আবু রায়হান মোহাম্মদ ইবনে আহমদ আল বীরুনি ছিলেন মধ্য যুগের একজন বিশিষ্ট আরবীয় শিক্ষাবিদ ও গবেষক। তিনি অত্যন্ত মৌলিক এবং গভীর চিন্তাধারা অধিকারী ছিল। তার পূর্ণ নাম হল আবু রায়হান মোহাম্মদ ইবনে আহমদ আল বীরুনি শহরের বাহিরে বসবাসের জন্য সাধারণভাবে তিনি আল-বুরুনী নামেই বেশি পরিচিত। রুশীয় তুর্কীস্তান খিওয়াতে এটি এখানে অবস্থিত। শহরটি খৌজিজিমের রাজধানী কাছাকাছি ছিল এখন শহরটি নদী বিলীন হয়ে গেছে এখন এই স্থানটি আল-বরিয় শহরটি নাম করা হয়েছে মুখি তিনি গণিত, জ্যোতিবিজ্ঞান, রসায়ন এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞান দক্ষতা। অধিকন্তু ভূগোলবিদ, ঐতিহাসিক, গণিতবিদ, দার্শনিক ও চিকিৎসা বিজ্ঞান, ভাষাতত্ত্ববিদ ও ধর্মতত্ত্বের নিরপেহম বিশ্লেষক। স্বাধীন চিন্তাধারা, মুক্তবুদ্ধি, সাহসিকতা, নির্ভীক সমালোচক এবং সঠিক মতামত জন্য যুগশ্রেষ্ঠ বলেন স্বীকৃত। হিজরী চতুর্থ শতকের শেষার্ধ এবং পঞ্চম শতাব্দীর প্রথম অর্ধে আল-বুরুনী কল বলে। তিনি সর্বপ্রথম প্রাচ্য জ্ঞানবিজ্ঞান, বিশেষ করে ভারত জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতি মুসলিম মনীষীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। অধ্যাপক মাপা বলেছেন আল-বুরুনী শুধু মুসলিম বিশ্বই নয় বরং তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তি এক জন।আবু রায়হান আল বিরুনি ইরানের একটি অতি সাধারণ পারিবারে ৯৭৩ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর তারিখে জন্ম গ্রহণ করেন। জীবনের প্রথম ২৫ বছর আবু রায়হান আল বিরুনি স্বীয় জন্মভূমিতে অতিবাহিত করেন।
তিনি গণিতশাস্ত্র আবু নাস এর ইবন আলি ইবন ইরাক জিলানি এবং তদ্রূপ আরো কিছু বিদ্বান ব্যক্তির কাছে শিহ্মা গ্রহণ করেন। অধ্যয়নকালেই তিনি তার কিছু প্রাথমিক রচনা প্রকাশ করেন এবং প্রখ্যাত দার্শনিক এবং চিকিৎসাশাস্ত্রজ্ঞ ইবন সিনার সাথে পত্র বিনিময় করেন। আল বিরুনির মাতৃভাষা ছিল খাওয়ারিজিম আঞ্চলিক ইরানি ভাষা। কিন্তু তিনি তার রচনাবলি আরবিতে লিখে গেছেন। আরবি ভাষায় তার অগাধ পান্ডিত্য ছিল। তিনি আরবিতে কিছু কবিতাও রচনা করেন। অবশ্য শেষের দিকে কিছু গ্রন্থ ফার্সিতে অথবা আরবি এবং ফার্সি উভয় ভাষাতেই রচনা করেন। তিনি গ্রিক ভাষাও জানতেন। হিব্রু ও সিরীয় ভাষাতেও তার জ্ঞান ছিল অসিম।তিনি ১০০৮ সালে নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং শাহ আবুল হাসান আলি ইবনে মামুন কর্তৃক সম্মানে গৃহীত হন। তিনি আলি ইবনে মামুনের ইন্তেকালের পর তার ভ্রাতার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন এবং অনেক নাজুক রাজনৈতিক কার্যকলাপ ছাড়াও রাজকীয় দৌত্যকার্যের দায়িত্বেও নিয়োজিত থাকেন। মামুন তার সৈন্যবাহিনী কর্তৃক ১০১৬ সাল থেকে১০১৭ সালের ভিতর নিহত হওয়ার পর সুলতান মাহমুদ খাওয়ারিজম দখল করে নেন।গণিতবিদ আবু নাসের মানসুর ইবন আলি এবং চিকিৎসক আবুল খায়ের আল-হুসায়ন ইবন বাবা আল-খাম্মার আল-বাগ দাদদির সাথে গজনি চলে যান। সেখানেই তার জ্ঞানচর্চার স্বর্ণযুগের সূচনা হয়। তখন হতে তিনি গাজনি শাহী দরবারে সম্ভবত রাজ জ্যোতির্বিদ হিসেবে অবস্থান করতে থাকেন। তিনি কয়েকবার সুলতান মাহমুদের সাথে উত্তর-পশ্চিম ভারতে গমন করে ছিলেন। গজনির সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি ভারতে প্রায় ১২ বছর অবস্থান করেন। এখানে সংস্কৃত ভাষা শেখেন এবং হিন্দু ধর্ম, ভারতীয় সভ্যতা এবং সংস্কৃতি, দেশাচার, সামাজিক প্রথা, রাতিনীতি, কুসংস্কার ইত্যাদি বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি ভারতীয় কিছু আঞ্চলিক ভাষাও জ্ঞান লাভ করেছিলেন। তিনি সেই এক যুগের অধ্যায় ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দ্বারা রচনা করেন তার বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ কিতাবুল তারিকিল-হিন্দ।
আল-বিরুনি যে কত বড় ফলিত বিজ্ঞানী এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে তিনি যে কত উচ্চস্তরে স্থান লাভ করেছিলেন সে সম্বন্ধে একটি ঘটনা উল্লেখই যথেষ্ট। একদিন সুলতান মাহমুদ গজনিতে তার হাজার বৃহ্মের বাগানে গ্রীষ্মবাসের ছাদে বসে আল বিরুনিকে বললন এ বাড়ির চার দরজার কোন দরজাটি দিয়ে আমি বের হবো, আপনি তা গুনে ঠিক করে একটি কাগজ়ে লিখে আমার কম্বলের নিচে রেখে দিন। আল-বিরুনি তার আস্তারলব যন্ত্রের সাহায্যে অঙ্ক কষে তার অভিমত একটি কাগজ়ে লিখে সুলতান মাহমুদের কম্বলের নিচে রেখে দিলেন। তখন সুলতান রাজমিস্ত্রির সাহায্যে একটি নতুন দরজা সৃষ্টি করে বেরিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসে দেখেন আল-বিরুনির কাগজে অনুরূপ কথাই লেখাঃ আপনি পূর্ব দিকের দেয়াল কেটে একটি নতুন দরজা করে বেরিয়ে যাবেন। কাগজের লেখা পাঠ করে সুলতান রেগে গিয়ে ছাদ থেকে আল-বিরুনিকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়ার জন্য আদেশ দিলেন। নিচে মশামাছি প্রতিরোধের জন্য জাল পাতা ছিল। সুলতানের আদেশ কার্যকর হওয়ার পর আল-বিরুনি সেই জালে আটকে গিয়ে মাটিতে আস্তে পড়ার ফলে বেশি আঘাত পেলেন না। সুলতান আল-বিরুনিকে আবার ডেকে আনলেন এবং তার চাকরের কাছ থেকে আল বিরুনির দৈনিক ভাগ্য গণনার ডায়েরিটা নিয়ে সুলতান দেখলেন, তাতে লিখা আছে আমি আজ উঁচু জায়গা থেকে নিচে পড়ে গেলেও বিশেষ আঘাত পাব না। সেটা দেখে সুলতান আরো রেগে গিয়ে আল-বিরুনিকে জেলে পাঠালেন। তারপর আল-বিরুনিকে কারগার থেকে মুক্তির সুপারিশ করতে কেউ সাহস পেলেন না। ছয় মাস পর সুলতানের মনমর্জি বুঝে প্রধানমন্ত্রী আহমদ হাসান একদিন আল-বিরুনির প্রতি সুলতানের নেক নজর আকর্ষণ করলেন। সুলতান মাহমুদের এ কথা স্বরণই ছিল না। তিনি তৎহ্মণাৎ তাকে মুক্তি দিলেন।ইউরোপীয় পন্ডিতদের মতে আল-বিরুনি ছিলেন স্বয়ং বিশ্বকোষ এবং তার প্রত্যেকটি গ্রন্থ ছিল জ্ঞানের আধার। ভারতীয় পন্ডিতরা আল-বিরুনিকে জ্ঞানের সমুদ্র বলতেন । কোনো অবস্থাতেই তার এসব অমূল্য গ্রন্থের পরিচয় কম কথায় দেয়া সম্ভব নয়। আল-বিরুনির ভারত থেকে গজনি প্রত্যাবর্তন করার কিছু দিন পর সুলতান মাহমুদ ইন্তেকাল করেন। অতঃপর পুত্র সুলতান মাসউদ ১০৩০ সালে সিংহাসনে আরহণ করেন। তিনি ১০৩০ সাল থেকে১০৪১ সাল পর্যন্ত সিংহাসনে ছিলেন। সুলতান মাসউদ আল-বিরুনিকে খুব সম্মান করতেন। আল-বিরুনি তার অণুরক্ত হয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থের নাম সুলতানের নামানুসারে রাখেন, কানুন মাসুউদী এবং সেটা সুলতানের নামে উৎসর্গ করেন। সুবিশাল গ্রন্থখানা সর্বমোট ১১ খন্ডে সমাপ্ত। গ্রন্থটির গুরুত্ব উপলব্ধি করে সুলতান মাসউদ অত্যন্ত খুশি হয়ে একটি হাতির ওজনের পরিমাণ রৌপ্য বৈজ্ঞানিক আল-বিরুনিকে উপহার করেন। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ না করে বাহিক্য সন্তোষ প্রকাশ করে সব রৌপ্যই রাজকোষে ফিরিয়ে দেন। মন্তব্য করেন, তার এত ধনসম্পদের কোনো প্রয়োজন নেই।
কানুন মাসুউদী এর বিষয় গ্রন্থটির প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ডে জ্যোতির্বিজ্ঞান, তৃতীয় খন্ডে ত্রিকোণমিতি। এতে দু'টি তালিকা দেয়া হয়েছে। এখানে জ্যোতির্বিজ্ঞান আলোচনার সাথে ত্রিকোণমিতিকে উচ্চস্তরে উন্নীত করার প্রচেষ্টায় তিনি যে সফলতা লাভ করেছেন তা প্রশংসনীয়। মাসউদের অণুরোধে অতি সরল পদ্ধিতে সাধারণের বোধগম্য ভাষায় দিবারাত্রির পরিমণবিষয়ক একটি পুস্তকও তিনি প্রণয়ন করন। চতুর্থ খন্ডে গোলাকার জ্যোতির্বিদ্যা (Spherical Astronomy); পঞ্চম খন্ডে চন্দ্র, সূর্যের মাপ, গ্রহ এবং দ্রাঘিমা; ছষ্ঠ খন্ডে সূর্যের গতি প্রকৃতি; সপ্তম খন্ডে চন্দ্রের গতি প্রকৃতি; অষ্টম খন্ডে চন্দ্রের দৃশ্যমান ও গ্রহণ এবং নবম খন্ডে স্থির নহ্মত্র; দশম খন্ডে পাঁচটি গ্রহ নিয়ে এবং একাদশ জ্যোতিষ বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং এখানে তিনি মূল্যবান অর্থ উপস্থাপন করেন।আল-বিরুনির সর্বমোট ১১৩টি গ্রন্থের উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে ১০৩টি গ্রন্থ সম্পূর্ণ হয়েছে এবং ১০টি অসম্পূর্ণ গ্রন্থের উল্লেখ রয়েছে। আবু নাসের মানসুর ১২টি, আবু সাহল আ-মাসিহি ১২টি, আবু সাহল আল-মাসিহি ১২টি, আবু আলি আল-হাসন ইবন আলি আল-জিলি একটি পুস্তক তার নামে আরোপিত করে উল্লেখ করেছেন। ফলে মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩৮টি। উপরিউক্ত রিসালায় রচনার পরে তিনি আরো কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য হতে প্রতীয়মান হয়, তার রচিত গ্রন্থের সর্বমোট সংখ্যা ১৮০টি। এগুলো তথ্য, তত্ত্ব ও পরিসরের দিকে হতে বিভিন্ন। কোনোটি পুস্তক, কোনোটি গবেষণামূলক সন্দর্ভ আবার কোনোটি বৃহদাকার গ্রন্থ, যাতে জ্ঞানের বিশাল ভান্ডার বিধৃত ধারণ করা হয়েছে।জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নামে একটি হলের নামকরণ করা হয়। আল-বিরুনি ৬৩ বছর বয়সে গুরুতর রোগে আক্রান্ত হন। তার পরও তিনি ১২ বছর বেঁচেছিলেন। ১৩ই ডিসেম্বর ১০৪৮ সালে তিনি মারা যান।
সূত্রঃ http://www.juniv.edu/hall/al-beruni-hall
http://www.iranicaonline.org/articles/biruni-abu-rayhan-ii
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ১২:২১