somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: তাদের একটি রাত

১৯ শে মার্চ, ২০১৭ রাত ৩:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঘরটি পছন্দ হল বিহারীর। ছোট এক জানলাওয়ালা। ছাদটা মাথা থেকে অন্তত এক মানুষ দূরে ঝুলন্ত। জানলা মেললেই দূরে খোলা মাঠ। ঘরে হাওয়া খেলবে খুব। লম্বায় চওড়ায় সমান- খাপে খাপ বর্গ। খাট, টেবিল বসলেই হলো। আর হাঁটাচলা-নড়াচড়া করতে একটু ফাঁকা জায়গা- ঘরে তো আর সে কাবাডি খেলবে না।
এর আগে যে ঘরে থাকতো বিহারী, সে ঘরটা ছিল এর দেড়গুণ সাইজের। খাট, টেবিল, আলনা আর একপাশে বইয়ের স্তুপ থাকার পরও, ঘরটায় দিব্যি হাঁটাচলা করা যেত। একবার তো ক্যারামবোর্ড এনে বসানো হয়েছিল ঘরের ভিতরেই! গোসলের আগে বিহারী প্রতিবার শরীরটা ঘামিয়ে নেয়। এতে আরাম পাওয়া যায় গোসলে- বিশেষত শীতে। জানলা দরজা লাগিয়ে জামা কাপড় সব খুলে গানের সাথে সাথে লাফাতো বিহারী। বুকডাউন দিত। আর্চিং করত। পাশের রুমের মিলুর ডাম্বেল ছিল একজোড়া। মাঝে মাঝে ডাম্বেলজোড়া এনে ব্যায়াম করত সে। ঘরেই। অবশ্য ৩০ ইঞ্চি বুক এসব ঝক্কি নিতে না পেরে শুকিয়ে ২৯ হয়ে গিয়েছিল!
তবে দুপুর হলে আলোর ঝলকানিতে চোখ মেলা যেত না সে ঘরে। আলোর দরকার আছে- কিন্তু এতো নয়। সূর্য সকালের খপ্পর ছেড়ে মধ্যাহ্নের বুকে মুখ রাখতেই, বিহারীর মনে হতো- তার চোখের ঠিক এক হাত দূরে কেউ ৬০ পাওয়ারের একটা এনার্জি বাল্ব জ্বালিয়ে দিয়েছে। খচখচ করতো চোখ। বিহারীর দিনের বেলা কোন কাজ নেই, সব শুরু হয় সন্ধ্যের পর। যার দিনে কাজ নেই, সে একটু দুপুরে ঘুমিয়ে নেবে- এতে আর আশ্চর্যের কী? অথচ ঐ ঘরে থাকার সময় এই উষ্ণ কাজটিই বিহারী করতে পারত না।
নতুন ঘরটা সে হিসেবে অনেক ভালো। জানালাটা চাপিয়ে দিলেই অমাবশ্যা। তারপর অন্ধকারে ঘুমাও, কি পর্ন দেখো, কি ট্রাউজারের ফিতা আলগা করে নিচে নামিয়ে হাত মারো- কেউ দেখবে না।
মনে মনে খুশী হয়ে উঠল বিহারী।
বিহারী করে না কিছু- অবশ্য টিউশনিকে কিছু করার মধ্যে ধরলে, সে অনেক কিছু করে। চারটা টিউশনি কম কথা নয়। বাপ প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট অংকের টাকা পাঠায়। বাপের আশা, ছেলে শহরে থেকে একটা চাকরি ঠিক খুঁজে নেবে। এদিকে বিহারী দিনের বেলাটা শুয়ে বসে কাটিয়ে দিয়ে সন্ধ্যেয় দুইটা টিউশনি করিয়ে জীবনের পাট খতম করে। শনি-সোম-বুধ সন্ধে সাতটায় ঘর থেকে বেড়িয়ে দশটাতে ফেরে। রবি-মঙ্গল-বৃহস্পতি আটটায় বেড়িয়ে এগারোটা। বেশ আছে বিহারী এভাবে। চাকরি তো আর চাইলেই পাওয়া যায় না। সে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোন রকমে পাশ করেছে- তারোপর দুই বছর ধরে বইয়ের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। কে তাকে ডেকে নিয়ে চাকরি দেবে?
কিন্তু সারাজীবন টুইশনি করে কাটিয়ে দেবে না বিহারী। টিউশনি করানো কারও সাথে কোন বাবা তার মেয়ের বিয়ে দেবে না। কেন দেবে? বিহারী ভাবে, কোন মেয়েকে বিয়ে করার যোগ্যতাও তার নেই। সে কেমন পুরুষ! তাছাড়া এভাবে শুয়ে বসে থাকতেও মাঝেমাঝে বিরক্ত লাগে বিহারীর। কিছু একটা করতে ইচ্ছে করে- অথচ করার মত কিছুই খুঁজে পায় না। যেদিন এমন হয়, সেদিন টিউশনিতে মনোযোগ দিতে পারে না বিহারী। ছাত্রের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। অবশেষে ঘরে এসে অসময়ে আধাশরীর ভিজিয়ে প্লান করে সে। শুয়ে শুয়ে প্লান করে। খেতে খেতে প্লান করে। এমন একটা প্লানই এখন সংকল্প হয়ে গিয়েছে বিহারীর।
তার প্লান, সে ব্যবসা করবে। বেকারির ব্যবসা। বাড়িতেই একটা বিস্কুট বানানোর কল বসিয়ে লোক খাটাবে। আর সে নিজে দেখভাল করবে সাপ্লাইয়ের দিকটা। বাজারে একটা বড় দোকান থাকবে- মালের অর্ডার ওখানে বসেই নেবে বিহারী। তার এক বন্ধুর বাবা গত দশ বছরে এই বেকারির ব্যবসা করে কোটিপতি হয়েছে। তাদের বাড়িতে ঢুকলেই এখন চোখ জ্বলে যায়। ঐ বন্ধুর বাড়িতে গিয়েই সে প্রথম টাকার রঙ দেখেছিল সচেতনে।
কোন ব্যবসার জন্য সর্বপ্রথম যেটা দরকার সেটা হলো, বড় অংকের ক্যাশ- যেটা এখন বিহারীর নেই। সে জানে, তার বাপ এব্যাপারে সায় দেবে না। তার বাপ কৃষক মানুষ- ব্যবসার মর্ম কি বুঝবে! বিহারী এখন তাই তার বাপের মরার অপেক্ষা করে আছে। বাপ মরলেই সব জমিজামা আসবে তার নামে। সেখান থেকে কিছু জমি বেচে বেকারিটা শুরু করবে সে। শুরুটা হলেই হলো- তারপর সব তরতর করে এগুবে। মা অবশ্য চেঁচাবে খুব। সে ব্যাপার নয়। দুএকদিন পর ব্যবসার বাড়বাড়ন্ত দেখে নিজেই চুপ মেরে যাবে। মাকে খুব চেনে বিহারী।
এই মেসের মালিক লোকটাকে ভালো লাগেনি বিহারীর। বিহারী প্রায় বছর সাতেক বাড়ির বাইরে। অন্তত ১৫ বার মেস পাল্টেছে সে। কিন্তু কোনবারই মেসমালিককে দেখে তার সুবিধের মনে হয়নি। সবাই কেমন যেন খাই খাই স্বভাবের। চোখ দেখলেই বোঝা যায়, কোন বর্ডারকেই বিশ্বাস করে না তারা। সবাই যেন তাদের চুষে খাওয়ার দিব্যি নিয়েই মেসে থাকতে এসেছে। তবে একদিন মেস ব্যবসা করার প্লানও করেছিল বিহারী। কিন্তু সাথে সাথেই সে চিন্তা দূর করে দিয়েছে। এমন খাটাশ পেশায় জীবনেও জড়াবে না সে।
তার নতুন মেসমালিক লোকটা হুজুর। মাথায় টুপি, পরনে পাঞ্জাবী। গা থেকে ভুড়ভুড় করে ‘মরার বাড়ির’ মত আতরের গন্ধ আসে। চোখে যত্ন করে সুরমা দেয়া। এই টাইপের মানুষগুলাকে দুচোখে দেখতে পারে না বিহারী। গর্বে এদের মাটিতে পা নামতে চায় না। ভাবটা এমন, স্বর্গে তারা অলরেডি সিট বুকিং দিয়ে দিয়েছে; এখন শুধু মরার অপেক্ষা। উপরন্তু আজ লোকটা বলে দিয়েছে, “বাসা ভাড়া আমি অগ্রিম নিব। যে মাসে থাকবেন, সেই মাসের ভাড়া ১ তারিখেই দিয়ে দিতে হবে। বাসা ছাড়তে হলে, দুই মাস আগে বলে রাখতে হবে। আজকে বলবেন, আর কাল তল্পিতোল্পা গোটাবেন- সেটা আমি মানব না। কোন সমস্যা হলে, চিল্লাচিল্লি না করে আমাকে জানাবেন। ঠিক করে দেব। দিনের বেলা অকারণে লাইট জ্বালাবেন না।”
এসব কথা শুনতে শুনতে লোকটার অণ্ডকোষে নাক মুখ খিঁচে সর্বশক্তি দিয়ে লাথি মারতে ইচ্ছে করছিল বিহারীর। একের পর এক লাথি। এমন লাথি, যাতে করে তার লিঙ্গ আজীবনের জন্য ভেল্টে যায় - স্বর্গের সত্তুর হুরের সম্মিলিত ব্লোজবও যেন আর সেটাকে সোজা করতে না পারে। যাতে করে তার বউ তাকে ডিভোর্স দিতে বাধ্য হয়। যাতে করে..................
অবশ্য সব ইচ্ছে পকেটে পুরে হাসি মুখে সবকথারই জবাব দিয়েছে বিহারী। “আচ্ছা ভাই... আচ্ছা...আচ্ছা আচ্ছা...আপনি কোন চিন্তা করবেন না... আচ্ছা...ভাববেন না.........”
বিহারীকে দুইমাসের ভাড়া অগ্রিম দিতে হয়েছে। এনিয়ে তার কোন খেদ নেই। ঘরটা তার মনের মত- আজকাল এমন ঘর অনেক ভাগ্য করলে পাওয়া যায়।
বিকেলের দিকে শাহিন একটা কম্বল গায়ে এসে বলল, “তোর শালা ভাগ্যটা ভালো। গলি ঘুরতেই মেয়েদের মেস। চোখের খিধাটা অন্তত ভালো করে মিটবে।”
শাহিনের কয়েকটা দিক খুব অবাক করে বিহারীকে। এই যেমন, সে এ এলাকার সবগুলো মেসের খবর রাখে। প্রত্যেকটা মেসেই তার পরিচিতি। কোন মেসে কোন রুম ফাঁকা হলো, কার রুমে নিয়মিত মেয়ে আসা-যাওয়া করে, কোন মেসে শিবিরের পোলাপাইন সব ঘাপটি মেরে আছে, কোন মেসের বেটি খাবার চাল চুরি করে বেচে- সব সে মুখস্ত বলতে পারে। প্রত্যেকটা মেসেই কেউ না কেউ আছে তার আত্মীয় বা বন্ধু। বিহারী যে আগের মেস ছেড়ে নতুন মেসে উঠবে, এটা শাহিন জানত। কিন্তু ঠিক কোন মেসে উঠবে সেটা জানতো না- আসলে এখনও কাউকেই কথাটা বলেনি বিহারী। অথচ শাহিন ঠিকই চলে এসেছে খুঁজে বের করে।
শাহিন একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে। টেবিলের উপর থেকে ‘মাসিক রহস্য পত্রিকা’ নিয়ে সূচিতে চোখ বুলায় সে। বলে, “রহস্য পত্রিকা পড়িস এখনো? আমি তো পড়ার মত কিছুই পাই না। সেই এক জীনভূতের গল্প- কোন নতুনত্ব নাই। আর যে ফিচারগুলা ছাপায়, ওমন হাজার হাজার নেট ঘাঁটলে পাওয়া যাবে। বেকার ৪০/৫০ টাকা খরচ করার মানে নাই কোন।”
শাহিনের গায়ের কম্বলটা নীল। বিহারী দেখেছে, ইউনিয়ন পরিষদে প্রতিবছর ঠাণ্ডার সময়ে এমন লাল, নীল, গোলাপি কম্বল সরকার থেকে গবীর মানুষদের দেয়া হয়। পাতলা বটে কম্বলগুলো- তবে গরম আছে। শাহিনের গায়ের কম্বলটা যে রিলিফেরই, সে ব্যাপারে বিহারীর কোন সন্দেহ নেই। তাদের বাড়ির গরু দেখাশোনা করে যে লোকটা, তার গায়ে ঠিক এই কালারের কম্বল দেখেছে বিহারী।
বিহারী জিজ্ঞেস করে, “খয়রাতের কম্বল গায়ে দিছিস যে? এই গরমে কেউ কম্বল গায়ে দেয়?”
“গরম? বলিস কীরে? বসন্ত কালে গরম? আমার তো মনে হচ্ছে, কম্বলটা খুললেই হাইপোথার্মিয়ায় মরবো!”
ডিসকাভারি চ্যানেল ইফেক্ট। বেয়াল গ্রিলসের ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ দেখতে দেখতে সবাই সার্ভাইভাল এক্সপার্ট হয়ে গিয়েছে। এদের ঠাণ্ডা লাগলে হাইপোথার্মিয়া হয়, সামান্য পিপাসা লাগলেই ডিহাইড্রেশন হতে থাকে!
শাহিন পাতা উল্টাতে থাকে রহস্য পত্রিকার। উল্টাতে উল্টাতে একটা পৃষ্ঠায় থেমে গিয়ে পড়তে শুরু করে। অখণ্ড মনোযোগে।
শাহিন স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি খাটো। হাঁটেও একটু খুড়িয়ে। গালের খোচাখোচা কুটকুটে কালো দাড়ি তার মুখটার ৭৫% ঢেকে রেখেছে। তিনমাস না কাটানো চুল কাঁধে। চাইলে অনায়াসে থালা হাতে রাস্তায় বসিয়ে দেয়া যাবে তাকে। প্রতিবন্ধী ভেবে অনেকেই দুটাকা একটাকা ফেলে দেবে থালায়।
“ফয়সাল আসতেছে। তোর মালিক আবার যখন তখন রুমে হানা দেয় না তো?” শাহিন চোখের পাতা রহস্য পত্রিকার পৃষ্ঠা থেকে না সরিয়ে বলে।
বিহারী তার কথার কোন জবাব না দিয়ে টেবিলে ডেক্সটপটা সেট করে। বিছানা থেকে টেবিলটা দূরে হয়ে গেল। বিছানা আর টেবিলের মাঝে সে দুইমাস আগে কেনা ‘নতুন’(!) পাপোশটা রাখবে। ফুলতোলা পাপোশ। পা রাখলেই মনে হয় বিড়ালের গায়ে পা ঘষছে। আরামের অনুভূতিটা সারা গায়ে ছড়িয়ে পরে। আস্তে আস্তে- রান্নার কড়াইতে সয়াবিন তেল ছড়িয়ে পড়ার মত করে। অথচ পাপোশটা সে প্রথমে কিনতে চায়নি। হকারটা খুব করে ধরেছিল বলে, ১১০ টাকায় কিনেছিল একজোড়া।
হকারটা সেদিন বুঝি প্রত্যাশার বাইরে বিক্রি করেছিল। সেই খুশীতেই কিনা কে জানে, সে বিহারীকে একচাপ চা খাইয়েছিল; সাথে একটা গোল্ডলিফের শলাকা। বিহারী হিসেব করে দেখেছে- সিগারেট আর চা- মোট ১৩ টাকা বাদ দিলে, পাপোশজোড়া কিনতে লেগেছে ৯৭ টাকা। একদম ঠগেনী বিহারী এবেলায়।
বিহারী ঠিক করেছে, এবারে একটা ওয়্যারলেস কিবোর্ড আর মাউস কিনবে। বহুদিন থেকে কিনতে চাইছে- কিন্তু কেনা হচ্ছে না। কোনবারই টাকায় কুলোয় না। এবারে হাতে কিছু টাকা জমেছে।
সন্ধ্যের একটু পরপরই ফয়সাল এলো। সে পাশারির দোকান থেকে বাঁশি কিনে এনেছে একটা। খাস এটেলমাটির বাঁশি। বাঁশিটা বিহারীর হাতে দিয়েই গাঁট হয়ে বসেছে বিছানায়। ফয়সাল তাদের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা- প্রায় ছয় ফুটের মত। একটু গম্ভীরও- সে কোন কথা না বলে মোবাইল টেপা শুরু করে দিয়েছে।
ঘর বদলেছে বলে আজ সবগুলো টিউশনি বন্ধ দিয়েছে বিহারী। অনেক রাত অবধি আড্ডা হবে। তারপর একদম শেষ রাতে আলো নিভিয়ে পর্ন দেখেবে তারা। বিহারীর পিসি’তে পর্নের হিউজ কালেকশন আছে। লিসা অ্যান, মিয়া খলিফা, মিয়া মালকোভা, টরি ব্লাক। মেলানিয়া ট্রাম্পের এরোটিক সব পিক কালেক্ট করে কিছুদিন আগে একটা ভিডিও বানিয়েছিলো মিথুন, লুমিয়া স্টোরিটেলার দিয়ে। সেটাও আজ দেখা হবে।
রাত সাড়ে দশটার দিকে শরিফুল আসতেই নাক কুঁচকে শাহিন বলে উঠল, “আজ কি সাপ খেয়ে আসছিস নাকি? মুখ চোখ লাল হয়ে আছে।”
শরিফুল মেঝেতে বসে। একটা পেপারের উপর। বলে, “সাপ খাওয়ার ইচ্ছা একদিন আছে, বন্ধু। সব খাইছি কিন্তু সাপ খাইতে পারলাম না একদিনও।”
ফয়সাল হাসতে হাসতে বলে, “একদিন আমার প্রসাব খেয়ে দেখিস। একেবারে এনার্জি ড্রিংসের স্বাদ পাবি!”
শরিফ এসব কথায় কান না দিয়ে ফেসবুকে কোন এক মেয়েকে নক করে। শরিফ এক ঠাণ্ডা মগজের ছেলে, কেউ কোনদিন রাগ করতে দেখেনি। বিহারীর ফ্রেন্ডজোনের সবচেয়ে অদ্ভুতুড়ে চরিত্র শরিফুলের। সে এমন এক ছেলে যার ক্লোন হয়তো গোটা দুনিয়ায় আরেকটা নেই। কারণ, শরিফুল সব খায়। যা ইচ্ছা হয়, তাই খায়। মাকরাসা, তেলাপোকা, ব্যাঙ, সিগারেটের মোতা, ড্রেনের জল, গাছের পাতা, কাঁঠালের মুচি, পচা ডিম, মুরগীর বিষ্ঠা, আলুর কাঁচা চোঁচা, নিজের প্রসাব, মরা ব্রয়লার মুরগীর রান, গরুর কাঁচা চর্বি। আর সবচেয়ে বেশি খায় গাঁজা। তার হজম ক্ষমতা অবাক করার মত। এতোসব উচ্ছিষ্ট খয়েও কেউ শোনেনি, শরিফের পেট খারাপ করেছে। দিব্যি এসব খেয়ে নাক ডেকে ঘুমাতে পারে সে।
শাহিনেরা ভেবে পায় না, শরিফ ভাত খায় কেন। সে তো এসব খেয়েই জীবন ধারণ করতে পারে!
শাহিনের, ফয়সালের, বিহারীর রাত গভীর হয়। তারা হাসে, ফেসবুকে মেয়েদের প্রোফাইল ভিজিট করে। শরিফ ফেসবুকের মেয়েটার সাথে চ্যাট করতে থাকে। রাত রাতের পেটে আরও ডুকে যায় যেন। আরো কিছুক্ষণ পর, সবগুলো মেসের রুমের গুঞ্জন বন্ধ হলে, যখন অনেক দূরে একটা কুকুরের ডাক শোনা যায়, তারা চারজন গোল হয়ে বসে।
গাঁজার পাতাগুলো আগেই কেটে রেখেছে ফয়সাল। ব্লেড দিয়ে। শরিফুল তার হাত থেকে পাতাগুলো নিয়ে বাঁশিতে পুরে। এরপর অগ্নি সংযোগ করে, টান দিয়ে বলে, “ঝাঁঝ নাই। পাতা কাটা হয় নাই ভালো করে। আরো কুঁচিকুঁচি করে কাটা লাগবে।”
এবারে পাতা কাঁটার দায়িত্ব নেয় শরিফুল নিজেই। বিহারী সারা ঘরে রুমস্প্রে মারতে মারতে বলে, “আজই উঠলাম। মালিক যদি বুঝে যায়, এসেই গাঁজা খাচ্ছি- কাল সকালেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বেড় করে দিবে। ৩৫০০ টাকা গোয়ামারা যাবে এই আমারই। তোদের কী?”
বিহারীর কথায় কেউ দ্বিধা বোধ করে না। শাহিন বলে, “বেড় করে দেয়া এতো সহজ? টাকা পেট থেকে কেমনে বেড় করতে হয় জানা আছে আমার। তাছাড়া উঠার সময় কি মালিক বলে দিছিল যে, রুমে গাঁজা খাওয়া যাবে না? তোর রুম, এখানে তুই গাঁজা খাবি না বাবা খাবি সে তোর ব্যাপার। মালিক কথা বলার কে?”
বিহারী শাহিনের কোন জবাব না দিয়ে আবার বসে। তার চোখ শরিফুলের হাতের দিকে। সে নিবিড়চিত্তে বাবুর্চিরা যেভাবে বেগুন কাটে, সেভাবে গাঁজার পাতা কাটছে। বিহারী চোখ সরায় না শরিফুলের হাত থেকে। সে ব্লেডের ওঠানামা দেখে- দেখে, ব্লেডটা গাঁজার পাতাগুলো কেটে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে।
বিহারীর একটা সিগারেট জ্বালাতে ইচ্ছে করে। পকেট থেকে সিগারেট বেড় করতেই, শরিফুল মাথা তুলে বলে, “গাঁজা খাওয়ার আগে সিগারেট টানা যায় না। পিনিক পাওয়া যায় না পরে। পাতা কাটা শেষ। ডিরেক্ট গাঁজাই খা।”
শরিফুল পাতাগুলো বাঁশিটাতে ভরলে টান দেয় বিহারী। টান দিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকে। এরপর নিমাই করে তারা চারজন। বাঁশিটা ঘুরতে থাকে চারজনের মাঝে। ফয়সাল হয়ে শরিফ, তারপর শাহিনের হাতে পৌঁছে। বাঁশি ঘুরে আসার আগেই, আবার পাতা কেটে জমা করে রাখে শরিফুল তার দক্ষ হাতে। আর বাঁশি ঘুরতে থাকে। গরম হয়ে যায়, এঁটেলমাটির বাঁশিটা। লাল হয়ে যায় তার মেটে চেহারা।
একসময় আসর থেকে উঠে যায় বিহারী। তারপর ফয়সাল, শাহিন। সবার শেষে শরিফুল। তারা বিছানার প্রস্থে শুয়ে পরে একেএকে। চাপচাপ থাকে সবাই। চারজনেই কারোরই আর মনে থাকে না, যে, তারা আজ শেষ রাতে মেলানিয়া ট্রাম্পের ইরোটিক পিকের প্রেজেন্টেশন দেখতে চেয়েছিল।
শুধু বিহারী কিছুক্ষণ পর একবার বলে ওঠে “শালা আমার বাপটা মরলেই ল্যাঠা চুকে যায়। শালার ওর জন্যেই আমার বেকারিটা শুরু হচ্ছে না।”
মোমের মত গলে গলে তাদের চারজনের চোখে নেমে আসে ঘুম।
রাতটা শেষ হয়ে আসে। সূর্য ওঠে। কিন্তু ওদের ঘরে আলো প্রবেশ করতে পারে না। শুধু ২৬ পাওয়ারের এনার্জি বাল্বটা ফকফক করতে থাকে।
১৯ মার্চ, ২০১৭
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মার্চ, ২০১৭ রাত ৩:২৮
১১টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবনের গল্প

লিখেছেন ঢাকার লোক, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৩৫

মাত্র মাস দুই আগে আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা আমার এক বোনের বাড়ি। তার স্ত্রী মারা গেছেন তার সপ্তাহ দুই আগে। মক্কায় উমরাহ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমান

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:১২

" অভিমান "

তোমার ঠোঁটে বোল শিখেছি
তুমি আমার মা, কেমন করে
ভুলছ আমায় বলতে
পারিনা। এমন করে চলে
গেলে, ফিরে ও এলেনা। হয়তো
তোমার সুখেই কাটছে দিন,
আমায় ভাবছ না।

আমি এখন সাগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×