একজন বিশ্বজিৎ ও ছাত্রলীগ ভয়ংকর
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
রাজনীতি যে এত নিষ্ঠুর, মানুষ যে এত নৃশংস এবং একটি ছাত্রসংগঠন যে এমন দানব হতে পারে, তা ভাবলেও গা শিউরে ওঠে।
বিশ্বজিৎ দাস নামের যে যুবকটি রোববার ভোরে বাসা থেকে নিজের কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন, তিনি কি ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করছিলেন, মৃত্যুদূত তাঁর সামনে অপেক্ষা করে আছে। আর সেই মৃত্যুদূতের নাম ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ নামধারী কতিপয় দুর্বৃত্ত তাঁকে পিটিয়ে, কুপিয়ে পুরো শরীর রক্তাক্ত করে হত্যা করেছে। রক্তে পুরো শরীর, জামাকাপড় ভেসে যাচ্ছে, তিনি করজোড়ে ক্ষমা চাইছেন, বারবার বলছেন, ‘আমি রাজনীতি করি না, আমি ছাত্রদল বা শিবির করি না, আমি হিন্দু। আমি দরজিখানায় কাজ করি।’ কিন্তু ছাত্রলীগের বীর পুঙ্গবেরা তাঁকে ক্ষমা করেনি। সর্বশক্তি নিয়ে তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। যখন যুবকটি তাদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে কাছের হাসপাতালে যেতে চাইলেন তাতেও তারা বাদ সাধল। ওরা তাঁকে চিকিৎসাও নিতে দেবে না।
এ কেমন রাজনীতি? এ কেমন মানবিকতা? আমরা রাষ্ট্রের কাছে জবাব চাই। জবাব চাই রাজনীতির কাছে। কেন বিশ্বজিৎ দাসকে এভাবে মরতে হলো? তিনি রাজনীতি করতেন না। তাঁর গরিব মা-বাবা তাঁকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন জীবিকা অন্বেষণে। ভাইয়ের সঙ্গে থাকতেন। নিজের মতো করে তিনি জীবিকা খুঁজেও নিয়েছিলেন, দরজির কাজ করতেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল একদিন মা-বাবার আশা পূরণ করবেন। আয় বাড়বে, নিজের সংসার হবে। কিন্তু সেই স্বপ্নকে হত্যা করেছে জটিল, কুটিল ও নিষ্ঠুর এই রাজনীতি। ওরা জানে না, একটি মানুষ তো কেবল একটি মানুষ নন। সেই মানুষটির সঙ্গে থাকে তাঁর পরিবার, তাঁর স্বজন, তাঁর স্বপ্ন। সবকিছু গুঁড়িয়ে দিয়েছে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কতিপয় দুর্বৃত্ত। আমরা দেখতে চাই প্রধানমন্ত্রী এই দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেন। আমরা দেখতে চাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কত দ্রুত এদের গ্রেপ্তার করেন। আমরা দেখতে চাই আইন এখানে নিজস্ব গতিতে চলে কি না? গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, তদন্তে যাঁরা দোষী সাব্যস্ত হবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হেবে। বিশ্বজিতের হত্যার দৃশ্য টেলিভিশনের পর্দায় দেখানো হয়েছে, হত্যাকারীদের ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। গাড়ি ভাঙচুরের জন্য যদি মির্জা ফখরুল ও রুহুল কবির রিজভীদের বিরুদ্ধে ত্বরিত মামলা হতে পারে, তাহলে ছাত্রলীগের চাপাতিওয়ালা কর্মীদের বিরুদ্ধে কেন হতে পারে না? আইন কি সবার জন্য এক হবে না?
বিরোধী দলের অবরোধ ঠেকানো আর একজন নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষকে সাতসকালে পিটিয়ে এবং কুপিয়ে মারা ভিন্ন কথা। বঙ্গবন্ধুর নামে গড়ে ওঠা একটি ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা কেন ঘাতক হবে?
বিশ্বজিৎ হত্যার ঘটনাটি ঘটে পুরান ঢাকায়। রোববারের ১৮ দল আহূত অবরোধ চলাকালে বিএনপি ও জামায়াত-সমর্থিত আইনজীবীরা মিছিল করেন আদালতপাড়ায়। সেই মিছিল বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত এলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ধাওয়া করেন। দুই পক্ষে কিছুক্ষণ ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলে। এরই মধ্যে কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়। চারদিকে হইচই পড়ে যায়। এ সময় বিশ্বজিৎ ফুটপাত দিয়ে তাঁর দরজির দোকানে যাচ্ছিলেন। অমনি ছাত্রলীগের কর্মীরা ধাওয়া করেন। ধাওয়া খেয়ে তিনি একটি ক্লিনিকের দোতলায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তখন ছাত্রলীগের একদল কর্মী ‘ওপরে ওপরে’ বলে চিৎকার করেন। আরেক দল কর্মী দোতলায় উঠে তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। কেউ তাঁকে ধরে লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকেন, কেউ চাপাতি দিয়ে কোপাতে থাকেন। ছেলেটি তখন হাতজোড় করে বলেছিলেন, ‘আমি রাজনীতি করি না, ছাত্রদল বা শিবির করি না। আমি হিন্দু। আমি একটি দরজিখানায় কাজ করি।’
কিন্তু তাঁর সব আবেদন-নিবেদন, আহাজারি নিষ্ফল হয়ে যায় আক্রমণকারীদের নৃশংসতা ও বর্বরতার মুখে। বিশ্বজিৎ দাস যদি ছাত্রদল কিংবা শিবির করতেন, তাহলেও কি তাঁকে হত্যার অধিকার রাখে ছাত্রলীগ? তাহলে দেশে আইন, সরকার, প্রশাসন পুলিশের কি প্রয়োজন? যুবকটি অপরাধ করলে তাঁকে থানায় দাও, বিচার করো। বিচারের আগে পিটিয়ে হত্যা করা কেন?
এই নির্মম-নৃশংস ঘটনা যখন ঘটেছিল তখন এর পাশেই পুলিশ নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। বিরোধী দলের মিছিল-সমাবেশ ঠেকানো তাদের দায়িত্ব হলেও ছাত্রলীগের আক্রমণ ঠেকানো তাদের দায়িত্ব নয়। এমনকি তারা কাউকে হত্যা করলেও পুলিশ কিছু বলবে না। টিভিতে শুনলাম এক পুলিশ কর্মকর্তা বললেন, ‘বিশ্বজিৎকে কারা মেরেছেন জানেন না, তাঁরা দেখেননি। শিবিরও হতে পারে।’ ভাবটা এমন যে শিবির মারলে কিংবা শিবির মরলে পুলিশের কিছু করার নেই। ওই পুলিশ কর্মকর্তা কি এ কথাই বোঝাতে চাইছেন?
অবাক লাগে, সারা দেশে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা যে পুলিশেরও ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে, তাদের গাড়িতে আগুন দিচ্ছে, ভাঙচুর চালাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। তাদের মিছিল ঠেকাতে পারে না। তাই মিছিল ঠেকানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ছাত্রলীগকে। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা বলেছেন, বিরোধী দলের আন্দোলন ঠেকাতে নাকি ছাত্রলীগ-যুবলীগই যথেষ্ট। এখন ঠেলাটা বুঝুন। গত এক মাসে জামায়াত-শিবির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যত বদনাম কুড়িয়েছে, এই একটি ঘটনায় বঙ্গবন্ধুর সৈনিকেরা তার চেয়ে বেশি কুখ্যাতি লাভ করেছে। তারা নিজেরা ডুবেছে, আওয়ামী লীগকে ডুবিয়েছে, এমনকি সরকারকেও। সরকারি দলের ওই নেতাদের মনে থাকার কথা, ক্ষমতায় থাকতে একবার খালেদা জিয়াও বলেছিলেন, বিরোধী দলকে মোকাবিলায় তাঁর ছাত্রদলই যথেষ্ট। কিন্তু ১৯৯৬ ও ২০০৬ সালে ক্ষমতা হারানোর পর সেই ছাত্রদলের টিকিটিও পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগও ক্ষমতা হারালে ছাত্রলীগের অবস্থা তার চেয়েও খারাপ হবে। ১৯৭৫ সালের পর ছাত্রলীগের অধিকাংশ নেতা গর্তে লুকিয়ে ছিলেন। গর্তে লুকিয়ে ছিলেন ২০০১ সালের বিপর্যয়ের পরও।
সরকারের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি এতটাই দুর্বল হয়, তারা যদি জামায়াত-শিবিরের ক্যাডারের মাস্তানি মোকাবিলা করতে না পারে, সরকারের উচিত ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া। নেতারা মুখে বড় বড় আওয়াজ দেন আর কাজের বেলায় ঠনঠন।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, দেশের মানুষ বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাহলে এতগুলো গাড়ি পুড়ল কেন? এত গাড়ি ভাঙচুর হলো কেন? এত সম্পদ ধ্বংস হলো কেন? কেন সরকার মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে পারল না?
রাজপথের খেলা বড় ভয়ংকর। এই খেলায় কে জিতবে বলা কঠিন। ঢিল মারলে পাটকেল খেতে হয়। এই আত্মঘাতী পথ দুই পক্ষকেই পরিহার করতে হবে। ছাত্রশিবিরের ক্যাডারদের সন্ত্রাসী হামলা বন্ধ করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানাই। কিন্তু একটি সন্ত্রাসী ঘটনা ঠেকাতে আরেকটি সন্ত্রাসী ঘটনার জন্ম দেবেন না। হত্যার জবাব হত্যা নয়। জবাব হলো বিচার, আইনি ব্যবস্থা।
গণতন্ত্রের আন্দোলন কী, আইনের শাসন কী—সে কথা হয়তো বিশ্বজিৎ রোববার রাস্তায় নামার আগে জানতেন না। তিনি জানতেন, বেঁচে থাকাই গণতন্ত্র, মানবাধিকার। কিন্তু এখন গণতন্ত্রের নামেই দলীয় মাস্তানেরা তাঁর সেই অধিকার কেড়ে নিল। সেদিন যারা রাজপথে অবরোধ পালন করেছে, রাস্তায় গাড়ি ভাঙচুর করেছে, তারাও বলছে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য এটি করা হয়েছে। আর যারা অবরোধকারীদের ঠেকাতে শান্তি মিছিল করেছে, তারাও বলেছে, গণতন্ত্র রক্ষা করতে চায়। কিন্তু একজন বিশ্বজিৎ দাস কিংবা বিমানবন্দরের মোড়ে একজন দিনমজুর গণতন্ত্র কী, তা জেনে গেলেন নিজেদের জীবন দিয়ে।
আমাদের আর কত প্রাণ দিতে হবে? আর কত সম্পদ ধ্বংস হবে? আর কত মায়ের বুক খালি হবে? আর কত স্বজনের কান্নায় বাতাস ভারী হবে?
এই বিজয়ের মাসে বিশ্বজিৎ দাস কী (!) বিজয় দেখে গেলেন? কী অপরাধে তিনি মৃত্যুদণ্ড পেলেন? এই প্রশ্নের জবাব ছাত্রলীগকে দিতে হবে, ছাত্রলীগ যে রাজনীতির সমর্থক, সেই রাজনীতির অভিভাবকদের দিতে হবে। আপনারা যত পারুন বিরোধী দলের ষড়যন্ত্র ফাঁস করুন, তাদের সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধে পুলিশ নামান। বিজিবি নামান। প্রয়োজনে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করুন। কিন্তু দলীয় ক্যাডার লেলিয়ে দেবেন না। কাউকে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে বলবেন না। এভাবে বিশ্বজিতেরা জীবন দেবেন, আর আপনারা গণতন্ত্রের সুললিত বাণী আওড়াবেন, তা হতে পারে না।
একটি হিংসার ঘটনা আরও নতুন হিংসার জন্ম দেয়। এই ঘৃণা নতুন ঘৃণার জন্ম দেয়। রাজনীতিতে কি কেবলই ঘৃণার চাষ হবে? রাজনীতি কি কেবলই মানুষ হত্যার কায়দাকানুন শেখাবে?
একাত্তর সালে যে অপশক্তিকে আমরা পরাস্ত করে বিজয়ী হয়েছি, সেই অপশক্তি আবার মাথাচাড়া দিক, সেটা আমরা কেউ চাই না, আবার সেই দানব ঠেকাতে নব্য দানবের আবির্ভাবও কাম্য হতে পারে না।
ছাত্রলীগ নামের এই নব দানবকে এখনই নিবৃত্ত করুন। মনে রাখবেন, পদ্মা সেতু বা হল-মার্ক কেলেঙ্কারির চেয়েও ভয়ংকর এই ছাত্রলীগ। এতএব ছাত্রলীগ থেকে সাবধান।
Prothom Alo
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
কুড়ি শব্দের গল্প
জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!
সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন
ধর্ম ও বিজ্ঞান
করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন
তালগোল
তুমি যাও চলে
আমি যাই গলে
চলে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফুরালেই দিনের আলোয় ফর্সা
ঘুরেঘুরে ফিরেতো আসে, আসেতো ফিরে
তুমি চলে যাও, তুমি চলে যাও, আমাকে ঘিরে
জড়ায়ে মোহ বাতাসে মদির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন
মা
মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।
অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন
কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।
একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন