somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সিফফিনের যুদ্ধ এর কিছু ইতিহাস

২৬ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ১১:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সিফফিনের যুদ্ধ বা জঙ্গে সিফফিন হযরত আলী রাঃ আর সিরিয়ার গভর্নর আবু সুফিয়ান ইবনে হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এর মধ্যে সংঘটিত একটি যুদ্ধ।
যদিও প্রথম দিন থেকেই হযরত আলী রাঃ বুঝতে পেরেছিলেন যে যুদ্ধ অবশ্যই হবে তবু ওজর নিঃশেষ করার প্রয়োজনে জামালের যুদ্ধ শেষে কুফায় ফিরে এসে তিনি জারির ইবনে আব্দিল্লাহ আল বাজালিকে একটা পত্রসহ মুয়াবিয়ার কাছে সিরিয়া প্রেরণ করেছিলেন। পত্রে তিনি লিখেছিলেন যে মুজাহির এবং আনসার তার বায়াত গ্রহণ করেছে এবং হযরত মুয়াবিয়া রাঃ যেন বায়াত গ্রহণ করেন হযরত উসমান রাঃ হত্যার মামলা পেশ করে যাতে তিনি কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী রায় প্রদান করতে পারেন। জারির কাছে বিস্তারিত জানতে পেরে হযরত আলী রাঃ খুব দুঃখ পেয়েছিলেন এবং মালিক ইবনে হাবিব আল ইয়ারবুইকে নুখায়লাহ উপত্যকায় সৈন্য সমাবেশ করার আদেশ দিলেন। ফলে কুফার উপকণ্ঠে প্রায় আশি হাজার লোক জড়ো হয়েছিলো। প্রথমে হযরত আলী রাঃ জিয়াদ ইবনে নদর আল হারিছির নেতৃত্বে আট হাজারের একটা শক্তিশালী রক্ষীবাহিনী এবং সুরায়হ ইবনে আল হারিছির নেতৃত্বে অন্য একটা চার হাজারের শক্তিশালী বাহিনী সিরিয়া আভিমুখে প্রেরণ করলেন। অবশিষ্ট সৈনবাহিনির নেতৃত্ব নিজে গ্রহণ করে হযরত আলী রাঃ সিরিয়া অভিমুখে যাত্রা করলেন। কুফার সীমান্ত অতিক্রম করে তিনি যোহর এর সালাত আদায় করলেন এবং এরপর দায়র আবু মুসা, নাহর, নারস, কুব্বাত কুব্বিন, বাবিল ও দায়র কাব, কারবালা, সাবাত, বাহুরা সিনি, আল আনবার এবং আর জাযিরাহ স্থানে বিশ্রাম গ্রহণ করেন আর রিক্কায় উপনীত হলেন। সেখানকার জনগণ উসমানের পক্ষে ছিল এবং তখনেই ইবনে মাখতামাহ আল আসাদি তার আটশত লোকসহ তাবু খাটিয়েছিল। সেসব লোক হযরত আলী রাঃ এর পক্ষ ত্যাগ করে মুয়াবিয়ার সাথে যোগ দেওয়ার জন্য কুফা থেকে বেরিয়ে এসেছিল। যখন তারা হযরত আলী রাঃ এর বাহিনী দেখতে পেল তখন তারা ফরাত নদীর ওপরের সেতু খুলে ফেললো যাতে তিনি নদী পার হতে না পারেন। কিন্তু মালিক ইবনে হারিছ আল আশতারের ধমকে তারা ভীত হয়ে গেল এবং উভয়ের মধ্যে আলাপ আলোচনার পর সেতু জোড়া লাগিয়ে দিল এবং হযরত আলী রাঃ তার সৈনবাহিনি নিয়ে নদী পার হয়ে গেলেন। নদীর অপর পারে যেয়ে দেখতে পেলেন জিয়াদ এবং সুরায়হ সেখানে অপেক্ষা করছে। তারা হযরত আলী রাঃ কে জানালো ফরাত অভিমুখে মুয়াবিয়ার এক বিশাল বাহিনী আসছে আমাদের দ্বারা তাদের গতিরোধ করা সম্ভব হবে না এই কারনে আমরা হযরত আলী রাঃ এর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তাদের থেমে থাকার ওজহাত হযরত আলী রাঃ গ্রহণ করলেন এবং অগ্রবর্তী হওয়ার আদেশ দিলেন। যখন তারা সুর আর রুম নামক স্থানে গিয়ে দেখতে পেল আবু আল আওয়ার আস সুলামি সেখানে সৈন্য সহ অবস্থান করছে। হযরত আলী রাঃ মালিক ইবনে হারিছ আল আশতার কে সেনাপতি করে সেখানে পাঠালেন এবং নির্দেশ দিলেন যে যত দূর সম্ভব যুদ্ধ এড়িয়ে তাদেরকে যেন প্রকৃত আবস্থা বুঝিয়ে বলা হয় এবং উপদেশের মাধ্যমে মনোভাব পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়। মালিক ইবনে হারিছ আল আশতার তাদের কাছ থেকে অল্প দূরে ক্যাম্প করলেন। কিন্তু তিনি যুদ্ধের কোন ভাব দেখালেন না। অপর দিকের অবস্থা থমথমে ছিল যে কোন সময় যুদ্ধ শুরু করার তারা উন্মুক্ত অসি হাতে অপেক্ষা করছিলো। আবু আল আওয়াল হঠাৎ করে রাতের বেলা আক্রমণ করে বসলো এবং সামান্য যুদ্ধের পর পালিয়ে গেল। পরদিন হযরত আলী রাঃ সসৈন্যে সেখাপৌছে সিফফিন অভিমুখে যাত্রা করলেন। হযরত মুয়াবিয়া রাঃ পূর্বেই সিফফিন পৌছে ছাউনি পেতেছিল এবং ফরাত কূল অবরোধ করে সৈন্য মোতায়েন করেছিলো। হযরত আলী রাঃ সেখানে পৌঁছে মুয়াবিয়াকে অনুরোধ করে পাঠালেন যেন সে ফরাত কূল থেকে সৈন্য সরিয়ে পানি নেওয়ার ব্যবস্থা অবরোধমুক্ত করেন। হযরত মুয়াবিয়া রাঃ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে হযরত আলী রাঃ এর সৈন্যগন সাহসিকতার সাথে আক্রমণ করে ফরাত কূল দখল করেন। তারপর হযরত আলী রাঃ মুয়াবিয়ার কাছে বশীর ইবনে আমর আল আনসারি, সাইদ ইবনে কায়েস আল হামদানি এবং শাবাছ ইবনে আত তামিমীকে প্রেরণ করলেন এই জন্য যে তারা যেন যুদ্ধের ভয়াবহতা তাকে বুঝিয়ে বলে এবং সে যেন বায়াত গ্রহণ করে একটা মীমাংসায় আসতে রাজি হয়।

এই প্রস্তাবে হযরত মুয়াবিয়া রাঃ সরাসরি বলে দিল যে উসমানের রক্তের প্রতি সে উদাসীন থাকতে পরে না কাজেই তরবারিই একমাত্র মীমাংসা এর কোন বিকল্প নেই। ফলে উভয় পক্ষের যোদ্ধারা একে অপরের মোকাবেলা করার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে পড়লো। হযরত আলী রাঃ এর পক্ষে যারা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করেছিলেন তারা হলো হুজব আদি আল কিন্দি, সাবাছ ইবনে রিবি আত তামিমি, খালিদ ইবনে মুয়াম্মার, জিয়াদ ইবনে নদর আল হারিছি, জিয়াদ ইবনে খাসাফাহ আত তায়মি, সাইদ ইবনে কায়েস আল হামদানি, কয়েস ইবনে সাদ আল আনসারী এবং মালিক ইবনে হারিছ আল আসতার। আর মুয়াবিয়ার পক্ষে আবদার রহমান ইবনে খালিদ বিন ওয়ালিদ, আবু আল আওয়ার আস সুলামি, হাবিব ইবনে মাসলামাহ আল ফিহরি, আবদুল্লাহ ইবনে জিলকালা, উবায়দুল্লাহ ইবনে উমার ইবনে আল খাত্তাব,সুরাহবিল ইবনে সিমত আল কিন্দি এবং হামজাহ ইবনে মালিক আল হামদানি। জিলহজ মাসের শেষে যুদ্ধ বন্ধ করা হল মুহরামের জন্য যুদ্ধ ১ মাস বন্ধ থাকার পর ১ সফর আবার যুদ্ধ শুরু হল। হযরত আলী রাঃ এর পক্ষ থেকে কুফি অশ্বারোহীগণের সেনাপতি হলেন মালিক আশতার ও কুফি পদাতিক বাহিনির সেনাপতি হলেন আম্মার ইবনে ইয়াসির এবং মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে অশ্বারোহীগণের সেনাপতি হলেন সহল হুনায়েক এবং পদাতিকের সেনাপতি হলেন কায়েস ইবনে সাদ। হযরত আলী রাঃ ঝাণ্ডা বহনকারী ছিল হাসিম ইবনে উতবাহ। মুয়াবিয়ার সেনাদলের দক্ষিণ বাহুর সেনাপতি ছিল ইবনে জিলকালা এবং বাম বাহুর সেনাপতি ছিল হাবিব ইবনে মাসালামাহ।
প্রথম দিন মালিক ইবনে আশতার যুদ্ধের ময়দানে তার লোকজন নিয়ে এবং হাবিব ইবনে মাসলামাহ তার লোকজন নিয়ে মালিকের মোকাবেলা করলো। সারাদিন তরবারি এবং বর্শার যুদ্ধ চলেছিল। পরদিন হাসিম ইবনে উতবাহ হযরত আলী রাঃ এর সৈন্য নিয়ে ময়দানে নামলো এবং আবু আল আওয়াল তার মোকাবেলা করলো। অশ্বারোহী অশ্বারোহীর উপর পদাতিক পদাতিকের উপর ঝাপিয়ে পড়লো এবং ভয়ানক যুদ্ধে দৃপ্তপদে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করেছিলো। তৃতীয় দিন আম্মার ইবনে ইয়াসির অশ্বারোহী এবং জিয়াদ ইবনে নদর পদাতিক বাহিনী নিয়ে ময়দানে নামলো। আমর ইবনে আস বিশাল বাহিনী নিয়ে তাদের মোকাবেলা করলো। মালিক এবং জিয়াদের প্রবল আক্রমণে শত্রুপক্ষ পরাজয়ের মুখামুখি এবং আক্রমণ রোধে ব্যর্থ হয়ে সেনা নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে যায়। চতুর্থ দিনে মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়া যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। উবায়দুল্লাহ ইবনে উমার তার মোকাবেলায় এসেছিল মুহাম্মাদ বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে হযরত মুয়াবিয়া রাঃ সেনেদলের প্রভূত ক্ষতি করে। পঞ্চম দিনে আবাদুল্লাহ ইবনে আব্বাস ময়দানে গেল এবং তার মোকাবেলা করার জন্য ওয়ালিদ ইবনে উকবা এসেছিল। কিন্তু আবাদুল্লাহ বীরবিক্রমে এমন প্রচণ্ড আক্রমণ করলো যে ওয়ালিদের সেনা পিছু হটে গেল। ছষ্ঠ দিনে কায়েস ইবনে সাদ আল আনসারী ময়দানে নামলো তার বিপরীতে ইবনে জিলকালা এসেছিল। উভয় পক্ষে এমন লড়াই হয়েছিল যে প্রতি পদক্ষেপে মৃতদেহ দেখা গিয়েছিল এবং রক্তের স্রোতধারা বয়ে গিয়েছিল। অবশেষে রাত নামলে উভয় বাহিনী আলাদা হয়ে যায়। সপ্তম দিনে মালিক আশতার ময়দানে নামলে হাবিব ইবনে মাসলামাহ তার মোকাবেলায় এসে যোহরের নামাজের পূর্বেই ময়দান ছেড়ে পিছিয়ে গেল। অষ্টম দিনেহযরত আলী রাঃ নিজেই ময়দানে গেলেন এবং এমন প্রচণ্ড বেগে আক্রমণ করলেন যে যুদ্ধক্ষেত্র কম্পিত হয়ে উঠেছিল। বর্শা ও তীরবৃষ্টি উপেক্ষা করে ব্যূহের পর ব্যূহ ভেদ করে শত্রুর উভয় লাইনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং মুয়াবিয়াকে চ্যালেঞ্জ করে বললেন অযথা লোক ক্ষয় করে লাভ কি ? তুমি আমার মোকাবেলা কর। তাতে একজন নিহত হলে অপরজন শাসক হবে। এ সময় ইবনে আস মুয়াবিয়াকে বললো আলী ঠিক বলেছেন। একটু সাহস করে তার মোকাবেলা কর। হযরত মুয়াবিয়া রাঃ বললো তোমাদের প্ররোচনায় আমি আমার প্রান হারাতে প্রস্তুত নই। এই বলে সে পিছনের দিকে চলে গেল। মুয়াবিয়াকে পিছনে হটতে দেখে হযরত আলী রাঃ মুচকি হেসে ফিরে এলেন।
যে সাহসিকতার সাথে হযরত আলী রাঃ সিফফিনে আক্রমণ রচনা করেছিলেন তা নিঃসন্দেহে অলৌকিক। যখনই যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতেন তখন শত্রু ব্যূহ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত এবং দুঃসাহসী যোদ্ধারাও তার মুখামুখি হতো না। এই কারনে তিনি কয়েক বার পোশাক বদল করে যুদ্ধক্ষেত্রে এসেছিলেন। একবার আরার ইবনে আদ’হামের মোকাবেলায় আব্বস ইবনে রাবি ইবনে হারিস ইবনে আবদাল মুত্তালিব গিয়েছিল। আব্বাস অনেকক্ষণ লড়াই করেও আরারকে পরাজিত করতে পারছিল না। হঠাৎ সে দেখতে পেল আরারের বর্মের একটা আংটা খুলে আছে। আব্বস কাল বিলম্ব না করে তরবারি দিয়ে আরও কটি আংটা কেটে দিয়ে চোখের নিমিষে আরারের বুকে তরবারি ঢুকিয়ে দিল। আরারের পতন দেখে হযরত মুয়াবিয়া রাঃ বিচলিত হয়ে গেল এবং আব্বাসকে হত্যা করতে পারে এমন কেউ আছে কিনা বলে চিৎকার করতে লাগলো। এতে গোত্রের লাখম গোত্রের কয়েকজন এগিয়ে এসে আব্বাসকে চ্যালেঞ্জ করলে সে বললো যে সে তার প্রধানের অনুমতি নিয়ে আসবে। আব্বাস হযরত আলী রাঃ কাছে গেলে তিনি তাকে রেখে তার পোশাক পরে এবং তার ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করলেন আব্বাস মনে করে লাখম গোত্রের লোকেরা বললো তাহলে তুমি তোমার প্রধানের অনুমতি নিয়েছ। তার উত্তরে হযরত আলী রাঃ বলেনঃ যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো তাদেরকে যারা আক্রান্ত হয়েছে কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ্‌ নিশ্চয় তাদের সাহায্য করতে সক্ষম। তখন লাখাম গোত্রের একজন লোক হাতির মত গর্জন করতে করতে হযরত আলী রাঃ এর উপর আঘাত করলো। তিনি সে আঘাত প্রতিহত করে এমন জোরে আঘাত করলেন যে লোকটি দ্বিখণ্ডিত হয়ে ঘোড়ার দুদিকে দুখণ্ড পরে গেল। তারপর সে গোত্রের অন্য একজন এসেছিল। সেও চোখের নিমিষে শেষ হয়ে গেল। আসি চালনা ও আঘাতের ধরন দেখে লোকেরা বুঝতে পারল যে আব্বাসের ছদ্মবেশে আল্লাহ্‌র সিংহ ময়দানে যুদ্ধ করছেন। তখন আর কেউ সাহস করে তার সামনে আসে নি। আম্মার ইবনে ইয়াসির ইবনে আমির ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় যে কজন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন।
তিনি প্রথম মুসলিম যিনি নিজের ঘরে মসজিদ নির্মাণ করে আল্লাহ্‌র ইবাদত করতেন। তার পিতা ইয়াসির এবং মাতা সুমাইয়ার সাথে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তার পিতা ও মাতা উভয়ে ইসলামের প্রথম শহীদ। আম্মার রাসুল সাঃ সময় থেকে ও বদর থেকে শুরু করে মহানবী সাঃ এর সাথে সকল যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। ইসলামের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রান। তার ধার্মিকতা বিশিষ্ট চারিত্রিক বৈশিষ্ট ও সৎকর্মের জন্য রাসুল সাঃ অনেক হাদিস আছে। আয়েশা রাঃ ও বেশ কয়েক জন সাহাবীর বর্ণনায় আছেঃ
রাসুল সাঃ বলেছেন, “আম্মারের আপাদমস্তক ইমানে ভরপুর”।
রাসুল সাঃ আরও বলেন, “আম্মার সত্যের সাথে সত্য আম্মারের সাথে। সত্য যেদিকে আম্মার সেদিকে। চোখ নাকের যতটা কাছে আম্মার আমার ততটা কাছের, কিন্তু হায় হায়! একটা বিদ্রোহী দল তাকে হত্যা করবে”।
রাসুল সাঃ আরও বলেন, “হায়, হায়! সত্য ত্যাগী একদল বিদ্রোহী আম্মারকে হত্যা করবে, আম্মার তাদেরকে জান্নাতের দিকে ডাকবে এবং ওরা আম্মারকে জাহান্নামের দিকে ডাকবে। তাঁর হত্যাকারী এবং যারা তার অস্ত্র ও পরিচ্ছদ খুলে ফেলবে তারা জাহান্নামের অধিবাসী”।
হযরত আলী রাঃ ক্ষমতায় আশার পর আম্মার তার একজন একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। তিনি সেসময় সকল প্রকার সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রতিরক্ষা মূলক কাজে অংশ গ্রহণ করেছিলন। বিশেষ করে জামালের এবং সিফফিনের যুদ্ধে। আম্মার শত্রু সনৈব্যূহের মধ্যে প্রবেশ করে একের পর এক আক্রমণ রচনা করে তাদের মোকাবেলা করছিলো। তখন কিছু সৈন্য তাকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং আবু আল যুহরী নামক এক পিশাচ তাকে এমন আঘত করেছিল যে যা সহ্য করতে না পেরে সাউনি তে ফিরে গেলেন। সাউনিতে ফিরে তিনি পানি চাইলেন। লোকেরা তাকে এক বাটি দুধ দিয়েছিল। দুধ দেখে আম্মার বলেছিলেন, “আল্লাহ্‌র রাসুল ঠিক কথাই বলেছেন”। লোকেরা এই কথার অর্থ জানতে চাইলে তিনি বললেন, “আল্লাহ্‌র রাসুল আমাকে একদিন বলেছিলেন এই পৃথিবীতে আমার শেষ খাদ্য হবে দুধ”। এই দুধ পান করার পর নিজে কে আল্লাহ্‌র কাছে সপে দিলেন। হযরত আলী রাঃ তার মাথা কোলে তুলে নিয়ে বললেন নিশ্চয় যদি কোন মুসলিম আম্মারের মৃত্যুতে মানসিক ভাবে আহত না হয়ে থাকে তবে তাকে যর্থাথ ঈমানদার বলা যাবে না। হযরত আলী রাঃ অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন, রাসুল সাঃ বলেছিলেন “আম্মার সত্যের সাথে সত্য আম্মারের সাথে”। আম্মার ইবনে ইয়াসির ইবনে আমির সিফফিন যুদ্ধে মারা যান। অন্যদিকে আম্মারের মৃত্যুতে মুয়াবিয়ার সৈনদের মধ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তাদের মনে ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে তারা ন্যায়ের জন্য হযরত আলী রাঃ এর বিরুদ্ধে লড়ছে। আম্মারের সম্পর্কে রাসুল সাঃ এর ওই বানী অনেকেই জানত আম্মারের মৃত্যুতে তাদের ভুল ভেঙ্গে গেল। তারা বুঝতে পারল যে তারা অন্যায় যুদ্ধে লিপ্ত এবং হযরত আলী রাঃ ন্যায়ের পথে রয়েছেন।

এ চিন্তা অফিসার হতে শুরু করে সাধারন সৈনিক সবার মনে আলোড়ন তৈরি করেছিলো। তাছাড়াও রাসুলের সাঃ অনেক সাহাবী এবং আনসারী এ যুদ্ধে শহীদ হন। যেমন খুজায়মাহ ইবনে ছাবিত আল আনসারী। রাসুল সাঃ তার সাক্ষ্যকে দুজন লোকের সাক্ষ্যের সমতুল্য সত্য বলে মনে করতেন একারণে তার উপাধি ছিল যূশ শাহাদাতাইন। সিফফিনের যুদ্ধে ময়দানে তার কাছাকাছি কোন হযরত আলী রাঃ এর সৈন্য এলে তিনি চিৎকার করে বলতেন, আমি যূশ শাহাদাতাইন খুজায়মাহ ইবনে ছাবিত আল আনসারী আমি রাসুল সাঃ কে বলতে শুনেছি “যুদ্ধ কর, যুদ্ধ কর, আলীর পক্ষে যুদ্ধ কর”। নবম দিনে দক্ষিণ বাহুর দায়িত্ব দেওয়া হল আবদুল্লাহ ইবনে বুদায়ল কে এবং বাম বাহুর দায়িত্বে ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস হযরত আলী রাঃ মধ্যভাগে ছিলেন। মুয়াবিয়ার সৈন্যদের নেতৃতে ছিল হাবিব ইবনে মাস্লামাহ। উভয় লাইন মুখামুখি হলে একে অপরের উপর সিংহের মত ঝাপিয়ে পড়েছিল এবং চারদিক থেকে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। হযরত আলী রাঃ এর পতাকা বনি হামাদানের হাতে ঘুরছিল।

একজন শহীদ হলে আরেকজন তুলে ধরে। প্রথমে শুরায়রের হাতে ছিল তার পতনে শুরাহবিল ইবনে শুরায়রের হাতে গেল তারপর ইয়ারিম ইবনে শুরায়রের, তারপর হুবায়রাহ ইবনে শুরায়র তারপর মারসাদ ইবনে শুরায়র এই ছয় ভাই শহীদ হবার পর পতাকা গ্রহণ করল সুফিয়ান তারপর আবাদ, তারপর কুরায়ব জায়েদের তিন পুত্র । তারা শহীদ হবার পর পতাকা ধারন করলো বসিরের দুপুত্র উমায়র ও হারিস। তারা শহীদ হবার পর পতাকা ধারন করল ওহাব ইবনে কুরায়ব। এই দিনের যুদ্ধে শত্রুর বেশি লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ বাম বাহুর দিকে। সেদিকে এত তীব্র বেগে আক্রমণ করেছিল যে আবদুল্লাহ ইবনে বুদায়লের সাথে মাত্র তিনশত সৈন্য ছাড়া সকলেই যুদ্ধক্ষেত্র পিছিয়ে গিয়েছিল। এই অবস্থা দেখে হযরত আলী রাঃ আশতারকে বললেন ওদের ফিরিয়ে আন। ওদের জীবন যদি ফুরিয়ে আসে থাকে তাহলে পালিয়ে গিয়ে মৃত্যু কে এড়ানো যাবে না। দক্ষিণ বাহুর পরাজয় বাম বাহু কে প্রভাবিত করবে ভেবে হযরত আলী রাঃ বাম বাহুর দিকে এগিয়ে গেলেন। সেসময় উমাইয়াদের এক ক্রীতদাস আহমার বলল তোমাকে কতল করতে না পারলে আল্লাহ্‌ আমার মৃত্যু দেন এই কথা শুনে হযরত আলী রাঃ এর এক ক্রীতদাস ফায়সান তার উপর ঝাপিয়ে পড়লো। সে শহীদ হলে হযরত আলী রাঃ আহমারকে এমন আছাড় দিলেন যে তার শরীরের সব জোড়া খুলে গিয়েছিল।

তখন ইমাম হাসান ও মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়া তাকে জাহান্নামে পাঠায়ে দিল। অন্যদিকে মালিক আসতারের আহব্বানে দক্ষিণ বাহুর পালাতক লোকজন ফিরে আসে তীব্র আক্রমণ করে শত্রুকে পূর্বস্থানে ঠেলে নিয়ে গেল সেখানে আবদুল্লাহ ইবনে বুদায়েল শত্রু কর্তৃক ঘেরাও হয়ে ছিলেন। নিজের লোকজন দেখে সাহস ফিরে এলো। সে মুয়াবিয়ার তাবুর ওপর ঝাপিয়ে পড়লেন। হযরত মুয়াবিয়া রাঃ আবদুল্লাহ ইবনে বুদায়েল কে দেখে ভয় পেয়ে তার দেহরক্ষীদের পাথর মারতে বলল। এতে তিনি শহীদ হন। মালিক বনি হামদান এবং বনি মুযহিদ এর যোদ্ধা নিয়ে মুয়াবিয়ার উপর আক্রমণ চালাবার জন্য এগিয়ে গেল এবং দেহরক্ষীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাগলো। দেহরক্ষীদের পাঁচটি চক্রের মধ্যে একটি বাকী থাকলে হযরত মুয়াবিয়া রাঃ পালাতে চাইলে, এমন সময় কে একজন সাহস দেওয়ায় সে ফিরে দাঁড়াল। অপর দিকে আম্মারের তরবারি প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। আম্মার যেদিকে যেত রাসুল সাঃ এর সকল সাহাবী তাকে অনুসরণ করত।
এইদিনে আম্মার শহীদ হন। এসব অকুতোভয় যোদ্ধাগনের মৃত্যুতে হযরত আলী রাঃ দুঃখিত হৃদয়ে হামদান ও রাবিয়াহ গোত্রদ্বয়ের লোকদের বললেন আমার কাছে তোমরা বর্ম ও বর্শা সমতুল্য। উঠে দাঁড়াও এসব বিদ্রোহীকে উচিত শিক্ষা দাও। ফলে হামদান এবং রাবিয়াহ গোত্রদ্বয়ের বার হাজার সৈন্য তরবারি হাতে দাড়িয়ে গেল।তাদের পতাকা ছিল হুদায়ন ইবনে মুনযিরের হাতে। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করলো এবং ব্যূহ একের পর এক ভেদ করে রক্তের স্রোত বইয়ে দিল এবং লাশ স্তূপীকৃত হয়ে রইল। রাতের গাঢ় অন্ধকার না নামা পর্যন্ত তরবারি থামলো না। এটাই সেই ভয়ঙ্কর রাত যা ইতিহাসে আল হারিরের রাত্রি বলে খ্যাত। এই রাতে অস্ত্রের ঝনঝনানি ঘোড়ার খুরের শব্দ এবং মুয়াবিয়ার সৈন্যদের আর্তনাদে আকাশ প্রকম্পিত হয়েছিল। আর হযরত আলী রাঃ এর দিক থাকে অন্যায় ও বিভ্রান্তি নিপাত যাক শ্লোগানে তার সৈন্যগণের সাহস বৃদ্ধি করছিল এবং মুয়াবিয়ার হ্রদয় শুকিয়ে দিয়েছিল। সকাল বেলায় দেখা গেল ত্রিশ হাজার উর্ধে লোক নিহত হয়েছে। দশম দিনে হযরত আলী রাঃ এর সৈন্যগন একই মনোবল নিয়ে যুদ্ধে গেল। দক্ষিণ বাম বাহুর দলনেতা ছিলেন মালিক আল আসতার এবং বাম বাহুর নেতা আব্বাস। তারা এমন তীব্র বেগে আক্রমণ রচনা করেছিলেন যে মুয়াবিয়ার সৈন্যরা পালাতে শুরু করেছিল।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ১১:৩৪
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×