বিকাশ থেকে টাকা তোলা আর ফ্লাক্সি লোডের জন্য একটা দোকানেই প্রতিবার যাই। ভাই বলে ডাকি দোকানের মালিককে। সারাদিন তিনিই বসে থাকেন দোকানে। কোন সহযোগী নেই, অথচ দোকানটাও ছোট নয়। কাস্টোমার লেগেই থাকে সবসময়। বিকাশ আর ফ্লাক্সি’র সাথে অন্যান্য জিনিসও আছে। যেমন- সাবান, জেল, ফেসওয়াস, ব্যাটারি, কার্ডরিডার, ব্রাশ-পেস্ট ইত্যাদি। প্রচণ্ড ভালো ব্যবহার। হেসে কথা বলেন সবসময়।
আটমাস থেকে টানা যাচ্ছি বলে খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে গিয়েছে আমার সাথে। আমি ভেবেছিলাম অবিবাহিত। কিন্তু পরে ভেবে দেখেছি, বাঙালি ছেলেরা পড়া ছেড়ে কাজে নেমে পড়লেই বিয়ে করে বসে। নিজের ইচ্ছায় নয়তো পরিবারের চাপে। সে হিসেবে তার দুই তিনটা বাচ্চা থাকার কথা। বাচ্চাগুলা হয়তো ভর্তিও হয়েছে স্কুলে। জিজ্ঞেস করিনি কোনদিন।
আজ বন্ধুর কাছে শুনলাম, তার বৌ নাকি ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে অনার্স শেষ করেছে। তাদের বিভাগে প্রথম বিভাগে পাস করেছে মাত্র তিনজন- সে সহ। আর তার ছেলে পড়ছে ক্লাস থ্রিতে!
টাস্কি খেয়ে গেলাম রীতিমত। এতোটা আশা করিনি আমি। ছেলে ক্লাস থ্রিতে পড়ে, আর মা শেষ করলো পড়া; তারমানে মেয়েটার বিয়ে হয়েছে ক্লাস সিক্সসেভেনেই। তের-চৌদ্দ বছর বয়সে!
জিজ্ঞেস করলাম, “তুই কীকরে জানিস?”
-আজ দোকানে গেলাম। বলছিল একজনকে। শুনলাম বলছে, “পড়াশুনার খুব শখ। তো পড়া চালায় যাইতে বললাম। আমি তো নিজে ইন্টারও পাশ করতে পারি নাই। ওকে পড়াতে ভালো লাগে। মনে হয় নিজেই পড়ছি। রেজাল্টও ভালো করছে- মনে হচ্ছে কষ্টটা সার্থক।”
অবাক হয়ে শুনে যাচ্ছিলাম শুধু। সে বলছিল। আমার মনে হচ্ছিল, লোকটার ফ্যান হয়ে গেছে সেও। আমার মতো।
এতক্ষণ লোকটার কথাই ভাবছিলাম। আমাদের দেশে বিয়ের পর মেয়েরা পড়ালেখার সুযোগ পায় খুব কমই- তাও স্বামী শিক্ষিত হলে। বেশিরভাগ সময়ই, বিয়ের পর মেয়েরা সাংসারিক চাপ, উৎসাহের অভাব- ইত্যাদি মেলা কারণে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারে না। বাচ্চা হলে তো কথাই নেই। আমি তো এক চল্লিশ বছরের শিক্ষকেও চিনি, যে চল্লিশ বছর বয়সে মেয়ের বয়সী ১৭ বছরের একজনকে বিয়ে করেছে। যতদূর জানি লেখাপড়া করছে না মেয়েটা।
এমন প্রেক্ষাপটে, এই চিত্র সত্যিই বিস্মিত করে। ভাবায়। থমকে যেতে হয়, এমন লোকগুলোর সামনে। ইচ্ছা করে একটু কথা বলি- কথাচ্ছলে প্রশংসা করি একটু। কিন্তু হয়ে ওঠে না। হয়তো লজ্জায়।
কথাটা শোনার পর লোকটার সাথে দেখা হয়েছে কয়েকবার। দরকারে। প্রতিবার তার হাসি দেখেছি মুখে। প্রতিবারই মনে হয়েছে, সত্যিই হাসিটা সুন্দর লোকটার। নির্মল।
২
বই পড়ার অভ্যাসটা ঠিক কবে শুরু হয়েছিল জানি না, তবে মনে আছে ক্লাস স্যাভেনে পড়ার সময় বৃত্তির টাকা পেয়ে প্রথম বই কিনেছিলাম। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’। বইটা এতোই ভালো লেগেছিল যে, এরপর আর বই পড়া ছাড়তে পারিনি। যেখান থেকে পারি, যেভাবে পারি বই সংগ্রহ করে পড়েছি। বিভূতিভূষণের আত্মজীবনী পড়ে কিনা কে জানে, একসময় ইচ্ছে হয়েছিল লেখক হওয়ার। কল্পনা করতে ভালো লাগত, আমার বই বেড় হচ্ছে, পাঠক পড়ছে, নামী সাহিত্য পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হচ্ছে, বিভিন্ন সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিচ্ছি- ইত্যাদি। এসব ভাবতেও এখন লজ্জা লাগে।
আজ সন্ধ্যায় নিজের সংগ্রহ করা বইগুলো দেখছিলাম। সংকল্প করেছিলাম, কিনেছি এমন বই পড়ব। কিন্তু ৩০০ বইয়ের ভিড়ে নিজের টাকায় কেনা বই একটাও খুঁজে পেলাম না! সব কোন না কোন লাইব্রেরী থেকে আনা। কিছু বই বন্ধুর থেকে ধার করে আনা। কিছুদিন আগে পর্যন্ৎ, কোথাও গেলে সেখানে পাবলিক লাইব্রেরী আছে কিনা খোঁজ করতাম। যদি থাকতো, তবে লাইব্রেরী কার্ড করে, কয়েকটা বই পড়ার জন্য নিয়ে চম্পট দিতাম। আমি এপর্যন্ত অন্তত ২৫ টা লাইব্রেরীতে রেজিস্ট্রেশন করেছি। একই লাইব্রেরীতে বিভিন্ন নামে রেজিস্ট্রেশনও করেছি কয়েকবার। ভাগ্যিস, আমার চেহারাটা মনে রাখার মত নয়। তেমন হলে, ধরা খেয়ে যেতাম নির্ঘাত।
যাক গে, বলছিলাম, লেখক হওয়ার বাসনার কথা। পেশাদার লেখক হওয়ার ইচ্ছে ছিল। এখন সে ইচ্ছে ছুটে গিয়েছে। বিভূতিভূষণেরই আত্মজীবনী পড়ে জেনেছি, তিনি জীবন চালানোর জন্য মাস্টারি থেকে শুরু করে হেন চাকরি নেই করেননি। ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ লেখার পর তো সে সময়ে রব উঠেছিল, তিনি হোটেলের ব্যবসাও শুরু করেছেন!
আসলে কোন বাঙালি লেখকের পক্ষেই লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নেয়া সম্ভব নয়। দুই বাঙলার প্রখ্যাত লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতাকে। শামসুর রাহমান সাংবাদিকতা করেছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি হওয়ার পরও। লেখার মান যেমনই হোক, ইমদাদুল হোক মিলন বা আনিসুল হকের বই প্রচুর বিক্রি হয় বলে জানি। তারাও লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নিতে পারেননি। ইমদাদুল হক মিলন, এখন কালের কণ্ঠের সম্পাদক; আনিসুল হক প্রথম আলোর সাথে কীভাবে যেন জড়িত।
এর কারণ হয়তো, আমার মত পাঠকেরাই- যারা বই কেনে খুব কম। কিনলেও বছরে গন্ডাখানেক এর বেশি নয়। একজন হার্ডকোর পাঠকের (আমি এর মধ্যে পরি না) সপ্তাহে অন্তত দুইতিনটা বই লাগে। তারা হয়তো বই কেনে, কিন্তু সাধারণ পাঠকের মাঝে বই কিনে পড়ার স্বভাবের অভাব আছে। এতে তো অপাঠ্য (সিলেবাসের পাঠ্য তালিকায় নেই বলে বলছি) বই, তার উপর যদি টাকা দিয়ে কিনে পড়তে হয়, তাহলে বই পড়ার দরকারটাই বা কী!
কিছুদিন আগে, উইকিপিডিয়ায় পড়লাম, সিডনি শেলডনের ১৮ টি উপন্যাসের মোট বিক্রির পরিমাণ ৩০০ মিলিয়ন কপি! ড্যান ব্রাউনের একেকটি বই কয়েক কোটির বেশি কপি বিক্রি হয়। ভাবি, ড্যান ব্রাউন বাঙালি লেখক হলে কত কপি বিক্রি হতো। বড় জোর দুই তিন হাজার কপি! তার বেশি একটাও নয়।
ইংরেজি বইয়ের পাঠক সারাবিশ্ব জুড়ে আছে, বই বেশি বিক্রির এটা একটা কারণ হলেও, সবচেয়ে বড় কারণটা হলো সেসব দেশের মানুষের বই কেনার প্রবণতা। সব লেখকই তো বিশ্বব্যাপী খ্যাতি পায় না, অথচ খুব কম পরিচিত লেখকের বইও কয়েক লাখ কপি বিক্রির রেকর্ড আছে। Me before You নামের মাঝারি মানের একটা আমেরিকান উপন্যাস পড়লাম কয়েকদিন আগে- এমন লেখা ইমদাদুল হক মিলন হয়তো মাসে দুইটা তিনটা করে লিখতে পারবেন। অথচ বইটা লাখেরও বেশি পাঠক কিনেছে!
হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া আর কেউ শুধু লেখাকে পেশা হিসেবে নিয়ে খুব ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পেরেছেন বলে শুনিনি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কিছু করতেন না। একসময় ব্যবসা করতেন- সেটাও ছেড়ে দিয়ে লেখালেখিতে পুরো মনোনিবেশ করেছিলেন। লিখেছিলেনও প্রচুর অল্প সময়েই। কিন্তু তার লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নেয়ার ফলাফল আমরা জানি। অর্থকষ্টে মরতে হয়েছে তাকে।
আজ সন্ধ্যায় নিজের কেনা বইয়ের কথা বলছিলাম। হ্যাঁ, পেয়েছি বটে একটা। বুদ্ধদেব গুহের ‘দশম প্রবাস’। তার কানাডা ও আমেরিকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা অনবদ্য এক ভ্রমণবৃত্তান্ত। বইটার ২য় অধ্যায়ে খুব ছোট করে, বাঙালি লেখকের দুঃখের কথা বলেছেন। লিখেছেন, “আমি যে বাঙালি লেখক। হতভাগ্য। ইংরেজিতে লিখলে, সে লেখা যেমনই হোক না কেন, আমি কোটিপতি হতে পারতাম। অতি নিচের স্তরের ইংরেজি লেখকও আমার মত বাঙালি বেস্ট সেলারকে চাকর রাখতে পারে।”
বুদ্ধবেদ গুহের মত বিখ্যাত লেখক যখন এমন কথা বলেন, তখন লেখক হওয়ার ইচ্ছেটা মরে যায়। অবশ্য, আমার সে ইচ্ছা আগেই মরে গিয়েছিল, যখন বুঝেছিলাম, যাই লিখছি সব ভাগাড়ে যাওয়ার মত। আমি না লিখলেই বরং কিছু জঞ্জালের হাত থেকে বাংলা সাহিত্য রক্ষা পাবে।
তবে, লেখক হতে না পারি, পাঠক হবো অন্তত। খুব ভালো পাঠক- যে বই কিনে পড়ে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মার্চ, ২০১৭ রাত ১২:১৭