somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হারিয়ে ফেলা শীতল ছায়া । (গল্প)

১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৩:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



গভীর রাতে গ্লাসে পানি ঢালার আওয়াজে সায়ানের হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায় । ঘুম চোখে সে তাকায় ডীম লাইট জ্বালানো ডাইনিং রুমের দিকে, কিন্তু ওখানে কেউ নেই ।পাশের রুম থেকেও বড়ভাইয়ের নড়াচড়ার শব্দ আসলো । আম্মুর রুম থেকেও দীর্ঘশ্বাসের একটা হাহাকার কানে আসলো । সায়ান ভাবে, তবে কী আমার মতো গভীর রাতের এই আওয়াজ সবার কানে পৌঁছায় ? চোখের কোণে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে ? কিন্তু আমাদের সবার তো খুশি হওয়ার কথা ছিলো, দীর্ঘ এক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছি বলে ! এখন তো আর কোন কিছুর জন্য দায়বদ্ধতা নেই, সকলেই মুক্তি পেয়ে গিয়েছি । তবে কেন এই গভীর রাতগুলোতে অজানা দুঃখে বুক কেঁপে ওঠে ?

সায়ানের বাবার নাম দবির উল্লাহ্‌। তিনি খালার ঘরে বড় হয়েছেন । কারণ অতি অল্প বয়সেই উনার বাবা মা দুইজনই মারা যান আর রেখে যান তার জন্য শুধুই দারিদ্রতা। এরপর থেকে খালা তাকে মায়ের স্নেহ দিয়ে কোলে পিঠে করে মানুষ করেন।তিনি পড়ালেখায় অত্যন্ত মনযোগী হওয়ায় খালা কষ্ট করে হলেও দবির সাহেবকে পড়াশোনা করান । আর সেই সুবাদেই দবির সাহেব পুলিশের চাকরিটা পান । এর কিছুদিন পর পুরনো ব্যারাম হাঁপানীতে খালা শয্যাশায়ী হন, উনি আর টিকে ওঠতে পারেন নি ।তখন দবির সাহেবের খড়ের তৈরি ঘরটা ছাড়া আর কিছুই রইলো না ।তিনি ঘরের ভেতর দেব কাঠের খাটটায় শুয়ে ছালার ফাঁক দিয়ে ফুটে থাকা আসমানের তারাগুলো দিকে তাকিয়ে আছেন ।আর আনমনে আঙ্গুলের ইশারায় জপছেন, এইটা হলো বাবা, এইটা হলো মা, এইটা হলো খালা, এইটা হলো বাবা…

খালা মারা যাওয়ার কয়েক মাস পরে দবির সাহেব সায়ানের মা রাবেয়া বানুকে বিয়ে করেন ।রাবেয়া বানু তেমনি খাটো ছিলেন যেমনি লম্বা ছিলেন দবির সাহেব ।তবে এ নিয়ে দবির সাহেব মোটেও নাখোশ ছিলেন না । তিনি বউ হিসেবে চাইতেন একজন সহজ সরল নারীকে সেই হিসেবে রাবেয়া বানু পরিপূর্ণ ।একটি ভাঙ্গাচুরা ছনের ঘর নিয়ে দুইজন মানুষ তাদের নতুন জীবন শুরু করেন ।এরপর থেকে দবির সাহেবের হিসেবী মনোভাব তাকে কখনো পিচপা হতে দেয় নি । পুলিশের সামান্য কটা বেতনের টাকা থেকে তিল তিল করে জমিয়ে দবির সাহেব ভালোই সহায় সম্পত্তি গড়ে তুলেন ।

সায়ানদের বাড়ি এখন চারপাশ ওয়ালে ঘেরা বিশাল রাজকীয় গেইটে আবদ্ধ । দক্ষিণ এবং পশ্চিম কোণে আছে দুইটা বড় পুকুর । বাড়ির চারপাশে সবুজ গাছগাছড়ায় ঘেরা । উত্তর পাশে গোয়াল ঘর, ওখানে দুটো বিশাল সাইজের অষ্ট্রেলিয়ান গাভী আছে । মাঝখানে আছে বিশাল দালান ঘর আর তার মুখোমুখি পূর্বপাশে আছে কাচারি ঘর, দুই ঘরের মাঝে মাঠের মত বিশাল আঙিনা। ফসলের মৌসুমে উঠান বাড়ি ফসলাদিতে একাকার হয়ে যায় । বলা যায় দবির সাহেব একটা স্বর্গ বানিয়েছেন । দবির সাহেবের বংশ ভূইঁয়া থাকলেও উনার পেশার সুবাদে দশ গ্রামের মানুষ উনার বাড়িকে দারোগা বাড়ি বলে এক নামে চেনে ।যেমনি অর্থবিত্ত তেমনি সম্মান রয়েছে দবির সাহেবের ।সায়ান এবং তার বড় ভাই মেশিন পার্টস এর ব্যবসা করেন, দবির সাহেবই টাকা পয়সা দিয়ে ছেলেদের ব্যবসাটা দাঁড় করিয়ে দেন। সবকিছুতেই দবির সাহেবের একচ্ছত্র ছোঁয়া জড়িত । তাঁর বাবা উনাকে দিয়ে গিয়েছিলেন ‘শূন্য’ আর তিনি তাঁর সন্তাদের দিয়েছেন ‘স্বর্গ’ ।সায়ানদের এই অবস্থানে আসার জন্য তাঁর বাবা দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর সকল সুখ আহ্লাদ বিসর্জন দেয়ার সংগ্রামে যে জটিল ধাঁধা এঁটেছিলেন তা সন্তানদের কাছে অজানাই রয়ে গেল ।

সায়ানের এখন খুব মনে পড়ে বাবাকে । আমরা ছোটকাল থেকেই বাবার উপর বিরক্তই ছিলাম। বাবা সবকিছুতেই হিসেব খুঁজতেন। আমরা তিন ভাইবোন যখন স্কুল কলেজে পড়েছি তখন খুব মেপে মেপে টাকা দিতেন, যাওয়া আসার ভাড়া দশটাকা আর টিফিন তিন টাকা মোট তের টাকা । এর থেকে একটাকাও কখনও বেশি দিতেন না । আমরা রাগ করে বলতাম, এমন মেপে মেপে টাকা দাও কেন আমাদের, পথে কোন বিপদ আপদও তো হতে পারে তখন কী করবো । আব্বা উত্তরে বলতেন, আল্লাহর উপর ভরসা রাখো, আর বিপদ আপদ আসলে টাকা বেশি থাকলেও কিছু করার থাকে না ।এ কথা শোনার পর আব্বার উপর আমাদের রাগ আরও বাড়তো । বাবা খেলনা কিনে দেওয়ার সময়ও এমন খেলনা কিনে দিতেন যেন সহজে তা নষ্ট না হয়, আর বেশি দামী খেলনা তো কখনোই কিনে দিতেন না । একবার মনে আছে বড় ভাইয়া একটা দামী খেলনা গাড়ির জন্য অনেক কান্না করেছিল কিন্তু আব্বা কিনে দেন নাই । আম্মা এ নিয়ে অনেক রাগারাগি করেছিল আব্বার সাথে । আব্বা বলেছিল, যেখানে টাকার অভাবে কত বাবা মা তাদের বাচ্চাদের দুধ খাওয়াতে পারে না সেখানে সামান্য মনেরপ্রশান্তির জন্য এত দামী খেলনা কেনার কোন অর্থ নেই ।এইসব ভারী কথা শুনে আমাদের আরও গা জ্বলতো । কিন্তু আব্বা তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকতেন, এই কারণে আমাদের আরও রাগ হতো । মনে মনে আব্বাকে গালিও ছুড়তাম ।

আমাদের জামা কিনে দেওয়ার ক্ষেত্রেও আব্বার ছিল কঠিন হিসেব । দুই সেট জামা তোলা থাকতো বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের জন্য আর পাঁচটা জামা থাকতো পুরো বছর পরার জন্য । আবার জামা ব্যবহারেও যত্নশীল হতে হবে । তবে জামা ছিঁড়ে গেলে নতুন জামা কিনে দিতেন । আব্বা ছেঁড়া জামা পড়া একদমই পছন্দ করতেন না । তাই আমরাও এর সুবিধা নিতাম, ইচ্ছে করে জামা ছিঁড়ে ফেলতাম ।কিন্তু একদিন আপু আব্বার কাছে ধরা খেয়ে গিয়েছিল, সেদিন আমাদের তিন ভাইবোনকে অনেক বকা দিয়েছিলেন । আমরা তিন ভাইবোন সারারাত কেঁদেছিলাম । তবে আব্বা কখনো আমাদের গায়ে হাত তুলতেন না, আর এই বকা খাওয়ার একটা সুফলও ছিল ।পরদিন আব্বা আমাদের তিনজনকে মিষ্টি দোকানে মিষ্টি খেতে নিয়ে যেতেন ।

আব্বার উপর পরিবারের সবাই বেশি মেজাজ খারাপ করেছিল আপুর বিয়ের সময় । স্বয়ং আপুও অনেক কেঁদেছিল । তখনকার সময় সাধারণত সকল বাবাই চাইতেন পয়সাওয়ালা ঘরে মেয়েকে বিয়ে দিতে । ছেলে কী করে তা ব্যাপার ছিল না বরং ছেলের আব্বার কী আছে, তাদের বংশ কী এগুলোই ব্যাপার ছিল । অথচ আব্বা এমন এক ছেলেকে আপুর জন্য ঠিক করলেন যাদের চালচুলো কিছুই ঠিক নেই । ছেলের যোগ্যতা বলতে আছে শুধু এম এ পাস, কয়দিন পর চাকরিতে ঢুকবে ।এই নিয়ে আম্মার সাথেও আব্বার কয়েক দফা রাগারাগি হয় আর গ্রামের মানুষও অনেক কানাখোসা করতে শুরু করলো । কিন্তু আব্বার এসব নিয়ে কোন মাথা ব্যথাই ছিল না । অন্যের কথায় কান দেওয়ার মত লোক উনি কখনোই ছিলেন না । এমনকি আব্বা কখনো কারো ব্যাপারে অগোচরে বদনামও রটাতেন না, যা বলার সামনা সামনিই বলে দিতেন সেটা শুনতে তিতা হোক আর মিঠা হোক । আর তিনিও চাইতেন তাঁর বদনাম আড়ালে না করে তাঁর সামনে যেন করে, আব্বা দ্বিমুখীতা খুবই ঘৃণা করতেন ।এইসব কারণে সমাজের মানুষ আব্বাকে একটু কটু চোখেই দেখতেন । আপুর বিয়ের বিষয়ে আব্বার একটাই যুক্তি ছিল, আমার মেয়ে যার সাথে ঘর করবে তার কী আছে সেটা আমার কাছে মুখ্য বিষয় । ছেলে এখন খারাপ অবস্থানে থাকলেও শিক্ষিত ছেলে যেহেতো সম্মানজনক একটা চাকরি অবশ্যই করবে । আর আমি যদি পয়সাওয়ালা কোন অশিক্ষিত বেকার ছেলের কাছে আমার মেয়েকে তুলে দেই ওই ছেলে যে সারাজীবন পয়সাওয়ালা থাকবে তার গ্যারান্টি কে দেবে ?সে যদি কোন কারণে তার সম্পত্তি হারায় তখন তো তার কামলা খাটা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবেনা । আর আমার মেয়েকে না খেয়ে মরতে হবে । ছেলে শিক্ষিত হলে সে পৃথিবীর যে কোন জায়গায় সম্মানের সাথে কোন না কোন চাকরি জোগাড় করতে পারবেই । অন্তত মেয়েকে না খেয়ে মরতে হবে না । আম্মা আর আপুর এইসব কথা শুনে গা আরও জ্বালা করতো । কিন্তু আব্বার কথা মতই আপুর বিয়ে হয় । একটা আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে আজ পর্যন্ত আপুর মুখে তার জামাইয়ের সুনাম ছাড়া কখনো কোন দুর্নাম শুনি নি ।অনেক পরে দুলাভাই থেকে জানতে পারি আব্বা নাকি বিয়ের আগে উনাকে শুধু একটা প্রশ্ন করেছিলেন, আর তা হলো, তোমার সাথে আমার একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিতে চাই তুমি আর কী কী চাও ? দুলাভাই উত্তর দিয়েছিল আমি শুধু আপনার মেয়েকে চাই আর আমার কোন কিছু লাগবেনা ।আব্বা তার শুধু এই উত্তরটি শুনেই তার কাছে নিজের একমাত্র মেয়েকে তুলে দিয়েছিলেন ।

ভাইয়াকে বিয়ে করানোর পর রীতি অনুযায়ী শশুর বাড়ি থেকে ভাইয়া তেমন কোন কিছুই পায় নি । এ নিয়ে আমাদের সবার রাগ ছিলো স্বয়ং আপুও বলতো, কী ঘরে ছেলে বিয়ে করাইছেন পুরাই ফকিরনীর জাত ! আসলে বড় ভাইয়ের শশুর বাড়ির টাকাপয়সার অভাব নেই কিন্তু অত্যন্ত কৃপন প্রকৃতির । উনাদের কেউ আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসলেও নাস্তা হিসেবে আনতেন শুধু এক ডজন কলা আর না হয় সূতলি দিয়ে বাঁধা ডজনখানেক আঁখ । অথচ আব্বা কিছুই বলতো না উল্টো আম্মুকে বলতো ভালো করে তাদেরকে যেন সমাদর করে । কোন এক অজানা কারনে আব্বাকে দেখেছি তিনি কারো কাছ থেকে কোন কিছু আশা করতেন না । তিনি নিজেরটা নিয়ে নিজেই থাকতে চাইতেন ।এমনকি আব্বাকে কখনো কারো কাছে ধার চাইতেও দেখি নি । আব্বা আমাদেরকে বলে, একটা জলজ্যান্ত মেয়ে তার প্রিয় পরিবারকে ছেড়ে আমাদের ঘরে এসেছে এর থেকে আর কী কিছু আমাদের পাওয়ার আছে ? আর আমাদের বিধান অনুযায়ী তো মেয়েটির সকল দায়িত্ব আমাদের । সে তো এখন আমাদের ঘরেরই সদস্য তাহলে আমরা তার পরিবার থেকে কী চাইবো ? মেয়েটিকে তারা ভরসা করে আমাদের কাছে তুলে দিয়েছে এখন সেই ভরসা রক্ষার দায়িত্ব আমাদের । আমরা কেন তাদের কাছে দায়িত্বের কথা বলবো । ছেলে বৌ হিসেবে আমরা একটা মেয়ে চেয়েছি সেটা আমরা পেয়েছি । এইসব কথা বলে আব্বা আমাদের কখনো খুশি করতে পারে নি উল্টো আমাদের রাগ আরও বেড়ে যেত । কিন্তু আমাদের কিছুই করার নাই, আব্বার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

আব্বা অবসরে এসেছিলেন দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরের চাকরি জীবন শেষ করে । অবসরে আসার কয়েক মাসের মাথায় হঠাৎ তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন । ডাক্তার বলেন, আব্বার মগজের আংশিক অংশ গলে পানি হয়ে গেছে, এর তেমন কোন চিকিৎসা নেই তবে গলে যাওয়াটা ধীর গতি করার জন্য কিছু ঔষধ নিয়মিত খেতে হবে ।এরপর থেকে আব্বা আর কখনো স্বরূপে ফেরেন নি ।সারাক্ষণ সবার সাথে উল্টোপাল্টা বকতেন যাকে দেখতেন তার সাথেই কথা বলা শুরু করে দিতেন, মেজাজও খিটখিটে হয়ে গিয়েছিলো । কিছু সময় মনে হতো ভালো আছেন আবার কিছু সময় খারাপ । খাওয়ানো লাগতো অনেক কৌশল করে । আলো ছাড়া থাকতে পারতেন না তাই সবসময়ই আব্বার রুমে লাইট জ্বলতো । পায়খানা পেশাবের কোন নিয়ম কানুন ছিল না ।সবকিছুই ভুলে যেতেন, হাঁটতে হাঁটতেই অথবা বসা থাকতেই যেখানে সেখানে পায়খানা পেশাব করে দিতেন ।জোর করে গোসল করানো লাগতো । কাছের কাউকে চিনতেও কষ্ট হতো আব্বার ।এমনকি আমাদের দিকেও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন যেন আমাদের নতুন দেখছে । ঘুম খুবই কম ছিল সারাদিন রাত ঘরে ঘরে পায়চারি করতেন ।রাতভর আব্বার হাঁটার শব্দ না হয় কাশির শব্দ অথবা গ্লাসে পানি ঢালার শব্দ শোনা যেত । অবাক ব্যাপার হচ্ছে আব্বা গ্লাসে শুধু পানি ঢালতেন কিন্তু খেতেন না । মনে হয় যেন পানি ঢেলেছেন ঠিকই কিন্তু খেতে ভুলে গেছেন । সকালে উঠে দেখতাম সব গ্লাস পানিতে ভর্তি ।পুরো টেবিল পানিতে ভরে গেছে ।ডাক্তারের কাছে নেয়া যেত না । অনেক কায়দা করে টেক্সিতে উঠাতে হতো আবার হসপিটালের সামনে পৌঁছালে টেক্সি থেকে নামতে চাইতো না । অনেক কসরত করে নামাতে হতো ।আব্বার দীর্ঘ এই অসুস্থতার ভারে আমাদের পুরো পরিবারেরই কাহিল অবস্থা । এমনও হয়েছে আমরা ভাবতাম এইভাবে বেঁচে থাকার থেকে আব্বা মরে গেলেইতো ভালো হয় ।

আব্বাকে শেষ যেবার হসপিটালে নিয়ে এসেছিলাম তিনি তখন খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন । হসপিটালে ভর্তি করাতে হয়েছিল ।একদিন হসপিটালের বেড থেকে আব্বা আমাকে ডেকে বললেন, দেখ তো সায়ান পুরো দেওয়ালে এই আরবী অক্ষরের লেখাগুলো কী ? অথচ আমি দেখছি পুরো দেয়ালই সাদা । আমি আব্বাকে বললাম, কই আব্বা এখানে তো কিছু লেখা নেই । আব্বা বলে তুই দেখছিস না তোর চোখে সমস্যা আছে । তখন আবার ডাক্তার এসে আমাকে ডাকলেন তার রুমে । ডাক্তার বললেন, রিপোর্ট দেখে যা মনে হলো আর আশা নেই । উনাকে বাড়ি নিয়ে যান । তারপর আব্বাকে বাড়িতে নিয়ে আসি । বাড়িতে আনার দুইদিনের মাথায় প্রায় দুপুরের সময় আব্বাকে অনেক সুস্থ দেখা গেল । আপুর হাতে অনেক খাওয়া দাওয়া করলেন ।তারপর সুস্থ মানুষের মত ঘুমাতে গেলেন । আমরা আব্বাকে এমন দেখে অনেক খুশী হয়েছিলাম কিন্তু এটা যে আব্বার সারাজীবনের ঘুম হবে তা বুঝতে পারি নি । আব্বা আর জেগে ওঠেন নি ।

আব্বার জানাজায় অনেক মানুষ হয়েছিল । জানা অজানা এত মানুষ আসবে তা কখনো কল্পনায় ছিলো না । সবার চোখ দিয়েই পানি পড়েছিল । আব্বা জীবিত থাকাকালীন তেমন বেশি মানুষের সাথে আব্বাকে কখনো মেলামেশা করতে দেখি নি কিন্তু জানাজায় এত অচেনা মানুষ কোথা থেকে আসলো তা বুঝতে পারলাম না ।এমনকি মাটি দেওয়া শেষ হওয়ার পরেও আব্বার কবরের কাছে অনেকে দাঁড়িয়ে ছিলো । আব্বার বানানো পারিবারিক কবরস্থানে আব্বাই প্রথম পা রাখলেন ।

আজ পনের দিন হয় আব্বা মারা গেছেন ।এই পনের দিনে প্রতিদিন রাতেই ঘরে আব্বার পায়চারির শব্দ শুনছি । কখনো পায়ের আওয়াজ, কখনো পানি ঢালার আওয়াজ কখনোবা কাশির শব্দ মনে হয় যেন আব্বা এখনো আমাদের ছায়া হয়ে আছেন ।পৃথিবীতে কিছু মানুষ থাকে যাদের চিন্তা ভাবনাগুলো অন্য সকলের উর্ধে থাকে । যাদেরকে বোঝা অনেক কঠিন । আব্বা সেইরকমই একজন ছিলেন । জীবিত থাকতে আমরা আব্বাকে কখনোই বুঝি নি । আমরা আব্বার অন্তর আত্মাকে কখনোই উপলব্ধি করার চেষ্টা করি নি ।এখন বুঝতে পারি আসলে আমরা কী হারিয়েছি ।আমরা শুধু বাবাকে ভুলভাবেই বিচার করেছি অথচ আব্বা যা কিছু গড়েছেন সবই তো আমাদেরকে দিয়ে গেছেন ।যা করেছেন সবকিছুই তো আমাদের জন্যই করেছেন । আব্বাকে আমরা যেভাবে ভেবেছি আব্বা আসলে সেই রকম ছিলেন না । এখন আমরা যদি হিসেব মেলাতে বসি আব্বার থেকে আমরা সারাজীবন কী পেয়েছি তখন দেখতে পাই আব্বা আমাদের সকল প্রয়োজনই মিটিয়েছেন কিন্তু আমরা আগে কখনোই বুঝি নি। আমরা ভাবতাম আব্বা কৃপণ । অথচ তিনি ছিলেন মিতব্যয়ী এবং দূরদর্শী একজন মানুষ । যখন যতটুকু প্রয়োজন ছিলো ঠিক ততটুকুই করছেন । তিনি অতিরঞ্জিত কোন কিছুই পছন্দ করতেন না আর আমরা সেটাকে ভাবতাম কৃপণতা ।

এসব ভাবতে ভাবতে সায়ানের কানে ফজরের আযানের শব্দ আসে । সায়ান বিছানা ছেড়ে নামাজ পড়তে যায় । নামাজ শেষে বাবার কবরের দিকে যেতেই দেখে ওখানে আম্মা, বড়ভাই আর আপু দাঁড়িয়ে আছে ।আপুও এত ভোরে শশুর বাড়ি থেকে চলে এসেছে ।তাদের খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে । তাহলে কি সবার অবস্থা আমার মতই ? কবরস্থান থেকে বাড়িতে আসার পথে বাবার পুরনো বন্ধু আক্কাছ চাচার সাথে দেখা হয় আমাদের । চাচা আমাদেরকে বলে, তোমাগো আব্বারে তো রাতে স্বপ্নে দেখছি । বড় ভাই জিজ্ঞেস করে, কী দেখেছেন চাচা ? চাচা বলে, আমি তোমার আব্বাকে জিজ্ঞেস করি, কিরে দবির কেমন আছোছ? তোমার আব্বা হাসি দিয়ে বলে, আমি তো খুব ভালো আছি তোদের কী খবর ? তহনই ঘুমটা ভেঙ্গে যায় ।

স্বপ্নের কথা শুনে আমাদের মন অপরাধীর মত হোঁ হোঁ করে কেঁদে ওঠে….


[ গল্পটা অনেক আগের লেখা । আমার অনেক প্রিয় একটি গল্প । তাই আরো পরিমার্জন করে প্রকাশ করলাম আবার । ]


ছবি- নেট থেকে ।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৩:৪৪
৩০টি মন্তব্য ৩০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×