কীভাবে শুরু করবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। আহমদ ছফা একজন দেবতুল্য মানুষ অনেকের কাছে। মুক্তমনারা যেমন পূজা করে হুমায়ুন আজাদের, সময়ে অসময়ে তার চোখ দিয়ে বিশ্ব দেখে আর মাঝেমাঝে তার বহুলপ্রচলিত বচন হতে দুএকটা শুনিয়ে বা কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধের দুএক লাইন কোট করে নিজেকে উদার প্রমাণ করে আর অনেকটা শ্লোকের মতোই আওড়ায় তাকে সকাল সন্ধ্যা,- আহমেদ ছফাও তেমন হয়ে গেছেন আধামুক্তমনাদের কাছে। যারা নিজেদের খাস বাঙালি ভাবেন না, আবার মুসলমানও ভাবেন না পুরো- মাঝামাঝি "বাঙালি মুসলমান" মনে করেন, তাদের কাছে তিনি গুরুই বটে। ফেসবুকে দেখেছি আহমদ ছফা চর্চা কেন্দ্র নামে গ্রুপ আছে। তার মানে আহমদ ছফা এমন কিছু করে গেছেন, যার মধ্যে চর্চা করার মতো অনেক কিছুই আছে। অবশ্য কতোটুকু চর্চা হয় জানি না। কারণ সেগ্রুপ থেকে আমি কোনদিন তার কয়েকটা খালি গায়ের পিক ছাড়া অন্যকিছুই পাইনি। থাক সে কথা।
কথাটা সহজ ভাবেই বলে ফেলি। যদি আহমদ ছফা বেঁচে থাকতেন, তার সাথে দেখা করতে যেতাম আমি, কোন একদিন। অবশ্য তিনি আমাকে দর্শন দিতেন কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ অবশ্যই মনে আছে। ভাগ্য প্রসন্ন হলে, তার সাক্ষাত মিললে, তাকে প্রশ্ন করতাম কিছু, যেগুলোর উত্তর তার রচনাবলী অনেক চষেও পাইনি।
প্রথমেই জিজ্ঞেস করতুম, " হে জ্ঞান তাপস, আপনি আপনার এক প্রবন্ধে* বলেছিলেন, ররি ঠাকুর আপনার সমাজ, বাঙালি মুসলমান সমাজ নিয়ে কোন গল্প লিখে যাননি, লিখে যাওয়ার উদারতা প্রকাশ করেননি যদিও রবি ঠাকুরের প্রজারা বেশিরভাগ ছিল মুসলমান- তারাই সকালসন্ধ্যা পরিশ্রম করে ঠাকুরপরিবারের অন্ন সংস্থান করেছে। তাই, আপনি রবীন্দ্রনাথকে পুরোপুরি আপন করতে চান কিন্তু পারেন না। হে আলোচিত বিদ্বান, আপনি নিজেই কি এখানে রবি ঠাকুরকে দূরে ঠেলে দেননি? আপনি যদি নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দিতেন, তবে কী তাকে বরণ করে নিতে কোন কষ্ট হতো? মৌলবাদীরা বাঙালি শব্দটা শুনেই নাক সিটকোয়, গন্ধ নাকি পায় বিজাতিয়- তাই তারা বাঙালি মুসলমান টার্মটা গ্রহন করেছে। কৈ কোন সনাতন ধর্মাবলম্বী তো তার জাতিয়তার প্রশ্নে বলেন না, "আমি বাঙালি হিন্দু"। বলে, "আমি বাঙালি"। তাহলে কি গুরু, আপনার ভাষ্য মতে, ধরে নিতেই পারি, বাঙালি পরিচয়টা শুধু তারাই দেবে যারা সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী?"
যাক, আমার মূল প্রশ্ন সেটা নয়। আমি তাকে জিজ্ঞেস করতাম, "যেটা লিখননি সেটা নিয়ে কেন তার সমালোচনা করবেন আপনি? আর ধরুন, কোন লেখক শিশুদের জন্য কিছু লিখে যাননি, তাই বলে কি তাকে শিশুবিদ্বষী ভাবতে হবে? আমি খুব বেশি জানিনে। অল্প পড়াশুনা আমার। তবুও যতদূর জানি, সে থেকে বলতে পারি, রবি ঠাকুর তারাশঙ্কর বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো জীবনের সংগ্রামী দিকগুলো তুলে ধরেননি। তার সব গল্পই মূলত কবিতার মতো বাঁধা। রোম্যানটিক। কোথাও তিনি ব্যাঙ্গ করেছেন, কোথাও এঁকেছেন জীবন- কিন্তু সব লেখা রোম্যানটিকতার পর্দার ভেতর থেকে। তিনি ছোটগল্পের ক্ষেত্রে আর্ট ফর আর্ট এ বিশ্বাস করতেন। সমাজ যে গল্প লিখে পরিবর্তন করা যায় না, সেটা তিনি বুঝেছিলেন। তাই সমাজের অবস্থা তুলে ধরার চেয়ে, গল্পটাই প্রাধান্য পেয়েছে সেখানে- তার সব লেখাই যেন কোন তালমাত্রাহীন অবোদ্ধ কিন্তু চিন্তু চেনা সুরের। সেখানে তিনি মুসলমানদের গল্প লিখেননি বলে পর হয়ে যাবেন? আপনি নিজেই তাকে আলাদা ভাবেন না তো নিজের থেকে? যদিও তিনি ব্রাহ্ম, মোটা দাগে কি আপনিও ভুলতে পারেন না, হিন্দু মুসলমানের বিভাজনটা? বাঙালি মুসলমান টার্মটা ব্যবহার করে আপনি নিজেই নিজেকে আলাদা করে রাখেননি?"
* জীবিত থাকলে রবীন্দ্রনাথকেই জিজ্ঞেস করতাম (আহমদ ছফা নির্বাচিত প্রবন্ধ)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১০:১৮