বাইরে ঘন আধার করে ঝপঝপিয়ে বৃস্টি নেমে এলো, জানালার পাল্লা গুলো হা করে খোলা ছিলো--ভেজা ঠান্ডা বাতাস তীর বেগে এসে মুহূর্তের মধ্যে আমাদের বিছানা টা ভিজিয়ে ফেললো ! রান্নাঘর থেকে মায়ের চিৎকার ভেসে এলো, --"জানালাটা লাগাসনি কেনরে মিনু !--এই অবেলায় সব ভিজে গেলো !" মা খুব রেগে গেছে আমার উপরে জানি, এই আত্মভোলা মেয়েকে নিয়ে বড় জ্বালা হয়েছে- এটাও জানি ! কিন্তু আমিতো জানি, আমি এই মুহূর্তে এই আধাগ্রাম্য, আধা মফঃস্বলীয়, গাছ পালায় ছাওয়া নতুন বাড়ীর (আমাদের বাড়ীর নাম, অথচ বাড়ী পুরনো হয়ে ঝুরঝুরে হতে শুরু করেছে!) তৃতীয়া কন্যা, পঞ্চম বর্ষীয়া মিনু নই!--আমি মিশে যেতে শুরু করেছি গল্পের বইয়ের পাতার সেই সব চরিত্রগুলোয়,-সমাপ্তীর মৃন্ময়ী- কিংবা শতবর্ষের নীরবতার রেবেকা বুয়েনদিয়া---আরও কত অজানা মেয়েগুলোর মাঝে!
আমি বরাবরই এরকম, ভুলোমনা, কল্পনাপ্রবন আর অতিরিক্ত আবেগময়ী! মা চেঁচিয়েই যাচ্ছে, আর আমি ভ্যাবলার মতো জানালার ভেজা শিক ধরে, আরোও ভিজতে ভিজতে রেবেকা বুয়েনদিয়া হয়ে যাচ্ছি!--ঐতো আমার কিশোরী মনে প্রথম বারের মতো পাল তুলে ঝড়ের গতিতে ছুটে আসছে জোসে আরকাদিও--এসেই আমাকে পাগলের মত জড়িয়ে ধরে, আমার ঠোটে.... লজ্জা আর অনাগত ভয়ে কেঁপে উঠি আমি! সে এক অদ্ভূত, অজানা ভয়, ....ইশ্!!!! !মা দেখে ফেলে যদি আমায় এই অবস্থায়? আমি এখন পুরোপুরি রেবেকা, যে কি না তার অকালপক্ক আবেগে প্রেমিক আরকাদিওর আদরে দিশেহারা....কোত্থেকে মেজো আপা এসে ঠাস করে আমার গালে একটা চড় দিয়ে আমাকে বাস্তবের নতুন বাড়ীর শ্যামলা, রোগা, ভাসাভাসা চোখের সেজো মেয়ে- মিনুতে ফিরিয়ে আনলো । --"বেশী বাড় বেড়েছিস তুই, দিনরাত খালি নাটক, নভেল পড়ো না? সব বই সবুর মিঞার কাছে বেঁচে দেব দাড়াও!" কঠিন, নির্মম জগতে ফিরে এলাম--রেবেকা আর আরকাদিওর অনাকাংখিত, অবৈধ অথচ গা শিহরানো তীব্র, মধুর প্রেম! এমনকি, মৃন্ময়ী
তার স্বামীর কাছে ফিরে এসেছে অপূর্ব, সুন্দর সমাপ্তীর আকাংখায়!--সব কর্পূরের মতো মিলিয়ে গেলো!
মেজো আপার মার খেয়ে ঘরের কাজে নেমে পরলাম, আমার দোষে বৃস্টিতে ভেজা বিছানা গুটালাম, মেঝে মুছলাম--মা এসে সবাইকে পাকঘরে যেতে বললেন রাতের খাবার খেতে। বাবা আমাকে আদর করে অবশ্য বললেন খাবার সময়,-" এতো গল্পের বইয়ে ডুবে থাকলে রেজাল্ট খারাপ হবে পরীক্ষার মা !"আমি ক্লাসে প্রথম হতাম সবসময়।তাই গল্পের বই বেশী পড়লে
বাবা বেশী বকতেন না। কিন্তু মেজো আপা পিছু লেগে থাকত আমার সবসময়! ও অবশ্য আমাকে আদরও করত, কিনতু কি অদ্ভূত কারনে আমার বড় হয়ে ওঠা পছন্দ করতনা! মনে আছে আমার প্রথম পিরীয়ডের সময় ও কেঁদেই ফেলেছিলো রাগে, দুঃখে!--আমি কেনো এতো বড় হয়ে গেলাম? আমি সব বুঝতাম প্রকৃতির এই চিরায়ত খেলার, ছবিও আঁকতাম বলে! আমার বই পড়া আমাকে আরও পৌছে দিত জগতের এই অভূতপূর্ব
সৃস্টির প্রক্রিয়ায়!--
----চলবে।