রেস্টুরেন্টটা বিশাল। অনেক মানুষের আনাগোনা। পুরুষ নারী, মেয়ে ছেলে, ধান্দাবাজ, চান্দাবাজ, রংবাজ, প্রেমিক, শ্রমিক, প্লেবয় ভালো পুলা, কলগার্ল কিউটমেয়ে- অনেক মানুষ আসে।
গমগম শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে সায়হামের। তার পাশে দুই তিন জন মাঝবয়সী বসে আছে। এতো চীৎকার করে কথা বলার কি আছে বুঝতে পারছে না ও। মনে হচ্ছে শালাগুলার কানে থাপড়া লাগায় একটা। শালা চুদির ভাই!
একটা চায়ের অর্ডার দিয়েছে সেই আদিম কালে। বান্দর মানুষ হয়ে গেল, শেখ হাসিনা দুইবার নির্বাচিত হোল, অভিজিত রায়কে হত্যা করা হোল, কমিউনিস্ট হেফাজত হোল, বাংলাদেশ আবার পাকিস্তান হোল কিন্তু চা দেয়ার নাম গন্ধ নেই। মন চায় চাপর মারে একটা টেবিলে। কিন্তু সাহস পেল না। একে তো পকেটে মাত্র আছে ২০ টাকা, তাতে আবার ১০ টাকা চায়ের বিল দিতে হবে। তার মানে আর থাকে মাত্র ১০ টাকা। এতো কম টাকা দিয়ে ডাঁট দেখানো যায় না- যায় না কেন যায় কিন্তু সায়হাম ভরসা পেল না।
অবশেষে চা আসল। দারুন কাচের কাপে চা। গায়ে কালো পাতার নক্সা করা। আঁকাবাঁকা নদীর মতো পাতাটার দিকে চোখ গেলেই মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু চুমুক দিতেই মন ক্যাচকে গেল। এতো চিনি মানুষ খায়। একে ওর জিনে ডায়াবেটিস আছে- বাপ দাদা সবার নিয়ম করে ওষুধ নিতে হয়- তায় এই চা। কুত্তাগুলার পাচায় বাঁশ ঢুকিয়ে দেয়া উচিত। কিন্তু নিতান্ত বাঁশের দাম বেশি আর সহজে পাওয়া যায় না বলে সায়হাম ওদের বাঁশ দিতে পারল না। একবার মনে হোল না খেয়ে উঠে যায়। কিন্তু ১০ টাকার চা তো আর জলে ভাসিয়ে দেয়া যায় না, এতে শুধু জলটাই দুষিত হবে। কামের কাম কিছু হবে না। তাই বাধ্য হয়েই সায়হামকে চাটুকু গলধকরণ করতে হোল।
অবশ্য ও জানেনা চা গলধকরন করা যায় কিনা। চা তো টেক করতে হয়। একবার “আমি চা পান করি”র ইংরেজি অনুবাদ স্যার ধরেছিল। ও বলেছিল, “I drink tea” ওর এই কথায় স্যার খেপে গেলেন। টানা ৪৫ মিনিট কান ধরিয়ে রাখলেন স্যার। শালা খাটাশ। ও বুঝতেই পারলনা কেন এই শাস্তি। পানের ইংরেজি তো ড্রিংক- এটাই ও আজীবন জেনে এসেছে। ওর বাপ জানে, দাদা জানে। আচমকাই পাল্টে গেলো শব্দটা! শব্দও কি দিনদিন সানি লিয়ন হয়ে যাচ্ছে নাকি!
ক্লাস শেষ এক আঁতেল দোস্তকে জিজ্ঞেস করল সায়হাম, “পাটি, আমার কি ভুল হইছে রে?”
-“আরে গর্দভ, ওটার ইংরেজি হবে, আই টেক টি”
পান করার ইংরেজি কি করে টেক হয়ে গেল সায়হাম এই চিন্তায় সে দিনটা গোটাল কাটিয়ে দিল। শালার বহু ক্যাচাল।
তো সায়হাম বাধ্য হয়েই চা টেক করল। এখন কি করা যায় সেটা ভাবা যাক। বাইরে প্রচণ্ড রোদ- বসন্তের। এই রোদে “বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আসে না”, শুধু চামড়াই কালো হয়। সায়হামের অবশ্য কালো হওয়ার কোন ভয় নেই। এমনিতেই ওকে দেখলে বারাক ওবামার ছোটভাই মনে হয়। রোদ আর ওর কি করতে পারে? তবে কিনা ও এক বন্ধুর কথা শুনে কয়েকদিন থেকে ফেয়ার এন্ড লাভলি মাখা শুরু করেছে। এতে ওর হেমিল্টন মাসাকাদজা মুখ কতটুকু লাভলি হয়েছে সেটা বোঝা না গেলেও, রোদে গেল যে সেটা পানি হয়ে যাবে এটা ও খুব বুঝতে পারে।
আর বাইরে গেলেই তো আর ও স্বর্গে পৌঁছে যাবে না। তার চেয়ে এই ভালো, কতো ললিপপ ললিপপ কিউট কিউট মেয়ে আছে ওদের বিএফের আর বাপ মায়ের সাথে। ওকে অবশ্য এক ঝাক কোকিলের মাঝে কাউয়া মনে হচ্ছে। দুই একজন ওর দিকে তাকিয়েছেও। দৃষ্টিতে “ছি ছি” ভাব থাকলেও তাতেই ফিদা হয়ে গেছে ও। চুলের স্পাইকে দুইতিনবার হাতও বুলিয়ে নিয়েছে সায়হাম।
একটু ভাব নেয়া যাক। যদিও ভাব নেয়ার উপায় ওর কাছে নেই। তবে এটা বাঁচোয়া যে ভাবিস্ট হতে বেশি কিছু চাই না। একটু কবি কবি কিংবা ব্যস্ত ব্যস্ত ভাব দেখালেই চলে। আরও বেশি ভাব নেয়া যায়- মোবাইলে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকলে। জাহান্নামে যাক দুনিয়া, আপনার পাশে বসে থাক ক্যাটরিনা- আপনি তাকাবেন না, এমনভাবে মোবাইলের স্কিনের দিকে তাকাবেন যে, যেন আপনি বিল গেটসের সাথে চ্যাটিং করছেন! তাতেই কাজ হয়ে যাবে। আপনি ভজারাম থাকে ভাবিস্ট উপাধি পেয়ে যাবেন। আরও যদি খোঁচা খোঁচা দাড়ি থাকে তাহলে তো সোনায় সোহাগা। ভাবে আপনি নোবেল কিংবা অস্কার পেয়ে যেতে পারেন।
সায়হাম মোবাইল থিয়োরিই চালাল। পকেট থেকে সেই আদিম সিম্ফনি এস ১০৩ বের করে ফেবুতে লগইন করল। আসল জীবনে ও যাই হোক না কেন। ফেলিস্ট কি রেপিস্ট, ফেসবুকে ও সেলিব্রেটি। জাস্ট নাউয়ে লাইকের সংখ্যা ৫০ আপ হয়ে যায়। এরজন্য অবশ্য কম ক্যালমা করতে হয় না ওকে। মাঝে মাঝেই “মামু লাইক পাইনা তো” টাইপের স্ট্যাটাস দিতে হয়। অনেক আঁতেল ফ্রেন্ড আবার ওকে মাঝে মাঝে লাইক ভিকারি বলে আনফ্রেন্ডও করে দিয়েছে। কিন্তু সায়হাম জানে যুদ্ধে আর লাইকে কোন ফেয়ার নেই, সবাই তাতেন্দা তাইবু।
একটা স্ট্যাটাস দেয়া যাক, “মামারা, হোটেল হুলুদ বাংলায় বসে চাইনিজ খাচ্ছি, তোমরা আমন্ত্রিত”! সাথে সাথে লাইকের বন্যা আর কমেন্টের সুনামি বয়ে যেতে লাগল।
-কস্কি মামা
-আরে আবালের ব্যাটা এত্তগুলা টাকা কৈ পাইলি। খাপ মারছিচ নাকি
-আমারে দাক্লি না ক্যানরে আবুল। বিলটা শেয়ার করতাম না হয়
- বস, চাইনিজ কি হাত দিয়া খাইছিস নাকি, তুই তো আবার বাহাতি
-পঙ্খা সায়হাম এখন চাইনিজে
-শালা ভাব দেখার আর জায়গা পাইস না
-ভাই, কেমন লাগছে
-যাচ্ছি কিন্তু
-আরে আমিও তো হোটেল হলুদ বাংলায়, কোথায় তুমি?
শেষ কমেন্টটা দেখে হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠল সায়হামের। যে কমেন্ট করেছে তার নাম- অবশ্যই ফেবু নাম- নীল মানবী। প্রপিকে অ্যাভাটর মুভির একটা মেয়ের নীল ছবি দেয়া আছে। যা শালা কি টাস্কিটাই না খেলাম!
একে তো প্রপিক দেয়া নাই, তায় এতগুলা মেয়ে আছে হোটেলে যে গেজও করতে পারছে না।
আরে এতো চিন্তার কি আছে, মেন্সন করে রিপ্লে দিল ও-“আরে আমি তো এই মাত্র বেড়িয়ে এলাম। তোমাকে দেখলাম না তো। অবশ্য তোমাকে চিনব আবার কি করে বল? ছবিতে তো আর বোঝার উপায় নেই”
কিন্তু কমেন্ট করার পরই বুঝতে পারল কি ভুলটাই না সে করেছে!
দেখল একটা মেয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। ওহ কি সুন্দর! পুরাই আলিয়া ভাট। সায়হামের লাফিয়ে ওঠা উচিত কিন্তু ওর ঘাম হতে লাগল। প্রচণ্ড ঘাম।
একে তো এই হোটেলে চাইনিজ পাওয়া যায় না, তার উপর বেড়িয়ে যাওয়ার কথা বলেছে!- ফাক ফেসবুক। কোন দুঃখে যে ভাব দেখাতে গিয়ে মিথ্যা স্ট্যাটাসটা দিল!
-এই তুমি রকিং বয় সায়হাম না
- হ্যাঁ, আমি
-দেখে অবশ্য ফাকিং মনে হচ্ছে
-কি?
-কিছু না। তুমি যে বললে বের হয়ে গেছ
-ও না, এমনিই বললাম। তোমাকে চিনতে পারিনি তো, তাই
-তো চাইনিজ খাওয়া হচ্ছে?
সায়হাম একেবারে মাটির সাথে মিশে গেল। নীল মানবী হেসে ফেলল।
-কি করো
-তুমি কার সাথে এসেছ
-ফ্রেন্ড।
সায়হাম আরেকটা ভুল করে ফেলল। ও ওয়েটারকে ডেকে একটা চা দিতে বলল।
-তুমি খাবে না।
-এখুনি টেক করলাম
-কি বললে, টেক করলাম?
-না না, খেলাম
“শালার একটা লিভ খেতে চাইলাম তাও হোল না। কি দরকার ছিল স্ট্যাটাসটা দেয়ার?” অবশ্য ভালোই লাগছে নীল মানবির সাথে কথা বলতে। যদিও বক্রোক্তি করছে কিন্তু সুন্দরী মেয়ের বক্রোক্তি বলে কথা- তাই সই।
চা এল যথা সময়ে- শালা গুলার পাচায় এবার পুরা বাঁশঝাড় ঢুকিয়ে দিতে ইচ্ছে হোল সায়হামের। শালা, এবার একটু দেরি করে দিলে কি এমন ক্ষতি হতো?
কি সুন্দর চায়ে চুমুক দিচ্ছে। চরম। এক হাজার লাইক। চায়ের জায়গায় নিজের ঠোঁট কল্পনা করে শিউড়ে উঠল সায়হাম। একটা স্ট্যাটাসের বিনিময়ে এরকম ঠোঁট দেখা! জীবন সার্থক। পিনিক আরো বাড়লো যখন ও বলল-
“একটা সেলফি হয়ে যাক”।
সায়হাম মাথা চুলকালো। আবার বোধহয় ইমেজ গেল; ওর এস ১০৩ তো আর বের করা যায়না! নীল মানবীই ফোন বের করল। মোটামুটি চলে। ফাইভ মেগা পিক্সেল ক্যামেরা। সেলফিটা সুন্দর হোল। ভালোই দেখাচ্ছে দুজনকে। আজ প্রথম সায়হামের নিজেকে হ্যান্ডসাম মনে হোল। মানবী বলল-“সন্ধ্যায় আপলোড দিব। তোমাকে ট্যাগ করে দিব এখন।”
-অবশ্যই
-তো থাক। যোগাযোগ তো থাকছেই
-তা তো বটেই
চলে গেল নীল মানবী। আসল নামটা অবশ্য জানা হোল না। কি আর হবে, ফরিদা টরিদা হবে। সুন্দর নাম হলে তো আর ফেইক নামের দরকার ছিল না।
পকেটে থেকে মানিব্যাগটা বের করতেই ওর চোখ আলু হয়ে গেল। আরেকটা দুইটাকার নোট কোথায়? একটা ১০ টাকার নোট আর ৫ টা দুইটাকার নোট থাকার কথা! একটা মিসিং!
আচ্ছা ১৮ টাকা নেবে না?
***
সন্ধ্যায় ফেবুতে ঢুকল সায়হাম। হ্যাঁ নীল মানবী পিকটা আপলোড করেছে। ট্যাগও করেছে। লাইকের বন্যা অলরেডি বয়ে গেছে, এখন চোরা স্রোত চলছে।
কিন্তু ক্যাপসনটায় চোখ আটকে গেল ওর।
“আজ বিকেলে রকিং সায়হাম এর সাথে হোটেল হলুদ বাংলায় চাইনিজ খেতে খেতে”
সায়হাম তো পুরাই শকড! নীল মানবী রকস!
সায়হাম ভাবিস্ট হয়ে স্ট্যাটাস দিল- “এই পৃথিবীতে কে চোর না!”
বিঃদ্রঃ- রম্য- তাই বানান ভুল হলে রম্য হিসেবেই ধরে নিবেন। ভেবে নেবেন আমি তাদের কি যেন বলে কটাক্ষ করেছি যারা বানান ভুল করে!
১০ই মার্চ ২০১৫
সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টা