথচ, ষোড়শ’ শতকের আগ্‌পর্যন্ত ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা একে গ্রহন করতে রাজিই ছিলেন না!

ইবনুল হাইছামের দ্বিতীয় অমর অবদান তাঁর ৭ খন্ডে সমাপ্ত সুবিশাল গ্রন্থ কিতাবুল মানাযির(Kitāb al-Manāẓir‎;كتاب المناظر) যা পরবর্তীতে দ্বাদশ শতকের শেষে কিংবা ত্রয়োদশ শতকের শুরুতে Opticae Thesaurus: Alhazeni Arabis নামে ল্যাটিনে অনূদিত হয়। এ গ্রন্থে তিনি তাঁর প্রস্তাবিত আলোর তত্ত্ব ছাড়াও অন্যান্য আলোকীয় ঘটনার (প্রতিসরণ, প্রতিফলন ইত্যাদি) পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন এবং গণিত ও জ্যামিতির সাহায্যে সে সব প্রমানের চেষ্টা করেছেন। এখানেই থেমে যান নি তিনি। প্রতিটি আলোকীয় ঘটনা(Optical Phenomenon) প্রমানের জন্য তিনি যেসব পরীক্ষা চালিয়েছিলেন সেসবের বর্ণনাও তিনি এতে সংযোজিত করে দিয়েছেন। এর সাহায্যে তিনি যেন সকলকে বলতে চাইছেন, ‘আমার কথা বিশ্বাস না হলে নিজেই পরীক্ষা করে দেখ’। বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রমানে পরীক্ষামূলক প্রমান উপস্থাপনের এটাই সম্ভবতঃ সর্বপ্রথম উদাহরণ। এ কারনেই, এই গ্রন্থকে মহাবিজ্ঞানী আইজাক নিউটনের(Isaac Newton) চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ফিলোসোফিয়া ন্যাচারালিস্‌ প্রিন্সিপিয়া ম্যাথ্‌মেটিকার’(Philosophiæ Naturalis Principia Mathematica) সাথে একই সারিতে তুলনা করা হয় এবং ত্রয়োদশ শতক হতে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত ইউরোপের প্রায় সকল পদার্থবিজ্ঞানী(ফ্রান্সিস বেকন, রজার বেকন থেকে শুরু করে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, কেপ্‌লার, দেকার্তে পর্যন্ত) এই গ্রন্থের নিকট ঋনী বলে বলা হয়ে থাকে।

মানবচক্ষুর গঠন নিয়ে কিতাবুল মানাযিরের একটি পাতা

সর্বকালের অন্যতম সেরা গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ আবু রায়হান মুহাম্মাদ ইবন্‌ আহমাদ আল বিরুনী (ابوریحان محمد بن احمد بیرونی‎; ৯৭৩-১০৪৮) আলোকবিজ্ঞানেও অবদান রেখেছেন। তিনিই প্রথম বলেন যে, আলোর একটি নির্দিষ্ট গতিবেগ রয়েছে এবং এক স্থান হতে অন্যস্থানে যেতে আলোরও সময়ের প্রয়োজন হয়। ইবনুল হাইছাম এবং ইবন্‌ সীনাও এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষন করেন, যদিও তাঁরা কেউই আলোর সুনির্দিষ্ট গতিবেগ কত তাঁ আবিষ্কার করতে পারেন নি। এখানে, বলে রাখা ভাল, আলোর গতি সংক্রান্ত মুসলমানদের এই ধারনাও ইউরোপে গৃহীত হতে হতে সপ্তদশ শতক পেরিয়ে যায়! আলো, আলোক রশ্মি, আলোর গতিপথ ও অন্যান্য সমস্যা নিয়ে আল-বিরুনীর কয়েকটি বই হচ্ছে, ‘তাজ্‌রীদ আল-শাফায়াত ওয়াল আনওয়ার আনিল ফাসায়িহী মুদাওয়ানাতি ফিল আস্‌ফার’, ‘তাহ্‌শিলু আশ্‌শাফায়াত বেয়াব’আদিত তর্‌কে আনিয়স্‌ সা’আত’ এবং ‘তামহিদুল মুস্‌তাকার্‌রে লিমানিল মামারবে’।

আল-বিরুনীর পরে আলোকবিজ্ঞানে মুসলমানদের বড় মাপের কোন কাজের সন্ধান পেতে খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতক এসে যায়। এর মধ্যে অবশ্য আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবন্‌ মাউদ নামের একজন আন্দালুসিয়ান কিছু কিছু কাজ করেন যা ভুলবশতঃ ল্যাটিন অনুবাদের কালে ইবনুল হাইছামের কাজ বলে চালিয়ে দেয়া হয়। কুতুব আল-দীন সিরাজী(قطب‌الدین شیرازی; ১২৩৬-১৩১১) মুসলমানদের স্বর্ণযুগের শেষ দিককার বড়মাপের মনীষী। চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা, সংগীত ও দর্শনে অবদান রাখা এই পারসিক আলোকবিজ্ঞানে ইবনুল হাইছামের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যান। তিনি এবং তাঁর ছাত্র কামাল আল-দীন আল-হাসান ইবন্‌ আলী ইবন্‌ আল-হাসান আল-ফারসী(كمال‌الدين ابوالحسن محمد فارسی; ১২৬৭-১৩১৮) মিলে সর্বপ্রথম রঙধনুর সঠিক আলোকীয় ব্যাখ্যা(Optical Explanation) প্রদান করেন। কামাল আল-দীন তাঁর 'আল-কুরা আল-মুহ্‌রিকা'(Burning Sphere) গ্রন্থে ইবন্‌ সাহলের কাজের এবং 'কিতাব তান্‌কিহ্‌ আল-মানাযির'(The Revision of the Optics) গ্রন্থে ইবনুল হাইছামের কিতাবুল মানাযিরের ভাষ্য প্রদান করেন। আলোকবিজ্ঞানে মুসলমানদের সর্বশেষ বড় কাজটুকু পাওয়া যায় ষোড়শ শতকের তুর্কী বিজ্ঞানী তক্বী আল-দীন মুহাম্মাদ ইবন্‌ মারুফ আল-শামী আল-আসাদী(تقي الدين محمد بن معروف الشامي السعدي; ১৫২৬-১৫৮৫) প্রণীত তিনটি খন্ডের 'কিতাব নুর হাদাক্বাত আল-ইব্‌সার ওয়া নুর হাক্বিক্বাত ওয়াল আন্‌যার'(Book of the Light of the Pupil of Vision and the Light of the Truth of the Sights) নামক সুবিশাল গ্রন্থে। তক্বী এমন এক অসামান্য প্রতিভাধর বিজ্ঞানী যিনি তাঁর সমকালীন বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখাতেই কোন না কোন অবদান রেখেছেন! আলোকবিজ্ঞানে তিনি তাঁর পূর্ববর্তীদের কাজকে অনেকদুর এগিয়ে নিয়ে যান উক্ত গ্রন্থের মাধ্যমে। আলোর প্রকৃতি(Nature), উৎস(Source), সঞ্চরণ(Propagation), গঠন(Structure) এবং প্রতিক্রিয়া(Effects) সংক্রান্ত আলোচনা ছাড়াও তিনি এই গ্রন্থে নানাবিধ আলোকীয় ঘটনাকে বিভিন্ন ক্ষেত্রের জন্য ব্যাখ্যা করেন। বিভিন্ন মাধ্যমের ঘনত্বের সাথে আলোর গতির পার্থক্যের স্বরূপও তিনি আলোচনা করেন। এছাড়া, একেবারে প্রাথমিক যুগের টেলিস্কোপের আলোচনাও তাঁর লেখায় পাওয়া যায়।

মোটাদাগে, আলোকবিজ্ঞানে এই হলো মুসলামানদের অবদানের সারাংশ। এখন, পদার্থবিজ্ঞানের অন্য শাখা জ্যোতির্বিজ্ঞানের দিকে নজর ফেরানো যাক। যদি, বুঝতে ভুল না করি তবে, মানুষ সৃষ্টির পর প্রথম যে মূহুর্তে মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে সুর্য, চন্দ্র এবং হাজারো নক্ষত্রের রূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছিল, জ্যোতির্বিদ্যার সূচনা সেই মূহুর্ত থেকেই। এই লেখার শুরুর দিকে মানব সভ্যতায় বিজ্ঞানের ইতিহাসের সূচনা বলতে গিয়ে জেনেছিলাম, মানব সভ্যতার সূচনা হয়েছে, টাইগ্রিস(দজ্‌লা) এবং ইউফ্রেটিস্‌(ফোরাত) নদীর অববাহিকায় মেসোপটেমিয়া (আজকের দিনের ইরাক) অঞ্চলে। আনুমানিক খৃষ্টপূর্ব ৩৫০০ সালে এখানে জড়জগতের বিভিন্ন পর্যবেক্ষন সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে লিখে রাখার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। একেই বিজ্ঞানের প্রতি মানুষের আগ্রহের সূচনা হিসেবে ধরে নিয়েছিলাম। উক্ত পর্যবেক্ষনসমূহের কিছু কিছু ছিল চন্দ্র, সূর্য এবং নক্ষত্রের ব্যাপারে। পরবর্তীতে মিশর, গ্রীস, রোম, ভারত, চীন, দিক্ষিন আমেরিকা যেখানেই সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে সেখানেই নক্ষত্র বিষয়ে মানুষের আগ্রহ লক্ষ্য করা গিয়েছে। তবে, সেসময় এ পর্যবেক্ষনসমূহ ছিল আজকের দিনের জ্যোতির্বিদ্যা(Astronomy) ও জ্যোতিষশাস্ত্রের(Astrology) সংমিশ্রন এবং ক্ষেত্রবিশেষে এতে জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রাধান্যই বেশী ছিল। এ কারনে, এই দুই শাস্ত্রের মাঝে পার্থক্যটুকু জেনে নেয়া দরকার।

রাতের আকাশে লক্ষ তারার সমাহার, জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রেরনা!

জ্যোতির্বিজ্ঞান হচ্ছে পৃথিবীর বাইরের জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তুসমূহ(Astronomical/Celestial Objects), যেমন- গ্রহ(Planets), নক্ষত্র(Stars), ধূমকেতু(Comets), নীহারিকা(Nebula), নক্ষত্রপুঞ্জ(Star Clusters), ছায়াপথ(Galaxy) প্রভৃতি এবং বিভিন্ন জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ঘটনা(Astronomical Phenomenon) সম্পর্কিত বিজ্ঞান। অন্যদিকে, জ্যোতিষশাস্ত্র হল কিছু পদ্ধতি, প্রথা এবং বিশ্বাসের সমষ্টি যাতে মহাকাশে জ্যোতিষ্কসমূহের আপেক্ষিক অবস্থান এবং তৎসংশ্লিষ্ট তথ্যাদির মাধ্যমে মানব জীবন, মানুষের ব্যক্তিত্ব এবং মানবীয় ও বহির্জাগতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে ভবিষ্যত বাণী করা হয়। অতএব, দেখা যাচ্ছে যে, জ্যোতিষশাস্ত্র যতটা না বিজ্ঞান তার চাইতে বেশী কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাস। প্রাচীনকালের বিজ্ঞানীদের মাঝে এই দুই শাস্ত্রের সমান্তরাল চর্চা দেখতে পাওয়া যায়। তবে, বিজ্ঞানের অনগ্রসরতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং সাধারন মানুষের বিজ্ঞানবিমুখীতা গ্রহ-নক্ষত্রের পাঠকে ঠিক মত বৈজ্ঞানিক ধারায় চালিত হওয়ার সুযোগ দেয় নি। মুসলমানদের মাঝেও এই দুই শাস্ত্রের চর্চা অব্যাহত ছিল। কিন্তু, তাঁরা এই চর্চাকে শুধুমাত্র বিজ্ঞানের পর্যায়েই উন্নীত করেন নি, বরং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন তত্ত্ব ও যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের মাধ্যমে একে বহুদুর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন, যা এক কথায় অভূতপূর্ব। কেমন করে এটি সম্ভব হলো, তা নিয়ে আলোচনা থাকছে পরের পর্বে।

চলবে.....
আগের পর্বগুলোঃ
১. ভূমিকা পর্ব
২. বিজ্ঞানের দর্শন
৩. বিজ্ঞানের ইতিহাস
৪. মৌলিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে অবদান
৫. ব্যবহারিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে অবদান
৬. রসায়নবিজ্ঞানে অবদান
৩২টি মন্তব্য ৩০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×