somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

মন থেকে বলি
আদ্যন্ত গৃহী। বইপোকা। লেখালিখিটা প্যাশন; তেমন বাছবিচার না থাকলেও থ্রিলার আর হরর জনরাতে স্বাচ্ছন্দ্য বেশি। অল্প বিস্তর ছবিয়ালও। ইন্সটাতে shajus shot হিসেবে পাবেন। মুভি দেখতে ভালো লাগে, ভালো লাগে খোলা আকাশ, সাগরের পাড়ে চুপ করে বসে থাকা আর নিস্তব্ধতা। প্রিয়

স্মৃতিতে ঈদ

২৬ শে জুন, ২০১৭ দুপুর ১:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



(ঈদের নামাজের প্রস্তুতিতে আমরা তিন বাপ ব্যাটা)


১।

'ঈদ মুবারাক...ঈদ মুবারাক...ঈদ মুবারাক...'

মসজিদের মাইক থেকে তিনবার ঘোষনা শুনতে পারলেই ব্যস। ঈদ শুরু আমাদের। সন্ধ্যা মিলাবার আগে থেকেই সবাই রাস্তায়। তখন তো এত হাইরাইজ ছিল না। কাজেই আমাদের দৃষ্টিও আটকাত না। বড়দের পাশাপাশি আমরাও আকাশ তন্ন তন্ন করে চাঁদকে খুঁজছি। একজন দেখতে পেলেই হলো। আমাদের মধ্যে যে আগে খুঁজে পেত, গর্বে যেন সে ফেটে পড়ত। গম্ভীরভাবে বাকিদের সে চাঁদ দেখাত। আমরা হুমড়ি খেয়ে ঈদের চাঁদকে দেখতাম।

তখন চাঁদ দেখা কমিটির নাম শুনিনি। নিজের চোখে চাঁদ না দেখলে আবার ঈদ কিসের। সৌদি আরবের সাথে তুলনা তো আরও পরে আসল। আমরা, মানে ছোটরা এত কিছু বুঝতাম না। আমাদের কাছে ঈদের ঘোষনাটাই ঈদ বার্তা হয়ে আসত।

মনে আছে, কাল ঈদ - এটা নিশ্চিত হওয়ার সাথে সাথে বাসার বড়দের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করা ছিল বাধ্যতামূলক। বাবা মা'কে দেখে শিখেছিলাম এটা। তারপরই হইচই। রাস্তায় লোক চলাচল বেড়ে যেত। অনেজে ছুটত শেষ মুহূর্তের বাজার করতে। বাসার কাছেই বিরাট বাজার। লোকে লোকারন্য। অনেক সময় এমনও হয়েছে যে তারাবীর নামাজ অর্ধেক পড়া শেষ। তখন খবর আসলো কাল ঈদ। লোকে তড়িঘড়ি এশার নামাজ শেষ করে ছুটত ঈদ প্রস্তুতিতে। এখন তো হাতের পাশেই স্বপ্ন বা আগোরা। ঈদের বাজার তো সারামাস ধরে চলে।

আমার কাছে ঈদ মানেই ছিল আগের রাতে পড়তে হবে না। আম্মু, খালা আর দাদীবুবু আমাদের হাতে মেহেদী লাগিয়ে দিত। আশেপাশের প্রতিবেশিরা আসত। হাতে কত রকম মেহেদীর আলপনা। আমরা রেডি হতাম আগের বছরের আনন্দমেলা দেখবার জন্য। কি উত্তেজনা! ঈদের দিন হত সেই বছরের নতুন আনন্দমেলা। কোথায় গেল সেই আনন্দমেলা? এখন ঈদের দিন পড়ে পড়ে ঘুমাই। আর সন্ধ্যাবেলা গ্লোরিয়া জিন্সে কফি। হ্যাহ..!!

ঈদের আগের দিনের সন্ধ্যায় ভাইয়া আর আমি কাগজ কলম নিয়ে বসতাম সালামী হিসেব করতে। মানে কার কাছ থেকে কত সালামী আদায় হতে পারে, তার এস্টিমেট করতাম। ঈদের দিন রাতে এস্টিমেটের সাথে মেলাতাম। প্রায় সময়ই মিলে যেত। কখনও কখনও কোন জায়গা থেকে হিসেবের চেয়ে বেশি পেলে আনন্দ রাখার জায়গা থাকত না। কিন্তু আমার ছেলেদের বেলায় এই উত্তেজনার ছিটেফোঁটাও দেখিনি। সালামি তো গোনেই না, এদিক ওদিক ফেলে রাখে। অবশ্য করবেই বা কি? ওই স্বাধীনতা তো ওদের আমরা দেইনি। ট্যাবে গেম খেলে আর টিভিতে কার্টুন আর মুভি দেখে ঈদ পার হয় ওদের। অন্যসব দিনগুলো থেকে পার্থক্য কোথায়? এখন বাসাতেও কেউ আসে না, আমরাও কোথাও যাই না।

ওহ হো! আসল কথাই তো বলা হয়নি। রোজার শেষ দিকে ঈদের কেনাকাটা হতো। 'ঈদ শপিং' কথাটা বললে শৈশবের সেই নতুন জামা-জুতো কেনার আনন্দটার কিছুই বোঝা যায় না। আব্বু আম্মু কে দেখতাম রোজা রেখে সারাদিন কেনাকাটা করে ঘরে ফিরে ঠান্ডা মেঝেতে চিৎপটাং হয়ে আছে। আমরা যেতাম শুধুমাত্র জুতো কিনতে, তাও ইফতারের পর। সেদিন কি উত্তেজনা! বিকেল থেকেই আমরা রেডি। জুতোই ছিল আসল জিনিস। কারন তখন বছরে এই একজোড়াই নতুন জুতো পেতাম। এলিফ্যান্ট রোডের দোকান ঘুরে ঘুরে যখন ফাইন্যালি কেনা হত, তখন আমার আনন্দ দেখে কে? পারলে সেই জুতো বুকে জড়িয়ে ঘুমাতাম। এবং অবশ্যই গোপনতম স্থানে লুকানো থাকত। বন্ধুরা দেখলেই তো পুরোনো হয়ে গেল। ঈদের নামাজের পর যখন নতুন শার্ট প্যান্টের সাথে পায়ে জুতোটা গলাতাম, নিজেকে মনে হত রাজা। নিদেনপক্ষে মহল্লার শের। গটগট করে হাঁটার শব্দে নিজেরই একটু পর পর আনন্দে হাসি পেত। তখন অবশ্য কেডসই কিনতাম। শু কিনেছি আরও অনেক বড় হয়ে। আমার ছেলেরা অবশ্য সারা বছরই নতুন জামা বা জুতো পাচ্ছে। কাজেই নতুন জামার সেই তীব্র আনন্দ থেকে ওরা বঞ্চিত।



২।

ঈদের নামাজ হত বেশ সকালে। কিন্তু আব্বু তুলে দিতে পারলে মাঝরাতে। 'ওঠ...ওঠ...দেরি হয়ে গেল' - এই চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গা ছিল বাঁধা। তারপর ঠান্ডা পানিতে গোসল। উফ...আজও সেই টর্চার মনে আছে। তারপর পাঞ্জাবি পাজামা পরে কানে আতর মাখা তুলো গুঁজে দিত দাদু। সেমাই খেয়ে নামাজের জন্য রওনা হতাম। খুৎবাতে উশখুশ করতাম, কখন শেষ হবে। ভাইয়ার সাথে খোঁচাখুঁচিও চলত তার ফাঁকে। নামাজ শেষে সবাই কোলাকুলি করতাম। বাসায় ফিরেই হাত পেতে দাঁড়ানো - সালামি। বাসা থেকেই প্রথম সালামিটা পেতাম। এরপর পরোটা আর গরুর গোশতের আলু-ঝোল ছিল বাঁধা মেন্যু। সেই স্বাদ যে শৈশবে মাথায় ঢুকে গেছে, আজও বেরোয় নি। সেই মেন্যু আজও চলছে।


আমার ছোটবেলায় ঈদ ছিল নির্ভেজাল আনন্দের দিন; বিশেষ করে আমার বয়সীদের জন্য। পকেটে কাঁচা টাকা ঝমঝম করছে। বাইরে ঘুরে বেড়ানোর অবাধ স্বাধীনতা - এর কোনটাই তো বাকি ৩৬৩ দিন পেতাম না। যা ইচ্ছা কেন, যা ইচ্ছা খাও, কেউ কিছু বলবে না। কেনার তালিকায় দুইটা জিনিস অবশ্যই থাকত। প্রথমটা হলো প্লাস্টিকের ঘড়ি। দাম মনে হয় ৫ টাকা ছিল। ১০ টাকা দামের আরেকটা ছিল। ওইটার আবার একটা চাবি ছিল আর ঢাকনা খোলা যেত। সালামি বেশি পেলে ১০ টাকারটাই কিনতাম।


দ্বিতীয় যে জিনিসটা কিনতাম সেটা হলো টিনের বন্দুক। নিশ্চয়ই মনে আছে বোল্ট একশন বন্দুকটা কথা। মাঝখান থেকে ভাঁজ করে স্প্রিং লোড করতে হতো। মাথায় একটা ছিপি লাগানো থাকত সুতো দিয়ে। ওটাই গুলি। ফায়ার করলে ফট শব্দ করে কিছুদূর গিয়ে ঝুলে পড়ত। প্রথম প্রথম আমরা সুতোটা লম্বা করে নিতাম যেন গুলি বেশি দূর পর্যন্ত যায়। পরে আবিষ্কার করলাম, নল দিয়ে ছোট পাথ্র ঢুকিয়ে গুলি করলে অন্যদের গায়ে লাগান যায়।


আরও দুটো জিনিস কেনা হত অবশ্যই। টিনের আর প্ল্যাস্টিকের গাড়ি। টিনের গাড়িটা ছিল সেডান। তখন তো বুঝতাম না। টিকত অনেকদিন। আর প্ল্যাস্টিকের গাড়ি সবসময় বড় সাইজের কিনতাম। ঈদের কয়েকদিন পর ওপরটা কেটে ফেলে বালু টানার ট্রাক বানানো হতো অবশ্যম্ভাবী ভাবে।


খাবার কি কিনতাম আজ ঠিক মনে পড়ছে না। তবে আট আনা দামের বরইয়ের আচার ১০/১২ টা কিনতামই। ঘোরো ফেরো আর একটা করে মুখে ফেলে চুষতে থাকো। কোথায় গেল সেই স্বাদের আচার? আইস্ক্রিমের জন্য বাঁধা ছিল বেবি আইস্ক্রিম। আর খেতাম লাল নীল সবুজ রঙ করা বরফকুচির কুলপি। চুষে খেতে যে কি মজা ছিল তা কি আজকালকার বাস্কিন এন্ড রবিন্স খাওয়া বাচ্চারা বুঝবে?



৩।

ঈদের দিনটা ফুরিয়ে যেত চট করে। এখন বুঝি, অতিরিক্ত আনন্দে কাটানোর ফলে টাইম কন্ট্র‍্যাকশনের মত হত। ২৪ ঘন্টাকে মনে হত ৪ ঘন্টা।

অবশ্য তাতে আমাদের দুঃখ ছিল না। কারন পরের দিনও ছুটি। আর বিকেলে নানুবাড়ি যেতাম। সালামির একটা বড় অংশ আসত সেখান থেকে। আর রাত নয়টায় আনন্দমেলা তো দেখতেই হবে। বছরের সেরা অনুষ্ঠান। তখন তো একটাই চ্যানেল - বিটিভি। অনুষ্ঠানগুলোও হতো সেই রকমের। একটু বড় হবার পর অপেক্ষা করতাম সন্ধ্যার সময় হওয়া ব্যান্ড শো'র জন্য। আমি তখন এলআরবি বলতে পাগল। বাসায় পোস্টার টানানো। যত কাজই থাক, এইটা মিস করতাম না।

আনন্দমেলা শেষের সাথে সাথেই ঈদও ফুড়ুৎ। মনে তখন দুঃখী দুঃখী ভাব। আরেকদিন পরেই তো পড়ালেখা শুরু হবে।


৪।

সেই শৈশব ছেড়ে এসেছে ৩০ বছর আগে।

এই চল্লিশের কোঠায় দাঁড়িয়ে যখন স্মৃতির পাতাগুলো হাতড়াই, তখন এইসব সুখের, আনন্দের মুহূর্তগুলো মনে পড়ে আর মনটা বিষাদে ভরে যায়। কোথায় হারিয়ে গেল আমার সেই ঈদ?

এখন ঈদ কখন আসে কখন যায়, টেরও পাওয়া যায় না। আমি কিন্তু একটু হলেও শৈশবের ঈদকে আঁকড়ে রেখেছি। ঈদের নামাজটা দুই ছেলেকে নিয়ে আব্বু আর ছোট ভাইয়ের সাথেই পড়ি। এর কোন ব্যতিক্রম আজও নেই। আর নামাজ শেষে সেই পরোটা গোশত। আমি এটা ছাড়া নাস্তা করতে পারিই না ঈদের দিন। অন্য অনেক মেন্যু অবশ্য যোগ হয়েছে। কিন্তু আমার মেন্যু একটাই।

ঈদ আসবে, ঈদ যাবে...কিন্তু আমার ঈদ এখনো হয় চাঁদ রাতে। ক্রিং ক্রিং ফোনের শব্দে। ওপাশ থেকে আব্বু-আম্মুর গলাঃ

"ঈদ মুবারাক, বাবা। ভাল আছিস? কাল কখন আসবি?"
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০১৭ দুপুর ১:২২
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ভাবছিলাম ২ লক্ষ ব্লগ হিট উপলক্ষে ব্লগে একটু ফান করব আড্ডা দিব, কিন্তু এক কুৎসিত অপব্লগার সেটা হতে দিলোনা।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:০৫



এটি ব্লগে আমার ২৬০ তম পোস্ট। এবং আজকে আমার ব্লগের মোট হিট ২০০০০০ পূর্ণ হয়েছে। আমি আনন্দিত।এই ছোট ছোট বিষয় গুলো সেলিব্রেট করা হয়তো ছেলে মানুষী। কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্প: সম্পত্তি

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৪



গল্প:
সম্পত্তি

সাইয়িদ রফিকুল হক

আব্দুল জব্বার সাহেব মারা যাচ্ছেন। মানে, তিনি আজ-কাল-পরশু-তরশু’র মধ্যে মারা যাবেন। যেকোনো সময়ে তার মৃত্যু হতে পারে। এজন্য অবশ্য চূড়ান্তভাবে কোনো দিন-তারিখ ঠিক করা নেই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শয়তান বন্দি থাকলে শয়তানি করে কে?

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:২০



রমজানে নাকি শয়তানকে বেধে রাখা হয়,তাহলে শয়তানি করে কে?

বহুদিন পর পর ব্লগে আসি এটা এখন অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। বেশ কিছু বয়স্ক, মুরুব্বি, সম বয়সি,অল্প বয়সি একটিভ কিছু ব্লগার... ...বাকিটুকু পড়ুন

বয়কট বাঙালি

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৯ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:২৪



কদিন পরপরই আমাদের দেশে বয়কটের ঢল নামে । অবশ্য তাতে খুব একটা কাজ হয় না । বাঙালির জোশ বেশি দিন থাকে না । কোন কিছু নিয়েই বাঙালি কখনই একমত... ...বাকিটুকু পড়ুন

“রোজা” নিয়ে গবেষণা করে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন জাপানের চিকিৎসা বিজ্ঞানী ‘ইউসোনরি ওসুমি’।

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৯ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ১১:৫০




‘রোজা’ ফারসি শব্দ, আরবিতে ‘সওম’। ভারতের রাজনীতিতে ‘অনশন’। ইংরেজিতে ‘ফাস্ট’। কিন্তু মেডিকেলের পরিভাষায় রোজার কোনও নাম ছিল না ও মেডিকেল বই গুলোতে রোজা’র বিশেষ কিছু গুণাগুণও উল্লেখ ছিল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×