সকালে ঘুম ভাঙ্গল গরুর ডাকের শব্দে। সামনেই কোরবানির ঈদ। গরুর ডাকে ঘুম ভাঙ্গটা অবাক হওয়ার মতো তেমন কিছু না। জানালা দিয়ে উকি দিলাম। আমাদের পাশের বাসার ভারাটিয়া মজিব আঙ্কেল ঈদের জন্য গরু কিনে এনেছেন। সেই গরু এখন সবাই খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে, আর প্রশংসা করছে। মজিব আঙ্কেলের মুখে এক ধরণের হাসি। মনে হচ্ছে এমন মোটা তাজা গরু কিনতে তিনি খুব গর্বিত। পরক্ষণেই চোখ পড়ল মায়ার দিকে। সেও বেশ উৎসাহের সহিত সবার সঙ্গে গরু দেখছে।..
..
বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালাম। কোন মতে লুঙ্গি একটা প্যাঁচ দিয়ে নিচে তালায় নেমে আসলাম। (উদ্দেশ গরু দেখা না, উদ্দেশ মায়াকে দেখা)
নিচে নেমে মায়াদের বাসায় ঢুকে পড়লাম। দূর থেকে দেখে গরুটাকে যত বড় মনে হচ্ছিল, কাছে আসার পর দেখলাম গরুটা এরচেয়ে আরো বড়! সবাই গরু দেখে প্রশংসা করে চলে গেল। আমি আর মায়া দাড়িয়ে রইলাম। মায়া আমার দিকে এগিয়ে আসল। বলল, 'কেমন আছেন অভি ভাই?'
হঠাৎ করে প্রশ্নটা করায় আমার বুক কেপে উঠে। আমি ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলাম, 'ভাল!?'
তখন দেখলাম মায়ার দুই বান্ধবী জুনি ও রুপা রিকসা থেকে নামছে। খুব সম্ভবত গরু দেখতে এসেছে। এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বড় গরু, তাও একটা বিষয়। যাই হউক, আমি এত দিকে নজর না দিয়ে গরু দেখতে লাগলাম। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই হুলুস্থুল একটা ব্যাপার শুরু হল। মায়ার দুই বান্ধবী গরুর সঙ্গে সেলফি তুলা শুরু করেছে, সেই সাথে মায়াও!! ওরা বিভিন্ন পুজ দিয়ে ছবি তুলছে। সেই সাথে গরুও গম্ভির একটা ভাব নিয়ে দাড়িয়ে আছে। হঠাৎ মায়ার এক বান্ধবী জুনি গরুকে একটা সানগ্লাসও পড়িয়ে দিল….! (অবাক ইমু)
..
ছবি তুলার এক পর্যায়ে আমার হাতে ক্যামেরা দেয়া হল। ওদের তিন বান্ধবীর গরুসহ কয়েকটা পিক তুলে দিতে। আমিও বাদ্ধ ছেলের মত ওদের ছবি একের পর এক তুলে যাচ্ছি।
..
এক সময় রুপা হুট করে বলে উঠে, 'আরে অভি ভাই আপনি তো শুধু পিক তুলেই যাচ্ছেন। কই নিজে তুলবেন না?'
আমি উত্তর দিলাম, 'নাহ.. এসবের প্রতি আমার কোনো ইন্টারেস্ট নাই।'
'আরেহহ.. কি যে বলেন। ভাল না লাগলেও তুলতে হবে, এসুন।'
এই বলে রুপা আমাকে টেনে মায়ার পাশে দাড় করিয়ে দিল। এখন মায়া আর আমি পাশাপাশি দাড়িয়ে আছি।..
আমাদের পিছনে গরু, বেশ ভাব নিয়ে দাড়িয়ে আছে। হয়তো এখন আমি মায়ার পাশে দাড়িয়ে আছি বলে বেটার জেলাস ফিল হচ্ছে। হউক জেলাস ফিল। জেলাস ফিল হওয়ারই কথা! মায়ার মতো একটা মেয়ের পাশে একটা মশা ভনভন করলে, যে কারো জেলাস ফিল করার কথা।
..
ছবি তুলতে আমি খুব ইতস্তত বোধ করছিলাম। কারণ এক তো পড়ে আসছি লুঙ্গি তার উপর মাত্র এক সাইজের একটা গেঞ্জি। তাও আবার এক পাশে ফুটো হয়ে আছে। মায়া আমার দিকে এগিয়ে এসে নিচু গলায় বলল, 'গেঞ্জিটা তো ফুটো হয়ে গেছে। ভাল একটা জামা গায় দিয়ে বের হতে পারলেন না? গাধা কোথাকার!'
ঠিক ঐ মুহূর্তে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছিল। কোন মতে নিজেকে সামলিয়ে কয়েকটা পিক তুলে, কোন মতে সেখান থেকে চলে আসলাম।
..
ছবি তুলা শেষে যে যার বাসায় চলে যায়। রাতে পড়া শেষ করে এফবিতে বসলাম। এফবিতে ডুকেই মাথাটা এক চক্কর খেয়ে গেল। একি!!!!! মায়া তার ফ্রেন্ডদের সাথে তুলা পিকগুলো ফেসবুকে আপলোড দিয়েছে। সাথে আমার গুলোও! ফ্রেন্ডদের সাথে তুলা পিক আপলোড করুক ভাল কথা, কিন্তু আমার পিকগুলো আপলোড করল কেন!? যাই হউক, আমি আমার পিকের নিচে কমেণ্টগুলো পড়তে লাগলাম। সেখানে অনেকে কমেণ্ট করেছে, 'দুইটা গরু দেখতে পাচ্ছি।' 'গরুর সাথে ঐটা রাখাল নাকি!' আরেকজন আবার কমেণ্ট করেছে, 'রাখালটাও তো বেশ স্মার্ট!' আবার কেউ কমেণ্ট করেছে 'ইসস,, রাখালটার তো গেঞ্জি ছিদ্র হয়ে গিয়েছে' মায়া সেসব কমেণ্টে লাইক দিয়ে রিপ্লে দিল, 'হ্যাঁ সে রাখাল, এই গরুটার' .....
এসব কমেণ্ট পড়তে পড়তে আমার মাথা গরম হয়ে গেল। মাথার সব কিছু এলোমেলো হতে লাগল। এতবড় অপমান! মায়া আমাকে এতবড় অপমানটা করতে পারল! আমি কিনা রাখাল!!! রাগে আমি পুরো কাঁপতে লাগলাম। কি করা যায় ভাবছি!!!!
..
আমি এখন বাসা থেকে বের হয়েছি। উদ্দেশ, মায়াদের বাসার দিকে। আমি আস্তে আস্তে ওদের বাসায় ডুকলাম। গরুটিকে বেধে রাখা হয়েছে খুঁটির সাথে। বাসার সবাই মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। এইতো সুযোগ। যা করার এখনি করতে হবে। আমি সুযোগ কাজ লাগালাম।..
..
বাধন থেকে গরুটিকে আলাদা করে দেয়ার পর গরু এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। হয়তো সে বিশ্বাস করতে পারছে না। অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর গরুটা উদ্দেশহীন পথে হাঁটা দিল। মনে মনে আমার খারাপ লাগলেও, আমি সেটাকে প্রাদান্য দিলাম না। যা করেছি বেশ করেছি।…
..
ঘরে এসে চুপচাপ বসে রয়েছি। মনটা কেমন যেন করছে। নিজেকে অপরাধী অপরাধী লাগছে। নিঃশব্দে বিছানায় শুয়ে পড়লাম, ঘুম আসছে না। অশান্তি একটা ভাব মনে বিরাজ করছে। একবার ভাবলাম গরুটাকে গিয়ে নিয়েই আসি। আবার সাথে সাথেই ভাবলাম, নাহ.. যা কররেছি বেশ করেছি।
একটু পরেই মায়াদের বাসায় চেচামিচি শুরু হল। হঠাৎ আমার মোবাইলে একটা কল আসল। চেয়ে দেখি মায়ার নাম্বার। বুকটা ধক করে উঠল। কল রিসিব কররে শুনতে পেলাম মায়া কান্না কান্না গলায় বলছে, 'অভি ভাই, আমাদের গরু হারিয়ে গেছে.. তাড়াতাড়ি আমাদের বাসায় আসুন প্লিজ'
আমি আর এক মুহূর্ত দেরি না কর মায়াদের বাসার দিকে দৌড় দিলাম।
..
মজিব আঙ্কেল উঠানে বসে হাহাকার করে হাউমাউ করে কাঁদছে। চারিদিকে লোক পাঠিয়েছে, কেউ নাকি খুঁজে পায়নি। মায়া তার মা'র এক পাশে দাড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদছে। আমাকে দেখে দৌড়ে আমার কাছে এল। আর ফুপাতে ফুপাতে বলতে লাগল, 'অভি ভাই, আমাদের গরুটাকে কে যেন চুরি করে নিয়ে গেছে।' মায়ার চোখে জল দেখে আমি আর দাড়িয়ে থাকতে পারলাম না। এক দৌড় লাগালাম.. যে রাস্তা দিয়ে গরুটাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম।
..
কপাল ভাল। গরুটাকে রাস্তায় পেয়ে গেছি। প্রাকৃতিক কার্য সারতে গিয়ে মনে হয় আটকে গেছে। আমি স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললাম। গরুর কপালে একটা চুমু দিয়ে গরুর রশিটা হাতে নিয়ে মায়াদের বাসার দিকে রওয়ানা হলাম। (মুখে আমার তখন বিজয়ের হাঁসি।)
..
রশি হাতে আমাকে সঙ্গে গরুকে দেখে সবাই অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে!! আমি সবার অবাক দৃষ্টি অবজ্ঞা করে বললাম, 'রাস্তায় খুজতে খুজতে এক সময় পেয়ে যাই। বেটার রশি ছুটে যাওয়ায় রাস্তায় হাওয়া খেতে বের হয়ে পরে।' এবারও সবাই চুপচাপ। আমি ভীত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, 'সবাই এমন চুপ করে আছ কেন?'। তখনি সবার মাঝে আনন্দর রোল পড়ে যায়। সেই সাথে আমাকে নিয়েও। সবার মুখে আনন্দর হাসি। মজিব আঙ্কেল খুশিতে একবার আমায় এসে জড়িয়ে ধরে। তারপর একে একে সবাই এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে আর বলতে লাগল 'যদি আমি আজ না থাকতাম...'। আর এদিকে আমি মনে মনে নিজের কৃতকার্যের জন্য লজ্জা পেলাম..। মায়া খুশিতে আবারো কেঁদে ফেলল। আর কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, ‘আজ যদি আপনি না থাকতেন, কি যে হত…’ এ কথা বলেই আবার কাঁদতে শুরু করল। হয়তো ওর ভূলটা সে বোঝতে পেরেছে….!! মনে মনে ভাবলাম, কি হতে যাচ্ছিল...আর কি হল!!
সেদিনের রাতের মতো মায়াদের বাসায় বিয়ে বাড়ির মতো আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছিল।
..
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ফেসবুকে ডুকলাম। মায়া আমাকে ট্যাগ করে আমার ও তার একটা পিক আপলোড দিয়েছে। আর সেই পিকের ক্যাঁপশনে ছোট করে লিখে দিয়েছে, 'সে আমার রাখাল ; যে আমার মতো গরুকে সারাজিবন দেখে-শুনে রাখবে।'
__________________________
লিখা- মোঃ মাহবুবুর রহমান (তন্ময়)
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১:৪৫