somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলা ব্লগ ও সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১২:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ব্লগ এখন মতপ্রকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিকল্পধারার মিডিয়া হিসেবে নানা ইস্যুতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে ব্লগসাইটগুলো। ব্লগ এবং ব্লগিং কনসেপ্ট খুব বেশি পুরনো নয়। 'ওয়েব লগ' নামের যে ধারণা থেকে ব্লগের যাত্রা শুরু সেই ধারণা থেকেও বর্তমান ব্লগ অনেকটাই সরে এসেছে। ফলে ব্লগসাইট এখন কেবল ব্লগারের ডেইলি লগ রাখার জায়গা নয়, বরঞ্চ মতপ্রকাশ ও প্রতিবাদের জায়গা হিসেবে হাজির রয়েছে। একটা বিষয় খুব গর্বের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্লগাররা দাবি করতে চায়, তা হলো কমিউনিটি বা সোশ্যাল ব্লগিংয়ের ধারণা বাংলাদেশ থেকেই প্রথম শুরু হয়। ব্লগসাইট আগেও ছিল। কিন্তু সেগুলো ছিল ব্যক্তিগত ব্লগসাইট, অভিন্ন প্রথম পাতা সেখানে ছিল না। ২০০৫ সালে বাংলা ভাষায় ব্লগসাইট চালু হলো অভিন্ন প্রথম পাতা নিয়ে। ফলে অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে বিশাল ব্লগ কমিউনিটি সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে প্রায় দেড় লাখ ব্লগার বাংলা ভাষায় ব্লগিং করছেন। এই সংখ্যার অধিকাংশই তরুণ-তরুণী। ফলে মতপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বা কমিউনিটি হিসেবে ব্লগের গুরুত্ব সহজেই স্পষ্ট।

ব্লগ ও ব্লগের গুরুত্ব নিয়ে শুরুতেই এতগুলো কথা বলার কারণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সাম্প্রতিক বক্তব্য। ৩ ডিসেম্বর গণভবনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভা শেষে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাব দিতে দিয়ে ব্লগ নিয়ে বেশকিছু মন্তব্য করেছেন সৈয়দ আশরাফ। বাংলাভাষী ব্লগারদের জন্য এটি আনন্দের যে, রাজনীতিবিদরা ব্লগসাইট দেখছেন এবং তা নিয়ে মতামত জানাচ্ছেন। তবে সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য থেকে ব্লগ এবং ব্লগসাইট নিয়ে মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা তৈরি হতে পারে বলে মনে হয়েছে। মতপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ব্লগ যে অমিত সম্ভাবনা নিয়ে প্রস্ফুটিত হচ্ছে তার যাত্রা সঠিকপথে রাখার স্বার্থেই এই লেখাটি লিখতে হচ্ছে। সৈয়দ আশরাফ তার বক্তব্যে বলেছেন, 'শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, আমি, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অনেককে নিয়ে ব্লগে অশালীন ও কুৎসিত কমেন্ট করা হয়। যার সঙ্গে বক্তব্যের কোনো সম্পর্ক নেই। দুয়েকটা পত্রিকা নীতিগত ও সম্পাদকীয় নীতি অনুযায়ী অশালীন মন্তব্য ছাপে না। সবাইকে ব্লগ মডারেট করতে হবে।' তিনি আরও বলেন, 'ব্লগ এখন অনেকটা পর্নোগ্রাফিতে পরিণত হয়েছে।' সৈয়দ আশরাফের এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, ব্লগ নিয়ে বেশ কিছু ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে। সংবাদপত্রগুলোর অনলাইন সংস্করণের নিচে মতামত প্রদানের যে সুযোগ দেওয়া হয় তাকেই ব্লগ ভেবে ভুল করা হচ্ছে। অথচ ব্লগ বিষয়টি সম্পূর্ণই ভিন্ন। পত্রিকার পাঠক প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে ব্লগকে গুলিয়ে ফেলার কারণেই সৈয়দ আশরাফ এই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু তিনি শব্দ হিসেবে ব্যবহার করেছেন 'ব্লগ'। ফলে ব্লগ নিয়ে এক ধরনের ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে। তিনি যখন বলেন 'ব্লগ এখন অনেকটা পর্নোগ্রাফিতে পরিণত হয়েছে', তখন ব্লগার হিসেবে আমরা আহত বোধ করি। এখানে স্পষ্ট ভাষাতেই জানাতে চাই, বাংলা ভাষায় ব্লগিং কোনো পত্রিকা শুরু করেনি কিংবা কোনো অনলাইন নিউজসাইট করেনি। এটি সত্য যে, ব্লগের জনপ্রিয়তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি পত্রিকা ও একটি অনলাইন নিউজসাইট ব্লগ শুরু করেছে। বর্তমানে বেশ কয়েকটি বাংলা কমিউনিটি ব্লগসাইট রয়েছে। আশা করব, সৈয়দ আশরাফ এই ব্লগসাইটগুলো দেখবেন এবং ব্লগ নিয়ে পুনরায় ভাববেন। বাংলা ভাষায় লেখার জন্য বিভিন্ন ধরনের ব্লগ হয়েছে। কোনো ব্লগে কড়াকড়ি মডারেশন নীতি, আবার কোনো ব্লগে সহজ মডারেশন নীতি রয়েছে। মূলত বাংলা ব্লগের মডারেশন নীতি ব্লগারদের দীর্ঘদিনের বোঝাপড়ার ফসল। ব্লগারদের নিজেদের মধ্যেও সমালোচনার চর্চা রয়েছে। ফলে কোনো ব্লগার অগ্রহণযোগ্য বা অশালীন কোনো পোস্ট দিলে ব্লগার কমিউনিটি থেকেই তার সমালোচনা করা হয়।

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, বাংলা ব্লগের বিকাশপর্বের সবকিছু ইতিবাচক নয়। অনেক নেতিবাচক বিষয়ও রয়েছে। নানা বিষয় নিয়ে ব্লগে কাদা ছোড়াছুড়ি হয়। মাঝে মধ্যে অগ্রহণযোগ্য ব্লগ পোস্টও আসে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে কুৎসা রটনাও চলে। কট্টর পার্টিজান কিছু ব্লগারও রয়েছে, যারা দলের বিরুদ্ধে কিছু বললে গালাগাল করতেও দ্বিধা করে না। ব্লগার সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়ায় লেখার মান নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে গেছে ব্লগসাইটগুলোর জন্য। এই নেতিবাচক বিষয়গুলোর দায় সামগ্রিকভাবে ব্লগার কমিউনিটির ওপরই বর্তায়। আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে নিজেদের দোষত্রুটিগুলো ঠিক করে নিতে ব্লগাররা কাজ করে যাচ্ছে। সেই সুযোগটুকু ব্লগারদের দেওয়া উচিত বলে মনে করি। ব্লগের সাফল্য অনেক। গত কয়েক বছর দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক ঘটনায় ব্লগার কমিউনিটি শক্ত অবস্থান নিয়েছে, নিজেদের মতামত জানিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়ে শুরু থেকেই ব্লগাররা শক্ত অবস্থান নিয়েছে। অনেক আগে থেকেই এ ব্যাপারে ব্লগে লেখা হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করে ব্লগ থেকেই গণস্বাক্ষর গ্রহণ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। ভাস্কর্য ভাঙার প্রতিবাদে ব্লগাররাই প্রথম মানববন্ধন করেছিল। কমিউনিটি হিসেবে নানা সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাজে ব্লগারদের অংশগ্রহণ সবসময়ই ছিল।

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যকে ইতিবাচকভাবেই দেখতে চাই। সংবাদপত্রের পাঠক প্রতিক্রিয়া ও ব্লগসাইটের মন্তব্যগুলোর দিকে রাজনীতিকরা লক্ষ্য রাখছেন জেনে ভালো লাগছে। তবে ব্লগ নিয়ে যাতে ভুল বোঝাবুঝি না হয় তা নিশ্চিত করাও জরুরি। আশা করব, আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো মতপ্রকাশের এই মাধ্যমটিকে শক্তিশালী রাখার ব্যবস্থা করবেন। ব্লগে লেখালেখি ও মন্তব্য করা নিয়ে সরকারি পর্যায় থেকে নানাবিধ নিয়মকানুন তৈরি করার চেষ্টা করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তার চেয়ে বিষয়টি বিশাল ব্লগ কমিউনিটির ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে একটি তথ্য জানাতে চাই, বর্তমানে বিভিন্ন কমিউনিটি ব্লগে যে নিজস্ব নিয়মকানুনগুলো রয়েছে তা ব্লগারদের দীর্ঘদিনের আন্দোলন ও বোঝাপড়ার বিষয়। এই ব্লগার কমিউনিটিই আন্দোলন করে ঠিক করে নিয়েছিল যে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কোনো পোস্ট ও মন্তব্য প্রকাশ করা যাবে না। এখন প্রায় সব ক'টি ব্লগে নিয়ম হিসেবে এটি স্থান পেয়েছে। সুতরাং ব্লগে লেখার নিয়মকানুন কেমন হবে তা ব্লগারদের ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত। সৈয়দ আশরাফের বলেছেন, 'নিজেদের ক্রেডিবিলিটি ধরে রাখতে ব্লগগুলো মনিটর করুন।' আমরা ব্লগাররা এমন কথাই দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি, কথাগুলো আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি। এত এত ব্লগার বাংলা ভাষায় রাজনীতি, অর্থনীতিসহ নানা বিষয়ে লেখে যাচ্ছে, তারা স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা করেন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এই মতামতগুলো বিবেচনায় নেবে। সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যের মতোই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি বলতে চাই, নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা যাচাই-বাছাই করতে ব্লগ ও ব্লগের মতো বিকল্প মিডিয়াগুলোর প্রতি নজর রাখুন। কারণ, এখানেই মানুষ সবচেয়ে সহজে নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারছে। বিনয়ের সঙ্গে জানাতে চাই অধিকাংশ ব্লগারই লেখে নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকে, এখানে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি নেই, ব্লগ লীগ বা ব্লগ দলও নেই। রাজনৈতিক যে কোনো পরিস্থিতিতে ব্লগাররা যেমন করে গত কয়েক বছরে অবস্থান নিয়েছে, তেমন করে সামনেও অবস্থান নেবে। মতপ্রকাশের এই সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রটিকে ব্লগাররা সফল করে তুলতে চায়। সেই সুযোগটুকু তাদের দেওয়া উচিত।


(লেখাটি ৬ ডিসেম্বর দৈনিক সমকালের সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত হয়েছে। কিছুটা সংশোধিত অবস্থায় ব্লগে প্রকাশ করা হলো।)

১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×