somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফিরে দেখা মুসলিম বিরোধী সাম্প্রদায়িকতা সাহিত্যের পাতা (রবীন্দ্রনাথ,শরৎচন্দ্র এবং অনেক হিন্দু কবিদের মুসলিম যে বিদ্বেষী)

১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১২:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বহু কাল আগে থেকেই বাংলা সাহিত্যে বিভিন্ন হিন্দু কবি সাহিত্যিকদের দারা ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতা এবং চরম বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন মুসলমানরা। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮২৭থেকে৮৭সাল) পদ্মিনী উপাখ্যানে (১৮৫৮ সাল) স্বাধীনতার কামনা, পরাধীনতার বেদনা, দেশপ্রীতি এবং বিদেশাগত মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষের ভাব প্রকাশিত হয়েছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৭৯ সালে প্রকাশিত অশ্রুমতী
নাটক উৎসর্গ করেন অনুজ রবীন্দ্রনাথকে। এবং উক্ত নাটক ছিল মুসলিম বিদ্বেষে পরিপূর্ণতা। উক্ত নাটকের সৈন্যগণ বলছেন আজ আমরা
যুদ্ধে প্রাণ দেব,চিতোরের গৌরব রক্ষা করব,মুসলমান রক্তে আমাদের অসির জ্বলন্ত পিপাসা শান্ত করব (অশ্রুমতী : জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নাটক সমগ্র, সাহিত্য সংসদ,২০০২, পৃষ্ঠা ১১৩।)।
এমনকি হিন্দু কবি সাহিত্যিকগণ মুসলমানদের ম্লেচ্ছ, যবন, নেড়ে, পাষন্ড, পাপিষ্ঠ, পাপাত্মা, দুরাত্মা, দুরাশয়, নরাধম, নরপিশাচ, পাতকী, বানর, এঁড়ে, দেড়ে, ধেড়ে, অজ্ঞান, অকৃতজ্ঞ, ইতর এ জাতীয় কোনো গালি দিতে বাদ দেয়নি। বঙ্কিম চন্দ্রের ‘মৃণালীনী’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘রাজ সিংহ’ ও ‘কবিতা পুস্তক’, ইশ্বর গুপ্তের ‘কবিতা সংগ্রহ’ দামোদর মুখোপাধ্যয়ের ‘প্রতাপসিংহ’ যজ্ঞেশ্বর মুখোপাধ্যয়ের বঙ্গানুবাদিত ‘রাজস্থান’ দীন বন্ধু মিত্রের ‘জামাই বারিক’ ইত্যাদি ইসলাম বিদ্বেষে পরিপূর্ণ। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৩৮সাল থেকে১৯০৩ সালে) কাব্যসজ্জায় সুস্পষ্ট মুসলমান বিদ্বেষ পাওয়া যায় । হেমচন্দ্র তার বীরবাহুতে (১৮৬৪সাল) লিখেছেন আরে রে নিষ্ঠুর জাতি পাষণ্ড বর্বর পুরাব যবন-রক্তে শমন-খর্পর’। ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আধুনিক বাংলা কাব্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, প্রথম প্রকাশ, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ১৯৭০।


সলিমুল্লাহ-খান বলছেনঃ
প্রথমেই দেখা যাক ভারতবর্ষের ইতিহাসকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিভাবে দেখিয়াছেন।
ইংরেজি বিশ শতকের গোড়ার দিকে লিখিতে বসিয়া ভারতবর্ষের ইতিহাসের অব্যবহিত আগেকার সাতশত বছরকে ঠাকুর ‘বিদেশি শাসন’ বলিয়া রায় দিয়াছেন। ব্রিটিশ মহাজনেরা ততদিনে প্রায় দেড়শত বছর এই উপমহাদেশ শাসন করিয়াছেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যখানে শুরু ধরিলে হিসাব তাহাই দাঁড়ায় বৈ কি! এর আগের সাড়ে পাঁচশত বছরের মুসলিম শাসনকেও রবীন্দ্রনাথ ‘বিদেশি শাসন’ বলিতেছেন। সমস্যার গোড়া এই জায়গায়।

সাম্প্রদায়িকতা শব্দটিও ঔপনিবেশিক শাসনের জের। প্রমাণস্বরূপ দুইটি কথা উল্লেখ করা যায়। এখন ভারতের ‘ইতিহাস ব্যবসায়ী’দের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের সংখ্যাই বেশি। তাঁহারা সাড়ে পাঁচশত বত্সরের মুসলিম শাসনকে বিদেশি শাসনই মনে করেন। সাম্প্রদায়িকতার গোড়া এই জায়গায়। আমাদের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা রবীন্দ্রনাথকে ছুঁইয়া কথা বলিবেন না। সত্যকে স্বীকার করিবেন না। ঘটনার মূলে যাইবেন না। তাঁহারা ভারতের ইতিহাস সাম্প্রদায়িকভাবে পড়িবেন ও লিখিবেন। সাম্প্রদায়িকতা জিইয়ে থাকার মূল কারণ এইখানেই পাওয়া যায়।

১৯৪৭ সালে আসিয়া ভারত দুই ভাগ হইল কেন? সবাই বলে, হিন্দু-মুসলমান দুই জাতি। তাই দুই আলাদা দেশ হইল। দ্বিজাতি তত্ত্বের মূল কথা এই। এই বাবদ মুহম্মদ আলী জিন্নাহকে বাহবা দিয়া থাকেন সকলেই। এখানে তাঁহার কৃতিত্ব কি? এ তো ষোল আনা রবীন্দ্রনাথ পথিকের কৃতিত্ব। হিন্দু-ব্রাহ্ম নির্বিশেষে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু হইতেই (যখন মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা দেখা দেয় নাই, তখন হইতেই) তাঁহারা ভারতবর্ষ শুদ্ধ হিন্দুর দেশ বলিয়া কল্পনা শুরু করিলেন। পাঁড় হিন্দুর কথা না হয় বাদই দিলাম। ব্রাহ্মধর্মের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রাজনারায়ণ বসু হইতে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বেবাকেই প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষভাবে এটি করেছেন। ধর্মোন্মাদ হিন্দুর উত্তরসূরি আজ বিজেপি, বজরঙ্গ দল, শিবসেনা, বিশ্বহিন্দু পরিষদ।

ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িকতার উদগাতা হিন্দু জাতীয়তাবাদ প্রবর্তক সম্প্রদায়। আর পাল্লা দেওয়ার জন্য মুসলমানরা অভিজাত সম্প্রদায় মুসলমানি জাতিধর্ম তৈরি করিয়াছেন।
এখন যদি বলি জাতীয়তাবাদ কি সাম্প্রদায়িকতার দায়ে উভয়পক্ষই দায়ী, তো তাহা হইবে চরম ভুল। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা এক নম্বরে দায়ী আর মুসলমান জাতীয়তাবাদীরা আছেন দুই নম্বর দাগে। এই সত্য যদি সঠিক নিরূপণ না করি তো ইতিহাসের মধ্যে একটি মেঘাচ্ছন্নভাব থাকিয়া যাইবে।ভারতের প্রগতিশীল ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার হইতে সুমিত সরকার পর্যন্ত অনেকেই হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার সত্যবিচার করিয়াছেন। তবে কিছু গণ্ডগোল তাঁহাদেরও মাথায় আছে।


মহাত্মা রণজিত্ গুহ আর তাঁহার শিষ্যসামন্তের কথাই ধরুন। তাঁহারাও নব্য-সাম্প্রদায়িক। গৌতম ভদ্র হইতে দীপেশ চক্রবর্তীর পায়ের নখ হইতে মাথার চুল পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক। এখন তাঁহারাও যদুনাথ সরকার আর রমেশচন্দ্র মজুমদারের ঘোলাজলে সুখে জলক্রীড়া করিতেছেন। পার্থ চ্যাটার্জিও এই দলে। তো আমরা কাঁহার দুয়ারে ভিক্ষা লইতে যাইব!ভারতবর্ষের ইতিহাস সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস। অন্তত পরাধীন যুগের ইতিহাস সেই কথাই বলিতেছে। সম্প্রদায় থাকলেও ঔপনিবেশিক যুগের আগের ইতিহাস সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস ছিল। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক সবসময় বলিতেন, ইংরেজরা আসার ৫০০ বছর আগে পর্যন্ত ভারতবর্ষে যুদ্ধবিগ্রহ ঢের হয়েছে, মগর একটিও সাম্প্রদায়িক যুদ্ধ হয় নাই। মানে হিন্দু বনাম মুসলমান যুদ্ধ হয় নাই একটিও। মুসলমান বাহিনীতে হিন্দু সেনাপতি আর হিন্দু বাহিনীতে মুসলিম সেনাপতি থাকাই ছিল প্রায় নিয়ম।

সেই সময় যাহারা বিদেশ হইতে আক্রমণ করিতে আসিয়াছিলেন, তাঁহারা বিদেশি পরিচয়েই আসিয়াছিলেন। বিদেশ হইতে আসিয়া তাঁহারা এই দেশেই থিতু হইয়াছিলেন। পহিলা পাঠান। তারপর মোগল। এই দেশ হইতে তাঁহারা ধনদৌলত পাচার করিয়া মধ্যপ্রাচ্যে, তুরস্কে কি মঙ্গোলিয়া লইয়া গিয়াছেন এমন প্রমাণ নাই। নাদির শাহ দিল্লির সিংহাসন লুট করিয়াছেন। ইহা লুটতরাজের ব্যাপার। বাবর হইতে বাহাদুর শাহ জাফর পর্যন্ত কি বিদেশি শাসক, না এই দেশের লোক!

অষ্টাদশ শতাব্দী তো অরাজক যুগ। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলার ইতিহাসে দুইটি বড় ঘটনা ঘটে। পশ্চিমে বর্গীর হামলা। আর পূর্ববঙ্গে মগ (আরাকানি) ও ফিরিঙ্গির (পর্তুগিজ) উত্পাত। আরাকানি ও পর্তুগিজ বাহিনী বার বার বাংলার পূর্বপ্রান্তে হামলা করিত। ইহাতে সাম্প্রদায়িক সুর শুনিতে চাহিলে শুনিতে পারিবেন। ইহার তাত্পর্য অন্য জায়গায়।আরাকান হইতে যাহারা আক্রমণ করিতেন বাংলার লোকজন তাহাদের ‘মগ’ ডাকিত। মারহাট্টাদেশ হইতে যাহারা আক্রমণ করিতেন বাংলায় তাহাদের বলা হইত ‘বর্গী। তাহারা বর্গাকারে সৈন্য সমাবেশ করিয়া আসিতেন বলিয়া এই নাম। কিন্তু লক্ষ করিলে দেখা যাইবে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে বাংলাদেশের বর্ণবাদী বুদ্ধিজীবীরা ভারতমুক্তির মন্ত্রদাতা বলিয়া শিবাজী বন্দনা করিতেছেন।

১৯০২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘শিবাজী উত্সব’ কবিতা লিখিলেন। শুধু তিনিই নহেন, ‘শিবাজী উত্সব’, ‘মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাত’ কে না লিখিয়াছেন! বর্গীর হামলায় বাংলার শিশুরা গতকালও আঁতকাইয়া উঠিয়াছে। সেই বর্গীর দলই ভারতের মুক্তিদাতা এই বাক্য বলিতে পিছপা হইলেন না রবীন্দ্রনাথ। কারণ কি?

১৮২৯-৩০ সালে ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবী জেমস টড একটি বই লিখিলেন। তাহাতে রাজস্থানের রাজদাঙ্গার কাহিনীকে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হিসেবে দেখানো হইল। রাজপুত আর মোগলের লড়াইকে হিন্দু ও মুসলমানের লড়াই আকারে দেখাইলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সেইখান হইতে পাঠ লইতে পিছুপা হন নাই। ১৯৪৭ ইহারই জেরবাদ। সেই সময় আমরা মনে করিলাম কিনা দেশভাগ হইলে সব সমস্যার সমাধান হইবে। নতুন করিয়া পাকিস্তানে হিন্দুরা আর ভারতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু হইলেন। আগে সারা ভারতেই মুসলমানরা সংখ্যালঘু ছিল। সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের জন্য দেশভাগের দরকার ছিল না। আরও বহু বিকল্প ছিল। তাই বলিতেছিলাম, সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস ইতিহাসের দিক হইতে দেখিতে হইবে।

ভারতবর্ষের ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির ক্ষেত্রে ইংরেজরা যথেষ্ট সহায়তা করিয়াছেন। আলাউদ্দিন খিলজী চিতোর দুর্গ আক্রমণ করিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে হিন্দুস্তানী কবি মালিক মুহম্মদ জয়সী কবিতাও লিখিলেন। আলাওল সেইটির বাংলা অনুবাদ করেন। জেমস টড ইহার সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা দিলেন। এক রাজা আরেক রাজার রাজ্য আক্রমণ করেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসের অনেক পুরানা ব্যাপার এই ধরনের। এহেন রাজদাঙ্গাকে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় রূপান্তরিত করায়, বিষয় ফুলাইয়া ফাঁপাইয়া বলায় ভারতবর্ষে বর্গীর হামলা আর হামলা থাকিল না, মুক্তিযুদ্ধ হইয়া দাঁড়াইল। বর্গীরা পুরা ভারতবর্ষের ইতিহাসকে তছনছ করিল। ‘মোগলাই পরোটা’র সাম্রাজ্য পোড়াইয়া ফেলিল। এই সুযোগেই ইংরেজ ভারতবর্ষ দখল করিল।

মগ আর ফিরিঙ্গির হামলাকে বাঙ্গালী ইতিহাস ব্যবসায়ীরা ক্ষমা করেন নাই। বর্গীর হামলাকে ক্ষমা করিলেন। কারণ বর্গীরা হিন্দু। নবনির্মিত হিন্দু।

রবীন্দ্রনাথ নিজেই আবার লিখিয়াছেন, শিবাজী ছিলেন অত্যন্ত বর্বর প্রকৃতির শাসক। হিন্দু জাতিভেদ প্রথাকে অতিক্রম করিতে পারেন নাই। শিবাজী নিজেও ইহার করুণ শিকার। ঠাকুরও কম যাইবেন কেন? তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছিলেন, তোমরা তো আমাদিগকে পতিত করিয়া রাখিয়াছিলে। তারাশঙ্করের ‘আমার সাহিত্য জীবন’ গ্রন্থে এইটি পাওয়া যায়।

রবীন্দ্রনাথ তো পতিত ব্রাহ্মণের ছেলে। ব্রাহ্মধর্ম অবলম্বন করিয়াও কিন্তু তিনি সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত হইতে পারেন নাই। অনেক প্রগতিশীলের মধ্যে এই সমস্যা বিদ্যমান। পশ্চিম বঙ্গে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সিপিআই ও সিপিআইএম শাখার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও এই প্রবণতা আছে।

বৌধায়ন চট্টোপাধ্যায় সিপিআইয়ের অনেক বড় নেতা ছিলেন। ১৯৬৮ সালে দাস ক্যাপিটালের শতবর্ষ উপলক্ষে তাঁহারা একটি বই প্রকাশ করেন। দিল্লির পিপলস পাবলিশিং হাউস প্রকাশ করে বইটি। ‘মার্কস অ্যান্ড ইন্ডিয়াস ক্রাইসিস’ নামের নিবন্ধে বৌধায়ন বলেন, ‘ভারতের বুদ্ধিজীবীরা সবাই চুতিয়া; দুইজনই শুধু ব্যতিক্রম— গান্ধীজি ও রবীন্দ্রনাথ।’ ‘চুতিয়া’ বলিয়া তিনি ঠিক বলিলেন; কিন্তু ওই দুইজনের ব্যাপারে ব্যতিক্রম কেন? ভারতের সব বুদ্ধিজীবীই যদি চুতিয়া, রবীন্দ্রনাথও ব্যতিক্রম নহেন। ইহার নাম সিপিআই! সিপিএমও বেশি আলাদা নয়। বাংলাদেশে কমিউনিস্ট নামধারী অধিকাংশই এই ধরনের।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হইয়াছে অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে। আবার এইখানে সাম্প্রদায়িকতা কেন? তো সাম্প্রদায়িকতা নয়, ইহার নাম রাজনীতি। সাম্প্রদায়িকতার শিকড় তুলিয়া ফেলা যাইতেছে না কেন? কারণ মানুষকে যে রাজনৈতিক ওয়াদা আমরা দিয়াছিলাম তাহা পূরণ হয় নাই। এনজিওর চোখে এখানে মানুষের মূল সমস্যা দারিদ্র্য। দারিদ্র্য দূর তাঁহারা করিতে পারিবেন না। তাই মানুষকে তাতাইয়া রাখিবেন। সাম্প্রদায়িকতা শিখাইবেন।

বাংলাদেশে যেই সব হিন্দু বসবাস করিতেছেন, তাহারা তো এখন আর প্রতাপশালী নহেন। তো বাংলাদেশে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার কারণ কি? ক্ষুদ্র জাতির উপর মুসলমানদের আক্রমণ করিবার কারণ কি? মুসলমানদের কোনো পদ তাহারা দখল করে নাই। তো যুক্তি একটাই হইতে পারে, বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতা ভারতের সাথে সম্পৃক্ত। ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে মানুষ হত্যা করে বলিয়া এখানকার মানুষ কি মুসলমান জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের নিরীহ হিন্দুদের উপর আক্রমণ করিবে? মোটেই না। বিষয়টি ষোল আনা রাজনীতির।

বাংলাদেশের সমাজে সাম্প্রদায়িকতার কারণ আর নাই। আছে উপমহাদেশ ভারতে। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদে যখন আক্রমণ হয়, তখন বাংলাদেশেও সাম্প্রদায়িক সংঘাত শুরু হয়। এখন অনেকেই রামুর বৌদ্ধপল্লীতে হামলার সাথে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের একটা যোগসূত্র আবিষ্কার করিতেছেন। রোহিঙ্গারাই যে কাণ্ডটা করিয়াছে তাহা অবশ্য কেহ বলিতেছেন না। কিন্তু আমাদের প্রথম শ্রেণীর একটি পত্রিকা হেড লাইন করিয়াছে— রোহিঙ্গাদের দিকে সন্দেহের আঙ্গুলি। সাম্প্রদায়িকতা আর কাহাকে বলে!

ভারতে সাম্প্রদায়িকতা আছে। কিছু রাজনৈতিক দল আছে, যাহারা মনে করেন ‘অখণ্ড ভারত’ প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। কারণ তাহারা ১৯৪৭ সালের দেশভাগ মানিয়া লয়েন নাই। নিজেদের সুবিধার জন্য তাহারা দেশভাগ করিয়াছিলেন। কিন্তু এখন তাহারা বলেন আমাদের মায়ের অঙ্গহানি করা হইয়াছে। বাংলাদেশের অস্তিত্বকেও তাহারা মানিয়া লইবেন না। কারণ তাহাদের নিকট বাংলাদেশের বা পাকিস্তানের অস্তিত্ব সমার্থক। আরেকটি প্রশ্নে তাহারা বাংলাদেশ চাহিতেছেন। ভারতীয় সাম্প্রদায়িক নীতির দ্বিধা একটাই। দেশে হিন্দু মুসলমান ছাড়া কোন সমস্যাই নাই। গোড়ার কথা এইটাই।

১৯৪৭ সালে দেশভাগটা কেন হইল? এই প্রশ্নে যদি আমরা বার বার না ফিরি তো সাম্প্রদায়িকতার মর্ম বুঝিতে পারিব না। ১৯৪৬ সালে বিলাতের মন্ত্রিপরিষদ মিশন ভারতে আসিল। তিনজন মন্ত্রী আসিলেন। তাঁহারা প্রস্তাব করিলেন ভারতের প্রদেশাদি তিন ভাগে ভাগ হইবে। স্বায়ত্তশাসিত তিন ভাগের শরিক রাজ্যও স্বশাসিত হইবে। আর ভারতবর্ষ হইবে ফেডারেশন। গান্ধীজির অনুমোদনক্রমে জওহরলাল নেহরু প্রস্তাবটি শেষতক মানিলেন না। প্রথমে মানিয়াও শেষতক না বলিলেন। ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাব কংগ্রেস গ্রহণ করিল। মুসলিম লীগও গ্রহণ করিলাম বলিয়া ঘোষণা দিলে কংগ্রেস বোকা বনিল। আর মুসলিম লীগও পরিশেষে পাকিস্তানের দাবি ছাড়িল না। বাংলা ও আসাম যোগ করিলে মুসলিম লীগের মেজরিটি হয়। পশ্চিমে পাঞ্জাব আর উত্তর-পশ্চিম প্রদেশেও মুসলিম মেজরিটি। ভারতের তিনটি ভাগের মধ্যে দুইই মুসলিম মেজরিটি অঞ্চল হইতেছে।

তখন কংগ্রেস বলিল আমরা প্রস্তাব মানি, তবে ভবিষ্যতে মানিব এমন গ্যারান্টি দিব না। তো জিন্নাহ পুনরায় পাকিস্তান দাবিতে ফিরিয়া চলিলেন। দেশ ভাগ হইল।

সত্যের খাতিরে বলিতে হয় ভারত সাম্রাজ্য বিশেষ। এখনও ভারতে ২৮ অঙ্গরাজ্য আর সাত ফেডারেল এলাকা। ইহার মধ্যে বাংলাদেশ আর পাকিস্তান নাই। বিশাল ভারত সাম্রাজ্য কোনদিনও অখণ্ড দেশ ছিল না। শুদ্ধ একটি সূত্রেই তাহাকে এক করা যাইত, যদি ইহাকে ফেডারেল আইন আর সমঝোতার রাজনীতি কায়েম করা হইত। নেহেরুজী চাহিয়াছিলেন এককেন্দ্রিক ভারত। বলা হয়, বর্তমানে ভারত হইল চেতনায় ফেডারেল, ধাতে এককেন্দ্রিক। ভারতের কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্ব এইটাই। তাহারা দিল্লির অর্থাত্ উত্তর ভারতীয় পুঁজির আধিপত্য চাহেন। চাহেন সমগ্র ভারতকে পায়ের নিচে দাবাইয়া রাখিতে। তাহারা যেমন চেন্নাই আর মুম্বাই চাহেন, তেমনই চাহেন নাগাল্যান্ড আর আসামকেও।

১৯৪৭ সালে তাহারা দেখিলেন যদি আমরা পাকিস্তানের দাবি অনুসারে মুসলমানদের বাহির করিয়া দিতে পারি তো বাকি ভারত নগদ রাখার একটি সূত্র মিলিবে। আমরা সবাই হিন্দু আমাদের এই হিন্দু রাজত্বে। এমনকি সেখানে তাহারা বৌদ্ধদেরও হিন্দু বানাইতে চাহিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি বড় অসততার প্রমাণ গৌতম বুদ্ধদেবকেও তিনি হিন্দু অবতার হিন্দু বানাইয়াছেন।

ভারতের শাসনতন্ত্রের সংকটও এই রকম। ভারতে শতকরা দুইজনেরও কম শিখ জাতির লোক। শিখদের ভারতীয় সংবিধান হিন্দু ঘোষণা করিল। কিন্তু শিখ জাতি আলাদা ধর্ম বলিয়া স্বীকৃতি চাহে। ভারতের বড় হিন্দু জাতি খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন— সবাইকে হিন্দু বানাইতে চায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বলিতেছিলেন, ‘মুসলমানরা একমাত্র বেয়াদব যাহারা হিন্দু পরিচয় স্বীকার করিবে না।’ ভারতের বড় জাতি ‘ভারতীয়’ আর ‘হিন্দু’ কথা দুইটিকে সমার্থক বানাইতে চাহে। সমস্যার মূলে এই ঘটনা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বলিতেছিলেন, ‘মুসলমানরা একমাত্র বেয়াদব যাহারা হিন্দু পরিচয় স্বীকার করিবে না।’

মুসলমানরা যদি ভারত হইতে বাহির হইয়া যায়, বাকি ভারতের এক হওয়ার প্রবল যুক্তি সবলে দাঁড়াইবে। নাগাল্যান্ড এবং মিজোরামকে বলা হইয়াছে খ্রিস্টান হইতে চাহ হও গিয়া, মাগর তোমরা হিন্দু। কাজেই আমাদের সঙ্গে থাকিতে হইবে। আলাদা হইতে পারিবে না। ভারতকে এককেন্দ্রওয়ালা সাম্রাজ্য রাখিতে যে শক্তি প্রয়োজন তাহা পাকিস্তান হইতে পাওয়া গিয়াছে। তো বাংলাদেশ কোন যুক্তিতে স্বাধীন হইয়াছে? ভারত তো বার বার বলিতেছে বাংলাদেশও মুসলমান দেশ— দ্বিতীয় পাকিস্তান। বাংলাদেশ বলিতেছে, আমরা মুসলমান বা ইসলামের কারণে স্বাধীন হই নাই। আমরা জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণনীতির ছায়ায় স্বাধীন হইয়াছি। বাঙ্গালী যদি আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারী হয়, তাহা হইলে মিজো কিম্বা নাগা জাতিই বা হইবে না কেন? কাশ্মীরি জাতি জাতি হইবে না কেন?এই যুক্তি ভারত মানিতে পারে না।

বাংলাদেশকে বার বার দ্বিতীয় ইসলামিক রিপাবলিক বানাইতে হইবে সেই দরকার পূরণের প্রয়োজনে। ভারতের লক্ষ্য এমনই।

সেই জন্য তাহারা দাউদ হায়দারকে আশ্রয় আর তসলিমা নাসরীনকে প্রশ্রয় দেন। তাহারা বলেন দেখ, দেখ, বাংলাদেশ কত ‘মৌলবাদী’! বাংলাদেশকে নিয়মিত সাম্প্রদায়িক দেশ আকারে দেখানো ভারতের লক্ষ্য। কারণ তাহাদের মেটাফিজিক্যাল যুক্তি। বাংলাদেশ আলাদা আজ শুধু ইসলামের কারণে। সাম্প্রদায়িকতার দ্বিতীয় দার্শনিক যুক্তি এই রকম আর কি।

ইংরেজ চাহিয়াছিল হিন্দু-মুসলমান বিরোধ বাধাইয়া দিতে। প্রথম দিকে হিন্দুরা ইংরেজদের সহযোগিতা করে। মুসলমানরা কিছুদিন করে নাই। পরে মুসলমানরা যখন ইংরেজদের সহযোগিতা করিল, তখন হিন্দু নেতারা কহিলেন দেশটা ভাগ করিব।

ভারত ভাগের দাবি হিন্দু সাম্প্রদায়িক নেতারাই তুলিলেন। আবার তাহারা বলিলেন, ভারত এক থাকিবে এক শর্তে; যদি মুসলমানরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয় তাহা হইলে। তাহাদের কাছে যাহারা মুসলিম স্বার্থ বা আদর্শকে বড় মনে করেন না তাহারাই বড় মুসলিম। নিজেদের দাবি তুললেই মুসলিমরা সাম্প্রদায়িক হয়।

বর্তমান ভারতের রাজনীতিও এই সাম্প্রদায়িকতার উপর প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতা ভারতের সাম্প্রদায়িকতার প্রতিফলন বা সম্প্রসারণ। আরও সম্প্রসারণ দেখা যায় মিয়ানমারে। ১৯৮২ সালের পরের কথা। মিয়ানমারের জাতীয় পরিচয়পত্রে ১৩৫টি জাতির স্বীকৃতি আছে। মিয়ানমারে ৫ কোটি জনসংখ্যার ৩ কোটি বর্মী। শতকরা ৬০ ভাগ বর্মী। বাকি ৪০ ভাগে অন্যান্য জাতির লোক। বাংলাদেশের সীমানায় বসবাসকারী মুসলমানদের বলে ‘আরাকানি মুসলমান’ বা রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গারা কেহ বা ৭০০ বছরও সেখানে বাস করিতেছে, কেহ বা ২০০ বছর, কেহ আরও কম হয়তো। মিয়ানমার সরকার এখন তাদের নাগরিক বলিয়া স্বীকার করিতেছে না। তাহাদের ওই ১৩৫ জাতির ভেতর ঢোকানো হয়নি। এটাও সাম্প্রদায়িকতা। বাংলাও রোহিঙ্গা জাতির ভাষা নহে। বর্মীও তাহাদের ভাষা নহে। তাহারা কখনো উর্দুকে নিজেদের ভাষা বলিতেছে, কখনো রোহিঙ্গা ভাষার দাবি তুলিতেছেন। এখন তাহাদের বলা হইতেছে, তোমরা আরব দেশে চলিয়া যাও। বাংলাদেশে ফিরিয়া যাও ইত্যাদি। তাহারা যাইবে কোথায়? ২০০ বছর থাকার পরও তাহাদের (রোহিঙ্গা) বিদেশি বলা হইতেছে। তাহারা নব্য ফিলিস্তিনি।

বলিতেছিলাম বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা বুঝিবার আগে প্রতিবেশী দুই দেশের সাম্প্রদায়িকতাও বুঝিতে হইবে আমাদের। সাম্প্রদায়িকতা ঔপনিবেশিকতার সমার্থক। যাহারা সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি করে (যথা জামায়াত) সরাসরি সাম্রাজ্যবাদের সমার্থক। সংখ্যাগুরু মুসলমান সবাই সাম্প্রদায়িক নহে, সাম্রাজ্যবাদীও নহে। নিজের বাসভূমে নিজের অধিকার দাবি করা সাম্প্রদায়িকতা নহে, অন্যের অধিকার অস্বীকার করাই সাম্প্রদায়িকতা।

নিজের বাসভূমে নিজের অধিকার দাবি করা সাম্প্রদায়িকতা নহে, অন্যের অধিকার অস্বীকার করাই সাম্প্রদায়িকতা।

সাম্প্রদায়িকতার আরেকটা মাপ। আমেরিকা ইরাক, লিবিয়ায় আক্রমণ করিল, ইহার প্রতিবাদ কি বৌদ্ধ কিংবা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর করা উচিত ছিল না? চীনের কি উচিত ছিল না প্রতিবাদ করা? শুধু মুসলমান প্রতিবাদ করিলে মনে হইবে সমস্যা মাত্র মুসলমানদের। আজ য়ুরোপে মুসলমান মেয়েরা মাথায় হিজাব পরিধান করিতেছে, বোরকা গায়ে চড়াইতেছে। সকলই সাম্রাজ্যবাদের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ।

নব্য ঔপনিবেশিকতার যুগে, মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা যাহা করিতেছে তাহাতে মুসলিমদের মধ্যে ঘৃণার বিস্তার হইতেছে। আলজেরিয়ায় ফরাসিরা ৮ বছর নির্মম নির্যাতন চালাইয়াছিল। যুদ্ধের সময় আলজেরিয়ার মেয়েরা ঘোমটা/হিজাব পরা শুরু করে ফরাসিদের প্রতিবাদস্বরূপ। স্বাধীনতার পর তাহারা হিজাব পরা বাদ দেয়। এখন আলজেরিয়ার মেয়েরা আবার ঘোমটা/হিজাব পরা শুরু করিয়াছে। ঔপনিবেশিকতার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ।

ভারতীয় সাম্প্রদায়িকতার ছায়ায় বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িকতা গড়িয়াছে। ভারতে সাম্প্রদায়িকতা দূর হইলে বাংলাদেশেও তাহা দুর্বল হয়। ভারতীয় আধিপত্য ব্যবসায়ের প্রধান দুই খুঁটি গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ। ভূত তো রহিয়াছে সরিষার মধ্যেই। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার মূল উচ্চমধ্যবিত্ত শাসক শ্রেণীর মধ্যে। ইহারা সম্পূর্ণভাবে সাম্রাজ্যবাদের অনুসারী। ইহাদের আত্মমর্যাদা বোধ নাই। ইহারা পচনশীল। সাম্প্রদায়িকতা ইহাদের দরকার।

ভারতীয় আধিপত্য ব্যবসায়ের প্রধান দুই খুঁটি গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ। ভূত তো রহিয়াছে সরিষার মধ্যেই।

তাদের বর্তমান পলিসি তিনটি। গরিবদরদী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মানব উন্নয়ন আর সুশাসন। এই তিন পলিসি। সরকার, বেসকারি ব্যবসায়ী আর বিদেশি এনজিও এই তিন এজেন্সি ভরসা। তাহাদের টার্গেট সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী আর ক্ষুদ্র জাতি। দারিদ্র্য তার পরও দূর হয় না। বরং দরিদ্র জনগণকে উত্তেজিত রাখিতে হইবে। নানা প্রোগাম হাতে নিতে হইবে। একটির নাম সুন্দরী প্রতিযোগিতা, আরেকটির নাম প্রতিভা প্রতিযোগিতা। ইহাই নাকি গ্লোবাল কালচার!

নব্য ঔপনিবেশিক দেশে সাম্প্রদায়িকতার বড় ভালো রাজনীতি আর হইতেই পারে না। শ্রীলংকার কথাই বিবেচনা করা যাক। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের আমরা বলি শান্তিপ্রিয়। তাহাদের প্রেসিডেন্ট যাহা করিলেন! পাকিস্তানের কথা বলিবার বাকি কি আছে। একটা দেশ পচিয়া গেলে যাহা হয়, পাকিস্তানের অবস্থা তাহাই। চীনেও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন হয়! তাহারাও ক্যাপিটালিস্ট মডার্নাইজেশন করিতেছেন।

মূল শিরোনামঃ সাম্প্রদায়িকতা, সলিমুল্লাহ খান; দৈনিক বনিক বার্তা, শনিবার, অক্টোবর ২০, ২০১২, কার্তিক ৫, ১৪১৯ সংখ্যা

ইংরেজদের সাথে যুদ্ধরত মুসলমানদের মৃত্যুতে খুশী হয়ে ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত রচনা করেছিলেন;

একেবারে মারা যায় যত চাঁপদেড়ে (দাড়িওয়ালা)

হাঁসফাঁস করে যত প্যাঁজ (পিঁয়াজ) খোর নেড়ে

বিশেষত: পাকা দাড়ি পেট মোটাভূড়ে

রোদ্র গিয়া পেটে ঢোকে নেড়া মাথা ফূড়ে

কাজি কোল্লা মিয়া মোল্লা দাঁড়িপাল্লা ধরি

কাছা খোল্লা তোবাতাল্লা বলে আল্লা মরি

এই কবিতায় চরম মুসলিম বিদ্বেষ প্রকাশ পেয়েছে।শুধু তাই নয় ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত স্পষ্টতই ব্রিটিশদের দালাল ছিলেন। তাইতো তিনি লিখেছিলেন;

ভারতের প্রিয় পুত্র হিন্দু সমুদয়

মুক্তমুখে বল সবে ব্রিটিশের জয় (দিল্লীর যুদ্ধ : গ্রন্থাবলী,পৃ. ১৯১)।

বঙ্কিমচন্দ্র তার শেখা প্রায় সবকটি গালি ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করেছে। ‘ম্লেচ্ছ’ হতে শুরু করে ‘যবন’ পর্যন্ত। এমনকি প্রাচীনকালে বৌদ্ধদের দেয়া ‘নেড়ে’ গালিটাকেও সে দিতে বাদ রাখেনি। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘আনন্দ মঠ’ (১৮৮২) উপন্যাসে এক মন্তব্যে বলেন, ‘‘ধর্ম গেল, জাত গেল, মান গেল, কূল গেল, এখনতো প্রাণ পর্যন্ত যায়। এ নেড়েদের (মুসলমানদের) না তাড়াইলে আর কি হিন্দুয়ানি থাকে’’। এমনকি গল্পের মাধ্যমে মসজিদ ভেঙে মন্দির গড়ার ইচ্ছাও প্রকাশ পেয়েছে এ উপন্যাসে; “ভাই, এমন দিন কি হইবে, মসজিদ ভাঙ্গিয়া রাধা মাধবের মন্দির গড়িব?” আনন্দমঠ, তৃতীয় খন্ড, অষ্টম পরিচ্ছেদ।

শুধু তাই নয়, “তিনি ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এ দানেশ খাঁকে দিয়ে মুসলমানদেরকে ‘শুয়ার’ বলে গালি দিয়েছেন। ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসে কতিপয় স্ত্রীলোককে দিয়ে সম্রাট আওরঙ্গজেবের মুখে লাথি মারার ব্যবস্থা করেছেন। ‘মৃণালিনী’তে বখতিয়ার খিলজীকে ‘অরণ্য নর’ বলেছেন। কবিতা পুস্তকে তিনি লিখেছেন, ‘‘আসে আসুক না আরবী বানর – আসে আসুক না পারসী পামর’’। (আফজাল চৌধুরীর শেষ কবিতা: মুকুল চৌধুরী, দৈনিক সংগ্রাম,ঈদসংখ্যা-২০১২)।

রবীন্দ্রনাথ তার বন্ধু চির মুসলিম বিদ্বেষী ব্রাহ্ম রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুর মিলিয়ে তিনি মুসলমান জাতি ও সমাজ সম্বন্ধে তার নানা লেখায় বরং বিরূপ মন্তব্যই করিয়াছেন। (বাংলাদেশের রবীন্দ্রচর্চা, মনিরা কায়েস, পৃ. ২৩)। তাই শিবনারায়ণ রায় বলেছেন: “তিনি (রবীন্দ্রনাথ) কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে কিছুই চর্চা করেননি। সম্পূর্ণ অবহেলা করেছেন.. (প্রতিক্ষণ, জুলাই ১৯৯৩, পৃ. ১৭)।” যেমন, গোরা উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, “ভালো মানুষি ধর্ম নয়; তাতে দুষ্ট মানুষকে বাড়িয়ে তোলে। তোমাদের মহম্মদ সে কথা বুঝতেন, তাই তিনি ভালোমানুষ সেজে ধর্ম প্রচার করেন নি।” (গোরা,পৃষ্ঠা ১৭)।” তাইতো সলিমুল্লাহ খান তাঁর ‘সাম্প্রদায়িকতা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘ভারতের বৃহৎ হিন্দুজাতি – খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন – সবাইকে হিন্দু বানাইতে চায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বলেছিলেন, ‘মুসলমানরা একমাত্র বেয়াদব যাহারা হিন্দু পরিচয় স্বীকার করিবে না’। (বণিক বার্তা ২০ অক্টোবর, ২০১২)।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো শরৎচন্দ্রও তার অনেক লেখায় মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাব প্রকাশ করেছেন। শরৎচন্দ্র তার “বর্তমান হিন্দু-মুসলমান সমস্যা” নামক প্রবন্ধে চরম মুসলিম বিদ্বেষী লেখা লিখেছেন। তাইতো সাহিত্যিক ও সমাজ দার্শনিক আহমদ ছফা বলেছেন, “এইরকম সাম্প্রদায়িক রচনা শরৎবাবুও লিখতে পারেন আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে” (যদ্যপি আমার গুরু, আহমদ ছফা, পৃষ্ঠা ৫৬)।

তথ্যসূত্রঃ ইন্টানেটের বিভিন্ন লেখা থেকে সংগ্রহ।
সাহিত্যের পাতায় হিন্দুদের মুসলিম বিরোধী সাম্প্রদায়িকতা

আমার ব্যাক্তিগত অভিমত একজন কবি,সাহিত্যিক বা লেখকের কোনো প্রকার ধর্ম বিদ্বেষ থাকাটা ঠিক নয়। তার বড়
পরিচয় সে মানুষ সে লেখক কবি সাহিত্যিক। তার কাছ থেকে মানুষ একতা বদ্ধ হওয়ার মত জ্ঞান ভাণ্ডার লেখা আশা করে।
একজন সাহিত্যিক কবি লেখকের চোখে সকল ধর্ম সমান থাকা ধরকার।কোনো ধর্ম ছোট কোনো ধর্ম বড় নয়।


সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১২:৪৬
২৯টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×