somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের ছুটি নিয়ে কিছু কথা

০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের ছুটি নিয়ে কিছু কথা

ড. মঞ্জুরে খোদা

আধুনিক জাপানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচনা মূলত ১৮২০-১৮৩০ এর দশকে। সেটা জাপানের অর্থনীতির সুচক বৃদ্ধি থেকেই বোঝা যায়। জাপান আধুনিক বিশ্বে প্রবেশ করে মেইজি রেসটোরেশনের (১৮৬৮-১৯১২) মধ্যে দিয়ে। এই সময়ে জাপানের শিক্ষার হার ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী। ১৮৮৬ সালে শতকরা ৪৩ ভাগ পুরুষ ও শতকরা ১০ ভাগ নারী শিক্ষিত ছিল। একটি সভ্য, আধুনিক শিল্পন্নোত দেশ হিসেবে জাপান কয়েক দশক ধরেই বিশ্ব অর্থনীতিতে উন্নয়নের মডেল হিসেবে আলোচিত। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশ গুলোর জন্য এই আলোচনা তাপর্যপূর্ণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ একটি কিভাবে অতি অল্প সময়ে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হলো তা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অবশ্যই অনেক বড় পাঠ। অপযাপ্ত ভূখন্ড, সীমিত সম্পদ, বৃহত জনগোষ্ঠী ও নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও এই জাতির বিকাশ ও বিস্ময়কর সাফল্যের কারনগুলো বিশ্লেষনের দাবী রাখে।

বিশ্বের প্রত্যেক দেশেই তার দেশের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্ম, ঐতিহ্য ইত্যাদি’র উপর ভিত্তি করে সেই দেশের সরকারী ছুটি ও জাতীয় দিবস গুলো নির্ধারিত করে। এশিয়ার একটি দেশ বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি জাপানের সরকারী ছুটির বিষয়টি বেশ কৌতুহলের, উৎসাহের ও শিক্ষার। দক্ষিন এশিয়ার দেশ গুলোর ছুটির বিসয় গুলো মুলত রাজনীতি ও ধর্মীয় নির্ভর। কিন্তু সেই দিক থেকে জাপানের বিষয়টি অনেকটা ভিন্ন। আর সেটা তাদের ছুটির বিষয় ও বিন্যাস দেখলেই বোঝা যায়। একটি দেশের বাৎসরিক ছুটির সাথে সেই আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটে। জাতীয় ছুটি ও দিবস নির্ধারণ করার মধ্য দিয়ে তাদের সেই নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ পায়। ১৯৪৮ সালের সরকারী ছুটি আইনের অধীনে তা নির্ধারণ করা হয় যদিও বিভিন্ন সময় তার কিছু পরিবর্তন ঘটেছে।
জাপানের সরকারী ছুটি ও জাতীয় দিবস গুলো নির্ধারিত হয়েছে তাদের রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক নীতির ভিত্তিতে। তাদের এই ছুটি ও দিবস বিন্যাসের মধ্যদিয়ে যে বিষয়টি সামনে আসে তা হলো তাদের শৃংখলা ও আনুগত্য, উন্নত সংস্কৃতিক চেতনা বোধ, প্রকৃতি-পরিবেশ-মানুষ ও প্রানের প্রতি দায়িত্ব ও ভালবাসা, সময় ও শ্রমের গুরুত্ব ও মর্যদা এবং সর্বপরি একটি প্রকৃত সভ্য, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ও চর্চা।

প্রথমে এক নজরে দেখে নেয়া যাক সূর্যদয়ের দেশ জাপানের বাৎসরিক ছুটির ক্যালেন্ডারটি
ছুটির দিন বা তারিখ উপলক্ষ্য, অনুষ্ঠান ও আয়োজন মালা

১ জানুয়ারী শুভ নববর্ষ দিবস ১৯৪৮*
১৪ জানুয়ারী প্রাপ্ত বয়স্ক দিবস। ছেলে-মেয়েদের ২০ বছর হওয়া উপলক্ষে তাদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য উৎসাহিত করার আনুষ্ঠানিক ভাবে অভিনন্দিত করা হয় ১৯৪৮*
১১ ফেব্রুয়ারী জাতি প্রতিষ্ঠা দিবস এবং দেশেকে ভালবাসার দিন হিসেবে স্মরণ করা হয় ১৯৬৬*
২০ মার্চ পূর্ব পুরুষদের সমাধিস্থলে গিয়ে শ্রদ্ধা জানানো এবং জীবন ও প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ১৯৪৮*
২৯ এপ্রিল শোওয়া দিবস। সম্রাট হিরোহিতোর জন্মের পরের সময়কালকে শোওয়া কাল হিসেবে এরা স্মরণ করে ২০০৭
৩ মে সংবিধান স্মরনীয় দিবস ১৯৪৮*
৪ মে প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা দিবস ১৯৮৯*
৫ মে শিশু দিবস, এই দিবসে শিশুদের স্বাস্থ্যকর সুন্দর ভবিষৎ কামনায় যে সব বাসায় শিশু আছে তারা তাদের ঐতিহ্য অনুযায়ী সাজায় ১৯৪৮*
১৫ জুলাই সাগর আশির্বাদ দিবস, যেহেতু জাপান সাগর দ্বারা পরিবেষ্টিত একটি দেশ, তাই খাদ্য ও নিরাপত্তার জন্য একে বিশেষভাবে স্মরণ করা হয় ১৯৯৫*
১৬ সেপ্টেম্বর প্রবীন নাগরিক সন্মান দিবস এই দিন তাদের দীর্ঘ ও সুস্থ জীবন প্রত্যাশ করা হয় ১৯৬৬*
২৩ সেপ্টেম্বর শরৎকালের প্রারম্ভে পূর্ব পুরুষদের সমাধিস্থল পরিদর্শন ও শ্রদ্ধা জানানো ১৯৪৮*
১৪ অক্টোবর স্বাস্থ্য ও ক্রীড়া দিবস ১৯৬৬*
৩ নভেম্বর সাংস্কৃতিক দিবস ১৯৪৮*
২৩ নভেম্বর শ্রমিক ধন্যবাদ দিবস ১৯৪৮*
২৩ ডিসেম্বর সম্প্রাটের জন্মদিন উদযাপন ১৮৬৮*
*উল্লেখিত সালে বাৎসরিক ছুটির আইনগুলো জাপান সরকার কর্তৃক সংশোধন, গৃহীত ও কার্যকর হয়

বাৎসরিক ছুটির এই তালিকা দেখে অনেকে মনে করতে পারেন মাত্র এই কয়েকদিন তাদের ছুটি, তার মানে তারা কি শুধু কাজই করে? বিষয়টা এমন না এর বাইরেও বেশ কিছু অনাআনুষ্ঠানিক লম্বা ছুটির ব্যবস্থা আছে। যেমন নববর্ষকে ঘিরে, সোনালী সপ্তাহ, এবং এদের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব ওবোন নতুন বছর ইত্যাদি। যে ছুটি গুলো বেসরকারী ভাবে নির্ধারিত হয়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানী তাদের মত করে নির্ধারণ করে এবং বাৎসরিক ক্যালেন্ডার তৈরী করে। এর সাথে ফুল দেখা (জাপানিজে বলে ‘হানামি’), আতোশবাজি/আলোর খেলা বা উৎসব (হানাবি), সাগরে যাওয়া (উমি দেখা), বাবা দিবস, মা দিবস এই সব হচ্ছে তাদের বাৎসরিক ও ধারাবাহিক আনন্দ, বিনোদন, স্মরণ ও উপভোগের অংশ।

এই বছর জাপান পার্লামেন্টে সরকার নতুন আইন Happy Monday System (সুখী সোমবার ধারা) চালু করা হয়েছে। নতুন করে সংস্কার করা এই আইনে নিয়মিত বাৎসরিক কোন ছুটি যদি রবিবারে পরে তাহলে সেই ছুটিটা আপনিই সোমবারে চলে যাবে। সোমবার সাথে যুক্ত করে দেয়ায় মাসের কোন কোন সপ্তাহে টানা ৫ দিন কাজ করার পর তারা তিনদিন ছুটি পাচ্ছেন। টানা তিনদিন ছুটি পাওয়ায় এই থোক ছুটি গুলো তাদের জন্য অধিক ব্যবহারিক হবে। নিজের এবং পরিবারে অধিক আনন্দ ও বিনোদনের কারন ঘটবে। বছরে বেশ কয়েকবার এই ধরনের সাপ্তাহিক ছুটির (শনি, রবি, সোম) কারনে একে Happy Monday Holiday বলা হয়। এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যদিয়েই এই জাতির একটি উন্নতি, বৈজ্ঞানিক ও সংস্কার মুক্ত মানসিকতার প্রকাশ পায়। জাতি হিসেবে এদের কিছু রক্ষনশীলতা থাকলেও রাষ্ট্র ও সমাজের যে কোন জন্য ভাল, উন্নত, কল্যান ও মঙ্গলকর কিছু গ্রহন করতে এদের কোন কৃপনতা নেই। এদের অনেক কিছুই বা প্রায় সব কিছুই ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সাথে এক অভূতপূর্ব সংমিশ্রন ও সমন্বয়ে গড়া।

আলোচনার শুরুতেই বলছিলাম বিস্ময়কর উন্নয়নের মডেল জাপান থেকে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু। কিন্তু উন্নত অনেক কিছু গ্রহন করার যে পরিমান সাহস, উদারতা ও সৌন্দর্য থাকা দরকার তা কি আমাদের আছে? অনেক ক্ষেত্রে এবং বিষয়ে আমাদের নীতি নির্ধারকদের আপোষ করতে দেখা যায় কিছু পশ্চাতপদ রক্ষনশীল ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কাছে। যেমন সাপ্তাহিক ছুটি কবে নির্ধারণ করলে দেশের জন্য ভাল হয় তা অনেকেই জানলে, বুঝলে, মানলেও তা কার্যকর করতে পারছিনা। কেন? কারন সবারই জানা। সাপ্তাহিক সরকারী ছুটি শুক্রবার থেকে রবিবার করলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? সেখানেও সংকীর্ণ রাজনীতি! পাকিস্থান, মালোএশিয়াসহ অনেক মুসলিম প্রধান দেশেও রবিবার সরকারী ছুটি। সেখানে বাংলাদেশ একটি বিকাশমান অর্থনীতি আমাদের স্বার্থেই এই বিষয়টির মিমাংশা হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই, বিভিন্ন সংগঠন ও প্রবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে দাবী করলেও সংশ্লিষ্টদের গা করেন নি। কেবল মাত্র একটি ধর্মীয় ভাবাবেগের কারনে বাংলাদেশ ও বহিবিশ্বের সাথে যোগাযোগের সুযোগ ও সময়ের গড়মিল হচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকার সাথে সময়ের রাত-দিন হিসেব করলে এই ব্যবধান হয় ৩ দিন! এর সাথে অন্যান্য দেশের সময়ের গড়মিল, হরতাল-অবরোধ বিবেচনায় নিলে আমাদের দেশের বর্হিবিশ্বের সাথে কাজ ও যোগাযোগের সুযোগ ঘটে দুই, আড়াই, সারে তিন ও চার দিনের মত। একটি দেশের উন্নয়নের জন্য সবার আগে দরকার শিক্ষা ও সংস্কার মুক্ত মানসিকতা যা আমরা এখনও অনেকটা অর্জন করতে পারিনি। যারা পেরেছে তারা গিয়েছে অনেক অনেক দূর। এশিয়ার দেশ জাপান হতে পারে তাদের জন্য উন্নয়ন গল্পের এক অনন্য উদাহরণ।
লেখক: গবেষক, ইনস্টিটিউট অব পলিসি সাইন্স, জাপান।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ১১:২৬
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাগতম ইরান

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৩

ইরানকে ধন্যবাদ। ইসরায়েলকে দাত ভাঙ্গা জবাব দেওয়ার জন্য।

হ্যাঁ, ইরানকে হয়তো এর জন্য মাসুল দেওয়া লাগবে। তবে, কোন দেশ অন্য দেশের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপে করবে আর সেদেশ বসে থাকবে এটা কখনোই সুখকর... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৩৯




আমরা পৃথিবীর একমাত্র জাতী যারা নিজেদের স্বাধীনতার জন্য, নিজস্ব ভাষায় কথা বলার জন্য প্রাণ দিয়েছি। এখানে মুসলিম হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান চাকমা মারমা তথা উপজাতীরা সুখে শান্তিতে বসবাস করে। উপমহাদেশের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্যা লাস্ট ডিফেন্ডারস অফ পলিগ্যামি

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০


পুরুষদের ক্ষেত্রে পলিগ্যামি স্বাভাবিক এবং পুরুষরা একাধিক যৌনসঙ্গী ডিজার্ভ করে, এই মতবাদের পক্ষে ইদানিং বেশ শোর উঠেছে। খুবই ভালো একটা প্রস্তাব। পুরুষের না কি ৫০ এও ভরা যৌবন থাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রিয় কাকুর দেশে (ছবি ব্লগ) :#gt

লিখেছেন জুন, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৩



অনেক অনেক দিন পর ব্লগ লিখতে বসলাম। গতকাল আমার প্রিয় কাকুর দেশে এসে পৌছালাম। এখন আছি নিউইয়র্কে। এরপরের গন্তব্য ন্যাশভিল তারপর টরেন্টো তারপর সাস্কাচুয়ান, তারপর ইনশাআল্লাহ ঢাকা। এত লম্বা... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেরত

লিখেছেন রাসেল রুশো, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:০৬

এবারও তো হবে ইদ তোমাদের ছাড়া
অথচ আমার কানে বাজছে না নসিহত
কীভাবে কোন পথে গেলে নমাজ হবে পরিপাটি
কোন পায়ে বের হলে ফেরেশতা করবে সালাম
আমার নামতার খাতায় লিখে রেখেছি পুরোনো তালিম
দেখে দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×