somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মাদ্রাসা শিক্ষা, সাংস্কৃতিক সংঘাত, উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের অশনি সংকেত

০৪ ঠা মে, ২০১৪ ভোর ৪:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ড. মঞ্জুরে খোদা

ভূমিকা
আধুনিক বিশ্বে শিক্ষা একটি স্বীকৃত বিষয়, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দ্যেশ্য অর্জনের একটি পরিকল্পিত প্রক্রিয়া। আর শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ভর করে রাষ্ট্র ও সমাজের ভাবাদর্শের উপর। শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল বৈষয়িক প্রতিষ্ঠা না ব্যক্তি চরিত্রের বিকাশ তাও অনেকের বিতর্কের বিষয়। এটা স্বাভাবিক, সমাজে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও মতাদর্শের মানুষ থাকলে শিক্ষার অর্থ এবং সংজ্ঞায় বৈচিত্রতা থাকবে। সেই বিতর্ক থাকলেও একথা নানাভাবে প্রমানিত শিক্ষা এবং উন্নয়নের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য।

তত্ত্ব ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্যের কারণে আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক ধারা ও প্রবনতা অনুযায়ী শিক্ষাকে গড়ে তোলা যায় নি। যে জন্য একদিকে যেমন দক্ষ মানবসম্পদের অভাব, অন্যদিকে অনেক শিক্ষিত নাগরিক কর্মহীন। একদিকে সম্পদের সীমাবদ্ধতা অন্যদিকে সীমিত সামর্থের অপরিকল্পিত ব্যবহার। যা দেশের পরিকল্পিত বিকাশের পরিবর্তে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা ধরণের সমস্যার সৃষ্টি করছে। তার একটি হচ্ছে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন ধারার শিক্ষাব্যবস্থার ব্যপক প্রসার।
শিক্ষা বিষয়ে আমাদের সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে পরিষ্কার নির্দেশনায় দেয়া হয়েছে যে, (ক) রাষ্ট্র একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজননীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করিবেন। এখানে আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর বলতে আমরা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত প্রাইমারী শিক্ষাব্যবস্থাকে বুঝব। সংবিধানের উক্ত অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এটা স্পষ্ট যে, প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা হবে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত, অবৈতনিক, বাধ্যতামুলক এবং দেশের সকল শিক্ষার্থীর জন্য একই পদ্ধতির।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ দিকঃ ১. প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার ৩টি প্রধান ধারা ও ৯টি উপধারা ২. ছাত্রসংখ্যা অনুযায়ী শিক্ষাক্ষেত্রে কওমী মাদ্রাসার স্থান দ্বিতীয় যা সরকারের নিয়ন্ত্রনের বাইরে ৩. মাদ্রাসা শিক্ষার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির হার ৪. বিভিন্ন ধারার অপরিকল্পিত শিক্ষা, শিক্ষাক্রম ও দর্শণ ৫. শিক্ষার অর্থায়ন, ব্যবস্থাপনা, নিয়ন্ত্রন ও সমন্বয়হীনতার পরিস্থিতি।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিক্ষার ধারা কওমী মাদ্রাসার বিষয়ে সঠিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া খুব দূরুহ। কারণ এই ধারার কর্তৃপক্ষ তাদের ছাত্র, শিক্ষক, শিক্ষা, তহবিল, পাঠক্রম ইত্যাদি বিষয়ে কোন তথ্য প্রকাশ করে না। পত্রপত্রিকা ও কিছু গবেষণা থেকে খবর পাওয়া গেলেও জাতীয়ভিত্তিক কোন তথ্য পাওয়ার সুযোগ নেই। ‘কওমী মাদ্রাসা বেফাকুল মুদাররেসিন শিক্ষাবোর্ড’ নামে একটি কর্তৃপক্ষ আছে কিন্তু সেখানে কোন প্রয়োজনীয় পরিসংখ্যান নেই, যা দিয়ে ভাল কাজ করা সম্ভব। তবে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তা বিশ্লেষনের মাধ্যমে একটি বাস্তব ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করেছি। কিভাবে এই ধারা দেশে অনৈক্য, সাংস্কৃতিক সংঘাত ও উন্নয়নের পথে বাধার কারণ তৈরী করছে তার আলোচনাই এই নিবন্ধের প্রচেষ্টা।

মাদ্রাসা শিক্ষার বিকাশ ও বাস্তবতা
১৯৪৭ সালে কলকাতার মাদ্রাসার আরবি শাখাটি ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। প্রতিষ্ঠা করা হয় সরকারী আলিয়া মাদ্রাসা। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড’। পরে এর তত্ত্বাবধানে ১৯৫৭ সাল নাগাদ ৭২৬টি আলিয়া মাদ্রাসা পূর্ব পাকিস্তানে গড়ে ওঠে। পাশাপাশি সমাজের রক্ষণশীল মুসলমানদের বেসরকারী উদ্যোগে গঠিত হয়েছে ‘কওমী মাদ্রাসা’। তাদের আদি আদর্শ হচ্ছে দেওবন্দে ১৮৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘দারুল উলুম দেওবন্দ’ মাদ্রাসা। এদের সম্পর্কে তথ্য খুবই কম এবং অনেক কিছুই অনুমানভিত্তিক। শুরু থেকেই তারা দেশের মূলধারার শিক্ষা বা রাষ্ট্রের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন থেকে অগ্রসর হয়েছে। যদিও মধ্যপ্রাচ্যে ও অন্যান্য ইসলামী দেশের সাথে তাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। এই সম্পর্ক শুধু আদর্শগত নয়, আর্থিকও। উল্লেখ্য, ব্রিটিশ আমলে এই মাদ্রাসাগুলোকে বলা হতো ‘খারিজি মাদ্রাসা’, যার অর্থ- সরকারি নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এ দেশে আলিয়া মাদ্রাসা ছিল এক হাজার। ২০০৮ সালে এই আলিয়া মাদ্রাসার মোট সংখ্যা দাড়িয়েছে ১৮ হাজার ৫১৮টি। তবে বর্তমানে সরকার নিয়ন্ত্রিত আলিয়া মাদ্রাসার বাইরে নিবন্ধনকৃত কওমী মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। সূত্রমতে, যদি অনিবন্ধনকৃত মাদ্রাসা এর সাথে যুক্ত করা হয় তাহলে কওমী মাদ্রাসার সংখ্যা দাড়াবে ৬৪ হাজার, মতান্তরে তা প্রায় ৭০ হাজারের উপরে। তাহলে বলা যায় বিগত ৪ দশকে মাদ্রাসার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৭০ গুন এবং প্রতি বছর বেড়েছে ১৭৫০টি করে। ড. আবুল বারাকাতের তথ্যমতে (২০০৮) মোট মাদ্রাসা ছাত্রের সংখ্যা ৯৮ লক্ষ ২৭ হাজার ৭৪২ জন। এর মধ্যে আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ে ৪৫ লক্ষ ৮০ হাজার ৮২ জন (৪৬%) এবং কওমী মাদ্রাসায় পড়ে ৫২ লক্ষ ৪৭ হাজার ৬৬০ জন (৫৪%)। কওমী মাদ্রাসার ৮৫ শতাংশই গ্রামে অবস্থিত এবং ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বোডিংএ খেকে পড়ে। তারমানে প্রায় ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী সরকারী নিয়ন্ত্রনের বাইরে কেবল ধর্মভিত্তিক শিক্ষা নিচ্ছে। সংখ্যার দিক থেকে শিক্ষার দ্বিতীয় বৃহত্তম ধারা সরকারের কোন প্রকার নিয়ন্ত্রন সমর্থনও করে না। ভিন্নভিন্ন শিক্ষায়, সংস্কৃতি ও মনোজগতের এক বিশাল দুরত্ব নিয়ে বাস করছে একই দেশের দুই বিপরীত মূখী প্রজন্ম। যাদের চিন্তা-চেতনার মৌলিক বিষয়গুলো সম্পূর্ণ আলাদা।

মাদ্রাসা শিক্ষার একটি ধারাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে সেটা হচ্ছে আলিয়া মাদ্রাসার ধারা। সরকার যখন মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়নের কথা বলে, তা মূলত আলিয়া মাদ্রাসার ধারাকেই বুঝিয়ে থাকে। হাজার হাজার কওমী মাদ্রাসা সরকারের নজরদারীর বাইরে এবং তারা কোন প্রকার পৃষ্টপোষকতা চায়ও না। এই কওমী ধারারই অনুষঙ্গী হচ্ছে ফোরকানিয়া মাদ্রাসা। এটি আরও সংকীর্ন। এখানে শুধু ‘আরবী বর্নমালা’ ও ‘কোরআন পাঠ’ শেখানো হয়। এ ছাড়া আছে হিফজুল কোরআন বা হাফেজিয়া মাদ্রাসা, এখানে বহু বছর পরিশ্রম করে অর্থ জানা ছাড়াই শুধু কোরআন মুখস্থ আবৃত্তি শেখানো হয়।

এ ছাড়া রক্ষণশীল এলিট মুসলমানরা নিজেদের জন্য শহর গুলোতে গড়ে তুলেছেন এক ধরণের মাদ্রাসা ব্যবস্থা। যেগুলো ‘ক্যাডেট মাদ্রাসা’ ও নানা নামে পরিচিত। এসব প্রতিষ্ঠানে কখনও ইংরেজী ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় আধুনিক পাঠদান করা হয়। তাদের পোষাক-পরিচ্ছদ আধুনিক। এখানে সহশিক্ষা চালু আছে এবং মেয়েদের আলাদা ঘরে শিক্ষা দেওয়া হয় না। টিভি-কম্পিউটার-নাটক-নৃত্য-স্পোর্টস-ছবি আঁকা এগুলোর কোনটাই এখানে ধর্মবিরোধী নয়। খালি একটি বিষয়ই তারা লক্ষ্য রাখেন, সেটা হচ্ছে ‘ইসলামের পুনরুজ্জীবন’ এবং সমাজে, অর্থনীতিতে, রাজনীতিতে আদর্শগতভাবে ইসলামের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করা। ইসলাম তাদের কাছে একটি মৌলবাদী বিশ্বাস। সে দিকে থেকে এই ধারাটিকে ‘আধুনিক রাজনৈতিক ইসলাম’ হিসেবে অভিহিত করা যায়। বাংলাদেশের নাগরিকদের একটি বড় অংশ ভাল করে জানে না এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ কেমন।

কি পড়ছে এবং কেমন তাদের সিলেবাসের ধরণ?
কিছু সংখ্যক মাদ্রাসায় প্রাথমিক স্তরে স্কুল টেক্সট বোর্ডের কারিকুলাম অনুসরণ করা হয়। বেশিরভাগ কওমী মাদ্রাসায় পড়ানো হয় তাদের নিজস্ব কারিকুলাম অনুযায়ী প্রণীত পুস্তকাদি। সর্ববৃহত কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বেফাক), যার চেয়ারম্যান হচ্ছেন চট্রগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রধান মাওলানা আহমদ শফী। এই বোর্ডের অধীনে প্রায় ৩ হাজার ৩০০ মাদ্রাসা আছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বোর্ডের নিজস্ব প্রকাশনা ‘আল বেফাক পাবলিকেশনের’ বই পড়ানো হয়। এই বই গুলোর সাথে অন্যান্য কওমী মাদ্রাসার পাঠ্যবইয়ে তেমন পার্থক্য নেই। প্রাথমিক স্তরে সাধারণ শিক্ষার মতোই সীমিত পরিসরে বাংলা, ইংরেজী, অঙ্ক, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল ও সমাজ পরিচিতি শিক্ষা দেয়া হয়। তবে বিজ্ঞান শিক্ষা উপেক্ষিত।

কওমী ও খারিজি মাদ্রাসা ব্যবস্থায় কি ধরণের সিলেবাস অনুসরণ করা হয় তা বুঝতে আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে প্রস্তাবিত নীতিমালার দিকে নজর দেয়া যাক। শিক্ষার স্বীকৃত সাধারণ বিষয়াবলীর আংশিক গ্রহনে তাদের কতটা অনীহা তা সেই নীতিকে রুখে দেয়ার মধ্যদিয়েই তারা প্রমান করেছে। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী প্রাথমিক পর্যায়ে (৫ম থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত) তাদের নিজস্ব পাঠ্যক্রমের বাইরে বাংলা, গণিত, ইংরেজী, সমাজবিজ্ঞান, ভূগোল, কম্পিউটার সবমিলিয়ে সরকার স্বীকৃত সিলেবাসের ৪০০ নাম্বারের কথা বলা হয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে (৯ ও ১০ম শ্রেনীতে) তাদের নিজস্ব পাঠ্যক্রমের বাইরে বাংলা ও ব্যাকরণ, ইংরেজী ও গ্রামার, গণিত ও বিজ্ঞানে সবমিলিয়ে সরকার স্বীকৃত সাধারণ সিলেবাসে ৩০০ নাম্বার যুক্ত হতো। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ( একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে) তাদের নিজস্ব পাঠ্যক্রমের বাইরে বাংলা ও ব্যাকরণ, ইংরেজী ও গ্রামার সবমিলিয়ে সরকার স্বীকৃত সাধারণ সিলেবাসের ২০০ নাম্বারের কথা বলা হয়েছে। স্নাতক পর্যায়ে কোন আধুনিক সিলেবাস নেই, তারা পড়বে ইসলামী রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইসলামী সমাজ ইত্যাদি।

এই সব মাদ্রাসায় কাদের বই পড়ানো হয়? কি পড়ানো হয়? ইহোলৌকিক জীবন ও বাস্তবতার সাথে তার সম্পর্ক কি? সেই বিষয়ে কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। সরকার কওমী মাদ্রাসার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের অংশগ্রহনে একটা নীতিমালা করতে যেয়ে তাদের হুমকির কারণে তা স্থগিত করেছে। তাদের প্রধান বক্তব্য সরকার ও প্রসাশনের কোন রকম নিয়ন্ত্রন তারা মানবে না। তারমানে দেশের ভিতরে সম্পুর্ন সরকার নিয়ন্ত্রনমুক্ত একটি গোঁড়া মৌলবাদী প্রশাসন এই শিক্ষা নিয়ন্ত্রন করবে!

জাতীয় স্বার্থের বিষয়গুলোতে নীতিমালা অভিন্ন হবে সেটাই সংবিধনে স্বীকৃত। সেখানে যদি মাদ্রাসা শিক্ষার বিষয় থাকে তা সরকারের সুনিদ্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে হওয়া উচিত। যার থাকবে স্বচ্ছতা, গ্রহনযোগ্যতা ও স্বীকৃতি এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। শিক্ষার মানবিক ও নৈতিক বিষয়টি যেমন গুরুত্বপূর্ণ একই সাথে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়টিও, এগুলোর একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি নয়।

সাধারণ শিক্ষার সাম্প্রদায়িকীকরণ আর মাদ্রাসা শিক্ষার তথাকথিত আধুনিকীকরণের এক জোড়াতালি ও গোজামিল দিয়ে চলছে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা। একুশ শতকের উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন, নাগরিক জীবনে কিছু আধুনিক সুযোগসুবিধা যুক্ত করে কি সেই আকাঙ্খা অর্জন সম্ভব? তা করতে যাওয়ার বিপদ কতটা ভয়াবহ যা আমরা লক্ষ্য করছি বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশে।

গণতন্ত্র ও উন্নয়নের বিরোধী, আধ্যাতিকতা নয় রাজনীতিই মূখ্য
গতবছর হেফাজতে ইসলাম নামে কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন ঢাকায় বিশাল সমাবেশ করলে তা সবার নজরে আসে। এবং নাগরিক জীবনে অনেকটা উদ্বেগ ও আতঙ্কের ভাব লক্ষ্য করা যায়। সরকার ও প্রশাসনকে কয়েকদিন নির্ঘূম রাত কাটাতে হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে দেশের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বাহিনীকে নামাতে হয়েছিল। মধ্যরাতে ব্যাপক অপারেশনের মাধ্যমে তাদের ঢাকা থেকে বিতাড়িত করতে হয়েছে। তারপর ঘটনাপ্রবাহে সরকারের নিয়ন্ত্রন থাকলেও মনে করার কারণ নেই এখানেই এই অধ্যায়ের শেষ। এটা ছিল প্রথম অংকের শেষ দৃশ্য। হেফাজতের ১৩ দফা যদি কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার রাজনৈতিক বক্তব্য ও কর্মসূচী হয় তাহলে যে সব দল উদারনৈতিক গণতন্ত্রের চর্চা করতে চায়, তাদের এখনই ভাবতে হবে, শিক্ষার এই ধারাটা তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ। তা যদি তাদের নীতির সাথে মানানসই না হয় তাহলে, এখনই এ বিষয়ে একটা সিন্ধান্তে আসতে হবে। আর যদি দলগুলো এদেরকে মাঠে রেখে ভোট ও ক্ষমতার খেলা চালিয়ে যায়- সেটা হবে মহাবিপদজনক!

ধর্মভিত্তিক শিক্ষার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিমন্ডল থেকে যে ভবিষ্যত নাগরিকরা বেড়িয়ে আসছে তাদের থেকে আমরা কি অর্জন করতে চাই? মাদ্রাসা শিক্ষা বিশেষ করে কওমী, হাফেজিয়া ধারার শিক্ষার্থীরা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সহায়ক কোন দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে এরা গড়ে ওঠে না। তাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য ইহোলৌকিক নয় পারলৌকিক। সঙ্গতই এই বিশাল শ্রমশক্তি একটি উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজের সহায়ক না হয়ে হচ্ছে এর অন্তরায়। সরকার জানছে না তারা কি শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। কেবল ধর্মীর স্পর্শকাতরতার অজুহাতে তারা থাকবে অন্ধকারে ও জবাবদিহিতার বাইরে‍! তাকে মেনে নেয়ার কারণ তো কেবল ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনীতির সমীকরণ! একবার কি ভেবে দেখেছি এর মাধ্যমে দেশকে এক ধরণের নিশ্চিত গৃহবিবাদের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে? যে ভয়াবহ বিপদের আলামত আজ স্পষ্ট!

বাংলাদেশে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় নিচ থেকে উপর পর্যন্ত তিনটি প্রধান ধারা এবং প্রাথমিক পর্যায়ে নয়টি উপধারা বিদ্যমান। মাদ্রাসাশিক্ষার কয়েকটি ধারার একটি বাদে অন্যগুলো সরকার নিয়ন্ত্রনের বাইরে যেমন, কওমী, ফোরকানিয়া, হাফেজিয়া প্রধানত। তারা তাদের বিষয় গুলো বাইরে জানাতে আগ্রহী না এবং তাদের কোন তথ্য-উপাত্ত বাইরের কাউকে সরবরাহ করে না। প্রশ্ন হচ্ছে কেন এই গোপনীয়তা? কেন একটি স্বাধীন দেশের নির্বাচিত সরকার থাকার পরও তারা দ্বায়বদ্ধতার উর্দ্ধে থাকবে?
বিষয়টি কি অবজ্ঞা করার মত কোন বিষয়? ক্ষমতাসীন দল সমাজের যে জনগোষ্ঠীর কাছে নিজের গ্রহনযোগ্যতা প্রমানে তৎপর তারা কি কখনো কোনভাবে এই সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল বা হবে? তাহলে তাদেরকে আস্থায় নেয়ার বিবেচনাটা কেন? সাময়িক জনপ্রিয়তা কারণে এদের শরীরে যে পুষ্টির যোগান দেয়া হচ্ছে তা ভবিষ্যত রাজনীতি ও প্রজন্মের জন্য কতবড় চ্যালেঞ্জ ও বিপদ একবার ভেবে দেখেছেন! ক্ষমতার কুৎসিত খেলার বলি হতে যাচ্ছে একটি সম্ভবনাময় আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশের স্বপ্ন।

মাদ্রাসা শিক্ষার পক্ষে যে যুক্তি দেয়া হচ্ছে মুসলমানদের আধ্যাত্বিক, মানবিক মূল্যবোধ ও গুণাবলির বিকাশ ঘটানো তাহলে এই শিক্ষার বাইরে যারা আছে তারা কি তাদের সেই বিষয়ের বিকাশ ঘটছে না? পৃথিবীর যে সব দেশকে আমরা সভ্য, উন্নত, মানবিক, সুশৃংখল বলি তাদের এই অর্জন কি ধর্মভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে হয়েছে? এই বিষয়ের যথার্থ উপলব্ধি না করাটাই ধর্মীয় গোঁড়ামি ও রক্ষনশীলতা। সমাজ রক্ষনলীলদের ভাষায় যদি চলতো তাহলে সভ্যতা এখানে আসতে পারতো না। শিক্ষার উদ্দেশ্য গোপন কোন বিষয় নয়। কিন্তু তাদের লক্ষ্য ও এজেন্ডা আরও দূরে। যা আজ আর কারো অজানা নয়। তারাও সেটা প্রকাশ্যে বলছে। মাদ্রাসার ছাত্রদের মধ্যে (যাদের ৮৫% দরিদ্র এবং গ্রাম বাস করে) সভ্যতা, আধুনিকতা, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে ইসলামি রাষ্ট্র-সমাজ প্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের দূরভিসন্ধি আজ আর তাদের গোপন কোন বিষয় নয়।

সাংস্কৃতিক সংঘাত, জাতীয় ঐক্য ও সংহতির অন্তরায়
বাংলাদেশের কয়েকটি প্রধান দিবস-উৎসব-উদযাপনের দিকে নজর দিয়েই দেখা যায় অবস্থাটা কেমন পরস্পর বিরোধী ও সাংঘর্ষিক। একটি স্বীকৃত রীতি-নীতির বিপরীত সমাজের একটি অংশ যে শিক্ষা লাভ করছে তা কোনভাবেই জাতীয় ঐক্য ও সংহতির জন্য সহায়ক না। তারমানে একটি উপযুক্ত নীতির অভাবে সমাজ বিভক্ত হয়ে পরছে। তৈরী হচ্ছে উদার গণতান্ত্রিক সমাজের একটি প্রতিপক্ষ। যারা এগিয়ে যাবার পথকে বাধাগ্রস্থ করছে। তাহলে প্রশ্ন রাষ্ট্র কেন এমন একটি আত্মঘাতি কাজ করছে? বাংলাদেশ রাষ্ট্র জন্মের মধ্যেদিয়ে সমাজ-রাজনীতির যে বিষয়টি মিমাংশিত হবার কথা ছিল। তা আজ শাসকদের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির সংকীর্ণ সমীকরণের প্রতিযোগিতায় হৃষ্টপুষ্ট।

মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা যেমন, বাঙালী জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র সংবিধানের খন্ডিত রুপও তারা স্বীকার করে না। বিজয়, স্বাধীনতা, শহীদ দিবসে দল বেঁধে ফুল দেয়া, প্রভাতফেরী, কুচকাওয়াজ ও মাঠে যাওয়া, জাতীয় সংগীত গাওয়াসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চেতনামুলক কর্মসূচী-আয়োজনকে তারা ইসলাম বিরোধী মনে করে। বাংলদেশের ইতিহাস সম্পর্কে তাদের ধারণা একমুখী, অনেকটা এই অঞ্চলে ইসলাম বিকাশের সাথে সম্পর্কিত। ভাষা ও স্বাধীনতা সম্পর্কে তাদের ধারণা খন্ডিত। নববর্ষ, নবান্ন, চৈত্রসংক্রান্তি, মেলাসহ ইত্যাদি উৎসব-আয়োজন তাদের কাছে অনৈসলামিক ও হিন্দুয়ানী বিষয়। দেশাত্ববোধক গান, রবীন্দ্রসংঙ্গীত, নজরুলগীতি, পল্লিগীতি, আধুনিক, ভাটিয়ালী, গণসংঙ্গীত, নাটক, নৃত্য, আবৃতি, চলচ্চিত্র, পালাগান, যাত্রা, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, আব্বাস আলী ইত্যাদি অপসংস্কৃতি। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মু্ক্তবুদ্ধির চর্চাকে মনে করে নাস্তিকতা। ভাষা-স্বাধীনতা-গণতন্ত্র প্রভৃতির স্মরণে ভাষ্কর্য ও বেদিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেয়া শিরক। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতা ও নান্দনিকতা বর্ধনের যে কোন শিল্পকর্ম ও ভাষ্কর্যের এরা ঘোর বিরোধী। এগুলো তাদের কাছে মূর্তি পুজার সামিল!

বিভিন্ন ধারার শিক্ষার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, দর্শণ, দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাস ভিন্নভিন্ন হওয়ার কারণে রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানে তার বিরোধ, সমন্বয়হীনতা, সাংঘর্ষিক প্রভাব ও পরিণতি স্পষ্ট। এরা সহশিক্ষা, নারী-পুরুষের স্বাধীন চলা-ফেরা, নারী উন্নয়ন ও নীতির বিরোধী। ৭০ হাজার মাদ্রাসার আংশিক প্রভাব যদি ৭০ হাজার গ্রামে তৈরী হয় সেখানে এই ধর্মান্ধরা ফতোয়া দেবে, শরীয়া আইনের পক্ষে কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। যার ছিটেফোটা আমরা সংবাদ মাধ্যমে জানতে পারি। রাজনৈতিক দলের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে জনগনের চেতনার মান বিকশিত করা, তাদের আধুনিক, উন্নত ও সমৃদ্ধ জীবনের স্বপ্ন দেখানো। একটি রাজনৈতিক দল কি ধরণের সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় তা তাদের আদর্শ ও কর্মসূচীর মধ্যে দিয়ে বেড়িয়ে আসে। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের কর্মসূচী ও দৃষ্টিভঙ্গি কি এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ?

রাষ্ট্র হচ্ছে একটি ইহোলৌকিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান তার চরিত্র হবে সার্বজনীন এবং ধর্মের প্রশ্নে তার অবস্থান হবে নিরপেক্ষ। কিন্তু সেই নীতির লংঘন করে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় হাজার বছরের বাঙ্গালী সংস্কৃতির বিপরীতে গড়ে উঠেছে ধর্মভিত্তিক শিক্ষার ধারা। নিজ ধর্মের চর্চা আর একটি জাতির ভাষাভিত্তিক সংস্কৃতির সাম্প্রদায়িকীকরণ এক কথা নয়। ঢাকায় যখন হেফাজতের সমাবেশ চলছিল তখন অনেক মেয়েকে মাথায় ঘোমটা দিতে দেখা গেছে বলে পত্রিকায় ও সামাজিক মাধ্যমে এসেছে। বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ, রাজনীতি সম্পর্কে উদাসীন একশ্রেণীর মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের পাশ্চাত্য ধাঁচের জীবন-যাপনে অভ্যস্ত, তারাও বুঝতে পারছে না তাদের সেই স্বাধীন ও উন্মুক্ত জীবনের সেই সুযোগ-অধিকার কিভাবে ঘিরে ধরছে এই ধর্মান্ধরা।

শিক্ষা ব্যবস্থার দুটো মৌলিক প্রশ্নের কোন সমাধানে আজো করা সম্ভব হয়নি। ১. অভিন্ন ধারার শিক্ষাপদ্ধতি চালু হবে কি না? ২. ধর্মীয় শিক্ষা যদি রাখতেই হয় সেখানে কি শিক্ষা দেয়া হবে, এবং তার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি কিভাবে গড়ে তোলা হবে? মূলত, সাম্প্রদায়িক শিক্ষার বিকাশ দেশের যতটুকু অর্জন তাকেও বিপদগ্রস্থ করছে নানাভাবে। বিভিন্ন ধারার শিক্ষা বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্য ও সংহতির পথে বড় বাধা ও উন্নয়নের অন্তরায়। একটি দেশের রাষ্ট্রীয় চরিত্রের পরিচয়টিও ফুটে উঠবে তার শিক্ষাব্যবস্থার উপর। ইসলামি রাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এক বিষয় নয়। উভয়ের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য বিপরীত।

এখানে ফিগারের মাধ্যমে বর্তমানে (বেনবেইস: ২০১২) প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে অধ্যায়নরত বিভিন্ন ধারার বিশেষত বাংলা, ধর্মীয় ও ইংরেজী মাধ্যমের (ইংরেজীর সাথে ও কিন্ডার গার্ডেন যুক্তকরে এই ধারার অবস্থাটা দেখার চেষ্টা করেছি, প্রকৃত তথ্য পেলে এই চিত্রের পরিবর্তন ঘটবে) শিক্ষার্থীর সংখ্যা ও ব্যবস্থাপনা উল্লেখ করা হয়েছে।


উপসংহার
একটি দেশের উন্নয়নের জন্য সেই জনগোষ্ঠির দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন জরুরী। তা সৃষ্টি হয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, রাষ্ট্র ও সমাজের নানা মাত্রিক কর্মকান্ডের মধ্যদিয়ে। সমাজ পরিবর্তন ও উন্নয়নের ইতিহাসে ধর্মীয় ও সামাজিক রক্ষনশীলতা সবসময় বাধার কারণ ছিল। তাকে মোকাবেলা করেই সমাজ এগিয়েছে। উদ্দেশ্য মহত হলে সাময়িক সেই ক্ষতকে অতিক্রম করা যায়। কোন রাজনৈতিক দল ও সমাজের অংশ যদি এর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে অক্ষম হয় তাহলে তাদের পিছনে ফেলেই এগিয়ে যেতে হবে।
দেশের সমস্যা অনেক তার তাৎক্ষনিক সমাধানের বাস্তবতা নেই। কিন্তু প্রথম বিষয় সেই সমস্যার প্রশ্নে নিজেদের নীতিগত অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার করা। শিক্ষার সাথে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়নের সম্পর্ক কতটা জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ এই উপলব্ধি নিয়ে আসা। এর বিভিন্নতা আমাদের উন্নয়ন ও সংহতির সম্ভবনাকে কিভাবে ক্ষতিগ্রস্থ ও বিপদগ্রস্থ করছে সেটিও। কিছু মানুষ অর্থনৈতিক ভাবে স্বচ্ছল যে ইসলামি দেশগুলোর উদাহরণ দেন তাদের সেই তথ্য, তত্ত্ব ও জ্ঞান পরিষ্কার করা তাদের উন্নয়নের প্রধান কারণ মানবিক পুজিঁ নয়, প্রাকৃতিক পুঁজি যা বাংলাদেশের খুবই সীমিত। সুতরাং আমাদের একমাত্র নির্ভরশীলতা হচ্ছে মানবিক পুজির উপর এবং তা গড়ে ওঠে উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে। সীমিত সামর্থের পরিকল্পিত ও সমন্বিত বিনিয়োগের কোন বিকল্প নেই। শিক্ষায় পরিকল্পিত বিনিয়োগ ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বিষয়টি বিশ্বব্যাপী জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে স্বীকৃত ও প্রমানিত। বাংলাদেশে শিক্ষায় বিনিয়োগের উপর বড় ধরণের কাজ হয়নি আর যা হয়েছে তার ফলাফল হতাশাজনক। সাধারণ শিক্ষার রেট অব রিটার্ণ নিয়ে কিছু কাজ হলেও মাদ্রাসা শিক্ষার রেট অব রিটার্ণ নিয়ে কোন কাজ হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আর যেহেতু এই বিষয়ের তথ্য-উপাত্ত সহজলভ্য না তার পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষনও কঠিন।
গোঁজামিল দেয়ার ফলাফল আপাত স্বস্তির হলেও ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা করছে ভয়াবহ বিপদ। দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী ভাবনা ও বিশ্বাস ভিন্ন। বাংলাদেশের গর্ভে সন্তর্পনে বেড়ে ওঠা এই ঘুমন্ত ভা্ল্লুকটি নাগরিকদের নজরে আসে গতবছর হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের মধ্যেদিয়ে। এবং তাদের আকাঙ্খা ও উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয় ১৩ দফা দাবী উত্থাপনের মাধ্যমে। সরকারের শক্তি প্রয়োগ ও কৌশল আপাত স্বস্তির হলেও তাদের জাল বোনার কাজ থেমে নেই। বক্তৃতার মঞ্চে তাদের তালিমদাতাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনার স্পষ্ট ইঙ্গিত। সুবিধা বঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এই কিশোর-তরুণরা আজ ধর্মীয় নেতাদের স্বার্থের স্বীকার। খারিজি মাদ্রাসার বিকাশ যেন বারুদের মজুদ বৃদ্ধি! এই সমস্যা সমাধানের রোডম্যাপ কোথায়? এ বিষয়ে সংবিধানের সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও প্রাধান্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। ৭ অনুচ্ছেদের ২এ উল্লেখ আছে, “জনগনের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্যকোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে” অথাৎ এটা পরিষ্কার যে সংবিধানে উল্লেখিত ব্যবস্থার বাইরে যে কোন কার্যক্রম বা বিষয় বাতিলযোগ্য। সংবিধান সমুন্নত রাখার এখতিয়ার সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের এবং সে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বিষয়/আইন বাতিল করতে পারে যদি তা সংবিধানে উল্লেখিত মৌলিক অধিকারের পরিপহ্নী না হয়। সরকারকেই এর দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্র ও সমাজের প্রয়োজনে জাতির উত্তর প্রজন্মকে তৈরী করতে।

মঞ্জুরে খোদা টরিক, লেখক, গবেষক, ইনস্টিটিউট অব পলিসি সাইন্স, AGU, জাপান।

দোহাই
এম এম আকাশ, মাদ্রাসা শিক্ষার রাজনৈতিক অর্থনীতি, ২৬ মে ২০১৩ ঢাকানিউজ২৪
আবু সাঈদ খান, কওমী মাদ্রাসা প্রাথমিক পাঠক্রম, ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির সঙ্গে কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ, দৈনিক সমকাল, ১৩ মার্চ ২০১৪
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান ইন্টারনেট সংস্করণ
মইনুল ইসলাম, শিক্ষায় বৈষম্য ও রাজনীতির তালেবানীকরণ, ৩০ জানুয়ারী, ২০১৪, প্রথম আলো
মুজিব মেহেদি (২০১১), মাদ্রাসা শিক্ষা: একটি পর্যবেক্ষণ সমীক্ষা, নারী প্রগতি সংঘ, ঢাকা।
Bangladesh Bureau of Educational Information & Statistics (BANBEIS) http://www.banbeis.gov.bd/webnew/
Abul Barkat, Rowshan Ara, et. al. (2011), Political economy of Madrassa Education in Bangladesh: genesis, growth and impact, HDRC, Nijera kori and ALRD, Rahman Pulishers, Dhaka.
Dr. Monjure Khoda, (2011). The Role of Education in the Socio-Economic Development of Bangladesh: Problem and Prospects (PhD thesis, unpublished), Graduate School of Policy Studies, Aichi Gakuin University, Japan.

সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মে, ২০১৪ সকাল ৮:৩১
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×