নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার দেশ

রুবেল১৯৮৭

আমি বিশ্বস করি ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশ কিন্তু ধর্মহীনতায় নয়।

রুবেল১৯৮৭ › বিস্তারিত পোস্টঃ

কি করে বাঙালি মুসলমান হয়ে গেল! - ১

০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৩ রাত ১০:৫২

জাতিতে তুর্কী, বসবাস সূত্রে আফগান, ইখতিয়ারুদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী এরকম একজন ভাগ্যান্বেষী। গজনীতে মুহম্মদ ঘোরী এবং দিল্লীতে কুতুবুদ্দিন আইবকের অধীনে সৈনিকের কাজ পাবার চেষ্টা করে তিনি ব্যর্থ হন। বদায়ুনের শাসনকর্তা হিজবরুদ্দিনের মাসিক বেতনের সৈনিকের কাজ নিয়েও তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেন না। অযোধ্যার শাসনকর্তা হুসামুদ্দিন তাঁকে বর্তমান মির্জাপুর জেলার ভাগবত ও ভিউলি পরগনার জায়গীর নিযুক্ত করেন। জায়গীরে নিযুক্ত হয়েই বখতিয়ার সৈন্য সংগ্রহ করেন এবং আশেপাশের ছোট ছোট হিন্দু রাজ্যগুলো জয় করতে থাকেন। ইতোমধ্যেই এ সব অঞ্চলে তুর্কী আক্রমণের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল বলে তার সুবিধা হয়। ওদন্তপুরী বিহার জয় করার পর তিনি বাংলার দিকে অগ্রসর হন।

এই সময় লক্ষ্মণসেন নবদ্বীপে অবস্থান করছিলেন। রাজজ্যোতিষী এবং পরামর্শদাতা ব্রাক্ষণগন লক্ষ্মণসেনকে পরামর্শ দিলেন যে বখতিয়ারকে বাধা দেয়া অর্থহীন। শাস্ত্রে আছে, এ সময় এ দেশ তুর্কীদের দ্বারা বিজিত হবে। শাস্ত্রে বিজয়ীর যে বর্ণনা দেয়া আছে তা বখতিয়ারের সঙ্গে একদম মিলে যায়। অতএব তিনি যদি প্রজাবর্গ সহ দেশ ত্যাগ করে পূর্ববঙ্গে বা কামরূপে আশ্রয় নেন তবেই বিধর্মী তুর্কীর অত্যাচার থেকে বাঁচবেন। অনেক ব্রাক্ষণ এবং ব্যবসায়ী নবদ্বীপ ছেড়ে চলে গেল। লক্ষ্মণ সেন গেলেন না। বখতিয়ার নিজেকে সমেত আঠার জন অশ্বারোহী নিয়ে নবদ্বীপে প্রবেশ করলেন। লোকে তাঁদের অশ্বব্যবসায়ী মনে করে থাকবে। তাই বিনা বাধায় তারা প্রাসাদে ঢুকে পড়েন। প্রাসাদে ঢুকে পড়েই তাঁরা যাকে সামনে পায় তাকে হত্যা করতে থাকেন। লক্ষ্মণ সেন প্রতিরোধের কোন সুযোগই পান না। তিনি নৌকা যোগে পূর্ববঙ্গে পলায়ন করতে বাধ্য হন। 'লক্ষ্মণ সেনের পুত্র কেশব। বিশ্বরূপ সেনের সাহায্যে বখ্‌তিয়ারের বঙ্গ-বিজয়ে গৌড়-বঙ্গে স্থাপিত হয় দ্বিতীয় সহযোগী সরকার;...।'

১২০৪ খ্রীষ্টাব্দে বখতিয়ার খলজী বাংলা দেশে যে মুসলমান শাসনের প্রতিষ্ঠা করেন তা ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজদ্দৌলার পরাজয় পর্যন্ত কার্যত এবং ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজদের দেওয়ানী লাভ পর্যন্ত আইনগত বজায় ছিল। '১২০৪ খ্রীষ্টাব্দে থেকে ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দে পর্যন্ত অর্থাৎ ৫৬২ বছর সময় কালের জন্য ৭৬ জন মুসলমান সুবাদার, রাজা ও নাযিম ক্রমাগতভাবে বংগদেশ শাসন করেছেন। তাদের মধ্যে ১১ জন সুবাদার ঘোরি ও খিলজী সম্রাটদের হাতে নিযুক্ত হয়েছিলেন, ২৬ জন ছিলেন স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজা; এঁদের মধ্যে শের শাহের রাজত্বকালের সমসাময়িক শাসকগণও ছিলেন এবং অবশিষ্ট ৩৪ জন ছিলেন মোগল সম্রাটদের অধীনস্থ নাযিম।'

প্রথম দিকের তুর্কী সুলতানরা দিল্লীর সুলতানের অধীনে বাংলা শাসন করতেন। ১৩৩৮ খ্রীষ্টাব্দে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তারপর দ'ুশ বছর, অর্থাৎ ১৫৩৮ পর্যন্ত বাংলার সুলতানরা দিল্লীর অধীনতা মুক্ত ছিলেন। এই সময়কে বাংলার স্বাধীন সুলতানী আমল বলা হয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে বাংলাদেশ তখন স্বাধীন ছিল। এই সময় যারা বাংলাদেশ শাসন করতেন তাদের বেশীর ভাগই ছিলেন বিদেশী। কিন্তু ১৪১৪ খ্রীষ্টাব্দে গণেশের সিংহাসন আরোহন থেকে ১৪৩৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত শামসুদ্দিন আহমদ শাহ-এর রাজত্ব পর্যন্ত গণেশ, জালালুদ্দিন ওরফে যদু এবং শামসুদ্দিন আহমদ শাহ এঁরা সকলেই ছিলেন এই দেশের লোক। তাই এই সময়টা বাংলা দেশ পরাধীন ছিল এরকম বলবার কোন কারণ নেই।

প্রথম দিকের তুর্কী শাসনের অবসানের পর ১৩৪২ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৪১৪ খ্রীষ্টাব্দে পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৪৬৬ খ্রীষ্টাব্দে থেকে ১৪৮৭ খ্রীষ্টাব্দে পর্যন্ত সময়ে ইরানী ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতানেরা বাংলা শাসন করেন। তারপর ১৪৮৭ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৪৯৩ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত আবিসিনীয় হাবশী বংশের সুলতানের সল্পকালীন শাসনের পর ১৪৯৩ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৫৩৮ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত আরবী হোসেন শাহী বংশের সুলতানেরা এ দেশ শাসন করেন। ১৫৩৮ খ্রীষ্টাব্দে হুমায়ুন বাংলা দখল করেন। কিন্তু তিনি বেশী দিন তা ধরে রাখতে পারেন নি। ১৫৩৯ খ্রীষ্টাব্দে শের শাহ বাংলার অধিকার নেন এবং তখন থেকে ১৫৭৬ খ্রীষ্টাব্দে দাউদ কাররানীর পরাজয় পর্যন্ত বাংলার আফগান পাঠান সুলতানদের শাসনাধীনে ছিল। ১৫৭৬ খ্রীষ্টাব্দের থেকে দিল্লীর মোগল সম্রাটদের নিযুক্ত সুবেদাররা বাংলা শাসন করতে থাকেন। আইনগত মোগল সম্রাটের সুবেদার থাকলেও কার্যত ১৭১৭ খ্রীষ্টাব্দে মুর্শিদ কুলি খাঁ বাংলায় স্বাধীন নবাবতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভ পর্যন্ত এই নবাবরাই বাংলা শাসন করেন। এঁদের মধ্যে মুর্শিদকুলি খাঁ ছিলেন দক্ষিণাত্যের এক ব্রাহ্মণ বংশজাত, সুজাউদ্দিন তুর্কি এব আলিবর্দী আরবী মুসলমান।

বখতিয়ার বাংলা জয় করে লখনৌতি বা গৌড়ে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। মাঝে কিছুদিন দেবকোটাও রাজধানী ছিল। ১৩৪১-৪২ খ্রীষ্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দিন আলী শাহ তাঁর রাজধানী পান্ডুয়া বা পুন্ড্রনগরে স্থানান্তরিত করেন। পরবর্তী এক'শ বছর পান্ডুয়াই বাংলার রাজধানী ছিল। পরবর্তী ইলিয়াস শাহী আমলে বাংলার রাজধানী ছিল গৌড়। আফগান সুলতান সুলেমান শাহ কাররানী বাংলার রাজধানী তান্তা থেকে রাজমহলে স্থানান্তরিত করেন। শের ইসলাম খান রাজমহলের স্থলে ঢাকাতে রাজধানী করেন। মুর্শিদকুলি খাঁ ঢাকা থেকে রাজধানী মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসেন। মোগল সুবেদারদের মধ্যে মানসিং এবং টোডরমল্ল ছাড়া আর সকলেই ছিলেন বিদেশী মুসলমান। কাজেই দেখা যাচ্ছে গণেশ, মানসিং ছাড়া মধ্যযুগে বাংলার শাসনভার যাঁদের হাতে ছিল তাঁদের সকলেই ছিলেন মুসলমান।

বাংলার সুলতান-সুবেদাররা ইসলামী বিধি অনুসারে দেশ শাসন করতেন। ইসলামী বিধি অনুসারে দেশ শাসন 'আমেরুল মোমেনিন' অর্থাৎ বিশ্বাসী মুসলমানগনের নেতা এবং মুসলমানদের দ্বারাই তাঁর নির্বাচিত হওয়ার কথা। কিন্তু ওমায়েদদের কাল থেকেই রাজপদ বংশগত হয়ে পড়েছিল। আব্বাসীয়রাও সেটা মেনে নিয়েছিল। তবে বাস্তবে শুধু বংশগত নয়, অস্ত্রবলও ঠিক করে দিত শাসক কে হবে। স্বাধীন সুলতানেরা তাঁদের রাজকর্মচারীদের নিয়োগের ব্যাপারে ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাধীন, কিন্তু অধীন সুলতান এবং সুবেদারদের এ ব্যাপারে দিল্লীর সম্মতি নিতে হত। সেই মত বিভিন্ন উজীর (মন্ত্রী), মজলিস (পদস্থ কর্মচারী), দবীর (সেক্রেটারী), লস্কর(সেনা), গুমাশ-তাহ (রাজস্ব আদায়কারী) প্রভৃতি নিযুক্ত হতেন। প্রধানমন্ত্রীকে অনেক সময় খান-ই-জাহান বলা হত। সুলতানের প্রধান সচিবকে বলা হত দবীর-খাস। সুলতান বা সুবেদার স্বয়ং ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান। তবে নির্দিষ্ট অভিযানের প্রধানকে সর-ই-লস্কর বলা হত। অশ্বারোহী, গজারোহী, পদাতিক এবং নৌ এই চার প্রকার?সৈন্য ছিল। সেনাবাহিনীর গঠন ছিল পিরামিডাকৃতি। যেমন একজন খাঁয়ের অধীনে দশ জন মালিক একজন মালিকের অধীনের দশজন আমীর একজন আমীরের অধীনে দশজন সিপাহ-সালার, একজন সিপহসালারের অধীনে দশজন সর-ই- খেল এবং একজন সর-ই-খেলের অধীনে দশজন অশ্বারোহী থাকত।

কাজীরা ইসলামের বিধান অনুযায়ী বিচার করতেন। রাষ্ট্রের ভিত্তি ধর্মীয় হওয়ায় অমুসলমানদের সমানাধিকার ছিল না। তবে তাদের সহ্য করা হত, শাসন কার্যেও নিযুক্ত করা হত। ‘স্বাধীন সুলতানদের আমলে শুধু মুসলমানরা নহে, হিন্দুরাও শাসনকার্যে গুরুত্বপূর্ণ অংশ গ্রহণ করিতেন। এমন কি, তাহারা বহু মুসলমান কর্মচারীর উপরে ‘ওয়ালি’ (প্রধান তত্ত্বাবধায়ক)-ও নিযুক্ত হইতেন। বাংলার সুলতানের মন্ত্রী, সেক্রেটারী, এমন কি সেনাপতির পদেও বহু হিন্দু নিযুক্ত হইয়াছিলেন।’



সেন শাসনের উচ্ছেদে জনসাধারণের মনে কোন ক্ষোভের সঞ্চার হয়নি। বৌদ্ধরা তো খুশীই হয়েছিল। রাজরোষ এবং ব্রাহ্মণদের অত্যাচার তাদের ওপরই হত সব থেকে বেশী। স্বাভাবিকভাবেই মুসলমান আক্রমণকারীদের তারা ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষাকর্তা বা উদ্ধারকর্তা ভেবেছিল। রামাই পন্ডিতের শূন্যপুরাণের ‘নিরঞ্জনের রুস্মা’ ছড়াটিতে সেই রকম মনোভাবই ব্যক্ত হয়েছে:



জাজপুর বাদি, সোল শা ঘর বেদি,



বেদি লয় কন্ন এ লগুন।



দক্ষিণ্যা মাগিতে জায়, জার ঘরে নাহি পায়



শাপ দিয়া পোড়ায় ভুবন ॥



মালদহে লাগে কর, ন চিনে আপন পর



জালের নহিক দিশপাশ।



বলিষ্ঠ হইয়া বড়, দশ বিশ হৈয়্যা জড়,



সদ্ধর্মীরে করে বিনাশ ॥



বেদে করি উচ্চরণ, বের‌্যা অগ্নি ঘনে ঘন,



দেখিয়া সভায় কম্পমান।



মনেতে পাইয়া মর্ম, সবে বোলে রাখ ধর্ম,



তোমা বিনা কে করে পরিত্রাণ ॥



এইরূপে দ্বিজগন,করে ছিষ্টি সংহরণ,



বড় হইল অবিচার।



বৈকুন্ঠে থাকিয়া ধর্ম, মনেতে পাইয়া মর্ম,



মায়াত হইল অন্ধকার ॥



ধর্ম হৈলা জবনরূপী মাথায়েত কাল টুপি



হাতে শোভে ত্রিকচ কামান।



চাপিয়া উত্তম হয় ত্রিভুবনে লাগে ভয়



খোদা বলিয়া এক নাম ॥



নিরঞ্জন নিরাকার হৈলা ভেস্ত অবতার



মুখেতে বলে দম্বদার।



জথেত দেবতাগণ সভে?হৈয়্যা এক মন



আনন্দেত পারিলা ইজার ॥



ব্রহ্মা হৈল্যা মহামদ বিষ্ণু হৈল্যা নেকাম্বর



আদসু হইলা শূলপাণি।



গণেশ হইলা গাজী কার্তিক হইলা কাজী



ফকির হইলা জথ মুনি ॥



তেজিআ আপন ভেক, নারদ হইলা শেক ,



পুরন্দর হইল মলনা।



চন্দ্র সুর্য আদি দেবে, পদাতিক সেবে



সভে মিলে বাজায় বাজনা ॥



আপনি চন্ডিকা দেবী, তিঁহ হৈলা হায়া ববি,



পদ্মাবতী হৈলা বিবি ন্যুর।



জথেক দেবতাগণ, সভে হয়্যা একমন,



প্রবেশ করিল জাজপুর ॥



দেউল দেহাড়া ভাঙ্গে, কাড্যা দিড়্যা খাএ রঙ্গে



পাখড় পাখড় বোলে বোল।



ধরিয়া ধর্মের পাত্র, রামাঞ্চি পন্ডিত গায়,



ই বড় বিষম গন্ডগোল ॥



‘ধর্ম কথা’র ‘ঘর ভাঙ্গার’ ছড়াতেও একই ইঙ্গিত:



ব্রাহ্মণের জাতি ধ্বংস হেতু নিরঞ্জন,



সাম্বাইল জাজপুর হইয়া যবন।



দেউল দেহারা ভাঙ্গে গোহাড়ের ঘায়,



হাতে পুথি কব্যা কত দেয়াসি পালায়।



ভালের তিলক যত পুঁছিয়া ফেলিল,



ধর্মের গাজনে ভাই যবন আইল।



দেউল-দেহারা যত ছিল ঠাঁই ঠাঁই,



ভগ্ন করি পাড়ে তারে না মানে দোহাই।



তারানাথের বিবরণী থেকে জানা যায় যে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বখতিয়ার খলজীর গুপ্তচরের কাজ করেছিল। তথাকথিত নিম্নবর্গের জনসাধারণ বা অন্ত্যজ পতিতদেরও সেন শাসনের প্রতি কোন রকম মোহ ছিল না। বরং মুসলমান শাসন তাদের ব্রাহ্মণ্য নির্যাতন এবং সামাজিক অপমানের হাত থেকে নিষ্কৃতির সুযোগ দিল। সমুদ্রযাত্রায় নিষেধাজ্ঞার ফলে যে সব মৎস্যজীবীরা সাগরে যেতে পারছিল না তারাও খুশী হল। ব্রাহ্মণ্য বর্ণাশ্রমী সমাজে যে সব অস্পৃশ্য লোকেরা এত দিন মানুষের সম্মান পায়নি, ইসলাম তাদের সামনে আশার আলো নিয়ে এল। দলে দলে তারা মুসলমান হয়ে যেতে লাগল। রাজশক্তির অভাবে ব্রাহ্মণেরাই সমাজরক্ষায় মন দিল। একদিকে যেমন শ্রীনাথশুলপানি-রঘুনন্দন-কৃষ্ণানন্দ নব্য স্মৃতির বেড়া দিয়ে ব্রাহ্মণ্য সমাজকে বাঁধতে চাইলেন অপরদিকে তেমনি চৈতন্য-অদ্বৈত নিত্যনন্দ আচন্ডালে প্রেম দিয়ে উচ্চ-নীচ সকলকে স্বীকৃতি দিতে চাইলেন। ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-বৈদ্য প্রভৃতি উচ্চ বর্ণের অনেক লোকও মুসলিম রাজ দরবারের পৃষ্ঠপোষকতা লাভের জন্য মুসলমান শাসনকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। লক্ষ্মণ সেনের সভাপন্ডিত হলায়ুধের ভণিতায় রচিত ‘শেক শুভদয়া’র প্রামাণিকতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। কিন্তু লক্ষণ সেনের সভার পঞ্চরত্নের অপর রত্ন উমাপতি ধর যে বখতিয়ারের স্তুতিবাদ করে শ্লোক রচনা করেছিলেন তাতে কোন রকম সন্দেহ নেই।



অষ্টম শতকে ইসলাম ধর্ম প্রবর্তনের ফলে আরবদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নতুন উদ্দীপনার সঞ্চার হয়। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রভূত উন্নতি হয়। আরব বণিকগণ ভারতবর্ষ এবং চীন এমন কি দূর প্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সামুদ্রিক বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করে। বিভিন্ন সমুদ্র বন্দরগুলোতে আরব বসতি স্থাপিত হয়। চীনের ক্যন্টন বন্দরে আরবদের সংখ্যা এত বেশী ছিল যে সম্রাট তাদের নিজেদের মধ্যেকার বিবাদ বিসম্বাদ মীমাংসার জন্য তাদের নিজেদের মধ্যে থেকেই কাজী নিযুক্ত করার অনুমতি দিয়েছিলেন। অষ্টম শতকেই বাংলার চট্টগ্রাম বন্দরে একটি আরব বসতি গড়ে উঠেছিল। যে সব আরব বণিক এখানে এসেছিল তারা বাণিজ্য করতেই এসেছিল। দেশ জয় কিংবা ধর্মপ্রচার এদের উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু নবম শতক থেকে যে সব সূফী দরবেশ এদেশে আসতে থাকেন তাদের উদ্দেশ্য ছিল ধর্মপ্রচার।



মুহাম্মদ (সঃ)’র মৃত্যুর পর খলিফাদের আমলে ইসলাম ধর্ম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। দামাস্কাসের ওমায়েদ বংশীয় খলিফাদের আমলে বলতে গেলে ইসলাম সর্বাধিক বিস্তৃতি লাভ করে। দেশের পর দেশ বিজিত হয়। খলিফাদের ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ, ভোগ-বিলাসিতা দেখে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা তাঁদের ধর্মগুরু বলে মানতে পারে না। বাহ্যিক আচার বর্জন করে এক শ্রেণীর লোকেরা রহস্যময় গুহ্য সাধনার দ্বারা আল্লাহ্‌-এর সঙ্গে মিলিত হতে চাইল। সুখ বা রুক্ষ পশমের জোব্বা পরত বলে এরা সূফী নামে পরিচিত হল।

সূফী সাধনার ওপর বৌদ্ধদের সাধন-পদ্ধতি এবং খ্রীস্টানদের মরমী সাধনার প্রভাব আছে।



কোরানের মধ্যেই সূফী সাধনার বীজ নিহিত আছে। পঞ্চদশ সুরা ‘হিজ্‌র’-এর তৃতীয় রুকুর ঊনত্রিশতম আয়াতে আছে, আল্লাহ্‌ মানুষের মধ্যে তাঁর রুহ্‌ (প্রাণ) সঞ্চার করেছেন। অতএব বাইরে থেকে আলাদা মনে হলেও প্রেমিক মানুষ এবং প্রেমাস্পদ আল্লাহ্‌-র মধ্যে একই স্বরূপ নিহিত আছে। আমিত্বের বিলোপ ঘটিয়ে (ফানা) আল্লাহ্‌-র সঙ্গে মিলিত হওয়াই (বাকা) সূফীর সাধনা। ধুল নুন অল-মিশরি, আবু সয়ীদ অল খবরাজ, বায়েজীদ অল বস্তামী, অল হসল বসরী, রাবেয়া, অল গজালী প্রভৃতি সাধকদের প্রচারের ফলে এই অদ্বৈতবাদী ধর্মীয় দর্শন বেশ প্রসার লাভ করল। সূফীরা বিভিন্ন দেশে তাঁদের মত প্রচারের জন্য বেরিয়ে পড়লেন। ভারতেও অনেক সূফী এলেন। এঁদের মধ্য লাহোরের সেখ ফরীদ এবং দিল্লীর নিজামুদ্দিন আউলিয়া বিশেষ উল্লেখযোগ্য।



নবম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে বায়েজীদ বস্তামী, মীর সৈয়দ সুলতান মাহমুদ সাহী-সওয়ার, শাহ নিয়ামতুল্লাহ বুৎসকিন প্রমূখ। সূফী সাধক শেখ জালালুদ্দিন তাবরেজী পান্ডুয়ায় ধর্ম প্রচার করতে আসেন। তাঁর কেরামত অর্থাৎ অলৌকিক কার্যকলাপে মুগ্ধ হয়ে লক্ষণ সেন তাঁকে পান্ডুয়ায় একটি মসজিদ নির্মাণের অনুমতি দেন এবং প্রচুর ভু-সম্পত্তি দান করেন। তিনি বহু লোককে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন।



তাহলে দেখা যাচ্ছে যে বখতিয়ার খিলজী কর্তৃক বাংলা জয়ের পুর্বেই এ দেশে ইসলাম ধর্মের প্রচার শুরু হয়েছিল এবং কিছু লোক সে ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমানও হয়েছিল। তবে তাদের সংখ্যা নিশ্চয় তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না। দেশে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই ধর্মান্তরের গতি বৃদ্ধি পায় আর বাইরে থেকে মুসলমানরাও বেশী সংখ্যায় আসতে থাকে। দেশের অর্ধেক লোক মুসলমান হয়ে যায়।



যে সব মুসলমান ধর্মপ্রচারক এদেশে ধর্ম প্রচার করতে এসেছিলেন এবং যে সব মুসলমান প্রশাসক ১২০৪ থেকে ১৭৫৭ পর্যন্ত বাংলা দেশ শাসন করেছিলেন তাঁরাই ছিলেন বাংলায় মুসলমান সমাজের কেন্দ্রবিন্দু। সাড়ে পাঁচ শ বছর ধরে মুসলমানরা এখানকার শাসনকর্তা সুলতান বা সুবেদার বা নবাব ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের সেনাবাহিনীতে, বিচার বিভাগে এবং রাজস্ব বিভাগে যেমন স্থানীয় লোকদের নিয়োগ করা হতো, তেমনি বাইরে থেকে অনেক মুসলমান নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ভারতে প্রবেশ করেছিল। তাদের অনেকে বাংলায় আশ্রয় লাভ করেছিল। আবার দিল্লী ভারতের মধ্যে প্রধান মুসলমান কেন্দ্র হলেও সেখানে সব সময় ষড়যন্ত্র-শঠতা-হত্যা আর রাজনৈতিক গোলযোগ লেগেই থাকত। বাংলা ছিল তুলনায় নিরাপদ। ফলে অনেক আমীর-ওমরাহ নিরাপত্তার আকর্ষণে বাংলায় চলে আসত। ফলে বেশ কিছু সংখ্যক অবাঙালি (আরবী, ইরানী, তুর্কী, আফগানী, হাবশী, মোগল, পাঞ্জাবী, বিহারী প্রভৃতি) মুসলমান বাংলায় বসবাস করতে শুরু করে। এ সবের উপর নির্ভর করেই খোন্দকার ফজলে রাব্বি তাঁর ফারসী গ্রন্থ ‘হকিকত-ই-মুসলমান-ই বাঙ্গালা’-এ দাবী করেছেন যে বাংলার অধিকাংশ মুসলমান বিদেশাগত আরবী, ইরানী, তুর্কী, আফগানী মুসলমানদের বংশধর। কিন্তু তাঁর এ দাবী মেনে নেয়া যায় না।



বাঙালি মুসলমানদের অধিকাংশই দেশজ অর্থাৎ ধর্মান্তরিত মুসলমান। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের প্রচারের ফলে এদেশে একটি ধারণা আছে যে এক হাতে কুরআন এবং অন্য হাতে কৃপাণ নিয়ে এ দেশে ইসলাম ধর্ম প্রচার করা হয়েছে। এ দেশের লোকদের বলপূর্বক ধর্মান্তর গ্রহণ করানো হত। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। সাড়ে পাঁচ শ বছরের শাসনে ধর্মান্তর গ্রহণের জন্য কোথাও কোন রকম বলপ্রয়োগ করা হয়নি এরকম দাবী করা যায় না। তবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রকৃত কারণ অন্যত্র নিহিত ছিল।



এ দেশের মুসলমান হয়ে যাওয়ার সব থেকে বড় কারণ ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়া আকুতি। পাল আমলে দেশে অনেক বৌদ্ধ ছিল। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষক সেন-বর্মন- দেব আমলে তাদের ওপর অকথ্য অত্যাচার হত। সেই অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পাবার আশায় তুর্কী আক্রমণকারীদের তারা দেবতার আসনে বসিয়ে ছিল। স্বাভাবিকভাবেই বহু সংখ্যক বৌদ্ধ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। বাংলার যে উত্তর ও পূর্ব অংশে বৌদ্ধদের সংখ্যা বেশে ছিল সেই উত্তর ও পূর্ব অংশে পরবর্তীকালে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ছিলেন মুন্ডিত মস্তক অর্থাৎ ন্যাড়া। তাই তাদের নেড়ে বলে বিদ্রূপ করা হত। পরে তাঁরা যখন মুসলমান হলেন তাঁদের সূত্র ধরে সব মুসলমানকেই নেড়ে বলে উপহাস করার উন্নাসিকতা প্রচলিত হল।



সেন আমলে ব্রাহ্মণরা নব্য স্মৃতি বিধানে সমাজকে এমনভাবে বেঁধেছিল যে সাধারণ মানুষ পদে পদে শোষিত, বঞ্চিত এবং অপমানিত হত।‘.... সমাজপতিদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ ও ধর্ম-ব্যবসায়ীরা মানুষের বিচার-শক্তি,মনন ও মনুষত্বকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। স্মৃতি-পুরাণ বলে অভিহিত ধর্মশাস্ত্রগুলি অংশ বিশেষ চতুর বিদ্বানরা এমনভাবে রচনা করেছিল যাতে ধর্ম বা শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে সাধারণ মানুষের বৃহত্তর অংশকে অনায়াসে মানসিক ভাবে নিজেদের দাস শ্রেণীতে পরিণত করা যায় এবং সমস্ত রকম মানবিক ও সামাজিক অধিকারগুলি বা প্রাপ্যগুলি থেকে বঞ্চিত করে তাদের শ্রম,তাদের ভূমি ও তাদের নারী ভোগ করা যায়।’ সমাজে তাদের ছোয়াঁ তো দুরের কথা, ছায়া মাড়ালেই উচ্চ বর্ণের লোকেরা কলুষিত হয়ে যেত এবং প্রায়শ্চিত করতে হত। উচ্চবর্ণের লোকেরা যাতে তাদের ছোঁয়াচ এড়িয়ে চলেতে পারে তার জন্য অস্পৃশ্যদের গলায় ঘন্টি ঝুলিয়ে চলতে হত। কিন্তু সে যদি মুসলমান হয়ে যেত, তাহলে কী হত?



পৃথিবীর কোন ধর্মই সম্পুর্ণ সাম্যবাদী নয়-ইসলাম ধর্মও নয়। তবে তৎকালে প্রচলিত ব্রাক্ষণ্য ধর্মের তুলনায় ইসলাম ধর্ম মানুষকে অনেক বেশী সমানাধিকার দেয়। মুসলমান হলে সে অন্তত তত্বগতভাবে আর যে কোন মুসলমানের সঙ্গে সমান। তার ছোঁয়া লাগলে তার সমাজে আর কারও জাত যায় না। কুরআন পড়তে তার কোন বাধা নেই। মসজিদের জামাতে সে যে কোন সম্ভ্রান্ত লোকের পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে পারে। আর ঘটনাক্রমে যদি দেশের বাদশাহও তার পিছনের সারিতে দাঁড়ান, তবে সিজদা দেওয়ার সময় তাঁর মাথা তার পায়ের কাছে এসে পড়ে। ব্রাহ্মণ্য সমাজ যাদের পতিত, অস্পৃশ্য অর্থাৎ ছোয়ারও অযোগ্য করে দুরে সরিয়ে রেখেছিল, ইসলাম তাদের সবরকম শৃঙ্খলমুক্ত করে সমাজে প্রতিষ্ঠা করেছিল। সমাজের নিু বর্গের লোকদের মুসলমান হওয়ার এতটাই প্রলোভন ছিল।



সুফী দরবেশরা এই কাজটাই করতেন। যে লোকটাকে ব্রাহ্মণ্য সমাজ জীবনের সব রকম সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে পতিত, অস্পৃশ্য করে গলায় অপমানের ঘন্টা বেঁধে চলতে বাধ্য করেছিল সুফীরা তার গলার ঘন্টা খুলে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই অন্তত ধর্মীয় অধিকারের ক্ষেত্রে দেশের শাসকের পাশে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। যার ফলে নিু বর্ণের অত্যাচারিত মানুষেরা দলে দলে মুসলমান হয়ে যাচ্ছিল।



বাংলায় মুসলমানদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই সুফীরা আসতে শুরু করেছিলেন। মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তাঁদের সংখ্যা আরও বাড়তে লাগল। বিভিন্ন জায়গায় খানকাহ প্রতিষ্ঠা করে তাঁরা ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করলেন। ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত বাংলায় সুফী প্রচারের স্বর্ণযুগ। ত্রয়োদশ শতকে বীরভুমে আবদুল্লাহ কিরমানী, বর্ধমানে মখদুম শাহ গজনবী ওরফে বাহীপীর, পান্ডুয়ায় দরবেশ শাহ সফিউদ্দিন, পান্ডুয়া-ত্রিবেণী অঞ্চলে জাফর খাঁ, চব্বিশ পরগনায় সৈয়দ আব্বাস আল্লী মক্কী ওরফে পীর গোরাচাঁদ, যশোরে বড় খাঁ গাজী, বাঁকড়ায় মুবারক গাজী, ঘুটিয়ারী শরীফে শরীফ শাহ, পাবনায় মখদুম শাহ দৌলা, দিনাজপুরে পীর বদরুদ্দিন, ঢাকায় সৈয়দ আলী তবারকী, মীরপুরে সুলতানুল আউলিয়া শাহ আলী বাগদাদী, নোয়াখালিতে সৈয়দ মৌলানা আহমদ তনুরী, সন্দ্বীপে বখতিয়ার মৈসুরী, ফরিদপুরে ফরিদুদ্দিন শফর গঞ্জ, শ্রীহট্টে শাহ জালাল, চট্টগ্রামে বদরুদ্দিন আল্লামহ প্রকাশ বদর শাহ প্রমূখ সূফী সাধকগণের চেষ্টায় ইসলাম বিস্তার লাভ করতে থাকে।



চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকেও এই ধারা অব্যাহত ছিল। এই দুই শতকে গৌড়ের আখি সিরাজুদ্দিন, আলউল হক, নূর কুতুব আলম, শেখ হুসেন, গৌড়-পান্ডুয়া-সোনারগাঁয়ে শেখ জাহিদ, শেখ রাজা বিয়াবানী, শাহ আল্লাহ, ফুরফুরায় শাহ্‌, আনোয়ার কুলী কলবী, কালনায় পীর বদরুদ্দিন বদর-ই-আলম, বীরভুমে মখদুম শাহ জাহিরুদ্দিন, মেদিনীপুরে পীর মাহাজীও, দিনাজপুরে সৈয়দ নেকমর্দান, চিহিল গাজী, রংপুরে মাহীগাজী শাহ জালাল বোখরী, রাজশাহীতে মৌলানা শহদৌলা, হামিদ দানিশমন্দ, বারাসাতের একদিল শাহ, খুলনার উলুখ খানি-ই-জাহান, সোনারগাঁয়ে পীর মাল্লা শাহ, হাজীবাবা সালেহ, বাখেরগঞ্জের দরবেশ খৈদুল আরেফীন, চট্টগ্রামে শাহ মহসীন আউলিয়া, শাহপীর, শাহ চাঁদ আউলিয়া, ত্রিপুরায় হজরত রাস্তী শাহ, নোয়াখালীতে হজরত ফয়জুল্লাহ শাহ প্রমূখ সূফী সাধকরা তাঁদের শিষ্য সহচর নিয়ে ইসলাম প্রচারে ব্যাপৃত ছিলেন।



ষোড়শ শতকে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের ফলে সমাজে সূফীদের প্রভাব অনেক কমে যায়। তবুও তাদের আগমন ও ধর্ম প্রচার অব্যাহত ছিল। আরব ইরান-তুরান থেকে এই যে সব সূফীরা এসেছিলেন তাঁরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিলেন। আজমীরের মুইনুদ্দিন চিশতী চিশতিয়া সম্প্রদায়ের সূফী ছিলেন। শেখ বাহাউদ্দিন ধকরিয়া মুলতানী সোহরাওয়ার্দীয়া সমপ্রদায়ের সূফী ছিলেন। চিশতিয়া ও সোহরাওয়ার্দীয়া ছাড়া পঞ্চদশ শতকে কাদেরিয়া এবং নকশবন্দীয়া নামে আরও দুটি সমপ্রদায়ের সূফীরা এদেশে আসেন। কাদেরিয়া সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা বাগদাদের আবদুল কাদের জিলানি। সৈয়দ মুহম্মদ গৌথ ভারতে এই মত প্রচার করেন। তুর্কীস্তানের খাজাউদ্দিন নকশবন্দ নকশবন্দীয়া সমপ্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। ভারতে এই সমপ্রদায়ের আদি প্রচারক হজরত মহমদ বাকী বিল্লাহ।



আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরীতে হাবীবী, তয়ফুরী, ফরখী, মকতী, জুনয়দী, কায়রূনী, তুর্সী, ফেরদৌসী, সোহরাওয়ার্দী, যায়দী, ইয়াজী, আহমদী, হুবয়বী, চিশতি এই চৌদ্দটি সূফী সমপ্রদায়’র উল্লেখ আছে। ষোড়শ শতক নাগাত ভারতে শাওরী এবং মাদারী সমপ্রদায়ও প্রাধান্য অর্জন করেছিল। বাংলাদেশে চিশতিয়া, সোহরাওয়ার্দীয়া, কলন্দরিয়া, আহমদীয়া, মাদরীয়া, নকশবন্দীয়া, কাদেরিয়া সমপ্রদায় বিশেষ প্রভাবশালী ছিল। ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে শাত্তারিয়া এই সমপ্রদায়ের মত প্রচার করেন। ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে বাংলায় সব চাইতে বেশী প্রভাব ছিল কলন্দরিয়া সমপ্রদায়ের। পান্ডুয়ার শাহ সফিউদ্দিন এই মত প্রচার করেন। ষোড়শ-শতকে এই সমপ্রদায় এত প্রসার লাভ করে যে লোক মুসলমান সাধক বলতেই কলন্দর বুঝত। তাই মুকুন্দরাম লিখেছেন, ‘কলন্দর হয়্যা কেহ ফিরে দিবা-রাতি।’ সপ্তদশ শতকে মুসলমানরাও কলন্দর অর্থে সকল সূফী ও মুসলমান সাধককে বুঝত। চট্টগ্রাম থেকে আরবী হরফে মুদ্রিত ‘যোগ কলন্দর’ নামক পুথি আবিষ্কৃত হয়েছে।



কয়েক শ’ বছর ধরে এই সব ধর্মপ্রাণ সূফীদের প্রচারের ফলে দলে দলে লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। সূফীদের সাধনায় বৌদ্ধধর্মের মাধ্যমে ভারতীয় যোগের প্রভাব পড়েছিল। আবার অন্যদিকে তাঁদের আগমনের পূর্বে এখানে তান্ত্রিক ধর্মকর্ম প্রচলিত ছিল। তান্ত্রিক গুরুদের লোকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে বিশ্বাস করত। সূফী দরবেশদের সাধনাও ছিল তান্ত্রিক গুরুদের মত। ফলে এখানকার সাধারণ লোক খুব সহজেই সূফীদের তান্ত্রিক গুরুদের আসনে বসালো। সূফীরা ইসলামের শরিয়তী বিধান মেনে চলতেন না এবং তাঁদের ধর্মীয় গোঁড়ামী ছিল না। ফলে খুব সহজেই সাধারণ মানুষ তাদের প্রতি আকৃষ্ট হত। ‘হিন্দু সমাজের নিম্নশ্রেণীর লোকেরা নানা অসুবিধা ও অপমান সহ্য করিত। কিন্তু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিলে যোগ্যতা অনুসারে রাজ্য ও সমাজে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করার পক্ষেও তাহাদের কোন বাধা ছিল না। বখতিয়ার খিলজীর একজন মেচজাতীয় অনুচর গৌড়ের সম্রাট হইয়াছিলেন। এই সকল দৃষ্টান্তে উৎসাহিত হইয়া যে নিম্নশ্রেণীর হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিত ইহাতে আশ্চর্য বোধ করিবার কিছু নাই।’(চলবে)





উৎস:

বাংলায় হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক ------ ড. নজরুল ইসলাম



মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ১২:৪৮

ভাঙ্গাচুরা যন্ত্রপাতি বলেছেন: ভাল লিখেছেন।

২| ০৫ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ৯:৫৪

রাখালছেলে বলেছেন: ওয়াও...সুন্দর হয়েছে । আরও দিন । তবে কিছু ছবি যুক্ত করতে পারলে মাথাটা আরও বেশী যুক্ত হতে পারে । ধন্যবাদ ।

৩| ০৫ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ১০:০৯

মামুন রশিদ বলেছেন: ইতিহাস বেশ সুন্দর ভাবেই উঠে এসেছে । লেখায় তথ্য সূত্র দেয়ায় অনেক ধন্যবাদ ।


ভালোলাগা +

৪| ০৫ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ১০:২৭

েবনিটগ বলেছেন: এই লোটা ভর্তি কোটা নিয়ে যারা মোটা কথা বলে তাদের বোটাসহ মূলৎপাটন করলে গোটা দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটা এখন সময়ের দাবি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.