বীর কানু আর বীর সিধু
দিবাসী শব্দটার সঙ্গে তো তোমরা সবাই কম বেশি পরিচিত! এদেশের এমনই এক আদিবাসী জনগোষ্ঠী হলো সাঁওতাল। বাংলাদেশের রাজশাহী, বগুড়া, দিনাজপুর ও রংপুর জেলায় সাঁওতালরা বাস করে। ভারত উপমহাদেশের প্রাচীনতম অধিবাসী হলো এই সাঁওতালরা। কিভাবে তাদেরকে চিনবে? সাঁওতালদের গায়ের রং কালো, চুল কালো ও কোঁকড়া, নাক আর ঠোঁট কিছুটা মোটা হয়।
অন্যান্য সব আদিবাসীদের মতো সাঁওতালদেরও কিন্তু আছে নিজস্ব ঐতিহ্য। তবে সবার চেয়ে সাঁওতালরা ঐতিহ্যের দিক থেকে এগিয়ে। কেনো? তাই তো আজ আমরা শুনবো।
এমনিতে সাঁওতালরা কিন্তু খুবই সহজ সরল এক আদিবাসী জনগোষ্ঠী। সহজ সরল আর প্রচণ্ড পরিশ্রমী। কাজের সময় ছেলেতে মেয়েতে কোনো ভেদাভেদ নেই তাদের মধ্যে। সবাই মিলেই কাজ করে সাঁওতালরা। বাংলাদেশের বাইরে ভারতেও সাঁওতালরা বসবাস করে। ভারতের অনেক জায়গাতেই আছে সাঁওতাল পল্লী, যে গ্রামে সাঁওতালরাই বেশি, সেই জনপদ বা গ্রামকে বলা হয় সাঁওতাল পল্লী।
সাঁওতালদের ঐতিহ্যের কথা বলছিলাম, এবারে শোনো, তারা কেনো সবার চেয়ে এগিয়ে। দুই বীর যোদ্ধার গল্পেই তোমরা তা জেনে যাবে। নাম তাদের কানু আর সিধু। তাদের আরো দুই ভাই ছিলো। চাঁদ আর ভৈরব। বাবার নাম চুনার মুরমু। বসবাস ভগনাডিহি গ্রামে। বাবা চুনার মুরমু ছিলেন ভগনাডিহি গ্রামের মোড়ল। এ কাহিনীর শুরু সেই ১৮৫৫ সালে।
অবশ্য এর অনেক আগে থেকেই সাঁওতালরা অত্যাচারী ইংরেজ শাসক আর জমিদার মহাজনদের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত ছিলো। সাঁওতালরা সহজ সরল হলে কি হবে, তারা খুবই স্বাধীনচেতা হয়। কারো বশ্যতাই স্বীকার করতে চায় না। তাই ইংরেজরা শত চেষ্টা করেও তাদেরকে শাসনের অধীনে আনতে পারছিলো না। শেষমেশ তারা সৈন্য পাঠালো। ক্যাপ্টেন ব্রুকের নেতৃত্বে একদল সৈন্য সাঁওতালদের দমন করতে গেলো। সেটা ১৭৭২ সালের কথা। আর তখন থেকেই শুরু হলো ইংরেজদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংগ্রাম। একপাশে বৃটিশ সৈন্যদের ভারী অস্ত্রশস্ত্র, অন্যদিকে সাঁওতালদের সাধারণ তীর-ধনুক।
শেষে অনেক কৌশলের আশ্রয় নিয়ে ইংরেজরা সাঁওতালদেরকে কায়ক্লেশে তাদের অধীনে আনলো। অবশ্য তারা সাঁওতালদের সরলতার সুযোগ নিয়ে, তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেই তা পেরেছিলো। তারা সাঁওতালদেরকে বর্তমান ভারতের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম আর ভাগলপুরের বিশাল অঞ্চল দিলো, যার প্রায় পুরোটাই ছিলো পাহাড়ি বনাঞ্চল। কথা ছিলো সেখানে চাষবাস করলে সাঁওতালদের খাজনা দিতে হবে না। তাই সাঁওতালরা ক্রমশ বনভূমিতে জঙ্গল কেটে সাফ করে গ্রাম প্রতিষ্ঠা করলো। কিন্তু তার কিছুদিন পরেই ইংরেজরা তাদের প্রতিশ্রæতি ভঙ্গ করে খাজনা আদায় করা শুরু করলো। শুধু তাই না, তারা ধীরে ধীরে খাজনার পরিমাণও বাড়াতে শুরু করলো। ১৮৫৪-৫৫ সালে খাজনার পরিমাণও যেমন বেড়ে গেলো অনেক, তেমনি বেড়ে গেলো খাজনা আদায়ের জন্য সাঁওতাল কৃষকদের উপর অত্যাচারও। এমনি পরিস্থিতিতে দুই ভাই সিধু আর কানু ডাক দিলো বিদ্রোহের।
১৮৫৫ সালের ১৫ জুন সিধু-কানু সাঁওতাল গ্রামে গ্রামে ‘গিরা’ পাঠালেন। গিরা হলো শালগাছের ডাল। সাঁওতালদের কাছে গিরা পাঠানোর মানে হলো ধর্মীয় আহ্বান জানানো। সিধু-কানু সকল সাঁওতালদের ধর্মের নামে ডাক দিলেন। আদিবাসীদের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, তারা কখনো তাদের ধর্মের ডাক আর গোত্রের ডাক উপেক্ষা করে না। আর তাই পুরো বনাঞ্চলে আওয়াজ উঠলো, চলো, চলো, ভগনাডিহি চলো।
১৮৫৫ সালের জুন মাসের ৩০ তারিখ, ভগনাডিহি গ্রামে প্রায় ১৫হাজার সাঁওতাল জড়ো হলো। হাতে তাদের তীর-ধনুক, টাঙ্গি-কুড়াল, ধামসা আর মাদল। আর সিধু-কানু তাদের সবাইকে বললেন, কিভাবে তারা প্রতারিত হচ্ছে। তাদের কষ্ট করে জঙ্গল কেটে তৈরি করা জমি কিভাবে তাদেরকে না দিয়ে জমিদাররা নিয়ে নিচ্ছে। স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার ডাক দিলেন এই দুই বীর। আর তাদের জ্বালাময়ী ভাষণে ১৫ হাজার সাঁওতাল গর্জে উঠলো। তারা ঠিক করলো কলকাতা অভিমুখে পদযাত্রা করবে।
সিধু-কানুর নেতৃত্বে প্রায় ৩০ হাজার সাঁওতাল একসঙ্গে হেঁটে হেঁটে কলকাতার দিকে রওয়ানা দিলো। তবে সঙ্গে নিয়ে আসা খাবার শেষ হয়ে যাওয়ার পর কিছু বিশৃক্সখলা দেখা দিতে লাগলো। কিন্তু পথের মাঝেই খবর আসলো যে, দুইজন সাঁওতালকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সিধু-কানু খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলেন, তাদেরকে উদ্ধার করে আনতে হবে। তারা দুই সাঁওতালকে নিয়ে যাওয়ার সময় দারোগার পথরোধ করলেন।
দারোগা তো প্রথমটা হকচকিয়েই গেলো। সে ভাবতেও পারেনি সহজ সরল সাঁওতালরা এমন রণমূর্তি নিতে পারে। সিধু-কানু তার হাত থেকে বন্দী দুই সাঁওতালকে মুক্ত করে নিলেন। রেগেমেগে দারোগা তাদেরকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিলো। সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজিত সাঁওতাল বিদ্রোহীরা তাকে আর তার সঙ্গীকে মেরে ফেললো। সেদিন ছিলো ৭ জুলাই। সিধু-কানু ঘোষণা দিলেন, আজ থেকে এখানে কোনো সরকার নেই। এবার সাঁওতালদের রাজত্বের সময়।
এবার সাঁওতালরা সিধু-কানুর নেতৃত্বে কুখ্যাত কুখ্যাত সব মহাজনদের ধরে ধরে শাস্তি দিতে লাগলো। এসব মহাজনরা এতোদিন তাদের সরলতার সুযোগ নিয়ে অত্যাচার করে যাচ্ছিলো।
১১ জুলাই তারা পাকুরের রাজবাড়ি আক্রমণ করলো। ১৫ জুলাই পাকুরের তরাই নদীর তীরে ইংরেজদের সঙ্গে সাঁওতালদের এক বিশাল যুদ্ধ হলো। এ যুদ্ধে অবশ্য সাঁওতালরা জিততে পারেনি। অসংখ্য সাঁওতাল যুদ্ধে মারাও গিয়েছিলো। আহত হয়েছিলেন সিধু, কানু আর ভৈরব।
কিছুদিন পরে ফুদকিপুরের কুখ্যাত কুঠিয়াল লারকিন্স তার লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে সাঁওতালদের মুখোমুখি হয়। যুদ্ধে তার শোচনীয় পরাজয় ঘটে। সে আর তার ছেলে সাঁওতালদের হাতে মারা যায়।
এবারে সাঁওতালদেরকে দমন করতে ১৬ জুলাই মেজর বরোজ এক বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে পিয়ালপুরে ঘাঁটি গাড়েন। সঙ্গে ছিলেন মেজর স্টুয়ার্ট আর কর্নেল জেন্স। কাছেই এক পাহাড়ের উপর ছিলো সাঁওতালদের ঘাঁটি। বিশাল সৈন্যবাহিনী বন্দুক-কামান নিয়েও তীর-ধনুক নিয়ে যুদ্ধ করা সাঁওতালদের সঙ্গে জিততে পারলো না। দীর্ঘ ৫ ঘণ্টার যুদ্ধ শেষে মেজর বরোজের বিশাল সৈন্যবাহিনী হেরে গেলো।
এই যুদ্ধে জিতে সাঁওতালদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেলো। ২১ জুলাই কাতনা গ্রামে একদল পুলিশের সঙ্গে বিদ্রোহীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ হলো। যুদ্ধে পুলিশরা হেরে গেলো। এদিকে ক্রমশ দুর্বার হয়ে ওঠা বিদ্রোহীদের দমন করতে লেফটেন্যান্ট টোলমাইন ও রাইকস এক বিরাট সৈন্যদল নিয়ে হাজির হলেন। কিন্তু এবারও বিধিবাম। সাঁওতালদের কাছে খয়রাশোলে প্রচণ্ড যুদ্ধে হেরে গেলো ইংরেজরা। লেফটেন্যান্ট টোলমাইন যুদ্ধের ময়দানেই মারা গেলেন।
যুদ্ধে না পেরে ইংরেজরা এবার অন্য কৌশল নিলো। কাপুরুষের মতো তারা সাঁওতাল পল্লীতে আগুন ধরিয়ে বৃদ্ধ, নারী, শিশুদের হত্যা করতে শুরু করলো। একের পর এক পুড়িয়ে দিতে লাগলো সাঁওতাল পল্লী। আর তারপর ১৭ আগস্ট বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণ করতে বললো। স্বাধীনচেতা সাঁওতালরা সিধু-কানুর নেতৃত্বে সে ঘোষণাকে ঘৃণা
অক্টোবর মাসের শেষের দিকে সিধু-কানুর নেতৃত্বাধীন সাঁওতালরা সংগ্রামপুরের কাছে এক পাহাড়ের গোড়ায় ঘাঁটি গাড়লো। অন্যদিকে ইংরেজরাও অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এক বিশাল বাহিনী নিয়ে জমায়েত হলো। সমস্ত বনভূমি নাগাড়া আর মাদলের শব্দে কেঁপে উঠলো। যুদ্ধ শুরু হলো। ইংরেজরা কামান আর বন্দুক নিয়ে পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হলো। আবারও কৌশলের আশ্রয় নিলো চতুর ইংরেজরা। বিদ্রোহীরা ১০০ গজের ভেতরে আসামাত্রই তারা ফাঁকা গুলি করতে শুরু করলো। আর গুলি গায়ে লাগছে না দেখে সহজ সরল সাঁওতালরা মনে করলো তাদের দেবতা তাদের সঙ্গে আছেন। তিনিই গুলি হাওয়া করে দিচ্ছেন। তারা দলে দলে পাহাড় থেকে নেমে এসে ইংরেজদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করলো। আর এরই মধ্যে ইংরেজরা বন্দুকে গুলি ভরে সাঁওতালদের নির্বিচারে গুলি করে মারতে শুরু করে দিলো। তাদের রক্তে সংগ্রামপুরের মাটি লাল হয়ে গেলো। গুলিবিদ্ধ হয়ে সিধু-কানু দুই ভাই-ই গুরুতর আহত হলেন। তবু সাঁওতালরা আক্রমণ চালিয়ে যেতে লাগলো। একের পর এক ইংরেজ সৈন্য মারা পড়তে থাকলো। অবশেষে সাঁওতালরা ফিরে যেতে শুরু করলে ইংরেজরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
কিন্তু সংগ্রামপুরের যুদ্ধে জিতে ইংরেজদের কোনো লাভই হলো না। সাঁওতালরা তারপরও সিধুু-কানুর নেতৃত্বে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে লাগলো। এবার তারা কৌশল পরিবর্তন করলো। এবার গেরিলা হামলা শুরু করলো সাঁওতালরা। দিশেহারা হয়ে ইংরেজ সরকার ১০ নভেম্বর সামরিক শাসন জারি করলো। সেই সঙ্গে আবার শুরু হলো সাঁওতালদের উপর অমানুষিক অত্যাচার।
১৮৫৬ সালের ৩ জানুয়ারি সামরিক শাসন তুলে নেয়া হলো। আর ২৩ জানুয়ারি থেকে আবার শুরু হলো সাঁওতালদের গেরিলা আক্রমণ। ইংরেজ বাহিনী গেরিলা আক্রমণের চোটে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো। ২৭ জানুয়ারি লেফটেন্যান্ট ফেগানেরর বাহিনীর সঙ্গে ভাগলপুরে সাঁওতালদের মুখোমুখি যুদ্ধ হলো। যুদ্ধে মারা গেলেন সিধু-কানুর দুই ভাই চাঁদ ও ভৈরব। শুধু সিধু-কানুর ভাই-ই না, তারা ছিলেন সাঁওতালদের দুইজন বীরযোদ্ধা।
এসময় সিধু-কানুর খোঁজে ইংরেজ সৈন্যরা গ্রামে গ্রামে হানা দিতে শুরু করলো। সাঁওতালদের উপর চালাতে লাগলো অমানুষিক নির্যাতন। সে নির্যাতন সইতে না পেরে কয়েকজন সাঁওতাল সিধু-কানুর গোপন আস্তানার খবর ইংরেজ সৈন্যদের বলেই দিলো। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ইংরেজ সৈন্যরা সিধুকে তার গোপন আস্তানা থেকে গ্রেফতার করে সেখানেই গুলি করে মেরে ফেলে । আর তার পরের সপ্তাহে বীরভূমের জামতারা থেকে পুলিশ কানুকে গ্রেফতার করে। পরে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। এই দুই বীর নেতার মৃত্যুর পর বিদ্রোহী সাঁওতালরা পরাজয় মেনে নেয়। এই বিদ্রোহে প্রায় ২৫ হাজার সাঁওতাল মারা গিয়েছিলো।
কী খুব কষ্ট হচ্ছে সিধু-কানুর জন্য? কতো কষ্টই না করেছিলেন তারা তাদের গোত্রের মানুষদের কষ্ট লাঘব করার জন্য। অথচ শেষমেশ তাদেরকে কী পাশবিক ভাবে মেরে ফেলা হয়েছে। অবশ্য তাদের আত্মদান একেবারে বৃথা যায়নি। এখনো সিধু-কানুকে সাঁওতালরা তাদের বুকের মাঝে ভালোবাসা দিয়ে লালন করে রেখেছে। আর সারা পৃথিবীর মানুষ বিশেষ করে এই উপমহাদেশের মানুষ সিধু-কানুর স্মৃতি এখনও ধারণ করে আছে। যে দিনটিতে তারা প্রথম সাঁওতালদেরকে বিদ্রোহের জন্য ডাক দিয়েছিলেন, সেই দিনটিকে বিশেষ দিন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রত্যেক বছর ৩০ জুন সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে থাকে।