ইদানীং ছাত্রদের ৩৮ টাকার খাবার নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। আসলেইতো চাউলের কেজি যেখানে ৬৫/৭০ টাকা সেখানে ৩৮ টাকায় ভরপেট খাবার, ভাবা যায়? কিছুদিন আগে রাবির এক ছাত্রকে ক্যাম্পাসের গাছ থেকে আম চুরি করার অপরাধে পুলিশে দেওয়া হয়েছিল। পরে জানা গেল ছেলেটি আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে বাধ্য হয়ে ক্ষুধার তাড়নায় ক্যাম্পাসের গাছের আম চুরি করে খেতো।
এমনি একটা ঘটনা আমার চোখের সামনেই ঘটেছিল ২০০২-২০০৩ সালের দিকে । আমি তখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। হলে সিট না পাওয়ায় ভার্সিটির পাশেই একটা সস্তা মেসে থাকতাম। মেসের বড়ভাইয়েরা খুবই আন্তরিক তাই মানিয়ে নিতে খুব একটা সমস্যা হয়নি। মেসের খাওয়া দাওয়ার সুবিধার্থে বারো জন সদস্য মিলে একজনকে ম্যানেজার নির্বাচন করতাম, তার কাছেই সবাই খাবারের টাকা জমা দিতো। ম্যানেজার প্রতিদিনের বাজারের লিস্ট করে পর্যায়ক্রমে সবার হাতে দিতো, সবাইকে এক একদিন করে বাজার করতে হতো। মাসিক মিটিংয়ে ম্যানেজার খরচের হিসাব দিতো, তাতে দেখা যেতো সকাল দুপুর এবং রাতের তিন বেলার খাবারের খরচ পড়তো ২৮-৩০ টাকা।
একসময় খেয়াল করলাম মেসের বারোজন মেম্বারের মধ্যে একজন কখনোই মেসের খাবার খায় না। এতে করে আমাদের সবার প্রতিদিনের খাবার খরচ এক থেকে দেড় টাকা বেড়ে যাচ্ছে। মাসিক মিটিংয়ে তাই বিষয়টি নিয়ে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করলো। আমাদের সবচেয়ে সিনিয়র ডাবলু ভাই হান্নানকে(ছেলেটির নাম) ডেকে বললো
-তুমি মেসের খাবার খাচ্ছো না কেন?তোমার কারনে সবার খাবার খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
হান্নান তখন কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো
-আমার আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে গত এক সপ্তাহ ধরে শুধুমাত্র শুকনো চিড়া পানি দিয়ে ভিজিয়ে খেয়ে কোন রকম বেচে আছি। আমার মনে হয় আর পড়াশুনা করা হবে না।
হান্নানের এক কথা শুনে সবারই খুব মায়া হল, সবাই চিন্তা করতে লাগলো কিভাবে তাকে সাহায্য করা যায়!
মেসের মালিক দেশের বাইরে থাকেন, মালিকের ভাতিজা মতিউর ভাই মেসটি পরিচালনা করতেন। মতিউর ভাইয়ের সাথে আমাদের বন্ধুর মত সম্পর্ক ছিল। আমরা সবাই মিলে মতিউর ভাইকে অনুরোধ করলাম হান্নানের কাছ থেকে ভাড়া না নেওয়ার জন্য। আমাদের সবার অনুরোধ তিনি ফেলতে পারলেন না। তার জন্য একটা ফ্রী সিটের ব্যবস্থা করে দিলেন। আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম হান্নানের পেপার বিল, কারেন্ট বিল, বুয়ার খরচ বহন করবো। কিন্তু খাওয়ার খরচ কোথা থেকে আসবে?
আমাদের মেসের সবচেয়ে সিনিয়র ডাবলু ভাই সেটারও সমাধান করে দিলেন। মেসের পাশের বাড়ির এক ভাবি ডাবলু ভাইকে ওনার মেয়েকে পড়ানোর জন্য অনুরোধ করেছিলেন। ডাবলুর ভাই হান্নানকে ভাবির সাথে পরিচয় করে দিয়ে বললেন
-এই ছেলেটা আপনার মেয়েকে পড়াবে বিনিময়ে কোন টাকা দিতে হবে না, শুধু তিনবেলা খাবার দেবেন। ভাবি ডাবলু ভাইয়ের প্রস্তাবে সানন্দে রাজী হয়ে গেলেন।
আমরা সবাই হলে উঠলেও হান্নান হলে সিট পেলেও কখনই হলে ওঠেনি, সেই মেসে থেকেই পড়াশুনা শেষ করেছিল। সবার একটু আন্তরিক প্রচেষ্টার কারণে ছেলেটা সেদিন পড়াশুনা শেষ করতে পেরেছিল।
আমরা যারা পাবলিক ভার্সিটিতে পড়েছি, জনগনের টাকায় অল্প খরচে খাবার খেয়েছি তাদের পক্ষ থেকে দেশের জনগনের প্রতি কৃতজ্ঞতা রইলো।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৩২