কর্মসুত্রে আমি প্রায় বছর দুই চট্রগ্রামে ছিলাম। ঢাকার পরেই আমি চট্রগ্রামকে ভাল করে চিনি, চট্রগ্রামে আমি আমার জীবনে প্রথম চাকুরী শুরু করি এবং বলতে গেলে সেখান থেকে বিদেশ চলে যাই। এছাড়া আমাদের বেশ কিছু আত্বীয় স্বজন খালি হাতে চট্রগ্রাম গিয়ে বেশ টাকা কড়ির মালিক হয়ে যাওয়াতে আমাদের কাছে চট্রগ্রাম বেশ ভুল পরিচিত নাম! ঢাকার পরে কোথায়ও গিয়ে থাকার কথা ভাবতেই চট্রগ্রামের কথা মনে পড়ে! হা হা হা।। আমি জীবনে ঢাকার বাসা থেকে পালিয়ে চট্রগ্রামেই গিয়েছিলাম। সে অনেক অনেক আগের কথা, এখন পুরাই গল্প মনে হয়!
যাই হোক, চট্রগ্রামে চাকুরী সুত্রে আমি কম্পিউটারের ছাত্র পড়াতাম। একজন কম্পিউটার প্রশিক্ষক হিসাবে জীবনের প্রথম চাকুরীর স্মৃতি কি সহজে ভুলা যায়! তখন দেখতাম চট্রগ্রামের ধনীরা তাদের বাড়ীতে বছরে একটা বিশেষ দিনে, বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করত। আমার ধনী ছাত্র/ছাত্রীরা এই রকম বেশ কিছু দাওয়াতে আমাকে ডেকেছিল এবং আমি যোগ দিয়েছিলাম। সে অনেক আগের কথা হলেও এখনো মনে পড়ে। আমাদের এলাকায়ও তথা আমাদের দাদাকেও দেখেছি বছরে এমন একটা খাবারের আয়োজন করতে। দাদার মৃত্যুর পর চাচারা মাঝে মাঝে আয়োজন করলেও এখন আর করা হয় না! আমাদের জেনারেশন তো এই সব থেকে সরেই এসেছে! আমাদের এলাকায় এই সারাদিনের খাবারকে বলা হয়, জেয়াফত। ঠিক এমন খাবারের দিন এবং খাবারকে চট্রগ্রামে বলা হয়, মেজবানী!
জেয়াফতে অনেক গরু কাটা হত, রান্না হত একের পর এক, খাবার চলত সারা দিন! ছোট বেলার স্মৃতি বলে এখন অনেক কিছুই মনে করতে পারি না। তবে এটা স্পষ্ট মনে আছে জেয়াফতে থাকত – সাদা ভাত, গরুর মাংস (কেমন রান্না ছিল সেটা এখন মনে পড়ে না), লাউ বা কুমড়া বা আলু মাছ দিয়ে একটা মিশ্র তরকারী এবং মাছের মাথা ভেঙ্গে গাঢ় কলাই ডাল এবং শেষে থাকত দই। মোটামুটি চট্রগ্রামের মেজবানীতেও এমন রান্না দেখেছি। তবে সবাইকে তখন বলতে শুনেছি, চট্রগ্রামের মেজবানীতে নাকি গরুর মাংস একটা বিশেষ কায়দায় (নানান মশলায়) রান্না হয়, ফলে এই মেজবানীর গরুর গোশতের রান্নায় একটা আলাদা স্বাদ থাকে, আমি খেলেও স্বাদ মনে নেই। চট্রগ্রাম ছেড়ে চলে আসার পর আর এই মেজবানীর দেখা পাই নাই। তবে শুনেছি ঢাকাস্থ চট্রগ্রাম সমিতি বছরে এখনো ঢাকায় এমন মেজবানী করে থাকেন। আমার চট্রগ্রামের অনেক বন্ধু ঢাকায় আছে, যাদের বলে রেখেছি, এমন খাবারের কথা সুনলেই যেন আমাকে খবর দেয়! আমি যাব, খাব!
এদিকে রান্নাবান্নায় বিশেষ পারদর্শী হয়ে উঠে(!) এখন আমি বিভিন্ন জায়গায়/দোকানে গেলেই রান্নার আইটেম খুঁজে ফিরি! নেটে রেসিপি লিখে লিখে এখন রান্নার কোন নুতন কিছু পেলেই সাথে সাথে দেখে/কিনে ফেলি। রান্নার মশলাপাতি কিনে কিনে জমানো (মাঝে মাঝে ব্যবহার করা) এখন একটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে! প্রতিদিন নুতন কিছু রান্না করতেই চাই। অফিসের টেনশন, বউ-ছেলেদের চাপ, টাকা কড়ির টানাটানি কিছুতেই আমি আর থামি না! রান্না নিয়ে কে কি বলল, আমার তাতে কিছু যায় আসে না! আমি আমার পথেই চলছি। রান্না করে আমি আমার বুলেটের মুখের সামনে ধরে জিজ্ঞেস করি, কেমন হল বাপ! সে হেসে যখন বলে, ‘ভাল’ তখন মনে শান্তি পাই। আর সেই রেসিপি আপনাদের সামনে তুলে দেই।
রান্না নিয়ে আমি নানান প্রতিকুলতা পার করেছি। আমার ব্যাটারী প্রথম প্রথম আমার এই পাগলামি দেখে কিছু বললেও এখন আর কিছুই বলেন না, সমস্যায় সমাধান দেন, হেল্প করেন তবে এখনো মাঝে মাঝে মেজাজ দেখিয়ে ফেলেন! তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরা, রান্নাঘরে টুকটাক কিছু করতে থাকলে এখন তিনি খুশিই হল বলে মনে হন! এদিকে এখন পেঁয়াজ কাটা থেকে মুরগী কাটা, ছবি তোলা সব কিছুতেই আমি নিজ হাতে করতে চাই। কারন আমার রান্নার দ্বায়িত্ব/স্বাদ আমি নিজেই নিতে চাই! প্রতিটা রেসিপি যেহেতু দুনিয়ার কোনা কোনা থেকে দেখা হয় তাই আমি নিজেও সতর্ক থাকতে চাই। আমাদের রান্না/রেসিপির ফ্লোয়ার, পাঠক/পাঠিকা ভাই বোন বন্ধু যেন আমাদের রেসিপি দেখে রান্না করে স্বাদ পান সেটা আমার সব সময়ের বিবেচ্য বিষয়। কত রান্না স্বাদ হয়নি বলে রেসিপি ফেলে দিয়েছি!
যাই হোক, আজ সেই চট্রগ্রামের বিখ্যাত মেজবানীর গরুর গোসত রান্না আপনাদের দেখিয়ে দেব। তবে তা সর্টকাট, আই মিন রেডিমেট মিক্স মশলায়, যা গ্রোসারীতে পাওয়া যায়! আমি নিজেও আগে এই ধরনের সর্টকাট মিক্স মশলায় রান্না করতে চাইতাম না, এখন দেখি খারাপ নয়। বুদ্দি খাটিয়ে মাল মশলা আগুন পানি ঠিক মত দিতে পারলে, নট ব্যাড! কারো বাবার বুঝার উপায় নাই যে আপনি রেডিমেট মশলায় রান্না করেছেন! মেহমানতো আর আপনার রান্নাঘরে গিয়ে বসে থাকবে না! হা হা হা………। চলুন দেখে ফেলি!
(বাংলাদেশের বেশ কিছু মশলা কোম্পানী এমন প্যাকেটে মশলা বিক্রি করে থাকে)
উপকরনঃ
- এক কেজি গরুর গোসত (হাড় সহ)
- মেজবানী গরুর মাংসের মশলা (দুই কেজির জন্য যে প্যাক পাওয়া যায় তার অর্ধেক)
- তিনটে মাঝারি পেঁয়াজ কুঁচি
- কয়েকটা কাঁচা মরিচ
- লবন (শুরুতে কম দিয়েই শুরু ভাল)
- তেল, হাফ কাপ (গোস্তে চর্বি বেশি থাকলে তেল কম হলেও চলে)
প্রনালীঃ
কড়াইতে তেল গরম করে লবন যোগে পেঁয়াজ এবং কাঁচা মরিচ ভাঁজুন।
পেঁয়াজ নরম হয়ে গেলে এবার প্যাকেট থেকে মেজবানী মশলা একটা কাপে নিয়ে পানি দিয়ে গুলে প্রস্তুত করে নিন এবং ভাঁজা নরম পেঁয়াজে ঢেলে দিন।
ভাল করে ভাঁজুন, তেল উপরে উঠে যাবে এবং মশলায় একটা চমৎকার ঘ্রান বের হবে। তাড়াহুড়া করবেন না, এখনে ধৈর্য ধরে রাখুন। কাঁচা মশলার ঘ্রান চলে যেতে দিন।
এবার গরুর গোসত দিয়ে দিন।
ভাল করে মিশিয়ে নিন।
ঢাকনা দিয়ে মাধ্যম আঁচে মিনিট ৩০ রাখুন। মাঝে মাঝে নাড়িয়ে দিন। গোসত থেকে পানি বের হয়ে কষিয়ে রান্না হতে থাকবে।
গরুর গোসত শক্ত বলে হয়ত গোসত থেকে বের হওয়া পানিতে গোসত নরম হবে না ফলে আপনি আরো এক কাপ গরম পানি দিতে পারেন বা তারও বেশি, এটা নির্ভর করবে গোসত কেমন নরম হল তার উপর।
গোসত নরম হয়ে এলে ঢাকনা সরিয়ে দিন এবং ঝোল কমাতে চাইলে আগুন বাড়িয়ে দিন। এই পর্যায়ে ফাইন্যাল লবন দেখুন, লাগলে দিন, না লাগলে ওকে বলুন।
গা গা ঝোল/ মাখা মাখা হলে চুলা থামিয়ে দিন।
পরিবেশনের জন্য প্রস্তুত। মোজবানী গরুর মাংস রান্না।
অদ্ভুত, অসাধারণ স্বাদ। ঝাল নেই এবং এই স্বাদ আপনাকে বুঝানো সম্ভব না, আপনি খেলেই বুঝবেন, কেন এটা সারাদেশে মেজবানী রেসিপি হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে! বুলেট এবং ব্যাটারী খেয়ে আমার তারিফ করেছেন। যদি তারা আমার হাতে মেজবানীর মিক্স মশলা না দেখতো তবে হয়ত আরো প্রশংসা করত! হা হা হা…
ব্যচেলর, প্রবাসী ভাই বোন বন্ধুরা, দেখুন রান্না কত সহজ এবং সাধারন!
সবাইকে শুভেচ্ছা।
(বন্ধুরা আরো আরো রেসিপি দেখতে চাইলে আমার ব্যক্তিগত ব্লগে আসুন। প্রায় ৬০০ রেসিপির সমাহার, আপনি খুঁজে আপনার মনের মত করে রান্না করুন। দেখুন রান্না কত সহজ ও সাধারন। রান্নার হচ্ছে ভালবাসা! গল্প ও রান্না! )