আমার সেদিনের মার খাওয়া আমি ভুলে গেলেও টুটু ভোলেনি ৷ টুটু আর কোনদিন আমায় চিঠি লেখেনি ৷ রুনা আপু বলে, টুটু নাকি সত্যি আমায় ভালবাসে ৷ আমি রুনা আপুর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসি ৷ রুনা আপু খালাম্মার মেয়ে৷ টুটুর খালাতো বোন ৷ পড়ে আমার থেকে এক ক্লাস উপরে, একই স্কুলে পড়ি আমরা ৷ জিন্দাবাজার সরকারী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে ৷ এবছর রুনা আপু ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবে ৷ টেষ্ট পরীক্ষার আগে অব্দি আমি আর রুনা আপু একসাথেই স্কুলে যেতাম ৷ এখন ওর স্টাডি লীভ চলছে বলে রুনা আপু বাড়িতেই থাকে বেশির ভাগ সময়, বেশির ভাগ সময় নয়, রুনা আপু বাড়িতেই থাকে সব সময় ৷ পরীক্ষার আর সবে দু মাস৷ আগে রুনা আপু বিকেলে চলে আসতো আমাদের বাড়ি ৷ গল্প করার জন্যে ওকেই আসতে হতো কারণ আমার তো ওবাড়িতে যাওয়া বারণ টুটুর জন্যে ৷ বারণ বলতে আম্মু কখনই মুখে বারণ করেনি কিন্তু সারাক্ষণ যেভাবে চোখে চোখে রাখে আমাকে, আমি ওবাড়িতে গেলে খানিক পরেই আম্মুও ঠিক এসে হাজির হয়, রুকু, পড়া আছে না? বাড়ি চল! আমি বুঝে নিয়েছি আমার ওবাড়িতে যাওয়া চলবে না ৷ আমার মাঝে মাঝে খুব রাগ হয় আম্মুর পরে ৷ আম্মু এত অবুঝ কেন? আব্বুকে কিছু বলতে এখন আমার সংকোচ হয় ৷ বিশেষ করে টুটুর ঐ চিঠি লেখার পর থেকে৷ তবুও আব্বু বরং অনেক বেশি বোঝে আমাকে, আম্মুর থেকে অন্তত বেশি বোঝে, আব্বু বলে, কেন রুকু বারান্দায় যাবে না? কেন রুনাদের বাড়ি যাবে না? আর তুমি খেলতেই বা যাবে না কেন? ইচ্ছে হলেই যাবে রুনাদের বাড়ি, গল্প করবে, সামনের মাঠে গিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলবে! কিন্তু আমার যাওয়া হয় না ৷ ঐ টুটুর জন্যেই যাওয়া হয় না ৷ আমি ওবাড়ি গেলে টুটু টিউশনি পড়াতে যায় না ৷ এমনকি কোন কারণ আমি স্কুলে না গেলে টুটুও কলেজে যায় না ৷ কাজেই আমার চলা ফেরার গন্ডিটা অনেক ছোট হয়ে যায় ধীরে ধীরে ৷ টুটুর জন্যে ৷
টুটুর খালাম্মা উল বোনেন, অলমোষ্ট বারো মাস বোনেন, শুধু যখন প্রচন্ড গরম পড়ে, হাতের ঘামে উলে ফেঁসে ফেঁসে যায়, তখন কিছুদিন বন্ধ থাকে এই উলবোনা ৷ প্রতিবছর খালাম্মা সোয়েটারগুলোকে খোলে, যেগুলোকে আগের বছর বানিয়েছিল, টুটুর জন্যে, খালুজীর জন্যে আর রুনা আপুর জন্যে৷ হাতের লম্বা লম্বা টানে উল ছাড়িয়ে নিতে থাকে সোয়েটার থেকে,এক অদ্ভুত কায়দায় ছাড়িয়ে নেওয়া উলের গোলা বানায় হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে, ডিমের মত আকারে, বড় বড় সব গোলা, লাল, নীল, হলুদ, বেগুনি, সাদা আর সবুজ ৷ ডিম্বাকৃতি সব গোলা ৷ দুটো তিনটে গোলা একসাথে নিয়ে খালাম্মা বোনে, দু ঘর লাল, মাঝের চার ঘর সাদা কিংবা সবুজ, আবার দু ঘর লাল ৷ ফুটে ওঠে বকুল ফুল খালাম্মার সোয়েটারে৷ তেকোণা ষ্টোলে খালাম্মা ফুটিয়ে তোলে বড় বড় কদমের ফুল৷ যার গা থেকে ঝুলছে গোল গোল কদম, গলার দিকটায় গোল একটা বড় ফুটো, যাতে মাথা গলিয়ে সেই ষ্টোল গায়ে দেয় রুনা আপু৷ আমি বসে খালাম্মার বোনা দেখি, কখনও বা নিজেও একটু হাত লাগাই, চেষ্টা করি খালাম্মারই মত তাড়াতাড়ি হাত চলাতে উলের কাঁটায়, কিন্তু হয় না৷ গত বছর আমিও বুনেছি একটা সোয়েটার, ভাইয়ার জন্যে৷ প্যাচানো সাপ উঠে গেছে সেই সোয়েটারের ঝুল থেকে গলা অব্দি, নিচে চার ইঞ্চি চওড়া বর্ডার, হাতের বর্ডার দু ইঞ্চি, তেকোণা গলার বর্ডার দেড় ইঞ্চি৷ গাঢ় কচুয়া ( সবুজ) রঙের জমিতে সাপগুলো হলুদ৷ বোনার সময় আটকালেই এক ছুটে খালাম্মার কাছে, বুনতে গিয়ে মাঝে মাঝেই একটা ঘর ছেড়ে দিতাম, সাথে সাথে বুঝতে পারতাম না যে একটা ঘর ছেড়ে দিয়েছি বোনার সময়, বেশ কয়েক লাইন বোনা হয়ে গেলে যখন বুঝতে পারতাম, তখন ছুট খালাম্মার কাছে, খালাম্মা সেপটিপিন দিয়ে সেই ঘর এক লাইন এক লাইন করে তুলে আবার কাঁটায় তুলে দিয়ে শুধরে দিত বোনার ভুল ৷
-2-
বড়ো বেদনার মত বেজেছ হে তুমি আমার প্রাণে,
মন যে কেমন করে মনে মনে তাহা মনই জনে ৷৷
তোমারে হদৃয়ে করে আছি নিশিদিন ধরে,
চেয়ে থকি আঁখি ভরে মুখের পানে ৷৷
বড়ো আশা, বড়ো তৃষা, বড়ো আকিঞ্চন তোমারি লাগি ৷
বড়ো সুখে, বড়ো দুখে, বড়ো অনুরাগে রয়েছি জগি ৷
এ জন্মের মতো আর হয়ে গেছে যা হবার,
ভেসে গেছে মন প্রাণ মরণ-টানে ৷৷
আমি বড় একলা হয়ে গেছি যখন থেকে ভাইয়া ক্যাডেট কলেজে পড়তে গেছে৷ ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ ৷ চট্টগ্রামের কাছে ৷ সেই কতদূর! বছরে দু বার মাত্র ওদের ছুটি৷ তাও রোজার ঈদে পনের দিন আর কোরবানীর ঈদে মাœ এক সপ্তাহ৷ ভাইয়ার ছুটির আগেই আব্বু চট্টগ্রাম চলে যায় আর দু'দিন পর ভাইয়াকে সাথে নিয়ে ফেরে ৷ কি বিশাল এক লোহার ট্রাঙ্ক ভাইয়ার, তাতে বড় বড় করে সাদা রং দিয়ে লেখা , কায়সার আহমেদ ৷ একাদশ শ্রেণী ৷ ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ, চট্টগ্রাম ৷ একপাশে ইংরেজী আর একপাশে বাংলায় লেখা ৷ প্রতিবার ভাইয়া বাড়ি ফেরার সময় এই ট্রাঙ্ক নিয়ে ফেরে আবার এটা সাথে করে নিয়ে যায় ৷ আমি ভাইয়াকে কয়েকবার বলেছিও, হ্যাঁরে ভাইয়া, তুই এত্ত বড় একটা ট্রাঙ্ক প্রতিবার নিয়ে আসিস আর নিয়ে যাস? ছোট একটা স্যুটকেসে করে জামাকাপড় নিয়ে এলে কি হয়? ভাইয়া বলে, ওর ওখানে রেখে আসার সিষ্টেম নেই৷ সব ছাত্রেরই একটা করে এরকম ট্রাঙ্ক আছে আর প্রত্যেকেই সেটা বাড়ি নিয়ে যায় আর নিয়ে আসে আর প্রত্যেকের ট্রাঙ্কেই নাকি সাদা বা কালো কালিতে নাম লেখা থাকে ৷ সেই ট্রাঙ্কে ভাইয়ার যাবতীয় জিনিসপত্র ৷ বই খাতা, জামা কাপড় এমনকি খেলার সরামও৷ ভাইয়া ক্রিকেট খেলে ৷ তার ব্যাট, বল, স্ট্যাম্প, প্যাড, গ্লাভস সব থাকে এই ট্রাঙ্কের ভেতর ৷ ভাইয়া যখন বাড়ি ফেরে তখন সবচাইতে বেশি আনন্দ হয় আমার ৷ এই পনের আর সাত মোট বাইশ দিন আমার কোথাও যেতে নেই মানা ৷ দুই ঈদের সময় আমার স্কুলও ছুটি থাকে কাজেই পড়ার টেনশনও থাকে না ৷ ভাইয়া আসার আগেই আমি ছুটির পড়া করে রাখি, ভাইয়া এলে যেন বই নিয়ে বসতে না হয়৷ আমার ছুটি অবশ্য শুরুও হয়ে যায় অনেক আগে থেকেই, ভাইয়া আসারও আরও পনের দিন আগে থাকতে৷ প্রায় দিনই সকাল সকাল খাওয়া দাওয়া সেরে আমি আর ভাইয়া বেরিয়ে পড়ি ৷ কোনদিন কাছের লাক্করতলা চা বাগানে, কোনদিন বা আরেকটু দূরে , বাগান ছাড়িয়ে পাহাড়ের দিকে ৷ ছোট ছোট টিলাগুলৈ আমাদের পাহাড়৷ শহর থেকে একটু দূরের দিকে গেলেই মনিপুরীদের দেখা পাওয়া যায় ৷ প্রতিটা পাহাড়ের গায়েই থাক কেটে কেটে লাগানো আনারসের বাগান, ওদের বাগান ৷ ছোট ছোট টিলার উপর ওদের ঘর বাড়ি৷ পায়ে চলা সরু পথ বেয়ে একটু উঠে গেলেই চোখে পড়ে নিকোনো ঊঠোন, খড়ের চালের মাটির বাড়ি৷ নাক বোঁচা ফর্সা ন্যাংটো শিশুরা ঘুরে বেড়ায় উঠোনে, আমাদের দেখলেই এক ছুটে ঘরে ঢুকে যায় আর তারপর উঁকি দেয় দরজার আড়াল থেকে৷ প্রায় প্রতিটা উঠোনেই চারপেয়ে চৌকির মত একটা জিনিস থাকে, যাতে ওরা, মনিপুরী মেয়েরা সুতো বেঁধে বোনার কাজ করে ৷ সেই চৌকির কাঠামোর চারপাশে ছোট ছোট পেরেক গাঁথা থাকে ৷ সুতোর লাছি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আটকে দেয় সেই পেরেকগুলোতে ৷ তারপর ওর মধ্যেই ফুটিয়ে তোলে, গাছ, লতা, পাতা, পাখী আর পাহাড় ৷ আনারসের বাগান ৷ সরু সুতোয় বোনা গুলো হয় গায়ের চাদর, মোটা সুতোয় বোনাগুলো বিছানার চাদর, আরেকটু মোটাগুলো হয় কম্বল ৷ যেগুলো ওরা কাঁধের ঝোলায় পুরে শহরে নিয়ে গিয়ে বিক্রী করে, বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে ৷
(চলবে)