খবরটা পেলাম ছোটভাই এর কাছ থেকে।ওর স্বভাবমত বিস্তর চেচামেচির পর বলল, “ভাই বাবা এক বাচ্চা নিয়ে এসেছে বাসায়।”
“বাচ্চা মানে?”
“এক মেয়ে নাকি দত্তক এনেছে পালবে ওটাকে। এসব কি বুড়া বয়সে ভীমরতি নাকি?” বলেই আবার শুরু করল চেচামেচি।
আমি বললাম, “ঠিক আছে তুই ফোন রাখ আমি খোজ নিচ্ছি কি হয়েছে।”
বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর ফোন ধরল মা। সরাসরিই জিজ্ঞেস করলাম, “মা তোমরা নাকি এক মেয়ে নিয়ে এসেছ? ঘটনা কি?”
মা বলল, “আমাদের বর্গাচাষী তাহেরের বউটা মারা গেল বাচ্চাটা হওয়ার পরপরই। সবাই মিলে আমাদের ধরল বাচ্চাটাকে নিয়ে আসার জন্য। কি করব বল?”
“তাই বলে এ বয়সে এ ঝামেলা তাছাড়া দত্তক নেওয়ার সমস্যাও আছে তুমি তা জান?”
মা আমার ইঙ্গিতটা বুঝল। অল্প হেসে বলল, “কেন তোদের ধনসম্পদ কমে যাবে?”
বিদ্রুপটা গায়ে লাগল। ফোন কেটে দিলাম। এমনিতেই বাড়ির সাথে আমার সম্পর্ক তেমন একটা ভাল না এ ঘটনার পর আরও শীতল হয়ে গেল।
মাস ছয়েক পরের কথা আবার ইশতির ফোন।“ভাইয়া রুচিটা না খুব কিউট।খুব ছিচকাদুনে আবার আমার কোলে আসলে একদম চুপচাপ।আমি বাড়ি আসার পরথেকে সে আমার কোল থেকে নামছে না। আমার খুব ভাল লাগছে ওকে।”
আমি অবাক! “রুচিটা কে?”
“আরে আমাদের বোন আরকী।”
“ও!”
ইশতি এমনি। হটাত করেই কারও উপর সে রেগে যাবে আবার
পরক্ষণই রাগ কমে যাবে।ফোনটা কেটে দিলাম।মনে হতে লাগল সবাই যেন আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
ইন্ডিয়া থেকে দেশে আসতে খুব একটা সময় লাগে না।ঝামেলাও বলতে গেলে নাই।তারপরও আমি বাড়ি যাই না।
৪ বছর পর। পরীক্ষা শেষ। বাড়ি যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। মেয়েটাকে নিয়ে আব্বার সাথে বেশ কথাকাটাকাটি হয়েছিল আমার।মা এবার খুব করে ধরল। কি আর করা শেষ পর্যন্ত আসতেই হল আমাকে।দরজা খুলতেই দেখি দাড়িয়ে আছে মেয়েটি। ঝাকড়া চুল গোলগাল বেশ কিউট।আমার ছবি দেখে আগে থেকেই হয়ত সে চিনে রেখেছে আমায়।
আমাকে ঝড়িয়ে ধরল “ভাইয়া!”
একেতো ভ্রমণক্লান্তি তারউপর এইমেয়ে! বিরক্তিটা আরচাপিয়ে রাখতে পারলাম না।ধাক্কা দিয়ে সড়িয়ে দিলাম ওকে। রুমে ঢুকে আরও মেজাজ গরম হল। দেয়াল ঝুড়ে নানা আকাঝুকি।আমার রুমের এককোনে ভুতের মত ছবি আকা।চশমা চোখে দেখে বুঝলাম আমাকেই আকতে চেয়েছে সে।
মাকে ডেকে বললাম, “এসব কি?”
মা হেসে বলল, “রুচিটা যা দুষ্ট।সারা বাড়িঘরে ছবি একে রেখেছে।”
“তাই বলে আমার রুমে? ফাইজলামীর একটা সীমা থাকা উচিত।”
মেয়েটা হয়ত ধরতে পারেনি আমার বিরক্তিটা। একটু পরেই রুমে ঢুকে বলল, “ভাইয়া আমার জন্য চকোলেট এনেছ?”
চোখ লাল করে থাকালাম ওর দিকে। মা ওকে ঠেনে নিয়ে গেল।এতে কাজ হয়েছে সে আর আমার আশেপাশে এরপর আসল না।রাতে খাওয়ার সময় মাকে বললাম, “তুমি খাবে না?”
“না তোর বাবা আসুক একসাথেই খাব।শোন তুই রুচিকে তোর সাথে খেতে বল না!”
“কেন?”
“সে তোর সাথে খেতে চাচ্ছিল।”
কপালে বিরক্তির ভাজ ফুটল আমার।বললাম, “শুন মা আমার সাথে ন্যাকামি করবে না।”
তিনদিন পর ঢাকায় যাব ইশতির কাছে। রাতেই ব্যাগ গুছানোর কথা বললাম মাকে।সকালে খুটখাট শব্দে ঘুম ভাঙল আমার।
দেখি রুচি আমার ট্র্যাভেলব্যাগ খুলে কি জানি করছে।কেন জানি মেয়েটাকে হঠাৎ খুব ভাল লাগছে।উঠে ওকে ধরলাম। ভয়ে ওর চোখমুখ নীল হয়ে গেল।
“আমি তোমার ব্যাগে শার্ট রাখছিলাম” কোনমতে একথা বলেই কেদে ফেলল সে।
কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল, “আমাকে মেরো না ছেড়ে দাও আর কখনো আসব না তোমার রুমে।”
হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল।ছেড়ে দিলাম ওকে। আমি এতই খারাপ যে একটা বাচ্চা মেয়েও ভয় পায় আমাকে!আমার বোন আমাকে ভয় পায়? ছি: ছি:!
“রুচি,” এই “রুচি” ডাকতে লাগলাম ওকে।বারান্দায় দাড়ানো সে।ভয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা।ওকে কোলে নিয়ে বললাম তুমি চকোলেট খেতে চাচ্ছিলে না ঐদিন? আস আমার সাথে।বাসার সামনের দোকান থেকে একগাদা চকোলেট আর বেলুন নিয়ে আসলাম আমরা। ড্রাইভারকে বললাম, গাড়ি বের করতে।
রুচিকে বললাম, “তুমি যাবে আমার সাথে?” সে একপায়ে খাড়া। মা না করলেও ওর কান্নাকাটির জন্য রাজি না হয়ে পারল না।গাড়িতে বসেই শরু হল ওর গল্প। কত কথা।
“আচ্ছা ভাইয়া তুমি আমায় একটা সাইকেল কিনে দিবে? জান ছোট ভাইয়া না দিতে চায় না বলে আমি নাকি পরে গিয়ে ব্যাথা পাব। ছোট ভাইয়াটা যে কি? আমি যে বড় হয়ে গেছি সে বুঝেই না।দিবে তো?”
“আচ্ছা ঠিক আছে কালকে আসার সময় কিনে নিয়ে আসব।”
“আচ্ছা ভাইয়া তুমি আমায় একটা মোবাইল কিনে দিবে?”
“কেন?”
“বারে! তুমি যখন ইন্ডিয়া থাক তখন তোমার সাথে কথা বলব।”
“আচ্ছা দিব।”
মিষ্টি মুখের ঘ্রাণ লাগানো নানা আবদার আর গল্প করতে করতে ক্লান্ত রুচি কতক্ষন পর আমার কোলে ঘুমিয়ে পড়ল। ওর মুখের দিকে থাকিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল আমার।ভাবতে লাগলাম এই স্বর্গীয় সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করার অধিকার কে দিয়েছিল আমায়?
পুনশ্চ- আমার কোনো বোন নাই। এই অভাবটা আমাকে খুব পোড়ায়।খু-উ-ব!
স্বর্গে গেলে কে কি চাইবে জানি না আমি ঈশ্বরের কাছে আমার জন্য একটি বোন চাইব।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুলাই, ২০১০ রাত ৯:৫৩