somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পাখি, রুমমেট ও ভাতঘুম: এই শহরে ....

১৯ শে নভেম্বর, ২০১৬ রাত ৯:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চা খেতে গিয়েছিলাম।
ছোট্ট দোকান। একটা চালার নিচে কয়েকটা বেঞ্চ পেতে কারবার।
আমার চেয়ে বয়সে বড়ই হবে, কয়েকজন সিগারেট টানছিল। তারা মশগুল গল্পে। হঠাৎ শুনলাম, তাদের একজন বলছে, "যার কথা প্রতিদিন ভাবি, তারে আর কোনদিন দেখতে পারবো না। নেভার... পাখিটা জাস্ট ফুড়ুৎ......."
তাদের মধ্যেই বলল একজন, "আফসোস"।
তাকে আবার বলতে শুনলাম, "সে যদি ইউরোপ আমেরিকা যাইতো, ধর গেলো নরওয়ে বা সুইডেন বা রোম, তাও খোঁজার একটা ট্রাই মারতাম। ঐ সব দেশে মানুষ বেশি না। কিন্তু প্রবলেম হইলো পাখি বাংলাদেশেই আছে। ১৮ কোটির দেশে তারে কেমনে খুঁজি! কই পাই আবার দেখা!"
আমি হাফসোল খেয়ে চায়ে ছোট চুমুক দিলাম একটা!

এই শহরে থাকতে গেলে নানা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। অভিজ্ঞতার সঞ্চয় করে জ্ঞানীতে রুপান্তরিত হতে হলে আপনাকে মেসে থাকতে হবে। কত কিসিমের, কত রঙের, কত ঢঙের মানুষ! যারা মেসে ছিলেন, আছেন কিংবা ভবিষ্যতে থাকবেন তারা বুঝতে পারবেন ভালো করেই।
প্রথমে উঠলাম একটা single রুমে। পোষাল না। প্রচুর ভাড়া। ডাবল রুমে উঠেই পেলাম এক মহাজ্ঞানী রুমমেট। তার কাছ থেকে এই ক'দিনে যত জ্ঞান লাভ করেছি, সন্দেহ হয় প্লেটো হয়তো ততোটা জ্ঞান বা বিদ্যা লাভ করেননি সক্রেটিসের কাছ থেকে, সারাজীবনে।
প্রথমদিন রুমমেটকে দেখেই পিলে চমকে উঠেছিল আমার। অন্তত ছয় ফুট লম্বা তো হবেনই, সেই সাথে প্রস্থটাও কম নয়। লম্বা বলেই পেটের থলথলে চর্বি বোঝা যায় না। খাঁটি আর্মানি প্যাণ্ট, সেই গরমেও জিনসের সার্ট গায়ে। দুহাতে ব্রেস্লেট আছে অন্তত হাফ ডজন। আঙ্গুলে কিসের একটা ভোটকা আংটি। রাজস্থানী গোফ আর কাধ পর্যন্ত লম্বা চুল। তামিল সিনেমায় ভিলেনের কাজ একে দিয়ে হেসে খেলে হয়ে যাবে।
হ্যান্ড শেক করতে করতে ভাবলাম, "যাই কর। জানে মারিস না প্লিজ।"
আমাকে নাস্তা করাতে নিয়ে গেলেন। ডাল পরোটা খাইয়ে হাতে ধরিয়ে দিলেন বেনসনের একটা শলাকা। নিজেও টানতে লাগলেন বেশ জমিয়ে। এক টানেই যে এতো ধোয়া বেরুতে পারে তাকে না দেখলে বিশ্বাস করুন বিশ্বাস করতাম না। যেন কোন ইটের ভাটার আকাশমুখী চিমনি। আমি নিজে ধুমপান করি না খুব একটা। পরীক্ষার আগের রাতে হঠাৎ করে যখন মনে হয় যে সারাবছর কিছু পড়িনি, আগামীকাল তিনঘণ্টা বসে না থেকে অন্তত খাতা বোঝাই করতে হবে- তখন টেনসনের ঠ্যালায় সারারাত সিগারেট ফুকে "আগামীতে আর এমন ভুল করবো না, সময় মতো পড়বো" এই শপথ নিতে নিতে কাটিয়ে দিতাম। সেটা নিয়মিত ছিল না অবশ্যই। কিন্তু-
"পড়েছি যবনের হাতে
খানা খেতে হবে সাথে!"
তাই টানা শুরু করলাম আমিও। এটা জানতাম, বেনসন দামী সিগারেট। সুতরাং যে বেনসন খায় তার যে পকেটে মালকড়ি থাকে সেটা ধরে নিতে আমার আপত্তি ছিল না।
রাতে খাওয়ার পর যখন গেম খেলছি ফোনে, একটা সিগারেট হেলায় ছুড়ে দিলেন আমার দিকে। পড়ে গেল। ভাবলাম, ১২টাকা দামের সিগারেটকে কেউ এভাবে ছুড়ে মারে! সম্ভ্রমে মাথা নত হওয়ার মত অবস্থা!
তুললাম। দেখি মেরিস! এই ব্রান্ডের বিড়ির জোড়া পাঁচটাকা।
বলবো না বলবো না করে বলেই ফেললাম কথাটা। "তখন তো বেনসন টানছিলেন। এখন যে মেরিস?"
তিনি চমকে উঠে খানিকটা, বললেন, "ফার্স্ট ইম্প্রেসনের একটা ব্যাপার আছে না? প্রথমবারই যদি তোমাকে মিরিস খাওয়াতাম, তাহলে আমায় কী ভাবতে? ফকির ছাড়া?"
বুঝলাম, ফার্স্ট ইম্পেসন ব্যাপারটা গুরুতর। মানতেই হলো, ফার্স্ট ইম্প্রেসন ভালোই জমিয়েছেন তিনি, অন্তত আমার কাছে। এরপর এমন অনেকদিন হয়েছে যে আমার পকেটে আছে মাত্র বারো টাকা, তবুও ফার্স্ট ইম্প্রেসনটা ভালো রাখার জন্য হলেও আমাকে দামী সিগারেট খেতে হয়েছে।
তবে যাই বলুন, সেই ডেয়ারিং ইম্প্রেসনটা ধরে রাখা যায় না বেশিরভাগ সময় যদি না প্রকৃতপক্ষে আপনি তেমন হন। যেমন ধরে রাখতে পারেননি আমার রুমমেট। ফটোশপ বা এডিটর দিয়ে অন্তত চরিত্র পাল্টানো যায় না, সৌভাগ্যক্রমে।
........
রুমমেটের বিশাল বদঅভ্যাস আছে একটা। সেটা হলো জোরে জোরে ঊচ্চারণ করে পড়া। আস্তে পড়তেই পারেন না তিনি। এমনকি তিনি প্রেমিকার ম্যাসেজ থেকে ফেসবুকের নিউজফিডও পড়েন শুনিয়ে শুনিয়ে। যখন ব্লকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে পেপার পড়েন তখন মনে হয় বিটিভিতে সংবাদ পড়ছেন কেউ। একদিন গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে শুনলাম তিনি উহু আহু করছেন। কিছুক্ষণ পর শুনলাম বলছেন, আমি আর পারছি না বাবু। তারপর আবার, "উহ"। পরের দিন সকালে বুঝতে পেরেছিলাম তিনি আসলে রাতে সেক্সচ্যাট করছিলেন আর পড়ছিলেন প্রেমিকার ম্যাসেজগুলো জোরে জোরে!!!!
.....
আমেরিকান নির্বাচন শুরু হওয়ার অনেক আগেই একদিন কী মনে করে বলে ফেললেন, "ট্রাম্প হচ্ছে প্রেসিডেন্ট। দেখে নিও!" এরপর আর এ নিয়ে কথা হয়নি আমাদের। আসলে কথা খুব কমই হয়। তিনি তার নিজের পড়া, গফ, ভার্সিটি নিয়েই ব্যস্ত, আমিও মগ্ন নিজের কাজে। যেদিন নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর উত্তেজিত হয়ে বললেন, "তোমাকে বলেছিলাম না ট্রাম্প হবে? দেখলে তো কেমন অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল!"
তার কথা শুনে স্মরণ করার চেষ্টা করলাম কবে বলেছিলেন কথাটা। কিন্তু তিনি ভাবার সুযোগ না দিয়েই বললেন, "আরে সেদিন বললাম না? আরে ঐদিন যেদিন তুমি পেট খারাপ করে বিছানায় শুয়ে কোকাচ্ছিলে? আর বারবার দৌড়াচ্ছিলে বাথরুমে, খেয়াল নাই?"
হ্যাঁ, স্মরণ হলো, তিনমাস আগে তিনি বলেছিলেন বটে একবার কথাটা! সবজান্তাই বটে!

দুপুরবেলা, কব্জি ডুবিয়ে খাওয়ার পর ভাতঘুম দেয়াটা বোধহয় বাঙালিস্বভাব। প্রবলেমটা হলো, কজ্বি ডুবিয়ে খাওয়াটা আমার হয়না বহুদিন। পড়ার চাপও এতা বেশি যে দুপুরবেলা ঘুমানোটা বিলাসীতার পর্যায়ে পড়ে। তাই হয়তো সে স্বভাবটার অভাব আছে আমার। মেসের বেটির রান্না মুখে দেয়ার সাথে সাথেই রবি ঠাকুরের কবিতাটা মনে করার চেষ্টা করি। ঐ যে, তখনি জুতার স্বাধ ঘুচিল আমার। কল্পনায় আনি, কতো না দুর্ভাগা না খেয়ে আছে। ইথিওপিয়ায় কিংবা বাংলাদেশেরই আনাচে কানাচে কোথাও। আমি তো তাও খাচ্ছি! হোক সে পানির ডালে ভেজা ভাত আর মুখে দেয়ার অযোগ্য আলুবেগুনভাজি!
দূর্গাপুজো গেল। কোথাও যেতে পারলাম না। ইচ্ছে ছিল মন্ডপে মন্ডপে ঘুরে জীবন্ত দূর্গা, স্বরস্বতীদের পুজো দেব। হলো না। পুজোর প্রেম, পুজোর কচকচানি থেকে দূরে থেকে লাভটা কী হলো, বুঝলাম না ঠিক। পুজোর ভিড়, ঠেলাঠেলি, কোন অপরিচিত ষোড়শীর আড়চোখের চাহনি, অতঃপর পিছু নেয়া- এসব থেকে যে দূরে, সে হয় বোকা** নয়তো ***। গতবছরই তো- পুজোর সময়, সকালে বাড়ি থেকে সুযোগ বুঝে বেড়িয়ে দেবীদর্শন করেছিলাম সারাদিন। পাড়ার মোড়ের মন্ডপে রাত জেগে দেখেছি নাচ। আড়তিও। নাচিনি যে নিজেও- তাও নয়। আড়তি প্রতিযোগিতায় কেন প্রতিবার মেয়েরাই ফার্স্ট হয় সে নিয়ে কম হাসাহাসি করিনি। আর এবারে ঘরে বসে থাকলাম তেলাপোকার মত!
"পাড়ার পুজো গল্প লেখে কত
আমরা তাদের পাঠক ছিলাম কাল
এখন বদল হয়েছি দৃশ্যত
ছাতিম তবু বাতাসে উত্তাল..."
অবশ্য হতাশার কিছু নেই, সামনে লক্ষীপুজো। সেটা মিস করছি না।
যাক গে। বলছিলাম ভাতঘুমের কথা। ছুটি শেষ আজই। ভাবলাম দুপুরবেলা ঘুমিয়ে একটু বাঙাল স্বভাবটা বাঁচিয়ে রাখি। শুয়ে পড়লাম।
এটা ওটা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। মাকে দেখলাম স্বপ্নে। তিনি চাল ঝারছেন কুলায়; পাথর দেখছেন। এরপর চাপিয়ে দেবেন চুলায়। প্রেরণা চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে পড়ছে কিছু একটা। আব্বু কোরাণ পড়ছেন বারান্দায় বসে। মনে হলো, কেবল সকাল হলো, সূর্য উঠেছে কিছুক্ষণ হলো। আমাদের ছোট আমলোকী গাছের নিচে জড়ো হয়ে হুটোপুটি করে আমলোকী কুড়াচ্ছে প্রতিবেশী পিচ্চিগুলো। বাবলুদার কুকুরটা এসে শুয়েছে আমাদের উঠোনে- প্রেরণা ভাগিয়ে দিল। আলতো রোদ উঠোনে। মা এখুনি এসে ডাকবে আমাকে, "সেই কখন বেলা উঠেছে, বাবু। উঠো....."
ভেঙ্গে উড়ে ঘুম। চোখ মেলে দেখলাম বিকেলের আলো আমার রুমের জানালা বেয়ে বিছানায় এসে শুয়েছে। রুমমেট কথা বলছে ফোনে কারো সাথে আর আমার হাতঘড়িটা শব্দ করে সময় গুনে যাচ্ছে.... টিক টিক টিক...
আমি মেসেই আছি। মা নেই এখানে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০১৬ রাত ৯:২৮
১৮টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×