রবীন্দ্রনাথের যেকোন রচনা পড়ার সবচেয়ে বড় সমস্যাটা হলো, তার সম্মোহন করার বিপুল ক্ষমতা। তার কলমের প্রতিটি শব্দ এমন করে পেচিয়ে ধরে যে, এর বাইরে কিছু চিন্তা করার অবকাশ পাওয়া মুসকিল হয়ে যায়। বিশ্বসাহিত্যের প্রতিষ্ঠাতা, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তার কোন এক প্রবন্ধে* বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তার সুললিত অশ্রুতপূর্ব গদ্যে এমন এক জাল রচনা করেন, যা তার সমস্ত চিন্তাধারাকেই সুর্যালোকের মত সত্য হিসেবে মেনে নিতে পাঠককে বাধ্য করে। আবদুল্লাহ আবু সায়িদের সে সমালোচনা আমার ‘রবীন্দ্রবিদ্বেষ’ বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন রবীন্দ্রসাম্রাজ্যে পথভোলার মত হাঁটতে গিয়ে বুঝতে পারছি, তার সে সমালোচনা ছিল কতোটা যথাযথ।
পাঠককে সম্মোহিত করতে পারার ক্ষমতাকে সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখার অবশ্য কোন কারণ নেই। বিশেষত যখন পাঠককে ধরে রাখতেই অনেক লেখকের চোখের জল নাকের জল এক হয়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথের রচনার পরিমাণ পৃষ্ঠায় গোণার মত নয়। আশি বছরে বিশাল জীবনের ফলাফল রক্ষিত তার রচনাবলীর ৩০টি খন্ডে। তার কলম বিরাম চিহ্ন খুঁজে পায়নি মৃত্যুশয্যাতেও। কবিতা আর কথাসাহিত্য বাদ দিয়ে যদি প্রবন্ধগুলো নিয়েও আলোচনা করতে যাই, তাতে হাজার পৃষ্ঠা লেগে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। বাঙালীর জীবনের খুব কম বিষয়ই আছে, যে ব্যাপারে তিনি একটু হলেও তিনি কলম ধরেননি। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাপারগুলো নিয়েও তিনি ভেবেছেন, কিঞ্চিৎ হলেও সে ভাবনা তুলে রেখেছেন তার রচনাবলীর এখানে সেখানে। তার প্রবন্ধগুলো একমুখী নয়- চারিদিকে খানিকটা ছড়ানো ছিটানো। পল্লিউন্নয়ন নিয়ে তিনি লিখতে গিয়ে প্রসঙ্গত এঁকেছেন সমাজের অজাচারচিত্র; শিক্ষা নিয়ে লিখতে গিয়ে এনেছেন স্বদেশীআন্দোলন। নিজের কলমকে বাঁধা দেননি তিনি, স্বেচ্ছাচারীর মত তাকে যেতে দিয়েছেন যেদিকে ইচ্ছে।
সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ’ এর সমালোচনাকালে রবীন্দ্রনাথ লেখালেখির সাথে তুলনা দিয়েছিলেন গৃহিণীপনার। তার উপমাই ধার করে বলতে হয়, লেখালেখির রসুইঘরে রবি ঠাকুরের যেমন ছিল ঐশ্বর্য, তেমনি ছিল গিন্নীপনা। ভালো রান্নার মত, তার রচনার কুটোটি পর্যন্ত ফেলার উপায় নেই।
সাহিত্যের প্রতি আমার অনুরাগ যখন অঙ্কুরিত হচ্ছিল কেবল, ঠিক তখনি একজন শিক্ষকের সাথে পরিচয় হয়েছিল আমার। তাকে সাহিত্য সম্পর্কিত যে কোন প্রশ্ন করতে আটকাত না। তিনি তার জবাবও দিতেন সাধ্যমত। মূলত তার সাথে সম্পর্কটা আমার ছাত্র-শিক্ষকের ছিল না। তিনি কবিতা লিখতেন আর আমি ছিলাম তার কবিতার হার্ডকোর ভক্ত। বেশীরভাগ সময় সেসব সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া কবিতার প্রথম পাঠকও। তারই এক ছাত্রের বাড়ির বাইরের ঘরে ভাড়া থাকতেন তিনি। আমার রুটিন ছিল, সন্ধ্যায় পড়ার টেবিলে বসার আগে, অন্তত একবার হলেও তার মুখদর্শন করে আসা। খুব রসিক মানুষ ছিলেন না তিনি; সবকিছুই ছিল গৎবাঁধা। কিন্তু যেটুকুর টানে যেতাম, সেটা ছিল তার অফুরন্ত। কোনদিন তাকে প্রশ্ন করে, রিক্তমনে ফিরে আসতে হয়নি আমাকে। আমার সব প্রশ্নগুলিই যেন তিনি আগে থেকে জেনে যেতেন কোনভাবে। উত্তর পেলাম যথাযথ। আর ছিল ঘরভর্তি বই। মার্ক টোয়েনের বাঙালী সংস্করণ যেন। বিছানায়, মেঝেতে, টেবিলে, বালিশের নিচে, টিভির উপরে বই পড়ে থাকতো। অবশ্য সেসব তিনি টোয়েনস্টাইলে সংগ্রহ করেছিলেন কিনা, সে ব্যাপারে জিজ্ঞেস করিনি।
একদিন ক্লাস নিচ্ছিলেন স্যার। হঠাতই আমাদেরই কোন এক সহপাঠী তাকে জিজ্ঞেস করে বসলো, “স্যার, বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গল্পকার কে?”
সেসময়ে স্যারের প্রভাবেই আমরা বিভূতিভূষণ, মানিক, জীবনানন্দ পড়তে শুরু করেছিলাম। আমাদের কৌতূহলী মনে এমন প্রশ্ন জাগা তাই অস্বাভাবিক ছিল না।
তিনি নিঃদ্বিধায় জবাব দিয়েছিলেন, “মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়!”
স্যারের উত্তরে গুঞ্জন উঠেছিল ক্লাস জুড়ে। গুঞ্জনগুলোর যোগজীকরণ করলে যে প্রশ্নটা পাওয়া যায়, সেটা হলো, “মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কি তবে রবীন্দ্রনাথের চাইতেও বড় গল্পকার?”
এ প্রশ্নটাও তিনি হয়তো আগেভাগেই জেনে গিয়েছিলেন। নুরুল ইসলাম নাহিদ আমার মস্তিষ্কপ্রসূত প্রশ্নের দায়ভার বহন করতেন না। কোন প্রিন্টারে ছাপতেও দেয়া হত না সেসব। তা সত্ত্বেও কীকরে আমাদের সব প্রশ্ন তিনি আগেভাগেই জেনে নিতেন, সেটা নিয়ে গবেষণা করা যেত।
তিনি বলেছিলেন, “আমরা যখন ‘কে সেরা’ টাইপ আউলফাউল বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো, তখন রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়েই করবো। কে সেরা তাতে কিছু যায় আসে না। মানিক বন্দো’র জায়গায় আমি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা বিভূতির নাম বললে, মানিকের সাহিত্যমান একফোঁটা কমত না। কিন্তু তারপরও যদি এমন প্রশ্ন উঠে, উত্তরে বারবার নিশ্চয়ই একজনের নাম শুনতে কারো ভালো লাগবে না! রবি ঠাকুরকে বাদ দিয়ে ‘কে সেরা?’, সে তুলনাটা করা যেতে পারে। আমি বলেছি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সেরা গল্পকার। এর মানে, অন্তত আমার মতে, রবীন্দ্রনাথ বাদে যত বাঙালী গল্পকার আছেন, তাদের মধ্যে মানিক একনম্বর।”
স্যারের এই কথাটা মনের জ্বলজ্বল করে এখনো। রবীন্দ্রনাথের বিশালতা বোঝাতে এর চাইতে ভালো ব্যাখ্যা আর কী হতে পারে?
সেই রবীন্দ্রনাথই আত্মজীবনী পড়তে বসেছিলাম গতকাল। ঠিক করেছি, আজ লিখবো সেটা নিয়েই। একজন মুগ্ধ পাঠকের দ্বারা সাহিত্যসমালোনা করা সম্ভব নয় হয়তো- রবীন্দ্রসমালোচনার সামর্থ্যও নেই আমার। তাই লেখাটাকে সমালোচনা কিংবা রিভিউ না বলে, কয়েকপাতার প্রশংসাপত্র বললে, ভুল বলা হবে না।
অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদ ‘রবীন্দ্রপ্রবন্ধ/ রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা’ নামের একটা বই লিখেছিলেন, অনেক কাল আগে। সেবইয়ের ভূমিকাংশে তিনি বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রালোচনার একটি বড় বিপদ রবীন্দ্রনাথের অনন্য, লোভনীয় রচনাপ্রকৌশল। কবি রবীন্দ্রনাথই কেবল সমালোচককে বারবার উদ্ধৃতিদানে প্রলুব্ধ করে তোলেন, তা নয়, রাষ্ট্র ও সমাজ চিন্তাবিদ রবীন্দ্রনাথও তা করেন। তিনি তার বক্তব্যকে এতোটা লোভনীয় ভাষায় ব্যক্ত করেন যে, সমালোচকের নিজের ভাষার প্রতি মায়া হয়, করুণা জাগে। এবং পরিশেষে রবীন্দ্রনাথেই আশ্রয় নিতে হয়।”
আমার বেলাতেও এটা হতে বাধ্য। লেখাটা তাই উদ্ধৃতিময় হলে, আমাকে অপরাধী বলে কাঠগড়ার দাঁড় করাতে পারবেন না। এ দোষে সবাই দোষী।
২
আত্মজীবনী অনেক কারণে গুরুত্বপূর্ণ- কিন্তু লোক ভেদে ভিন্ন হয় প্রত্যাশার মাপকাঠি। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে সাহিত্যমান খুঁজে বেরানোটা বাতুলতা, ঠিক তেমনি হিটলারের ‘মাইন ক্যাম্পে’ আমি অনুপ্রেরণার আশা করতে পারেন না। তাদের আত্মজীবনী প্রয়োজনীয়, ইতিহাস তাদের দাবী করে। কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকানো তো সাহিত্যিকের কাজ নয়। সাহিত্যিকের আত্মজীবনী প্রয়োজনীয়- এমনটা ভাবারও কারণ নেই। তারা আত্মজীবনী প্রকাশ করেন নিজেকে প্রকাশ করার ইচ্ছায়, কখনো বা পাঠকপ্রিয়তা বিচারে প্রকাশকের তাগিদে। যেখানে প্রয়োজনীয়তা থাকে না, সেখানেই বরং রঙ একটু বেশি চড়া। বিয়ে বাড়িতে বাজি ফাটানোর প্রয়োজন কেউ বোধ করে বলে মনে হয় না। কিন্তু বিয়ের কোলাহলের চেয়ে সেটার আওয়াজই বেশি দূর পৌঁছে। তেমনি সাহিত্যিকের আত্মজীবনী অপ্রয়োজনীয়- তাই সেটার রঙ চাই একটু বেশী। এই চোখ ঝলকানো রঙটা সাহিত্যমান; এটা না থাকলে, সাহিত্যিকের আত্মজীবনীর কানাকড়িও মুল্য নেই।
এই ব্যাপারটা রবি ঠাকুর ধরতে পেরেছিলেন; তাই তিনি আত্মজীবনী লিখতে গিয়ে ঐতিহাসিক হতে চাননি। আত্মজীবনী যাতে এনসাইক্লোপিডিয়া না হয়ে সাহিত্য হয়, সেদিকে নজর দিয়েছিলেন বেশী।
“এই স্মৃতির মধ্যে এমন কিছুই নাই যাহা চিরস্মরণীয় করিয়া রাখিবার যোগ্য।...... নিজের স্মৃতির মধ্যে যাহা চিত্ররূপে ফুটিয়া উঠিয়াছে তাহাকে কথার মধ্যে ফুটাইতে পারিলেই তাহা সাহিত্যে স্থান পাইবার যোগ্য। ...এই স্মৃতি-চিত্রগুলিও সেইরূপ সাহিত্যের সামগ্রী। ইহাকে জীবনবৃত্তান্ত লিখিবার চেষ্টা হিসাবে গণ্য করিলে ভুল করা হইবে। সে হিসাবে এ লেখা নিতান্ত অসম্পূর্ণ এবং অনাবশ্যক।”
-ভূমিকা/ জীবনস্মৃতি
রবি ঠাকুরের জীবনীকারদের এই গ্রন্থ যে খুব বেশী সহায়তা করতে পারেনি, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
৩
“আমাদের একটি অনেক কালের খাজাঞ্চি ছিল, কৈলাস মুখুয্যে তাহার নাম। ........ লোকটি ভারি রসিক।...... বাড়িতে নূতনসমাগত জামাতাদিগকে সে বিদ্রূপে কৌতুকে বিপন্ন করিয়া তুলিত। মৃত্যুর পরেও তাহার কৌতুকপরতা কমে নাই এরূপ জনশ্রুতি আছে। একসময়ে আমার গুরুজনেরা প্ল্যাঞ্চেটযোগে পরলোকের সহিত ডাক বসাইবার চেষ্টায় প্রবৃত্ত ছিলেন। একদিন তাহাদের প্ল্যাঞ্চেটের পেন্সিলের রেখায় কৈলাস মুখুয্যের নাম দেখা দিল। তাহাকে জিজ্ঞাসা করা হইল, তুমি যেখানে আছ সেখানকার ব্যবস্থাটা কিরূপ, বল দেখি। উত্তর আসিল, আমি মরিয়া যাহা জানিয়াছি, আপনারা বাঁচিয়াই তাহা ফাঁকি দিয়া জানিতে চান? সেটি হইবে না।”
-শিক্ষারম্ভ/জীবনস্মৃতি
রবি ঠাকুরের গানগুলো শুনে, কবিতাগুলো পড়ে তার গম্ভীর দিকটার পরিচয় পাওয়া যায় মাত্র। তিনি যে খুব রাশভারী- এই ধারণাটা নিউরনে গেঁথে যায়, বিভিন্ন সময়ে তোলা তার স্থিরচিত্রগুলো দেখে। তিনি দাঁত বের করে খ্যাঁকখ্যাঁক করে না হোক, অন্তত গোঁফ ফাঁক করে মুচকি হাসছেন- এমন পিক আছে বলে মনে হয় না। থাকলেও আমার চোখে পড়েনি। এইতো কিছুদিন আগেও, যখন হাতে হাতে মোবাইল ছড়িয়ে যায়নি, স্টুডিয়োতে গিয়ে ছবি তুলতে হতো; তখনো সবাই মুখ বন্ধ করে ‘মা-মরা’ মুখে পোজ দিত। কেউ ছবি তোলার আনন্দে একটু হাসলে, ক্যামেরাম্যানের টাইট গলায় শোনা যেত, “ঠোঁট ফাঁক করে আছেন কেন? বন্ধ করুন!”
কোটটাই পরা টাকওয়ালা মাথার সৈয়দ মুজতবা আলীর স্টিলফোটগুলো দেখে কে বুঝবে, তিনি জন্মরসিক ছিলেন?
রবীন্দ্রনাথের হিউমরের পরিচয় মূলত পাওয়া যায় তার গদ্যে। বিশেষ’করে তার ছোটগল্পে। পাঠক গলা ছেড়ে তারা সপ্তকে হাসবে, এমন রচনা তিনি লেখননি। তবে ঠোঁটের কোণে হাসি লেগে থাকার মত রচনা তার বেশুমার।
এই প্যারার শুরুতে জীবনস্মৃতি থেকে যে অংশটা তুলে দিয়েছি, সে অংশটা না লিখলে কোন ক্ষতি ছিল না। তার সাহত্যিক জীবনে কৈলাস মুখুয্যের কোন অবদান নেই। তার ঘটনাবহুল জীবনে এর চাইতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে, যার বেশীরভাগকেই তিনি আত্মজীবনীতে স্থান দেননি। তিনি পাঠককে নিঃশ্বাস নেয়ার জায়গা তৈরি করে দিয়েছিলেন, এই ছোটছোট হাস্যরসাত্মক ব্যাপারগুলো তুলে ধরে। পাঠককে ধরে রাখার এএক অনন্য কৌশল। বিজ্ঞানের কোন জটিল বিষয় বোঝানোর সময়, শিক্ষকেরা যেমন ছাত্রের ঘুমভাব দূর করতে মাঝেমাঝে রসিকতা করেন, এ যেন তাই।
৪
জ্ঞানদানন্দিনী’র আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, সারদা সুন্দরী দেবীর সাথে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের যখন বিয়ে হয়, তখন তিনি মাত্র ছয় বছরের বালিকা। ঠাকুরেরা পিরালি ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাদের কোন পূর্বপুরুষকে মুসলমান হয়েছিলেন বলে, ব্রাহ্মণ সমাজ থেকে বের করে দেয়া হয় তাদের। পিরালী ছিল বলেই হয়তো, সারদা দেবীর পিতামাতার ইচ্ছে ছিল না, ঠাকুর পরিবারের সাথে সম্পর্ক গড়ার। সারদা দেবীর বিয়েটা তাই হয়, তার মায়ের অমতেই। জ্ঞানদানন্দিনীর মতে, এই শোকেই কাঁদতে কাঁদতে মৃত্যুবরণ করে সারদা দেবীর মা।
"আমার শাশুড়ীর (মহর্ষির স্ত্রী) রং খুব সাফ ছিল। তাঁর এক কাকা কলকাতায় শুনেছিলেন যে, আমার শ্বশুরমশায়ের (মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর) জন্য সুন্দরী মেয়ে খোঁজা হচ্ছে। তিনি দেশে এসে আমার শাশুড়ীকে (তিনি তখন ছয় বৎসরের মেয়ে) কলকাতায় নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিয়ে দিলেন। তখন তাঁর মা বাড়ী ছিলেন না—গঙ্গা নাইতে গিয়েছিলেন। বাড়ী এসে, মেয়েকে তাঁর দেওর না বলে-কয়ে নিয়ে গেছেন শুনে তিনি উঠোনের এক গাছতলায় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে লাগলেন। তারপর সেখানে পড়ে পড়ে কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয়ে মারা গেলেন।"
- স্মৃতিকথা, জ্ঞানদানন্দিনী দেবী।
এই সারদা দেবীই পরবর্তিতে জন্ম দেন বাংলার কিছু শ্রেষ্ঠ প্রতিভাকে।
রবি ঠাকুর তার মা সারদা দেবীর সংস্পর্শ খুব বেশী পেয়েছিলেন বলে মনে হয় না। ঠাকুরবাড়ির রীতি অনুসারে ছোট ছেলেদের দায়িত্ব থাকতো ভৃত্যদের উপর। তারাই করত সব দেখাশোনা। বিশ্ব কবি যে তার মায়ের আদর খুব বেশী পায়নি, তার প্রমাণ পাওয়া যায়, জীবনস্মৃতি থেকেই। শৈশবের তার যারা দেখাশোনা করত, সেই ভৃত্যদের নিয়ে ‘ভৃত্যরাজক তন্ত্র’ নামের আস্ত একটা অধ্যায় লিখেছেন তিনি। কিন্তু মায়ের জন্য আলাদা কোন প্যারা পর্যন্ত লিখেননি। প্রসঙ্গত যে কয়েকবার তার মায়ের কথা এসেছে, তাতে একবারও মনে হয়নি, পুত্রের প্রতি স্নেহশীলা ছিলেন তিনি।
৫
“হরিণ শিশুর নূতন শিং বাহির হইবার সময় সে যেমন যেখানেসেখানে গুঁতো মারিয়া বেড়ায়, নূতন কাব্যোদ্গম লইয়া আমি সেই রকম উৎপাত আরম্ভ করিলাম। বিশেষতঃ আমার দাদা আমার এই সকল রচনায় গৰ্ব্ব অনুভব করিয়া শ্রোতাসংগ্রহের উৎসাহে সংসারকে একেবারে অতিষ্ঠ করিয়া তুলিলেন।”
-জীবনস্মৃতি
রবি ঠাকুরের বিশ্বকবি হওয়ার পিছনে তার প্রতিভার পর আর কিছুর হাত যদি থেকে থাকে, সে তার পরিবার। তার সর্বগ্রাসী প্রতিভা এতো অকপটে প্রকাশিত হয়তো হতো না সে পরিবারের পটভূমি না পেলে। পুরো পরিবারটাই ছিল সাহিত্যের পাঠশালা। তার দাদারা সবাই ছিলেন কোন না কোন ভাবে সাহিত্যের সাথে জড়িত। দেবেন ঠাকুর নিজেই ব্রাহ্মসঙ্গীত লিখতেন। পুরো ভারতবর্ষ থেকে গুণী সংগীত শিল্পীরা ঠাকুর বাড়িতে এসে থেকে যেতেন কিছুদিন। এর চেয়ে ভালো সাহিত্যিক পরিবেশ আর কী হতে পারে?
খুব অল্প বয়সে লিখতে শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি যে কবি, এটা প্রচারও করতেন সগর্বে। তার দাদারা তার এতো বেশী প্রশংসা করতেন যে, কেউ তার সমালোচনা করলেই তিনি ভেবে নিতেন, লোকটা কবিতা বোঝে না!
“একদিন ছুটির সময় তাঁহার ঘরে (নর্মাল স্কুলের রাশভারী শিক্ষক গোবিন্দবাবুর ঘরে) আমার হঠাৎ ডাক পড়িল। আমি ভীতচিত্তে তাঁহার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইতেই তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি নাকি কবিতা লেখ।” কবুল করিতে ক্ষণমাত্র দ্বিধা করিলাম না। মনে নাই কী একটা উচ্চ অঙ্গের সুনীতি সম্বন্ধে তিনি আমাকে কবিতা লিখিয়া আনিতে আদেশ করিলেন।”
রবির শিক্ষার ব্যাপারে তার অবিভাবকেরা একটুও হেলা করেননি। বলা বাহুল্য, তারা এব্যাপারে হেলা করলেই ভাল করতেন। কারণ আদিম কাল থেকেই, আমাদের পিতামাতা আমাদের সর্বশিক্ষায় শিক্ষিত করতে গিয়ে শেষে শিক্ষার স্পৃহাটাই নষ্ট করে দেন।
“ইস্কুলে আমাদের যাহা পাঠ্য ছিল বাড়িতে তাহার চেয়ে অনেক বেশি পড়িতে হইত। ভোর অন্ধকার থাকিতে উঠিয়া লংটি পরিয়া প্রথমেই এক কানা পালোয়ানের[৫] সঙ্গে কুস্তি করিতে হইত। তাহার পরে সেই মাটিমাখা শরীরের উপরে জামা পরিয়া পদার্থবিদ্যা, মেঘনাদবধকাব্য, জ্যামিতি, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল শিখিতে হইত। স্কুল হইতে ফিরিয়া আসিলেই ড্রয়িং এবং জিম্নাস্টিকের মাস্টার আমাদিগকে লইয়া পড়িতেন। সন্ধ্যার সময় ইংরেজি পড়াইবার জন্য আঘোরবাবু আসিতেন। এইরূপে রাত্রি নটার পর ছুটি পাইতাম।”
-জীবনস্মৃতি
এতো শিক্ষার আয়োজন যে কোন কাজে লাগেনি, সেটা তার জীবন পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়।
বাংলা সাহিত্যের অনেক নব দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তার দেখানো পথ অনুসরণ করেই আজ বাংলা আসতে পেরেছে এতো দূরে। তবে তার সব দিক বাংলার সাহিত্যিকেরা অনুসরণ করতে পারেননি। কুস্তি তাদের অন্যতম। তিনি বাংলার একমাত্র সাহিত্যিক, যিনি কুস্তি শিখেছেন ও করেছেন!
(রবীন্দ্রনাথের কুস্তি নিয়ে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটা কাল্পনিক গল্প আছে। এই মুহূর্তে নাম মনে পড়ছে না।)
৬
যাক, অনেক কথা বললাম। আসলে গোটা বইটা নিয়েই আলোচনা করার, উদ্ধৃত করার এতো কিছু আছে যে, সব আলোচনা করতে গেলে আরও এমন ২০ টা ব্লগ লিখতে হবে। সেদিকে না গিয়ে এখানে ক্ষান্ত দেয়াই আমার জন্য সুবিধাজনক হবে বলে মনে করি। এতে ব্লগের ভিজিটরেরা অন্তত রেহাই পাবে!
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে রবি ঠাকুরের জন্ম কত বড় ঘটনা, এটা আর কাউকে বুঝিয়ে দিতে হয় না। তাকে নিয়ে অনেক বই পড়েছি। অনেক জীবনী অনেক আলোচনা। কিন্তু অনেকেই তার আত্মজীবনীটিই পড়ে উঠতে পারিনি। যারা পড়েননি, তারা মিস করেছেন অনেককিছু। রবি ঠাকুর কতসালে, কোথায়, কী করেছেন এসবের অনেক কিছুই হয়তো জানা যাবে না এবই পড়ে। তবে যা পাওয়া যাবে, তা জীবনী পড়ে পাওয়া সম্ভব নয়।
আত্মজীবনী অনেক পড়েছি। যখন বাংলা গদ্য শিশু ছিল, যেই তখনকার বিদ্যাসাগরের আত্মজীবনী থেকে, অত্যাধুনিক বাংলার অনেকের। কিন্তু এর থেকে ভালো একটাও পড়িনি। তপন রায়চৌধুরীর ‘রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তের পরচরিতচর্চা’ যারা পড়েছেন, তারা হয়তো জানেন, আত্মচরিত কতোটা মজাদার ও হাস্যরসাত্মক হতে পারে। তপন রায়চৌধুরীর অনেক আগেই কাজটা করে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। হয়তো তপন রায়চৌধুরী তাকেই অনুসরণ করেছেন। কে জানে?
*দুর্বলতায় রবীন্দ্রনাথ
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০১৭ রাত ৩:০১