somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জ্ঞান-বিজ্ঞানের রাজ্যে মুসলমানঃ উত্থান ও পতন পর্ব-১৭

০৫ ই জুলাই, ২০১০ রাত ৯:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জ্ঞানের রাজ্যে উত্থানের কারনঃ তৃতীয় পর্ব

মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে কেউ যদি পৃথিবীর সবচাইতে উন্নত, সম্পদশালী এবং বিস্তৃত একটি সম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি বনে যান, তবে সেই যুবকের মাথায় ভোগ-বিলাস ছাড়া আর অন্য কিছু খেলা করাই অস্বাভাবিক। চতুর্থ আব্বাসীয় খলিফা হারুন আল-রশীদ(هارون الرشيد; ৭৮৬-৮০৯)-এরক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয় নি খুব বেশী। ফলশ্রুতিতে, আরব্য রজনীর কিংবদন্তীতুল্য গল্পগুলোতে অপিরমিত ভোগ-বিলাসের যে উপমা-বর্ণনা দেয়া হয়েছে, তাতে বারবার এসেছে তাঁর নাম। কিন্তু, এই বিলাস-ব্যসনের মধ্য দিয়েও তিনি বিজ্ঞানচর্চার গুরুত্ব বুঝতে ভুল করেন নি। তিনি যে সময়ে ক্ষমতার মসনদে আরোহন করেন, সে সময়ে সৌভাগ্যবশতঃ তিনি একইসঙ্গে বখতইয়াসূ পরিবার এবং বারমাইক পরিবারকে সাথে পেয়েছিলেন। বখতইয়াসূ পরিবারের জ্ঞানসাধনার কথা তো আগেই বলা হয়েছে। আব্বাসীয় শাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম সহযোগী বারমাইকগণ প্রশাসক হিসেবে অনন্য যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন। কিন্তু, এই দুই পরিবারই বিজ্ঞানের উঁচুমানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এঁদের প্রত্যক্ষ উৎসাহে এবং খলিফার পৃষ্ঠপোষকতায় চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান সহ অন্যান্য বিষয়ে কাজ এগিয়ে যেতে থাকে। রোমান সম্রাট শার্লেমেন(Charlemagne; ৭৬৮-৮১৪) এবং ভারতীয় রাজ্যসমূহের সাথে কূটনৈতিক সুসম্পর্কের মাধ্যমে এ সময় মুসলমানদের মাঝে গ্রীক ও ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের আগমনের পথ সুগম হয়ে ওঠে।

হারুন আল-রশীদের দরবারে শার্লেমনের প্রতিনিধিদল

যোগ্য পিতার যোগ্য উত্তরসূরী ছিলেন আল-মা’মুন(ابوجعفر عبدالله المأمون; ৮১৩-৮৩৩)। পিতার রাজত্বকালে জন্মস্থান মার্ভে বসেই তিনি জ্ঞানের সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন এবং নিজের চারপাশে বিজ্ঞানীদের আবাস গড়ে তোলেন। এমনকি খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহনের পরেও প্রথম ছয় বছর তিনি জ্ঞানসাধনার সুবিধার্থে মার্ভে বসেই শাসনকার্য পরিচালনা করেন। অবশেষে, ৮১৯ খৃষ্টাব্দে তিনি স্বীয় পারিষদবর্গকে সাথে করে চলে আসেন বাগদাদ। খলিফা আল-মনসুর বাগদাদের প্রাসাদের পাঠাগার ও যৎকিঞ্চিত অনুবাদের কেন্দ্র হিসেবে যে ‘খিজানাত আল-হিক্বমা’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, প্রপৌত্র আল-মা’মুন তাকে ‘বায়তুল হিক্বমা’(بيت الحكمة‎; Bait al-Hikma) বানিয়ে ছাড়েন। ফলে, অবসর কাটানোর পাঠাগার থেকে এটি পরিণত হয় সমকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গবেষনা কেন্দ্রে! আল-কিন্দী, হুনায়ন ইবন ইসহাক, মুসা আল-খাওয়ারিজমীর মত বিজ্ঞানীরা নিজেদের কাজের জায়গা হিসেবে বায়তুল হিক্বমাকে বেছে নেন। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার বিজ্ঞানের অমূল্য গ্রন্থসমূহ অনূদিত হতে থাকে এখানে। কিন্তু, শুধুমাত্র গ্রীক-পারস্য কিংবা ভারতীয় গ্রন্থসমূহের অনুবাদকেন্দ্র হিসেবে একে বিবেচনাটা এর আসল গুরুত্বের কিছুই বোঝা যাবে না! জ্ঞানীদের আলোচনা, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা, গবেষকদের গবেষনা, অনুবাদকদের অনুবাদ- এই সবকিছু মিলিয়ে এটি বিজ্ঞানী এবং অনুবাদক তৈরীর একটি প্রতিষ্ঠানে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছিল। এ সকল কাজেই সক্রিয় পৃষ্ঠপোষোক হিসেবে মধ্যমনি হয়েছিলেন খলিফা আল-মা’মুন। এখানেই শেষ নয়। তাঁর জ্ঞানের অন্বেষা এতবেশী ছিল যে, বিবদমান বাইজান্টাইন সম্রাজ্যের সাথে যুদ্ধবিরতির শর্তের মাঝে তিনি গ্রীক বিজ্ঞানের পান্ডুলিপিও দাবী করে বসেন। সেইসাথে, উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন একটি প্রতিনিধিদলও প্রেরন করেন, যাঁরা এই পান্ডুলিপি সমূহের মূল্য অনুধাবন করবেন এবং বহন করে নিয়ে আসবেন। এই দলে অন্তর্ভূক্ত ছিলেন ইবন আল-বাত্‌রিক আর হাজ্জাজ ইবন আল-মাতারের মত বড় বড় বিজ্ঞানীরা। মা’মুনের অনুগ্রহে জ্ঞানের সাধক মু’তাজিলা সম্প্রদায় এ সময়েই খ্যাতির চুড়ায় আরোহন করে, যে ব্যাপারে আগেই আলোচনা করা হয়েছে।

মা’মুনের অকালমৃত্যুর পর তাঁর উত্তরসূরী আল-মু’তাসিম(أبو إسحاق عباس المعتصم بن هارون; ৮৩৩-৮৪২) এবং আল-ওয়াছিকের(لواثق; ৮৪২-৮৪৭) সময়েও এ পৃষ্ঠপোষকতার ধারা চলতে থাকে। এমনকি, আল-মুতাওয়াক্কিলকে(المتوكل على الله جعفر بن المعتصم; ৮৪৭-৮৬১) যারা নিষ্ঠুর এবং মু’তাজিলাদের প্রতি খড়গহস্ত বলে নিন্দা করেন, তাঁরাও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর উৎসাহকে অস্বীকার করেন না। তবে, মুতাওয়াক্কিলের পর থেকেই আব্বাসীয় খেলাফতের রঙ-জৌলুস হারাতে শুরু করে। খলিফারা বিভিন্ন গোষ্ঠীর ক্রীড়ানক হয়ে ওঠেন। শাসনক্ষমতা কমে যেতে শুরু করে। এর মধ্য দিয়েও তাঁরা কম-বেশী পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েই যান। এর উজ্জ্বল উদাহরন হচ্ছে সাবিত এবং সিনান পরিবার। সাবিত ইবন ক্বুরা, পুত্র সিনান ইবন সাবিত এবং পৌত্র ইবরাহিম ইবন সিনান ছিলেন একইসঙ্গে চিকিৎসাবিজ্ঞান, দর্শন এবং গণিতের তিন মহাসাধক। এঁরা প্রত্যেকেই সমকালীন আব্বাসীয় খলিফাদের সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছেন।

আব্বাসীয়দের দূর্বলতার কারনে জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল কেন্দ্র বাগদাদের গুরুত্ব হ্রাস পেলেও বিভিন্ন রাজ্যের রাজধানীগুলোতে গড়ে ওঠে নতুন নতুন কেন্দ্র। বু’য়ীদ(آل بویه; Āl-e Buye), মামলুক, সেলজুক(سلجوق; Saljūq), খাওয়ারিজম(خوارزمشاهیان; Khwārezmšhāḥīān), আগ্লাবিদ(الأغالبة), গজনী(غزنویان), সাফাভীদ(صفویان), মুঘল(شاهان مغول; Shāhān-e Moġul) সহ খৃষ্টীয় ষোড়শ শতক পর্যন্ত পৃথিবীর যেখানেই মুসলমানদের একটি স্বায়ত্বশাসিত কিংবা স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাকে কম-বেশী পৃষ্ঠপোষকতা দান করা হয়েছে। একই সময়ে প্রতিষ্ঠিত হলে এসব রাজ্যসমূহ অনেকক্ষেত্রেই পারস্পরিক বিবাদে লিপ্ত ছিল। কিন্তু, বিজ্ঞানের উন্নয়নে প্রায় সকলেই মুক্তহস্ত ছিলেন। আক্রান্ত সিসিলিতে যেখানে আর্কিমিডিসকে নির্মম মৃত্যুর শিকারে পরিণত হতে হয় সেখানে, মুসলমানদের মাঝে বিজিত রাজ্যের বিজ্ঞানীদের আগের চেয়ে বেশী সম্মানের অধিকারী হবার ভুরি ভুরি উদাহরন রয়েছে। খুব বেশী কথা না বলে শুধু সিরিয়ান চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং দার্শনিক ইবন খাম্মারের(?-১০১৯) উদাহরণ দেয়াটাই ভাল হবে। ধর্মে খৃষ্টান এই মনীষী তিন প্রতিদ্বন্দ্বী রাজবংশ বুওয়াহিদ, খাওয়ারিজম এবং গজনীর সালতানাতের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। নির্বিঘ্নে জ্ঞানসাধনার পাশাপাশি তিনি ধর্মের ব্যাপারেও কখনো জোরাজুরির শিকার হন নি। তবে, শেষজীবনে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছিলেন বলে জানা যায়।

যাই হোক, এ সময়কার প্রতিদ্বন্দ্বী সম্রাজ্যসমূহের মাঝে দুইটির কথা আলাদাভাবে বলতেই হয়। একটি হচ্ছে, কর্দোভার উমাইয়া খেলাফত(خلافة قرطبة; ৯২৯-১০৩১); আর অন্যটি হচ্ছে কায়রোর ফাতেমীয় খেলাফত(الفاطميون; ৯০৯-১১৭১)।

দশম শতকের শুরুতে আব্বাসীয় সম্রাজ্যের পতনের যুগে স্পেনের তৃতীয় আবদুর রহমান(عبد الرحمن الثالث‎; ৯১২-৯৬১) এবং তাঁর পুত্র দ্বিতীয় আল-হাকাম(الحكم الثاني; ৯৬১-৯৭৬) জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতার আরেক অনন্য নজির স্থাপন করেন। ৯১২ খৃষ্টাব্দে ক্ষমতায় আরোহন করে আবদুর রহমান ৯২৯ খৃষ্টাব্দে নিজেকে খলিফা ঘোষনা করেন। কর্দোভা বিশ্ববিদ্যালয় এ সময়ে পাশ্চাত্যের একমাত্র আলোকবর্তিকা হিসেবে আবির্ভূত হয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এখানে জমায়েত হচ্ছিলেন জ্ঞানের অন্বেষায়। বাগদাদকেন্দ্রিক যেসব গ্রন্থের অনুবাদ হচ্ছিল সেসব গ্রন্থেরই দ্বিতীয় দফায় অনুবাদ হতে থাকে এখানে। সেইসাথে চলতে থাকে পান্ডুলিপি সংগ্রহ। এই সংগ্রহ এমন এ পর্যায়ে উন্নীত হয় যে, পরবর্তী খলিফা আল-হাকামের সময়ে রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগারের পান্ডুলিপির সংখ্যা ৬,০০,০০০ তে গিয়ে পৌঁছে। ৪৪টি তালিকা গ্রন্থের মাধ্যমে তৎকালীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই গ্রন্থাগারটি খলিফা নিছক শোভা বর্ধনের জন্য রেখে দেন নি। তিনি নিজে যেমনিভাবে এ সকল গ্রন্থের একনিষ্ঠ পাঠক এবং টীকা-ভাষ্য রচয়িতা ছিলেন, তেমনিভাবে সব ধরনের শিক্ষার্থীর জন্য এই গ্রন্থাগারের দরজা খুলে দিয়েছিলেন। এটি ছাড়াও সে সময়ের কর্দোভায় আরও ৭০টি বড়মাপের গ্রন্থাগার ছিল বলে জানা যায়, যেগুলোতে প্রতিনিয়ত গ্রন্থের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ফলে, আক্ষরিক অর্থেই কর্দোভা শহরটিই একটি বিশাল বইয়ের বাজারে পরিণত হয়। জ্ঞানসাধনার প্রতি আল-হাকামের এই পৃষ্ঠপোষকতা কেবলমাত্র আব্বাসীয় খলিফা আল-মা’মুনের সাথেই তুলনীয়। আল-হাকামের পর তাঁর উত্তরসূরীরাও এ কাজ অব্যাহত রাখেন। ১০৩১ খৃষ্টাব্দে উমাইয়া শাসনের পতনের পর পুরো আন্দালুস(স্পেন) বিবদমান অনেকগুলো ছোট ছোট রাজ্যে(তাইফাঃ طائفة‎; tā'ifa) বিভক্ত হয়ে যায়। কিন্তু, এই সব ক্ষুদ্র রাষ্ট্রেও বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা থেমে থাকে নি। ফলে, সেভিল, টলেডো, গ্রানাডা প্রভৃতি নগরীতে বিজ্ঞানের সাধনা অব্যাহত থাকে ১৪৯২ খৃষ্টাব্দ অব্দি। ইবন বাজ্জাহ্‌(ابن باجة‎; ১০৯৫-১১৩৮), ইবন তুফায়েল( ابن طفيل; ১১০৫-১১৮৫) এবং ইবন রুশদের(ابن رشد‎; ১১২৬-১১৯৮) মত মহামনীষীরা এ সব ছোট রাজ্যের নৃপতিদেরই পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন।

আল-আন্দালুসের(স্পেন) মুসলিম তাইফা রাজ্যসমূহ

যে সময়ে স্পেনে উমাইয়া খেলাফতের যাত্রা শুরু হয়েছে, সে সময়ে কায়রোতে ফাতেমীয় খেলাফতকাল চলছে। ৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হবার পর পরবর্তী এক শতকে এটি মিসর, উত্তর আফ্রিকা, আরব উপদ্বীপ, সিরিয়া, লেবানন সহ এই বিশাল এলাকায় এক অনন্য সভ্যতার নজির স্থাপন করে। ৯৭০ খৃষ্টাব্দে খলিফা আল-মুঈজ লি দ্বীনিল্লাহর(معد المعز لدين الله‎; ৯৩২-৯৭৫) প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হয় আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় যা আজো টিকে আছে। বাগদাদের সুবিখ্যাত ‘বায়তুল হিক্বমা’র আদলে কায়রোতে গড়ে ওঠে ‘দারুল হিক্বমা’। পরবর্তীতে খলিফা আল-হাকিমের(الحاكم بأمر الله; ৯৯৬-১০২১) সময়ে এই পৃষ্ঠপোষকতা সর্বোচ্চ চূড়ায় গিয়ে পৌঁছে। তাঁর আগ্রহে কায়রো নির্মিত হয় মানমন্দির, যেখানে গবেষনা করেন সমকালীন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইবন্‌ ইউনুস(ابن يونس; ৯৫০-১০০৯)। তাঁর রচিত ‘আল-জিজ্‌ আল-কবির আল-হাকিমী’(آل الزيج الكبير الحكيمي) গ্রন্থটি আল-হাকিমের সম্মানেই রচিত হয়। এছাড়া ইবন আল-হাইছাম(ابو علي، الحسن بن الحسن بن الهيثم; ৯৬৫-১০৩৯)ও আল-হাকিম সহ অন্যান্য ফাতেমীয় খলিফাদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন।

এদিকে, ১৫১৭ খৃষ্টাব্দে উসমানীয় খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরবর্তী দুই শতক ধরে এটি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী সামরিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এর পাশাপাশি এখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতাও থেমে থাকে নি। অবশ্য, খেলাফত গ্রহনের আগে থেকেই এই পরিবার বিজ্ঞানের গুরুত্ব বুঝতেন। আলী কুশী(১৪০৩-১৪৭৪) ছিলেন একজন সনামধন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ, যিনি উলুঘ বেগের সাথেই কাজ করছিলেন। উলুঘ বেগের অকালমৃত্যুতে তৎকালীন উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদ তাঁকে ইস্তাম্বুল নিয়ে আসেন। এ সময়ে তাঁর সাথে তাঁর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্র এবং সহকারীও ইস্তাম্বুলে এসে আবাস গড়েন। ফলে, সেখানকার বিজ্ঞান সাধনায় এক নতুন প্রানের সঞ্চার হয়। সে সময় হতে ষোড়শ শতকের তক্বী আল-দীন মুহাম্মাদ ইবন্‌ মারুফ(تقي الدين محمد بن معروف الشامي السعدي; ১৫২৬-১৫৮৫) পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক বিজ্ঞানীর আবির্ভাব ঘটেছে যাঁরা সমকালীন সুলতান কিংবা খলিফার অনুগ্রহ লাভ করেছিলেন, যদিও পরের দিকে মূল বিজ্ঞানের চাইতে বিজ্ঞানের প্রয়োগ বা প্রযুক্তির দিকেই খলিফাদের আগ্রহ বেশী দেখা গিয়েছে।

ভারতবর্ষে মুঘল আমলে স্থাপত্য, চিত্রকলা সহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া গেলেও বিজ্ঞানের গবেষনায় ততটা আগ্রহ কিংবা আনুকূল্য দেখতে পাওয়া যায় নি। এর মাঝেও ১৭২০ খৃষ্টাব্দে সম্রাট মুহাম্মাদ শাহের(محمد شاه; ১৭১৯-১৭৪৮) দরবারে প্রনীত হয় ‘জিজ্‌ মুহাম্মাদ শাহী’, যাতে তৎকালীন পাশ্চাত্যের জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক তালিকাসমূহ সংশোধন করা হয়। ঐতিহাসিকগণ একে বিজ্ঞানের জগতে মুসলমানদের ‘শেষ স্ফুলিঙ্গ’(The last Flicker) বলে চিহ্নিত করেছেন।

বিজ্ঞানচর্চার প্রতি মুসলামান শাসকদের ব্যক্তিগত আনুকূল্যের অনেক লম্বা ইতিহাসের চুম্বক অংশই এখানে তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে। এর বাইরেও অনেক উদাহরন রয়েছে, যা সমকালীন শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধ করে তোলে। কিন্তু, এত কিছু সত্ত্বেও বিজ্ঞানের জগতে মুসলমানদের সদর্প পদচারনা সম্ভব হোত না যদি না তাঁরা প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের কাজসমূহের অনুবাদে পৃষ্ঠপোষকতা পেতেন। সত্যিকার অর্থে, অনুবাদের কাজে মুসলমান শাসকেরা যে পরিমান সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন তার তুলনা নেই। এরই ফলশ্রুতিতে এই কাজ তিন শতাব্দী ব্যাপী একটি আন্দোলনে রূপ নেয় এবং বিজ্ঞানের রাজ্যে মুসলমানরা হয়ে ওঠেন একক অধিশ্বর। এ আন্দোলনের গল্প আসছে পরের পর্বে।

চলবে.....
আগের পর্বগুলোঃ
১. ভূমিকা পর্ব
২. বিজ্ঞানের দর্শন
৩. প্রাচীন বিজ্ঞানের ইতিহাস
৪. মৌলিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে অবদান
৫. ব্যবহারিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে অবদান
৬. রসায়নবিজ্ঞানে অবদান
৭. আলোক-বিজ্ঞানে অবদান
৮. জ্যোতির্বিজ্ঞানে অবদান- প্রথম পর্ব
৯. জ্যোতির্বিজ্ঞানে অবদান- দ্বিতীয় পর্ব
১০. গণিতে অবদান
১১. ইসলামে বিভিন্ন দর্শনের উদ্ভব ও বিকাশ
১২. ইসলামে বিভিন্ন সম্প্রদায়গত দর্শনের সারসংক্ষেপ
১৩. মু’তাজিলা দর্শন এবং স্বাধীন দার্শনিকদের উদ্ভব
১৪. মুসলমান দার্শনিকেরা
১৫. জ্ঞানের রাজ্যে উত্থানের কারনঃ প্রথম পর্ব
১৬. জ্ঞানের রাজ্যে উত্থানের কারনঃ দ্বিতীয় পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুলাই, ২০১০ রাত ৯:৩৯
৪১টি মন্তব্য ৩৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×