গোয়েন্দারা এখন সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছেন জঙ্গিদের বোমা-বিস্ফোরক তৈরির কাঁচামালের রসদ সরবরাহ বন্ধ করার বিষয়ে। তারা মনে করছেন, জঙ্গি গ্রেফতার, আস্তানার সন্ধান ও উগ্রপন্থি সংগঠনে সদস্য রিত্রুক্রট বন্ধের পাশাপাশি যে কোনো উপায়ে বোমা তৈরির উপকরণ সরবরাহকারীদের শনাক্ত করা বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের বিভিন্ন এলাকায় জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের পর পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের বিপুলসংখ্যক বোমা ও বিস্ফোরক। জঙ্গিদের হাতে কীভাবে পেঁৗছাচ্ছে বিস্ফোরক ও বোমা তৈরির কাঁচামাল? কারা এসব জোগান দিচ্ছে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন গোয়েন্দারা। এরই মধ্যে সন্দেহভাজন ১৫ জনের তালিকা ভারতীয় গোয়েন্দাদের কাছে হস্তান্তর করেছে বাংলাদেশ। তারা জঙ্গিদের বোমার কাঁচামাল সরবরাহ করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বৈধ কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও যাতে কেউ ভুল তথ্য দিয়ে কোনো ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য কিনতে না পারে, সে ব্যাপারেও সতর্ক সংশ্লিষ্টরা। কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের নিয়ে এ ব্যাপারে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিসিসি) উপকমিশনার মুহিবুল ইসলাম খান সমকালকে বলেন, নব্য জেএমবির হয়ে যারা সাম্প্রতিক সময়ে বোমা তৈরি করছে আসছিল তাদের মধ্যে অন্তত দু'জন সিলেট ও সীতাকুণ্ডের অভিযানে মারা গেছে। আরও ২-৩ জনকে খোঁজা হচ্ছে। বোমা তৈরির কাঁচামালের সরবরাহ বন্ধ করার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে পুলিশের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের প্রধান এডিসি ছানোয়ার হোসেন সানি সমকালকে বলেন, পরপর বেশ কয়েকটি আস্তানা থেকে পাওয়া আলামত পরীক্ষা করে দেখা যায়, দেশীয় উপাদান ব্যবহার করেই জঙ্গিরা বোমা তৈরি করছে। অধিকাংশ সরঞ্জাম চট্টগ্রাম থেকে সংগ্রহ করেছে জঙ্গিরা। কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে বৈঠক করে করণীয় সম্পর্কে তাদের নির্দেশনা দেওয়া হবে। তবে এরই মধ্যে অনানুষ্ঠানিকভাবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। আগে দেশের বাইরে থেকে যেসব রুটে বোমা তৈরির সরঞ্জাম আসত সেগুলোর অধিকাংশই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি বণিক সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম সেলিম সমকালকে বলেন, সারাদেশে ছয় শতাধিক কেমিক্যাল ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির ব্যবসায়ী আছেন। কয়েক মাস পরপরই তাদের চিঠি দেওয়া হয়, যাতে বৈধ জিনিসপত্র বিক্রির আগেও ক্রেতার ব্যাপারে নানাভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়। হয়তো জঙ্গিরা অনেক সময় সীমান্ত এলাকা থেকে কোনো না কোনোভাবে বোমা বা বিস্ফোরক তৈরির উপাদান সংগ্রহ করে। তবে কোনো ঘটনার পরপরই কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের দিকে সন্দেহের আঙুল তোলা হয়, যা অত্যন্ত অস্বস্তিকর।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের একজন বোমা বিশেষজ্ঞ সমকালকে জানান, সম্প্রতি জঙ্গিদের প্রায় সব আস্তানায় ভারী বোমা, বিস্ফোরক ও হ্যান্ডগ্রেনেড পাওয়া গেছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও সিলেটের শিববাড়ির আস্তানায় ব্যাপক ধ্বংসক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক মজুদ ছিল। সীতাকুণ্ডের আস্তানায় যে বিস্ফোরক পাওয়া যায় তা দিয়ে একশ'র বেশি বোমা তৈরি করা সম্ভব। সেখান থেকে ২৯টি অবিস্ফোরিত হ্যান্ডগ্রেনেড, ৪০টি পাওয়ার জেল ও ২১ কেজি বিশেষ পাউডার পাওয়া যায়। এসব আলামত থেকে বোঝা যাচ্ছে, জঙ্গিদের কাছে বোমা তৈরির উপাদানের কমতি নেই।
জঙ্গিদের তৎপরতার ওপর সাত বছরের বেশি সময় ধরে খোঁজ রাখেন এমন একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, পুরনো জেএমবির সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে দক্ষ বোমা বিশেষজ্ঞ সোহেল মাহফুজ। ২০১৩ সালের পর থেকে সে নব্য জেএমবির হয়ে কাজ করছে। সোহেল নব্য জেএমবির বেশ কয়েকজনকে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত নুরুল ইসলাম মারজানের ভগি্নগতি সাগর, মোশাররফ ওরফে সোহেল রানা ও শোয়েব। সিলেটের নাসিরপুর ও সীতাকুণ্ডের আস্তানা নব্য জেএমবি তাদের বোমা তৈরির 'সেফ হোম' হিসেবে ব্যবহার করে আসছিল। সোহেল মাহফুজের সঙ্গে সিলেটে নিহত মোশাররফের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তাই দিনাজপুরের মোশাররফ জঙ্গি সংগঠনে ছদ্মনাম হিসেবে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সোহেল মাহফুজের নামের প্রথম অংশটি নেয়। দেশীয় প্রযুক্তিতে সীতাকুণ্ড ও মৌলভীবাজারে বোমা ও বিস্ফোরক তৈরি করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় জেএমবির আস্তানায় পাঠানো হতো বলে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছেন। রাজধানীর বিমানবন্দর গোলচত্বরে বিস্ফোরণ ও র্যাবের অস্থায়ী ক্যাম্পে হামলায় ব্যবহৃত বোমা ওই দুই আস্তানায় তৈরি করা হয়েছে বলে গোয়েন্দারা বলছেন।
দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিসানে হামলার আগে নব্য জেএমবি পার্শ্ববর্তী একটি দেশ থেকে ডেটনেটর এনে হাতবোমা তৈরি করত। গত বছর রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে ৭৮৭টি ডেটোনেটরসহ নব্য জেএমবির আবু তাহের, মিজানুর রহমান, সেলিম মিয়া ও তৌফিকুল ইসলামকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা পুলিশেকে জানায়, বড় মিজান ও ছোট মিজানের নির্দেশে তারা চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্ত এলাকা দিয়ে বিপুলসংখ্যক ডেটোনেটর ঢাকায় নিয়ে আসে। এসব ডেটোনেটর দিয়েই ঢাকায় জঙ্গিরা গ্রেনেড তৈরি করে; যা গুলশান হলি আর্টিসানে হামলায় ব্যবহার করা হয়। তাদের মধ্যে বড় মিজানকে এরই মধ্যে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। ওই সূত্র ধরেই সীমান্ত দিয়ে দেশের বাইরে থেকে জঙ্গিদের হাতে বোমা তৈরির সরঞ্জাম ও অস্ত্র তুলে দেয় এমন সন্দেহভাজন ১৫ জনের তালিকা ভারতীয় গোয়েন্দাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গোয়েন্দারা বলছেন, সম্প্রতি জঙ্গিদের ব্যবহৃত বোমার আলামত পরীক্ষা করে জানা গেছে, অধিকাংশ ঘটনায় তারা বিভিন্ন শিল্প-কলকারখানায় ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করে দেশীয় প্রযুক্তিতে বোমা তৈরি করছে। তবে বোমা তৈরির ক্ষেত্রে তারা নতুন কিছু বিষয় সংযোজন করে। অধিকাংশ বোমার সঙ্গে টাইমার যুক্ত করছে। আগের তুলনায় বড় আকৃতির বোমা বানাচ্ছে। একে জঙ্গিরা নাম দিয়েছে 'ফ্যামিলি সাইজ' বোমা। এসবের একেকটির ওজন অন্তত দুই কেজি। দেশীয় প্রযুক্তিতে তারা তৈরি করছে সুইসাইডাল ভেস্ট। প্রতিটি আস্তানায় অন্তত ৩-৪টি ফ্যামিলি সাইজ বোমা রাখা হচ্ছে। যাতে পুলিশ আস্তানার সন্ধান পেলে তাদের কাছে ধরা না পড়ে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পুরো বাসাটি তছনছ করা যায়। এ ছাড়া বড় আকৃতির বোমা রাখার আরেকটি লক্ষ্য পুলিশের ওপর প্রাণঘাতী আক্রমণ করা।
পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সমকালকে জানান, জঙ্গিদের একটি আস্তানা থেকে সম্প্রতি বোমা তৈরির একটি গাইডলাইন সম্পর্কিত বই পাওয়া গেছে। কীভাবে ঘরে বসে বোমা তৈরি করা যায় তার বিস্তারিত বিবরণ এতে দেওয়া আছে। পুলিশ বলছে, পরিচয় গোপন রেখে জঙ্গিরা বৈধ দোকান থেকেই বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক উপাদান সংগ্রহ করে। অনেক সময় তারা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রাসায়নিক পরীক্ষাগারের রসায়নবিদ পরিচয় দিয়ে সরঞ্জাম ক্রয় করছে বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে। এক্ষেত্রে তারা ভুয়া পরিচয়পত্র ব্যবহার করছে। এমনকি কেউ কেউ জঙ্গি মতাদর্শে বিশ্বাস করেই উগ্রপন্থিদের হাতে বোমা তৈরির কাঁচামাল তুলে দিচ্ছে। ২০১৫ সালে হুজিবি ও এবিটির জঙ্গিদের রাসায়নিক পদার্থ ও বিস্ফোরক সরবরাহের অভিযোগে চারজনকে গ্রেফতার করেছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তারা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের ল্যাব সহকারী গাজী মোহাম্মদ বাবুল, টিকাটুলির তিন রাসায়নিক দ্রব্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এশিয়া সায়েন্টিফিকের মালিক রিপন মোল্লা, ওয়েস্টার্ন সায়েন্টিফিক কোম্পানির কর্ণধার মহিউদ্দিন ও এফএম কেমিক্যাল অ্যান্ড সন্সের মালিক নাসির উদ্দিন। ওই অভিজ্ঞতা থেকে গোয়েন্দারা বলছেন, যাতে বৈধ বা অবৈধ কোনো সোর্স থেকেই জঙ্গিরা বোমা তৈরির উপাদান না পায়- এ বিষয়ে এখন সর্বোচ্চ জোর দেওয়া হচ্ছে। জঙ্গি মোকাবেলার পাশাপাশি তাদের বোমা তৈরির উপাদান ডেটনেটর, সার্কিট, সালফার ও পটাশিয়ামের উৎস বন্ধ করা বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশেজ্ঞরা।
সুত্র
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০১৭ রাত ৩:৪০