রাজধানীর কলাবাগানে দুর্বৃত্তদের হামলায় গত সোমবার সন্ধ্যায় নিহত হন জুলহাস মান্নান (৩৫) এবং তাঁর সঙ্গী মাহাবুব রাব্বি তনয় (২৬)। তাঁরা দুজনই ছিলেন বাংলাদেশে হিজড়া ও সমকামীদের অধিকারবিষয়ক ম্যাগাজিন ‘রূপবান’ প্রকাশনার সঙ্গে জড়িত।
জুলহাস ছিলেন ম্যাগাজিনটির সম্পাদক, আর লোকনাট্যদলের সদস্য তনয় সরাসরি যুক্ত না থাকলেও এর প্রকাশনায় সহযোগিতা করতেন বলে জানা গেছে।
নিহত জুলহাস মান্নান কেবল ‘রূপবান’ ম্যাগাজিনের সম্পাদকই ছিলেন না, তাঁর আছে আরও পরিচয়। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনির আপন খালাতো ভাই তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডিতে কর্মরত ছিলেন। এর আগে ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনার প্রটোকল কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
কলাবাগানের তেঁতুলতলা গলির আছিয়া নিবাস নামের ৩৫ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয়তলায় নিজ ফ্ল্যাটে বন্ধু তনয়কে নিয়ে একসঙ্গে থাকতেন জুলহাস।
নিহত জুলহাসের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে। তবে বড় হয়ে উঠেছেন ঢাকাতেই। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। ২০০৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার পর একাধিক এনজিওতে চাকরি করেছেন। ২০০৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে প্রটোকল অ্যাসিসটেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। এরপর যোগ দেন ইউএসএআইডিতে। ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত সমকামী, হিজড়া এবং মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা ‘ভয়েজ অব বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠনের সঙ্গেও কাজ করেছেন জুলহাস।
বাবা আবদুল মান্নান সাবেক সরকারি কর্মকর্তা। দুই ভাই ও এক বোনের পরিবারে জুলহাস ছিলেন সবার ছোট। তাঁর বড় ভাই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক সহ-সভাপতি মিনহাজ মান্নান ইমন। মেজ ভাই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।
জুলহাসের সঙ্গে নিহত তনয় নাট্যসংগঠন লোকনাট্যদলের শিশু সংগঠন পিপলস থিয়েটারে জড়িত ছিলেন। বয়সে প্রায় ১০ বছরের ছোট মাহাবুব রাব্বি তনয়ের সঙ্গে জুলহাসের সমকামী সম্পর্ক ছিল বলে তাঁদের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে।
সমকামীদের ‘সমপ্রেমী’ বলার আহ্বান জানিয়ে জুলহাস মান্নানের সম্পাদনায় ‘রূপবান’ ম্যাগাজিনের প্রকাশনা শুরু হয় দুবছর আগে, ২০১৪ সালের ২২ জানুয়ারি। অফসেট পেপারে ৫৬ পৃষ্ঠার চার রঙা এ ম্যাগাজিনটির প্রকাশক ছিলেন ‘গ্রে কমিউনিটি’র পক্ষ থেকে রাসেল আহমেদ।
ওই সময় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেওয়া ‘রূপবান’-এর প্রকাশক ম্যাগাজিনটি সম্পর্কে বলেছিলেন, বাংলাদেশের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে যেখানে সমকামীরা ব্যাপক বৈষম্যের শিকার হয়, সেখানে সমকামীদের স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি সমাজে ছড়িয়ে দিতেই এ প্রয়াস। বাংলাদেশে গে, লেসবিয়ান ও বাই সেক্সুয়াল ও ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য এটা একটি বড় প্ল্যাটফর্ম।
প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে সম্পাদক জুলহাস মান্নান ‘রূপবান’ প্রসঙ্গে বলেন, সমকাম নয়, বরং সমপ্রেমে বিশ্বাসী মানুষের ভালোবাসার অধিকারের বিষয়টি তুলে ধরতেই ‘রূপবান’-এর আত্মপ্রকাশ। এতে সমপ্রেমে বিশ্বাস করেনÑ এমন মানুষদের জীবনধারা, ভালোলাগা ও দুঃখ-কষ্টের বিষয়টি তুলে ধরা হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে সমকামীরা অদৃশ্য জীবনযাপন করে; কিন্তু আমরা জানাতে চাই যে, এই সমাজেই আমরা আছি এবং আমরা আপনাদের পরিবারেরই সদস্য।
ম্যাগাজিনের নাম ‘রূপবান’ রাখার কারণ ব্যাখ্যা করে জুলহাস বলেছিলেন, নামটি নেওয়া হয়েছে বাংলার একটি রূপকথার গল্প থেকে, যেখানে রূপবান নামের একটি সুন্দরী মেয়েকে একটি বাচ্চা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশের লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল ও ট্র্যান্সজেন্ডার (এলজিবিটি) মানুষদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ম্যাগাজিনটিকে বিরাট একটি পদক্ষেপ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা আশা করি এটা সমকামী সম্প্রদায়ের ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করবে।
রূপবান ম্যাগাজিনের সম্পাদকের প্রত্যাশা, সমকামীদের জীবনযাপন পদ্ধতি ও বিভিন্ন দিক নিয়ে ম্যাগাজিনটিতে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে, তা মানুষের মধ্যে সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে সক্ষম হবে।
ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে প্রকাশ হওয়া ‘রূপবান’-এর প্রথম সংখ্যাটি বের হওয়ার পরপরই এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও ক্ষোভ জানিয়ে ম্যাগাজিনটির প্রকাশনা নিষিদ্ধের দাবি জানায় ইসলামভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠক।সূত্র
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১:৪৫