ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার সবটুকু খারাপ তা যেমন বলা যাবেনা, একে নির্ভেজাল আশীর্বাদ হিসেবে বিবেচনা করলেও সত্যের অপলাপ হবে। ব্রিটিশ আমলে ইংরেজিনির্ভর শিক্ষাক্রমে প্রাচীন ভারতীয় ও বাংলার আদি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা, যা হাজার বছর ধরে এ ভূখন্ডে বিরাজমান ছিল, ক্রমান্বয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়তে থাকে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, স্বাধীনতার পরও আমাদের ইতোমধ্যে ভোঁতা হয়ে যাওয়া স্বজাত্যবোধের কারণে সেই প্রাচীন ঐতিহ্যসঞ্জাত শিক্ষার নির্যাস আমাদের শিক্ষাক্রমে বিশেষ স্থান করে নিতে পারেনি। উপরন্তু, ঔপনিবেশিক শিক্ষার সাথে যুক্ত হয়েছে নব্য পুঁজিবাদী ও বস্তুতান্ত্রিক উপসর্গ সমূহ। যে শিক্ষায় অর্থ সমাগমের সম্ভাবনা নেই, সে শিক্ষার প্রয়োজন কী- এমন একটি মনোভাব যেন শিক্ষাক্রমের পরতে পরতে প্রচ্ছন্ন অবস্থান ঘোষণা করে চলেছে। এ কারণেই, কবিতা এবং এর ছন্দ, অলঙ্কার ও রসতত্বের আলোচনা বহু আগেই আমাদের শিক্ষাক্রম থেকে নিরবে তিরোহিত হয়েছে।
আগে, কবিতা ও তার গঠন নৈপুণ্য জানতে বা বুঝতে বাংলা সাহিত্য বা ভাষাতত্বের পন্ডিত হবার প্রয়োজন পড়তোনা। মায়ের দুধে শিশুর যেমন সহজাত অধিকার, ভাষা ও সাহিত্যে- লিখতে পড়তে জানা মানুষ মাত্রেরই তেমন সহজাত অধিকার স্বীকৃত ছিল। তাই কাজী নজরুল ইসলাম সহ অনেক কবি সাহিত্যিককেই অত্যন্ত উন্নত ভাষাজ্ঞান ও ছন্দ-অলঙ্কার-রসতত্বে ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষার দ্বারস্ত হতে হয়নি। প্রাথমিক বা বড়জোর মাধ্যমিক স্তরের গড়পড়তা শিক্ষাই কবিতার সহায়-সস্ত্র-হাতিয়ার যোগান দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল।
কিন্তু বর্তমান শিক্ষাক্রমের দিকে তাকালে- ওখানে কবি হয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় রসদগুলো কি আদৌ চোখে পড়ে? পড়ার কথা নয়, কারণ কবিতা লিখে নগদ অর্থযোগের অপার সম্ভাবনা কোথায়? কাজেই কবিতা এবং কাব্য আমাদের ভোগবাদী, উগ্র পুঁজিবাদী ও বস্তুবাদী শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে স্বভাবতই নির্বাসিত। একারণে কবিতা সম্পর্কে মানুষের পার্সেপশন এখনো অন্তত শতাব্দীখানেক পিছিয়ে আছে। কবি বলতে এখনো মানুষ সেই অষ্টাদশ শতকে বাঙ্গালির পরিধেয় ঢোলা পোষাক, কাঁধে ঝোলানো চটের ব্যাগ, শ্মশ্রুমন্ডিত মুখমন্ডল- এমন ইমেজারি স্টেরিওটাইপের বাইরে যেতে পারনো।
দুঃখের বিষয়, কবি যশোপ্রার্থী অনেক যুবকও এই তথাকথিত ‘কবি কবি ভাব’ চর্চাকে বাস্তবিক কবিতার আঙ্গিকগত উৎকর্ষচর্চার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে থাকে। কবিতায় তাই সময় এসে থমকে আছে সেই অষ্টাদশ কি বড়জোর ঊনবিংশ শতাব্দীতে। পাশ্চাত্য কবিতায় যেখানে স্থান করে নিচ্ছে ঋজু ভাষা, সমসাময়ীক রাজনীতি, অর্থনীতি এমনকি কূটনীতি, বাংলা কবিতা সে তুলনায় কোথায় আছে তা ভেবে এবং মেপে দেখার প্রয়োজন আছে। পাশ্চাত্য কবিতার বিষয়বস্তু যখন একটি পেট্রল পাম্প (Elizabeth Bishop এর The Filling Station), দড়িতে শুকাতে দেয়া কাপড় (Richard Wilbur এর Love Calls Us to the Things of the World), সমুদ্র সৈকতে পড়ে থাকা কাঁচ (Amy Clampitt এর Beach Glass) ইত্যাদি, বাংলা কবিতায় এমন আধুনিক দিনানুদৈনিক অনুষঙ্গ কি স্থান করে নিতে পেরেছে?
লেখাটি শিল্প সাহিত্য ও সমাজ রাজনীতির পত্রিকা ‘সৃজন’-এর প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুলাই, ২০১৮ সকাল ৯:১৯