somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শমন শেকল ডানা'র একটা পাঠকীয় বিশ্লেষণ...

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ১:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হাসান মোরশেদ সুলেখক। তার বেশ কিছু গল্প পইড়া তব্ধা খাওয়া অনুভূতি হইছিলো আমার...গতোবছর যখন শুনলাম তার প্রথম উপন্যাস প্রকাশ পাইতে যাইতেছে, তখন বেশ উদগ্রীব ছিলাম। কিন্তু শেষকালে প্রকাশক আহমেদুর রশীদের নিরাপত্তাজনিত ডরে প্রকাশনা রহিত হয়। সেনা শাসনের কালে এই ভয় আমার পছন্দের না হইলেও যৌক্তিক মনে হইছিলো...কে হায় হৃদয় খুড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!? গতোবছর'ই জানতাম, এই বছরের সম্ভাব্য গণতান্ত্রিক পরিবেশে উপন্যাসের শুভমুক্তি হইবো...নির্বাচনী প্রক্রিয়া শেষে নির্বাচিত আওয়ামি আমলে অন্ততঃ কোন খড়গ নামবো না এই আশা লেখক-প্রকাশক করতেই পারেন...

শমন শেকল ডানা কিনলাম অতঃপর...উপন্যাসের নামকরনে যেই কাব্যিক প্রণোদনা, সেইটা এক্কেরে হাসান মোরশেদীয়। তার কাব্যপ্রেমী চরিত্রের প্রকাশ অতীতের মতোই এই উপন্যাসেও আছে...নামকরনের মধ্যেই গল্পের আরোহী চরিত্রটা স্পষ্ট হইয়া উঠে...শুরুতেই আমি টের পাই উপন্যাসের সংঘটন ধীরে ধীরে ক্লাইমেক্সের শিখরে উঠবো...আমি নিজে এই কাঠামোর পক্ষের লোক তাই উপন্যাসের মনোযোগী পাঠক হইয়া উঠতে সামান্য প্রতিবন্ধকতাও থাকে না।

তবে হাসান মোরশেদের উপন্যাস ভাবনার শুরুর যেই শক্তি টের পাওয়া যায় উপন্যাসের প্রথম পংক্তিতে...

মুক্তাদিরকে আমি খুন করি ঘুমের ভেতর।

এই লাইনের ব্যখ্যা-ট্যখ্যার ধার না ধাইরাই আমি যাদু বাস্তবতার অনুভূতি পাই...যেই যাদু বাস্তবতা হয়তো সারা উপন্যাসের পটভূমিতে মাঝে মাঝেই আসছে, কিন্তু এই যে প্রথম বাক্য...তার আবেদনেই হাসান মোরশেদ অধম পাঠকের কাছে প্রথম পয়েন্ট পাইয়া যান...একজন সাধারন পাঠক হিসাবে আমি পাই পূর্ণ পঠনের তাগীদ...যদিও এই মুক্তাদিরটা কে সেইটা আমার কাছে অপরিচ্ছন্ন থাকে...যদিও মুক্তাদিরের প্রতি ক্ষোভের জায়গাটা কেরম অপরিকল্পিত গাথুনির মনে হয়...কিন্তু মুক্তাদিরের উপর নায়কের বা লেখকের আক্রোশটা ভালোই উন্মোচিত হয়। এই ব্যাপারে আমার কিছু অবজার্ভেশন থাকলেও নান্দীপাঠের অভিজ্ঞতাটা ভালোই বলতে হয়...

যদিও আখ্যানের শুরুটা আমার কাছে মুখের তুলনায় খানিকটা দূর্বলই লাগে। টুপুর যেইখানে রাজকন্যা হয় আর লেখক-নায়ক হয় পাতাকুড়োনীর পূত্র...নায়কের এই যে প্রকাশ, তার আবেদনটা একটু কেরম কেরম জানি লাগে। গরীব-বড়লোকের বাণিজ্যিক ইমেজের যেই চিরকালীন বাঙালি চিহ্নায়ন আছে, সেই মর্তবায় লেখক এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ কইরা থাকলে অবশ্য আমার কিছু বলার থাকে না। পুরা গল্পের পরতে পরতেই টুপুরগো বিদেশ ভ্রমণ নিয়া একটা আহাজারি আছে...যেই আহাজারিটা লন্ডন প্রবাসী বড় ভাই আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষস্থানের অধিকারী একজনের স্বগতঃ সংলাপে প্রায়শঃই বাড়াবাড়ি ঠেকে। তয় এইটা বৈষম্য বুঝানের একটা মাপকাঠি হইতেই পারে বইলা আমি ভাবতে চেষ্টা করি। টুপুরের বড়লোকীটা আসছে ঐ বিদেশ ভ্রমণের রূপকেই...খুব সহজ রূপক বাইছা নিছেন লেখক...যেইটা অধিক ব্যবহারের কারনে মাপকাঠির চাইতে ঈর্ষার প্রকাশ বইলা মনে হইছে বেশী।

টুপুরের সাথে নায়কের সম্পর্কের গাথুনিটা একজন পাঠক হিসাবে আমার কাছে খুব স্পষ্ট হওনের আগেই আরো বেশ কিছু চরিত্র চইলা আসে পাতায় পাতায়...কবিতা তৎপরবর্তী নাসিমা...এবং মুখবন্ধের মুক্তাদির। আমার কাছে প্রারম্ভিক মুক্তাদিররে অনেক আকর্ষণীয় মনে হইলেও পঞ্চম পর্বের মুক্তাদির কেরম প্রাণহীন ঠেকে। চরিত্রটারে অনেক আরোপিত মনে হয়। উপন্যাসের গঠন রীতিতে যদি মেকী ভাব আসে তাইলে তার ধারাবাহিক সংযোগের বন্ধনগুলি ঢিলা হয়...নাসিমার চরিত্রটা পড়তে অনেক ভালো লাগলেও তার সমাজ বিশ্লেষণমূলক সংলাপগুলি তাই ওজনদার মনে হয়...অনেকবেশী লিফলেটের ভাষা মনে হয়...এমনকি প্রবন্ধেও এই ভাষা বিযুক্তির কারন হইতে পারে। তবে নাসিমা পর্বের ক্লীশে প্রগ্রেশনের মধ্যেও কিছু টুইস্ট খারাপ লাগে না। এই খারাপ না লাগাটারে লেখকের কৃতিত্ব ধরা গেলে গৌতম রায়ের পরিচিতিমূলক অংকটারে মারাত্মক বলা যায়...যদিও গৌতম রায়ের চরিত্রটারে কেরম সুসংবদ্ধ লাগে না...চরিত্রটার আগমন হয় যেনো তার অনুপস্থিতিতে নায়ক বিশ্ব বৈষম্য আর গ্যাটচূক্তি নিয়া ভাববেন তারই অবতারনার কৌশল, আমার কাছে এইটাও মনে হয়।

এরপর গল্পের পরিসমাপ্তি হয় হুটহাট...একটা ছোট্ট ক্লাইমেক্স...কিন্তু সেইটা দাঁড়ানের আগেই য্যান উপন্যাসের পরিনতি...বড় ভাই যেহেতু খালেদ নামক প্রাক্তন বিপ্লবী ছাত্রনেতা আর বর্তমান সামরিক কর্মকর্তারে বাঁচাইছিলো তাই প্রতিদানে নায়কের সম্ভাব্য মুক্তির আশ্বাস...আদিবাসী নেতা হেমলেটের চরিত্রটাও কয়েকটা সংলাপ আর স্বপ্নে পরিষ্কার হয় না আমার কাছে...ক্লেমেন্টতো আড়ালেই থাকে...

শমন শেকল ডানার একটু কড়া সমালোচনা আমি করতে চাই আলোচনার এই ভাগে আইসা। হাসান মোরশেদের লেখা আমার পছন্দ বইলা তার কাছে প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিলো আমার...কিন্তু উপন্যাসের কোন চরিত্রই দাঁড়ায় নাই বইলা আমার মনে হয়...সম্ভাবনা দেখাইয়াই কেরম ম্রিয়মান হইয়া গেছে তারা...এই অভিযোগ নায়কের ব্যাপারেও সত্য...শৈশবের খেলার সাথী কবিতা, মুক্তাদির, মায়িশা, মাস্তান সন্ত্রাসী বন্ধু মঞ্জুর, টুপুরের মা-মামা, গৌতম রায়, ফরহাদ, বড় ভাই, কর্ণেল খালেদ ইব্রাহীম...সকলের উপস্থিতিতেই কেরম তাড়াহুড়া...কেবল নাসিমা চরিত্রটাই খানিকটা সবল ছিলো...কিন্তু তার উপস্থিতি আগেই বলছি একটু ক্লীশে লাগছে আমার

হাসান মোরশেদ নায়ক চরিত্রটারে যদি এই অস্থির সময়ের প্রতিনিধি হিসাবে দেখাইতে চাইয়া থাকেন তাইলে তিনি সঠিক ট্র্যাকেই ছিলেন বইলা মনে হয়...কিন্তু নায়ক চরিত্রে তিনি আবার একটা মতাদর্শিক বাতাবরন চাপান যেইটা এতোটা ভিভিড না হইলেই বরং বেশি ভালো লাগতো। নায়ক চরিত্রটা আসলেই বুঝি নাই...কখনো তারে পোমো বোধহয়...কখনো আদর্শ পরায়ন, কখনো পুরুষতান্ত্রিক এই সব অস্থিরতার সূচক যদিও তবুও অস্থিরতার এই রূপরে ঘাটতি হিসাবেও পরিলক্ষিত হয়...

লেখকের প্রথম উপন্যাস হইলেও ফাকিবাজীটা টের পাওয়া যায়...উপন্যাসের বিস্তারে তিনি ফাকিবাজী করছেন, তিনি ফাকিবাজী করছেন একটা কালের ইন্টারপ্রিটেশনে। যদ্দূর বুঝি তিনি একটা পিরিয়ড উপন্যাসই লিখতে চাইছেন...পিরিয়ড উপন্যাসে কাল আর পাত্রের লগে যে স্থানও একটা পরিপূরক হইতে পারে, সেই ভাবনাটা অনুপস্থিত মনে হইছে আমার। কালিক আর স্থানিক বিবরন একলগে না থাকলে একটা কাহিনীর ভিন্ন অর্থ পর্যন্ত দাঁড়াইয়া যায়...উপন্যাসটা হয়তো সিলেটের মানুষ নাইলে ব্লগের মানুষের জন্য লেখা এইরমও মনে হইছে আমার কয়েকবার...যেই কারনে স্থানের কোন বাস্তবানুগ উল্লেখ নাই...নাইলে অনেক ঘটনাই কেরম অপ্রয়োজনীয় লাগে...লেখক অনেক কিছু কইতে চাইছেন ৬৪ পৃষ্ঠায়...সকল কিছুর ভাগ তাই কম হইয়া গেছে এক টুপুর আর কবিতা বাদে আর কারো উল্লেখই প্রায় বলা যায় দ্বিতীয়বার হয় নাই।

এতো কিছুর পর একটা কথাই বলতে চাই মনে গভীর দাঁগ হয়তো কাটে নাই শমন শেকল ডানা...কিন্তু পড়তে অনেক আরাম পাইছি...একটানে পড়া গেছে...কোথাও মলাট বন্ধ করার ইচ্ছা তেমন হয় নাই...

বইটার যেহেতু কম পৃষ্ঠা তাই দাম খুব একটা বেশি না...কমিশন সহ ৬৮ টাকা...আর তাই বইটার বহুল প্রচার কামনা করি...
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ ভোর ৬:১৭
৬টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×