গুহা (পর্ব ৩)
তপুর অতি উৎসাহী মনোভাবটাই তার বিপদে পড়ার কারণ হয়ে গেল। সে তার বইটিতে স্পষ্টই জেনেছিল অজানা সেই বিপদের কথা। তারপরেও নিজেকে সবার সামনে প্রমাণ করতে একাই গিয়েছিল সেই গুহা খুঁজে বেড় করতে। আর অসাবধাণতাবশত এক পাহাড়ি গর্তে পরে গেল। সে নিজেকে উদ্ধারের জন্য যথেষ্ট ছিলোনা। সে জানেও না এই কি সেই গুপ্ত গুহা যার কথা বলা আছে বইটিতে? কি সেই অজানা বিপদগুলো তার সামনে আছে? কারাই বা সেখানে বাস করত যার জন্য বলি দিতে হত কোন বালককে?
জানুয়ারী, ১৯৮৬ ইং
তপুকে খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই ওরা গেল গণেশের কাছে। গণেশের দোকানে যাবার আগেই নিজেদের মধ্যে সলাপরামর্শ করে নিল কি কি কথা তার সাথে বলবে। এরপর খুব স্বাভাবিক ভাবেই ওরা গণেশের কাছে গেল এবং তপু এই দিকে এসেছিল কিনা সেটা জিজ্ঞেস করল। এ কথা বলার সাথে সাথেই লোকটার চেহারায় পরিবর্তন দেখা গেল। তবে সে মিথ্যে বলার পাত্র নয়। তপু এখানে কেন এসেছিল আর কোন দিকে ফিরে গেছে সবই বলল। ওরা বুঝল তপু বাড়ির দিকে যায়নি। কারণ ঐ রাস্তাটা দিয়ে ওর বাড়ি যাওয়া কোনভাবেই সম্ভব না। তাহলে সে কোথায় গেছে সেটা ওদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।
প্রচীন সেই গুহার সন্ধান কিংবা সেখানে কিভাবে যেতে হবে, সেটার কিছুই ওরা জানেনা। তবে এতটুকু জানে তপু কোন রাস্তা দিয়ে গেছে। আর এটা নিয়েই এগুতে চায় ওরা। একটা সাইকেলে তিনজনে চলতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল ওদের। তারপরেও ঘুরে ফিরে তিনজনেই সাইকেল চালিয়ে মোটামুটি পাঁচ মাইল গেল। এরপর আর কারোই শরীরে কুলচ্ছিল না। অগ্যতা সিদ্ধান্ত হল বিশ্রাম নেয়ার। রাস্তার পাশেই এক বৃদ্ধের ছোট্ট একটা দোকান পেয়ে গেল। তিনজনে একটা বেঞ্চির উপরে বসে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। বৃদ্ধের কাছ থেকে পানি চেয়ে ইচ্ছেমত পানি খেল। এরপর বিস্কুট, পাউরুটি যাই পেল সেটাই কিনল। সেগুলোর কিছু কিছু মেয়াদ পেরনো ছিল। রবির খুব রাগ হল। কিন্তু ওদের কিছু করার নাই। এই দোকানের মাথা থেকেই রাস্তাটা দুই দিকে চলে গেছে। তপুকে পেতে হলে বৃদ্ধকে লাগতে পারে। রিফাতের তর সইছিল না। সে জিজ্ঞেস করেই বসল, “আচ্ছা চাচা, এইদিক দিয়ে কি কোন ছেলেকে সাইকেল চালিয়ে যেতে দেখেছেন?”
লোকটা প্রথমে ভ্রু কুচকে ফেলল, তারপর ফ্যাশ ফ্যাশ গলায় বলল, “হু একজনরে দেখছি”। ওদেরকে পরবর্তি প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়েই সেই উল্টো জিজ্ঞেস করল, “ছেলেটা কি হয় আপনাদের?”
রবি মুখ ফসকে বলে ফেলল, “বন্ধু”।
বুড়ো বেশ গম্ভীর হয়ে বলল, “বন্ধু হউক আর যাই হউক পোলাটায় ভালনা, এই বয়সে আমার কাছ থাইকে বিড়ি কিনছে”।
রবি বলতে চাচ্ছিল, ‘আপনি বিক্রি করলেন কেন?’ কিন্তু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বলল না। রিফাত সাগরের কানে ফিস ফিস করে বলছে, “আমি আগেই সন্ধেহ করেছিলাম, তপু আমাকে একদিন বলেছিল, ডিটেকটিভরা নাকি কোন কিছুর সমাধানে টেনশন কমাতে সিগারেট খায়”।
ওর কথা শুনে সাগর গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বলল, “হু, দেখি ও কত্ত বড় ডিটেকটিভ হয়েছে, সিগারেট না পেয়ে বিড়ি টানছে”।
ওরা বৃদ্ধের পাওনা মিটিয়ে তার দেখানো রাস্তায় চলল। কিছুদুর যেতেই সেই বৃদ্ধের চিৎকার শুনতে পেল। সে বলছে, “বাবারা ঐ দিকে যায়েন না, ঐদিকে হাতি শিকারিরা গেছে। রাতে হাতি আটকা পড়ছে মনে হয়।”
এই কথা শুনে ওরা তিনজনেই ভড়কে গেল। বিপদের উপর বিপদ। ওরা গেলে নিজেরাও বিপদে পড়তে পারে। কিন্তু তপুকে ফেলে রেখে গেলে ওরা নিজেরাই বিপদে পরবে। তপুকে খুঁজে পাওয়া না গেলে প্রথম ঝড়টা ওদের উপর দিয়েই যাবে। কারণ তপু ওদের ছাড়া অন্য কারো সাথে খুব কম মেশত।
রবি একটু নিশ্চিত হবার জন্য সেই বৃদ্ধকে বলল, “আচ্ছা, আমাদের বন্ধু আগে গিয়েছে না হাতি শিকারীরা?”
বৃদ্ধ উত্তরে ফ্যাশ ফ্যাশ গলায় বলল, “বিড়িখোরটা”।
একথা বলেই বুড়োটা খ্যাক খ্যাঁক করে হাসতে লাগল। এ হাসিতে ওদের গা-জ্বালা করল। এর আগে নিজেদের কাউকে এমন বলার সাহস কারো হয়নি। সাগর রাগের চোটে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সাইকেল চালাতে লাগল। প্রায় এক মাইল যাবার পর হঠাত চিৎকার করে বলল, “বদমায়েশ, পাক্কা বদমায়েশ বুড়া”।
.................................
বুড়োর কাছ থেকে সরে আসার এক ঘন্টা পর ওরা রাস্তাটার শেষে এসে পৌছুল। ওরা তিনজনেই দেখল রাস্তা থেকে একটু দূরে অপরিপক্ক হাতে হাতি শিকারিদের মস্তবড় ট্রাকটি গোপন করার চেষ্টা করা হয়েছে। ওরা এটাও খেয়াল করল যে, এই পাহাড়ি পথে ট্রাক কেন সাইকেল চালানোও অসম্ভব। ওরা আন্দাজ করল, তপু ওর সাইকেলটা আশেপাশেই লুকিয়ে রেখেছে। সে অনুমানের ভিত্তিতেই ওরা সাইকেল খোঁজা শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবচেয়ে বড় ঝোপটায় ওর সাইকেল পাওয়া গেল। এবারে তিনজনেই নিশ্চিত হল, তপু কোথায়, কোন উদ্দেশ্যে গেছে। কিন্তু কোনদিকে গেছে সেটা ওরা নিশ্চিত ছিলোনা। কিন্তু খালি হাতে ফিরে যেতে আসেনি ওরা। সেজন্যই নিজেদের সাইকেলটাও সেখানে লুকিয়ে রেখে পাহাড়ি পথ ধরে এগুতে লাগল।
প্রায় আধাঘন্টা এগুনোর পর ওরা পাহাড়ি পথেরও শেষ পেল। এরপর পথের কোন নিশানাই দেখতে পাচ্ছিলনা। এমন কি কেউ হেঁটে কোথাও গেছে তা জানবারও উপায় নেই। রবি হতাশ হয়েই পাহাড়ের একটু উঁচুতে উঠে একটা গাছের চিকন ডালের উপর গা এলিয়ে বসল। ততক্ষণে কুয়াশা কেটে গেছে। উঁচু থেকে বেশ দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল। ওরা মিনিট পাঁচেক এখানেই বসে ঝিমুলো। এরপর হঠাত একটি গলার আওয়াজ ওদেরকে অস্থির করে তুলল। কেউ বলছে, “উস্তাদ, ঐ পুরাতন গর্তটায় একটা চারপায়া হাতির পাশে একটা দোপায়াও আটকা পড়ছে”।
ওদের তিনজনের এপাশ থেকে আওয়াজ আসল, “ধ্যাত! এই ঝামেলা আবার জোটল কোত্থেকে? ঐ দোপায়াটারে মুখ বাইন্দা লইয়া আয়”।
কথাবার্তায় বোঝা গেল ওদের পাশের লোকটিই হাতিশিকারিদের লিডার। রিফাত ফিসফিসিয়ে বলল, “দোপায়াটা আবার তপু না তো?”
রবি বেশ চিন্তিত মুখায়ব নিয়ে বলল, “হবে হয়তো”।
লোকগুলোর এ কথায় ওরা বেশ চিন্তিত হয়ে গেল। ততোক্ষণে হাতি শিকারীরা বিনা বাক্য ব্যয়ে ওদের পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল। ওরা ভয়ে অস্থির। গাছের ডালপালার আড়ালে যতটা সম্ভব গা লুকোচ্ছে। তিনজনেই পরিষ্কার দেখতে পেল লোকগুলো সংখ্যায় প্রায় পাঁচ জন।
বেশ কিছুক্ষণ কোন কথা হচ্ছিলনা হাতি শিকারিদের। হঠাত একজন কথা বলে উঠল। প্রায় ওদের বয়সী একটা ছেলে লিডার লোকটাকে বলছে, “উস্তাদ, ঐ ছেলেটার পায়ে মারাত্মক জখম হইছে, হাতিটারও! মনে হইতাছে কেউ কামড়াইয়া মাংস তুইল্যা নিছে!”
উত্তরে কট্টাক্ষের সুরে বলল, “ হ’, তোর রাক্ষোসের পোলা খক্কোস আইছে না মাংস খাইতে”।
এ কথা শুনে ছেলেটি দমে গেল। এদিকে ওরা চুপচাপ লোকগুলোর কথা শুনছিল। জখমের ব্যাপারটা ওদের কারোই মাথায় আসছিল না। কিসে এমন হতে পারে? কোন মানুষ এমন কামড়াতে পারে, নাকি কোন পশু? হঠাত করেই রবির পায়ে একটা পোকা কামড়ে বসল। রবি নড়তে গিয়েই একটা ছোট গাছ শুদ্ধ ভেঙ্গে নিয়ে পড়ল। ওরা দেখতে পেল, এতক্ষণ যেখানে বসে ছিল সেটা পাহাড় ঘেঁষা পুরনো একটা দেয়াল। আর এই গাছটা সেখানে আগাছা হিসেবে ছিল।
ততোক্ষণে গাছের পড়ে যাবার আওয়াজে লোকগুলো থমকে দাঁড়িয়েছে। একজন লোক একটা রাইফেল হাতে ওদের দিকেই আসছে। ভয়ে ওদের বুক কাঁপছে। না জানি কী বিপদ সামনে আছে! মুক্তি মিলবে কি ওদের চার বন্ধুর এই ভয়ঙ্কর হাতি শিকারিদের কাছ থেকে?
চলবে...............