somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প- রিস্টবেল্ট

০৫ ই এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঘটমানঃ-
ঘড়ির দিকে দেখেন অজয়। বারোটা ছাপ্পান্ন। মোবাইলটা ভাইব্রেট করছে। সাইলেন্ট করে রাখেন তিনি। ব্লগের অ্যাডমিন কল করেছেন। কেন করেছেন জানেন বলেই রিসিভ করলেন না। ব্লগিং এর পাঁচ বছরের মাথায়ও এখন কিছুদিন থেকে ওয়াচিং এ আছেন তিনি। ব্যান্ডটা কব্জিতে পরিয়ে দেন তিনি।
আরও কিছুক্ষণ তাঁকে এখানে থাকতে হবে যতক্ষণ না আরেকজন এসে দায়িত্ব নেন, তাড়াতাড়িই চলে আসবেন কেউ একজন। দেড়টা থেকে আরেকটি সিফট শুরু।
রিস্টবেল্টের লাল রঙে চোখ আটকে যায় তাঁর। লাল! অথচ লালের সাথে এর কি সম্পর্ক খুঁজে পান না তিনি। কোথায় যেন- বোধহয় হেলাল হাফিজের কবিতায়- “তোমায় দিলাম একটা লাল হাত”- পড়েছিলেন তিনি। মনে পড়ছে না ঠিক। সেখানেও লালের সাথে হাত!
আবার কল আসে অ্যাডমিনের থেকে। কথা বলা নিষেধ ডিউটির সময়; - তাই ব্যক্তিগত কেউ এ নাম্বারটা জানে না পেশাগত কয়েকজন ছাড়া। আশেপাশে কেউ নেই বলে কিংবা ওই লাল রিস্টব্যান্ডের কথা ভেবেই নাকি নিঃসঙ্গতা বসত কলটা ধরেন তিনি।
“ভাই ডিস্টার্ব করলাম না তো?” বলে অমায়িক হাসি দেন অ্যাডমিন। অ্যাডমিন জানেন যে রাত যত গভীর হয় তাঁর ব্লগাররা তোতোই চাঙ্গা হয়ে ওঠেন, এটাই বোধহয় এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে! তাইতো এরকম একটা অফিসিয়াল( অফিসিয়াল!) ব্যাপারে কথা বলার জন্য তিনি মাঝরাতে কল করতে পারলেন!অজয় কিছুক্ষণ সময় নেন উত্তর দেয়ার জন্য।
“না না, ঠিক আছে।” অনেক ভদ্রতার সাথে বলেন তিনি। এরপর তিনি ভালোমন্দ খোঁজ নিয়ে আসল কথায় আসেন।
“ভাই, আমরা কিন্তু ভাই আপনার লেখাটা মুছে ফেলছি। কেন ফেলেছি মেইলে জানিয়েছি। একবার তাড়াতাড়ি দেখে নেবেন প্লিজ।”-প্রথম বাক্যটায় দুইবার ভাই বলা হয়েছে এটা অজয়ের কপাল কুঞ্চনের কারণ হয়ে যায়। কিন্তু তারপর যা বলা হোল এটাতে তাঁর কোন অভিব্যক্তি হলো না- সে যেন জানেই এরকম কিছু একটা হবে! দুই পাশেই নীরব থাকে কিছুক্ষণ। আবার বলতে শোনা যায় অ্যাডমিনকে, “আপনি আবার লেখা ছেড়ে দেন আমাদের ব্লগে তাই ফোন করলাম। আসলে জানেনই তো আমরা সব ধরনের লেখা প্রকাশে প্রস্তুত। পাঠকের ব্যাপারটা তো আমাদের দেখতে হবে বলেন। অনেক রিপোর্ট পরেছে আপনার লেখাটায়”
“না না, ব্যাপার না। আচ্ছা আমি মেইলটা পড়ে নিচ্ছি। আর আপনারা আমার লেখা পাবেন নিশ্চিন্ত থাকুন।” ফোনটা রেখে দেন অজয়।
মেইল চেক করতে ইয়াহুতে লগ ইন করেন তিনি। নেট খুব স্লো- সময় নিচ্ছে খুব। এক্সিট করেন। তিনি তো জানেনই কেন লেখা সরানো হয়েছে, এটা আবার ঘটা করে মেইল পড়ে জানার কি দরকার।
কব্জি আর কব্জিবন্ধের দিকে আবার চোখ যায় তাঁর। লাল রিস্ট ।
একবার ভাবলেন খুলে রাখবেন নাকি মেয়েটার হাতটা থেকে। কিন্তু জানেন যে এখন খুলে ফেললেও আবার কিছুক্ষণ পর পরিয়ে দিতে হবে। দেখি না শেষ পর্যন্ত কি হয়।
নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার। হাতপা কাঁপছে যেন ছিঁড়ে ফেলবে অক্সিজেন মাস্ক। অজয় গিয়ে হাত দু’টা চেপে ধরেন যেন খুলে ফেলতে না পারে। কু কু একটা শব্দ শোনা যায় ওর মুখ থেকে। চোখগুলো বের হয়ে আসতে চাচ্ছে অক্ষিকোটর থেকে। পা একটা ঝটকা মারে। অজয় আর ধরে রাখতে পারেন না, কিন্তু শেষ চেষ্টা করেন তিনি। সর্ব শক্তি দিয়ে হাত দু’টো চেপে ধরেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যায় রোগী। হাত ছেড়ে দেয় ও। কিন্তু সতর্ক থাকে যেন আবার এরকম করলে ঠিকমতো সব করতে পারেন ।
কিছু ঘটলে আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই ঘটবে। ঘড়িতে একটা পাঁচ বাজে।
অজয় ভাবে, “আমি কি একজন কে জেনেশুনেই মৃত্যুর দুয়ারে পাঠিয়ে দিচ্ছি? তা কি করে সম্ভব?”

“আনাচে কানাচে এখনো তোমার গন্ধ
তার সোমে ফাঁকে কাটে এখনো ছন্দ
থেকে গেলাম না হেরে গেলাম যেন রিয়ালিটি সো
তোমার আমার এই জাদুঘরে পোড়ে প্রেমের জীবাশ্ম।”
অনুপমের গানটা মাথায় ঘুরঘুর করে। তাড়িয়ে দিতে চান তিনি- পারেন না। “ছেলেটার গলায় আলাদা একটা ব্যাপার আছে”- ভাবেন তিনি। “থেকে গেলাম না হেরে গেলাম!” হা হা ! হাসি পায় অজয়ের। থেকে গেলে কি হবে? আর যদি না থাকি তাহলেই বা কি হবে!
আবার শব্দ করে ওঠে মেয়েটি। কু কু- যেন মুরগির বাচ্চা। এবার কিন্তু হাতপা ছোড়ে না। স্বাভাবিক হয়ে আসছে নিশ্বাস। অক্সিজেন প্রাপ্যতা এখন সেভেন্টি ফাইভ পারসেন্ট। বাঁচার সম্ভবনা আছে।
অজয়ের কপাল কুঁচকে যায় এবার। তাহলে তিনি ভুল প্রমাণিত হতে যাচ্ছেন! এটাই চান তিনি। নিজেকে ভুল প্রমাণিত করার জন্য কতো চেষ্টাই না তিনি করেছেন । পারেননি। নিশ্বাস ভারি হয়ে আসে তাঁর। দীর্ঘশ্বাস পড়ে একটা। তিনি অবাক হন। এটা কি তিনি চেয়েছিলেন! অবচেতন মনে কি তাঁর আকাঙ্খা ছিল যে তিনি যেন ভুল প্রমাণিত না হন? চোখ মুদে ফেলেন তিনি। কণ্ঠ থেকে আপনা আপনি বেড়িয়ে আসে- “মানুষের মন বড় আজব!”
সাধারণত প্যারানরমাল গল্প লিখেন ডক্টর– ইতোমধ্যে খ্যাতিও কম হয় নি। তাঁর ব্লগ অন্তত চারহাজার বার পড়া হয় প্রতিদিন। কমিউনিটি ব্লগিং এ এই উচ্চতায় পৌঁছান যে সে ব্যাপার না। অনেক খাটতে হয়। এমনও দিন গেছে, একটা বিষয় মাথায় এসেছে- কিন্তু লিখতে প্রচুর তথ্য-তত্ত্ব লাগবে; তিনি সারাদিন বাড়িতে বসে বই পড়েছেন। অনেক বই কিনতে পাওয়া যায় না- কিন্তু তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে তাতে কিছুই থেমে থাকে না। পিডিএফ পড়েছেন তিনি- এই পিডিএফের বিপক্ষেই যদিও একদিন তিনি কলম ধরেছিলেন। নেট ঘেঁটে ঘেঁটে খুঁজে বের করেছেন প্রয়োজনীয় তথ্য। তারপর লিখতে বসেছেন তিনি। অনেক পরীক্ষা- নিরিক্ষার পর লেখা প্রকাশ করেন। বিজ্ঞানের লোক তিনি- অবৈজ্ঞানিক কিছু তাঁর লেখায় কল্পনাও করা যায় না। সবসময় রেফারেন্স থাকে তাঁর কথার।
কিন্তু কিছুদিন থেকে বুঝছেন না- কেন জানি অতিপ্রাকৃত ব্যাপারগুলো নিয়ে তাঁর হাত থেকে লেখা বেরুচ্ছে। প্যারানরমাল লিখতেন- কিন্তু বিজ্ঞানভিত্তিক। মানুষিক অনেক কারণে মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে যায়; ফলে অনেক অদ্ভুত অদ্ভুদ জিনিস প্রতক্ষ করে তারা। এসব মানুষিক রোগীদের নিয়েই তাঁর বেশিরভাগ জনপ্রিয় লেখা। গল্পের শুরুতে মনে হবে- টানটান ভূতের গল্প কিন্তু একটু এগিয়ে গেলেই বুঝবেন বিজ্ঞানের এক অসাধারণ জগতে আপনি চরে বেড়াচ্ছেন এখন, থ্রিলার মনে হবে লেখাটাকে- বৈজ্ঞানিক থ্রিলার। অবশেষ তিনি ফিনিসিং করবেন ওই বিজ্ঞান দিয়েই- সব পরিষ্কার হয়ে যাবে পাঠকের কাছে।
কিন্তু আজকাল অ্যাবনরমাল ব্যাপার গুলো এমন ভাবে তাঁর লেখায় আসছে যে সেগুলো তিনি সরিয়ে ফেলতে পারছেন না।
আর সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার তিনি যা লিখছেন তাঁর অনেককিছুই অতীতের সত্য ঘটনা অবলম্বনে; নয়তো তা ঘটতে যাচ্ছে!
একবার তাঁর একটা গল্পের প্রয়োজনে নায়কের মা ছাদ থেকে লাফিয়ে পরে আত্মহত্যা করেন; কিছুদিন পর গ্রাম থেকে খবর এসেছে তাঁর মা গলায় দরি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। পোস্টমরটাম(postmortem) করলে জানা যায় তাঁকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা হয়েছে, তাঁর গায়ে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়! অনেক বিশ্রি কয়েকটা দিন ছিল সেসব। অজয় ঢাকায় ছিলেন- কিন্তু তাকেও অনেক জেরার মুখে পরতে হয়েছিলো। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও খুনি কে বের করা সম্ভব হয় নি। কিন্তু রিপোর্টে স্পষ্ট লেখা আছে- এটা মার্ডার- আত্মহত্যা নয়!
ঘড়িতে একটা পনের বাজে। আর পনের মিনিট তিনি সময় পাবেন তাঁর ক্ষমতা পরীক্ষার। পনের মিনিট পর আরেকজন আসবেন- তাঁকে লাল রিষ্টব্যাজটা খুলে দিতে হবে রোগীর হাত থেকে। মাত্র পনের মিনিট ডকটার, পনের মিনিট।
“থেকে গেলাম না হেরে গেলাম যেন রিয়ালিটি সো”- আবার ঘুর ঘুর করে মাথায়। “নাহ আর অনুপমের গান আমি শুনব না”- স্পষ্টই বলেন মুখ ফুটে। এই থেকে গেলাম নাকি হেরে গেলাম ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করেন তিনি এখন। অথচ চিন্তা করার কিছুই পান না খুঁজে- কি আবোলতাবোল ভাবছেন এসব!
মেয়েটার অক্সিজেন প্রাপ্যতা বাড়ছে- আশার খবর, বেঁচে যেতে পারে। তিনি উঠে গিয়ে একবার পায়ের পাতা মালিশ করে দেন।অবস্থা ভালোর দিকে যাচ্ছে। চিকন হাসি ফুটে ওঠে ঠোঁটে। অনেক মানুষ তিনি মরতে দেখেছেন, অনেককে দেখেছেন সেরে উঠে দিব্যি ঘুরে বেড়াতে।এখন আর তেমন ফিলিং আসে না। প্রথম প্রথম কেউ একজন মারা গেলেই চোখ ভিজে আসত। পরে এমনও দিন এসেছে যেদিন তাঁকে প্রত্যেকটা রোগীকেই মৃত ঘোষণা করতে হয়েছে। বাঁচলেও যা, মরলেও তা। কিন্তু এখনো কেউ বেঁচে ফিরলে কেমন একটা অত্মতৃপ্তি আসে- মুখের কোনে চিকন স্মাইলি দেখা যায়।
এখনো মুচকি হাসছেন তিনি- বাঁচতে পারে তো মেয়েটা।
কিন্তু হটাত মুখ গম্ভীর হয়ে আসে- “আমি তাহলে ভুল প্রমাণিত হচ্চি!”
একটা পঁচিশ। লাল বেল্টটা খুলে ফেলেন তিনি মেয়েটার হাত থেকে। আশে পাশে তাকান। কয়েকজন মুমূর্ষু রোগী ছাড়া কেউ নেই। এই মৃত্যুপুরিতে সবচেয়ে সুস্থ ছিল এই মেয়েটি; কিন্তু এর অবস্থাই এখন সবচেয়ে খারাপ। “আমার কারণেই কি?” ভাবেন ডক্টর।
আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে( স্বাভাবিক কেউ নয়- অপেক্ষাকৃত স্বাভাবিক) ওর নিশ্বাস।
ডক্টর বেল্টটা পকেটে ঢুকান।
আরেকজন আসেন; তাঁকে সব বুঝিয়ে দিয়ে বেড়িয়ে পড়েন অজয়। তিনি ভুল প্রমাণিত হলেন। নিজেকে হালকা লাগে তাঁর।

ফিরে দেখাঃ-
আজ রাত নটায় সিসিইউ’তে ঢুকেন তিনি। সবার দিকে দেখে তিনি সবচেয়ে মুমূর্ষু রোগী- যার পাশে এতক্ষণ ডক্টর বসে ছিলেন- তাঁর পাশে যান। বাঁধা কাজ করে যান তিনি।
হটাত ওই মেয়েটার দিকে চোখ যায় তাঁর। বয়স চৌদ্দ- পনের হবে। এতো পাতলা দেখতে যে মনে হয় হাওয়ায় উড়ে যাবে। নিজের মেয়ের কথা পরে ওঁর। এখন মাদ্রিদে আছে, মায়ের সাথে। “মৈথিলীর সাথে ডিভোর্সের প্রায় সাত বছর হোল প্রায়”- মনে মনে বলেন তিনি। বলাকা- ওঁর মেয়ে- বলাকা’কে যখন শেষবার দেখেন তখন ওর চেহারা এরকমই ছিল- হিলহিলে, পাতলা যেন বাঁশপাতার মতো যেন এখনি উড়ে যাবে বাতাসে। তাও প্রায় চার বছর হয়ে যাবে ওকে শেষবার দেখার। এখন নিশ্চয়ই অনেকটা বড় হয়েছে- বয়ফ্রেন্ডও আছে বোধহয়। ওখানে আঠার বছর বয়সে বয়ফ্রেন্ড না থাকাতাই অস্বাভাবিক। অনেকবার ভেবেছেন একবার ভিডিও কল করবেন- আবার ভেবেছেন- “ওও তো আমাকে করতে পারে আমি আগ বাড়িয়ে কেন করতে যাব?” । ভেবেছেন আর দীর্ঘশ্বাসকে চাপা দিয়েছেন তিনি।
আজ অনেকদিন পর একে দেখে তাঁর নিজের মেয়ের কথা মনে পরে। ওর বেডের কাছে যান তিনি। কিন্তু দেখেই তাঁর বুক ধক করে ওঠে। তিনি স্পষ্ট দেখতে পান আজ রাতেই মেয়েটা মারা যাবে। যাবেই। তিনি যেন তখনই মেয়েটার মরা হলুদ মুখটা দেখতে পাচ্ছিলেন। খারাপ লাগে তাঁর, কিন্তু স্বভাবসুলভ ভাবেই গাম্ভীর্য রক্ষা করেন।
এরকম হয়ে আসছে কয়েকদিন থেকেই। তিনি যাই ভাবছেন অনেকটা তাই হয়ে যাচ্ছে। আগে এরকমটা হতো না। গত পরশু তাঁর এখানে শেষ ডিউটি ছিল। ঢুকেই তিনি অনেক জীবন্মৃত দেখতে পান। অক্সিজেন মাস্ক লাগান কয়েকজন মৃত- যারা তখনও শ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছে, কয়েকজনের পাশে ঘুরে আসেন তিনি। তাঁর সেদিন শিফট ছিল রাত দেড়টা থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত। যাদের তিনি মারা যাবেন বলে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন তারা সব ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে- এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই।
ডক্টর মৃত সবার কব্জিতেই লাল বেল্ট বেধে দেন। লাল- বিদ্রহের প্রতীক- লাল মৃত্যুরও প্রতীক।
প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির কব্জিতে লাল রিস্টবেল্ট বাঁধা এই হাসপাতালের নিয়ম।
আজ এই মেয়েটাকে দেখেও তাঁর মৃত্যুর কথাই মনে আসে; মেয়েটার মুখে হলুদ ছায়া তিনি দেখতে পান। তাঁর মনে হয় আর কিছুক্ষণের মধ্যেই থেমে যাবে এর হৃদস্পন্দন- অসার একটা কঠিন বস্তুতে পরিণত হবে।
রাত এগারোটা পর্যন্ত রোগীর বাড়ির অনেকে আশেপাশে ছিল, কিন্তু রাত বারার সাথে সাথেই লোক কমতে থাকে, শীতের রাত- আজ ফেব্রুয়ারির ২ তারিখ- জমে শীত এসেছে। সবাই একসময় চলে যায়। শুধু থাকে ডক্টর আর মুমূর্ষু কিছু রোগী, যারা বাচতেও পারে আবার হারিয়েও যেতে পারে।
ডক্টর আবার যান ওই কিশোরীর বেডের কাছে, পাশে রাখা তুলে বসেন তিনি। মাস্ক লাগানো মুখটা ভালো করে দেখা যায়না। তিনি সেখানে , মৃত্যুর শীতলতা দেখতে পান। “আজ তুমি মারা যাবে, মেয়ে” অস্ফুট বলেন ডক্টর অজয়।
তিনি একটা অভাবনীয় কাজ করে ফেলেন। যেটা কেউ চিন্তাও করতে পারবেন না।
তিনি মেয়েটার কব্জিতে লাল বেল্ট বেঁধে দেন; যার মানে মেয়েটা মৃত!

ঘটমানঃ-
সিসিইউ থেকে বের হয়ে আসেন অজয়। অবাক লাগে, বিস্মিত হন আবার অনেক হালকা লাগে তাঁর।
গত কয়েকদিনে সকল রোগীর মরে যাওয়ার কারণ হিসেবে নিজেকে দাঁড় করান তিনি। তাঁর মনে হয় সবাই তাঁর কারণে মারা যাচ্ছে। তিনি যদি ওদের দেখে না বলতেন যে “তোমরা মরতে যাচ্ছ” তাহলে ওরা মরত না- এটা তাঁর মনে হয়।এখন একপাট তাই হেসে নেন তিনি। কতদিন এভাবে হাসা হয় না।
লিফটের দিকে যান তিনি। লিফটের দরজা খুললে দেখতে পান আগে থেকেই একজন নার্স আছেন।
“গুড মর্নিং ডক”
“গুড মর্নিং”।

“খুব ঠাণ্ডা না?”
“হা তা বেশ পড়েছে।”
নিজের দিকে মন দেয় ডক্টর। টানা আট ঘণ্টা কাজ করছেন তিনি, নিজের কি অবস্থা হয়েছে! ৯ টা থেকে এখানে ব্যস্ত আর ৫ টা থেকে ৯ টা পর্যন্ত নিজের চেম্বারে!
“আপনাকে অনেক বিধ্বস্ত লাগছে, আপনি ঠিক আছেন তো?” উদ্বিগ্নতা প্রকাশ পায় নার্সের কণ্ঠে। “না, আমি ঠিক আছি” বলে সোজা হওয়ার ভঙ্গি করে ডক্টর।
“আপনার কি সিফট শেষ ?” এবার ডক্টরই আগে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন। “উম হ্যাঁ” বলেন নার্স।
“হ্যাঁ” শব্দটা এমনভাবে উচ্চারিত হয় যে তিনি মুখ তুলে নার্সের দিকে তাকাতে বাধ্য হন। দেখেই জমে যান তিনি। মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে যায় একরাশ বরফ। শক্ত হয়ে যান তিনি।
মেয়েটার কব্জিতে বেল্ট বাঁধা!
তাঁর মনে হতে থাকে তিনি যেন পরে যাচ্ছেন কোন অতল আকাশ থেকে, হৃদপিণ্ডের শব্দ তিনি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন।
“আপনি ঠিক আছেন, ডক্টর ?” আবার প্রশ্ন নার্সের কণ্ঠে।

ফিরে দেখাঃ-
এটা তাঁর এ মাসে প্রকাশিত ৪র্থ ব্লগ। আগের তিনটাই পাঁচ হাজারের উপরে পঠিত হয়েছে। সাধারণত তিনি মাসে তিনটি ব্লগ লেখেন, কিন্তু এবার লিখছেন নিজ কারণে। আজ যা লিখছেন তা তাঁর ডাইরির পর্যায়েই পড়ে।
“আমার মনে হোল- ওদের মুখে আমি কবরের শূন্যতা দেখতে পাচ্ছি, অন্ধকার হলুদ একেকজনের মুখ। দেখতে পাই তাদের মুখে মাছে উড়ছে শব্দ করে। আমি বলি, “এরা মরতে যাচ্ছে”- নিজেকে বলি। আমার বিশ্বাস হয় এরা মৃত্যুপথযাত্রী। হ্যাঁ এটা মনে হতেই পারে সবার। আমি এমারজেন্সিতে ছিলাম- সেখানে সবাই মৃত্যুপথযাত্রী। কিন্তু সেখান থেকেও কেউ কেউ বেঁচে ফিরে। আমার কিছু কিছু মুখ দেখে উপরের মতো হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এর মধ্যে অস্বাভাবিক হোল সেটাই যে- তারা সবাই মারা গেলেন।”
এটুকু লিখে থেমে গিয়েছিলেন অজয়, নিজেকে বোঝান তিনি, “আমি কি আমাকে নিয়ে লিখছি?”
মনের আরেক প্রান্ত বলে- “লিখলেই বা, নিজেকে নিয়ে লেখার কিছু থাকলে লেখাই উচিৎ।”
লিখেন তিনি। কাহিনী অনেক মনস্তাত্ত্বিক- এক ডক্টরের মনে হয়- তিনি যদি কোন রোগীর মুখ দেখেই বলে দিতে পারেন সে বাঁচবে না মরে যাবে। এ নিয়ে অনেক মনঃকষ্টে ভগেন তিনি। নিজেকে তাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী মনে করেন তিনি। অবশেষে নিজেকে শেষ করে ফেলেন তিনি। ব্লেড দিয়ে শরীরের প্রত্যেকটি শিরা-ধমনী কেটে ফেলেন । সারা ঘর রক্তে ভেসে যায়- তাঁর মরতে সময় লাগে অনেক। ততক্ষণ মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করেন তিনি। ডক্টরের মৃত্যু দিয়েই গল্প শেষ হয়।
ডক্টর বলে, ব্যাপারটাকে অত্যন্ত ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন তিনি। সাথে যুক্ত হয়েছে খোব আর নিজের উপর রাগ।
অনেক নিষ্ঠুরতার সাথে লেখাটা শেষ করেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে কেউ এই লেখাটা পড়লে শিউড়ে উঠবে।
পোস্ট করার পর ব্লগে লেখাটা নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়ে যায়। অনেকে ভূয়সী প্রশংসা করেন। হিট হয়ে যায় গল্প। শুধু প্যারানরমাল লিখেন আর কারো পোস্টে মন্তব্য করেননা বলে কিছুদিন থেকে তাঁকে ওয়াচে রাখা হচ্ছে- তিনি বুঝতে পারেন। এবার তাদের নজরদারি আরও বাড়বে।
কিন্তু খারাপ খবর আসে বিকেলের দিকে সেদিন। দুই জন নামি আর জনপ্রিয় ব্লগার আত্মহত্যা করেন। এবং তা করেন অজয়ের দেখানো পথে,- দুই জনই শিরা কেটে ফেলে হাত পায়ের। রাতে আরও তিন জনের আত্মহত্যার খবর পাওয়া যায়। পরে আরেকজন ব্লগারের লেখা পরে জানা যায়, “যারা আত্মহত্যা করেছেন তারা সবাই অজয় রয়ের সর্বশেষ লেখায় প্রথম দিককার কমেন্টকারী ছিলেন। সবপ্রথম যে ব্যক্তি কমেন্ট করেছিলেন তিনি সেদিন রাতে সুইসাইড করেছিলেন।
এরপর থেকে ওই ব্লগের নামে অনেক রিপোর্ট আসে। অবশেষ অ্যাডমিন ব্লগটি মুছে ফেলতে বাধ্য হন।

ঘটমানঃ-
একদৃষ্টে অজয় তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। এখনো মাস্ক পরা, অনিশ্চিত বাঁচবে কিনা। এভাবেই সে যুদ্ধ করে যাচ্ছে প্রায় পাঁচদিন ধরে। মাঝে মাঝে যায় যায় অবস্থা- মাঝে মাঝে কিছুটা ঠিক থাকে।
আজ প্রায় চারদিন পর অজয়ের এখানে ডিউটি, এর কথা একপ্রকার ভুলেই গেছিল চেম্বার আর লেখালেখির চাপে। এখন পুরনো ঘার মতো দাগ দেখতে পায় ও।
ওর মুখটা যেন ওকে ব্যাঙ্গ করে। অজয় চোখ সরিয়ে নেয়। সে রোগী দেখেই বুঝতে পারে সে বাঁচবে নাকি মরে যাবে- তা এর দ্বারাই ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
ভোর হতে চলেছে। আজ দেড়টায় তাঁর সিফট। শীত করে খুব। ওঁ পকেটে হাত রেখে কিছুক্ষণ হেঁটে হেঁটে সবার অবস্থা লক্ষ করে। আবার ফিরে আসে মেয়েটার কাছে।
ওর দিকে তাকাতে লজ্জা পায় যেন সে। মেয়েটাকে ওর যোদ্ধা মনে হয়। হ্যাঁ যোদ্ধাই তো।
নিজের উপর আক্রোশ বারে ওর। কেন আমি সেদিন এর হাতে লাল ব্যান্ড বাঁধলাম! নিজেকে পরাজিত মনে হয়।
কান দুটো গরম হয়ে আসে, মাথায় হাত বুলায় একবার।
“থেকে গেলাম না হেরে গেলাম যেন রিয়ালিটি সো”- তাই তো! হেরে গেলাম আমি! কেন হারলাম? আমি হেরে যাওয়ায়ে মতো কাজ করেছিলাম?
মাস্কের কারণে মুখটা কিশোরীর দেখা যায় না। অজয়ের ওর মুখটা ভালোভাবে দেখতে খুব ইচ্ছে করে। আমাকে যে হারাল তাঁকে একবার দেখব না?
অক্সিজেন মাস্কটা খুলে ফেলে ও। ছটফট করে কিছুক্ষণ। শব্দ করে ওঁ ওঁ- মুরগির মতো- হ্যাঁ মুরগির মতো। হাতপা ছোরার চেষ্টা করে, কিন্তু অজয় চেপে ধরে।
লাল রিস্টব্যান্ড ওর কব্জিতে লাগিয়ে দেয় অজয়। একচিলতে হাসি ওর ঠোঁটে।


রিস্টবেল্ট নামের একটি অনুগল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা
১৭টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে

লিখেছেন লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩১

সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনের গল্প

লিখেছেন ঢাকার লোক, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৩৫

মাত্র মাস দুই আগে আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা আমার এক বোনের বাড়ি। তার স্ত্রী মারা গেছেন তার সপ্তাহ দুই আগে। মক্কায় উমরাহ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমান

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:১২

" অভিমান "

তোমার ঠোঁটে বোল শিখেছি
তুমি আমার মা, কেমন করে
ভুলছ আমায় বলতে
পারিনা। এমন করে চলে
গেলে, ফিরে ও এলেনা। হয়তো
তোমার সুখেই কাটছে দিন,
আমায় ভাবছ না।

আমি এখন সাগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

×