নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

I have a dream...

নিরন্তর সত্যের উপর পথ চলি, দুমড়ে মুচড়ে দেই সব বাধা!

আব্দুল হালিম মিয়া

আব্দুল হালিম মিয়া › বিস্তারিত পোস্টঃ

মুক্তিযুদ্ধের টুকরো স্মৃতি

২০ শে জুলাই, ২০১৩ সকাল ৯:৫৯

এক.

১৯৬৯ সাল। ক্লাস থ্রি'র ছাত্র। কোন এক প্রিয় স্যারের ক্লাস চলছিল। হঠাৎ গগন বিদারী শ্লোগানের শব্দে এক দৌড়ে দরজায়। চেয়ে দেখি হাই স্কুলের ছাত্ররা বিশাল এক মিছিল নিয়ে আমাদের স্কুলের দিকেই আসছে। অনেকের হাতেই হকি স্টিক। ক্লাসে ক্লাসে এসে সবাইকে মিছিলে আসার আহবান করতে লাগলেন ওনারা। সম্ভবত স্যারদের চোখের ভাষা বুঝতে পারলাম আমরা, কিছুক্ষণের মধ্যেই স্কুল ফাকা হয়ে গেল। রেল স্টেশনের মোড়ে একটু ফাকা গোল চত্বরের মত জায়গায় গিয়ে মিছিলের গতি থেমে গেল। হঠাত শুরু হলো হুড়োহুড়ি। কারা যেন মুসলিম লীগ সমর্থিত এক দোকানে জোরপূর্বক ঢকে গেছে। প্রচণ্ড শ্লোগান, হুড়োহুড়ির মধ্যে বের হয়ে এলো স্বৈরশাহী আইয়ুব খানের ফ্রেমে বাধানো ছবি দোকানের ওয়াল থেকে জোর পূর্বক খুলে নিয়ে। বাইরে এসেই প্রচণ্ড গতিতে মাটিতে আছাড় দেয়া হলো। তারপর শুরু হলো ওটার উপর পা দিয়ে ক্রমাগত আঘাত। কে কার আগে লাথি মারবো সে প্রচেষ্টায় সফল হতে বেশ দেরী হয়ে গেল। ততক্ষণে মিছিলের সামনের অংশটা বেশ কিছদুর এগিয়ে গেছে। দৌড়ে গিয়ে আবার শ্লোগান ধরলাম, "আইয়ুব, মোনায়েম দুই ভাই, এক দড়িতে ফাঁসি চাই", "ঢাকা না পিণ্ডি, ঢাকা, ঢাকা", "এগার দফা, এগার দফা মানতে হবে", "ছয় দফা, এগার দফা মানতে হবে, মানতে হবে।" মিছিলটি যতই সামনের দিকে এগুচ্ছে, ততই মিছিলের কলেবর বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর শ্লোগানের তেজ বাড়ছে যখন মুসলিম লীগের এমপির বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছি আমরা। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম তৎকালীন জমিদারের কাচারিতে। তিনি ছিলেন এমপি সাহেবের বড় ভাই। তার ছিল কিছু পাইক পেয়াদা। একজনের নাম ছিল 'অকেল দেওয়ান।' তার ওই বিশাল কাচারী ছিল এক প্রকার নির্যাতন কেন্দ্র। যারা খাজনা দিত না বা কথা শুনতো না, তাকে ধরে এনে এখানে প্রচণ্ড রকম নির্যাতন করা হতো। জনশ্রুতি আছে, তার বিশ্বস্ত অকেল দেওয়ানকে যদি তিনি বলতেন কাউকে ডেকে আনতে, অকেল তাকে ধরে নিয়ে আসতো, আর যদি কাউকে ধরে নিয়ে আসতে বলতেন, তাহলে তাকে বেঁধে নিয়ে আসতো। যাহোক, আমরা মিছিল নিয়ে ওখানে পৌঁছেই জোরপূর্বক গেট ভেঙ্গে ওখানে ঢুকে গেলাম। শুরু হলো ভাংচুর। কে যেন ভেতর থেকে একটা ঢাউস সাইজের রেডিও নিয়ে এলো। গোসলখানা জায়গাটা ছিল ইট সিমেন্ট দিয়ে বাধানো। ওখানে রেডিওটা এনে সাজোরে মেঝের উপর আঘাত করে চুরমার করা হলো। চোখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। যে যন্ত্রটার ভিতর থেকে গান, নাটক, সরকার কবিরুদ্দিনের গুরু গম্ভীর কণ্ঠে সকালের খবর শোনা হয়, তার ভেতরটা কেমন প্রচণ্ড কৌতুহুল নিয়ে বেশ কিছু সময় দেখছিলাম। ওর ভেতরটায় কি যেন খুজছিলাম, কিন্তু শত শত প্যাঁচানো গোছানো লাল নীল তার ছাড়া আর কিছুই পেলাম না। কে যেন পেছন থেকে শার্ট ধরে টানাটানি করছিল, পুলিশ এসে এখুনি এরেস্ট করতে পারে, সরে পরতে হবে।



দুই.

ছোটবেলায় সন্ধ্যার পর বাসা থেকে বের হওয়া একেবারেই নিষেধ ছিল, তার উপর সেই সময়ের উত্তাল দিনগুলিতে তো কথাই নেই। তারপরও বাসার সামনে দিয়ে যখন মিছিল যেত, ভেতরটা কেমন যেন করে উঠতো, দৌড়ে বাইরের ঘরের জানালা খুলে দেখতাম কারা মিছিল নিয়ে যাচ্ছে, কি কি শ্লোগান দিচ্ছে। বেশীরভাগ সময়ই খুব সুন্দর করে, রঙ বেরঙের নৌকা বানিয়ে মিছিল হতো, সেই সাথে কি সব সুমধুর শ্লোগান, 'জেগেছে জেগেছে, বাঙালি জেগেছে' 'শেরে বাংলার বাংলা, জেগেছে জেগেছে' 'সোহরাওয়ার্দির বাংলা, জেগেছে জেগেছে' 'শেখ মুজিবের বাংলা, জেগেছে জেগেছে', 'ভোট দিন ভোট দিন, নৌকা মার্কায় ভোট দিন', 'নৌকা মার্কায় দিলে ভোট, শান্তি পাবে দেশের লোক' ইত্যাদি।

১৯৭০ এর সেই ঐতিহাসিক নির্বাচনের কয়েকদিন মাত্র বাকী। রাত প্রায় দশটা, শীতের রাত, প্রায় সবাই ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় হঠাত মিছিলের আওয়াজ। দৌড়ে বাইরে এসে দেখি নৌকার মিছিল, সর্বসাকুল্যে ১০ থেকে ১৫ জনের বেশী নয়। ভুলে গেলাম মা'য়ের বকুনি আর বাবার চোখ রাঙানীর কথা। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম বাসা থেকে সামান্য দুরে ধানহাট নামক জায়গায়। মুসলিম লীগের এমপি ক্যান্ডিডেট, মাছ মার্কার নিজাম উদ্দীন সাহেবের বিশাল মিছিল ও সমাবেশের পাশে, প্রায় ঘেরাওয়ের মধ্যে। আমরা জনা দশেক মানুষ, আর ওরা প্রায় পাঁচ শতাধিক। এর মধ্যেও গগন বিদারী শ্লোগান দিচ্ছি, মাছ খাব না ডাল খাব, নৌকা মার্কায় ভোট দেব। শ্লোগান দেই আর ওদের দিকে তেড়ে তেড়ে যাই। মনে পড়ে, এমন গরম পরিস্থিতিতেও প্রতিপক্ষ নিজাম মিয়ার বড় ছেলে নাজির উদ্দীন ও অন্যান্যরা মিলে মানব বন্ধন রচনা করে আমাদের সাথে বড় রকমের একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ওই রাতে এড়াতে সক্ষম হন।



তিন.

অবশেষে নির্বাচনের দিন । সকাল থেকেই খুব উত্তেজিত। ক্লাস থ্রির ছাত্র, ফোরে যাব যাব ভাব। আব্বাকে বললাম আমিও যাব আপনার সাথে ভোট কেন্দ্রে। বাবা রাজী হলেন, রিকসায় চেপে (সম্ভবত) ভোট কেন্দ্রে গেলাম। যেতে যেতে বাবাকে বললাম, আব্বা ভোট কিন্তু নৌকা মার্কায় দিতে হবে। বাবা মুচকি মুচকি হাসছিলেন। কেন্দ্রে যেয়ে বাবা অবাক করা ঘটনা ঘটালেন। ভোট দেয়ার সাধারণ নিয়ম হলো ব্যালট পেপার নিয়ে বুথের ভিতর গোপনে সিল মারতে হবে। বাবা তা না করে প্রিসাইডিং অফিসারের টেবিলেই যেখান থেকে ব্যালট ছিঁড়ে দেয়া হয়েছিল, সেখানেই সবার সামনে আমাকে দেখিয়ে বললেন, এই দেখ আমি তোমার কথামত নৌকায়ই ভোট দিলাম। বলেই নৌকায় সিল মেরে বাবা ব্যালট বাক্সে পুরলেন। আশে পাশের সবার মুখেই তখন আনন্দের ঝিলিক।



চার.

১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চ। জানুয়ারিতেই প্রমোশন পেয়ে ক্লাস থ্রি থেকে ফোর এ উঠেছি। এতসব উত্তেজনাকর পরিস্হিতির মাঝেও রোল নং এক রাখতে পারায় মা, বাবা দু'জনই খুশী। ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শুনলাম বাসায় বসে রেডিওতে। কয়েকদিনের মধ্যেই বাড়ীতে বাড়ীতে, বটগাছের মাথায় বাংলাদেশের মানচিত্র-খচিত লাল সবুজের পতাকা টানিয়ে দেয়া হলো। নদীর পাড়ে ইপিআর এর ঘাটি বানানো হলো। ২৫শে মার্চের ভয়াল সেই কালো রাত যতই কাছে আসতে লাগলো, ততই চারিদিকে গুজব, গুঞ্জন ছড়াতে লাগল। দুর থেকে কোন ফেরী বা জাহাজ দেখা গেলেই সবাই ভাবতাম এই বুঝি পাকিস্তানি মিলিটারি এসে গেল। এদিকে দলে দলে ঢাকা ছেড়ে আসা মানুষের পদভারে মুখরিত হতে লাগলো আমাদের এলাকা। ঘাট এলাকায় আমাদের বাসা, প্রতিদিন আতংকিত মানুষের ছুটে যাওয়া লক্ষ্য করছি। কাউকে কাউকে বিশ্রামের জন্য ব্যবস্হা করতে হয়েছে। এর মধ্যে শুরু হলো বিহারি নিধন। খুব পরিচিত আমাদের ফ্যামিলি ডাক্তার মোস্তফার ভাই, বাবুলকে মেরে ফেলা হলো। বাবুল মাঝে মাঝে আসতেন আমাদের সাথে ক্যারাম খেলতে। তার নামাঙ্কিত একটা স্ট্রাইক উপহার দিয়েছিলেন আমাকে। তার মৃত্যুতে দুঃখ পেয়েছিলাম, কিন্তু কিছুই করার ছিল না আমাদের। ওই সময়ে আমাদের ছাত্রলীগ নেতা জব্বার ভাই একটা থ্রি নট থ্রি বন্দুক নিয়ে বড় রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে টহল দিতেন। যদিও সবাই জানতো পাকিস্তানি মিলিটারিদের কাছে এটা খেলনা ছাড়া আর কিছুই না, তারপরও সেটা ছিল একটা প্রতীকী উত্সাহ দেয়া। ২৫ শে মার্চের দুতিন দিন আগে আমরা শহরে থাকা আর নিরাপদ মনে করলাম না, চলে গেলাম কয়েক মাইল দুরে গ্রামে, বড় চাচার বাড়ী। ২৬ অথবা ২৭ তারিখ (ঠিক মনে নেই) যেদিন গোয়ালন্দে আর্মি সত্যি সত্যি চলে এলো মর্টার ছুড়তে ছুড়তে আমরা বড় চাচার বাড়ীতেও আর সেইফ মনে করলাম না। নৌকায় করে যাত্রা শুরু করলাম আরো গভীর গ্রামের দিকে। নৌকার মধ্যেই সারাটা দিন কাটলো, রান্নাও হলো ওখানে। নৌকা চলছে, সই এর উপর বসে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছি ফেলে আসা আমার প্রিয় স্মৃতির শহর গোয়ালন্দের দিকে। ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসছে সবকিছু, হঠাৎ দেখি আগুনের লেলিহান শিখা। সম্ভবত পাশ দিয়ে দ্রুত গতিতে চলে যাওয়া অপর এক নৌকা থেকে গলা বাড়িয়ে কে যেন আমাদেরকে দেখেই চিনতে পেরে বলে উঠলো, ওই যে আগুনের ধোয়া দেখছেন, ওটা আপনাদের বাড়ী, পুড়িয়ে দিল মিলিটারিরা। আমরা ভয়ে আরো দ্রুত চালাতে তাগিদ দিলাম মাঝিদেরকে। সন্ধ্যার পর পর পৌঁছে গেলাম বেতকার চরে মকিম ভাইদের বাড়িতে। সেখানে দুদিন কাটানোর পর, সোজা পাবনার শ্যামপুরে নানা বাড়ী। যুদ্ধের পুরো নয় মাস সেখানেই কাটাই। অনেক স্মৃতি সেখানে। সম্ভবত ১৬ কিংবা ১৭ ডিসেম্বর ফিরে যাই গোয়ালন্দে। গিয়ে দেখি আমাদের বাড়ী আল্লাহর বিশেষ রহমতে অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। তবে পুরো বাড়ী লুট হয়েছে, কোন কিছুই নেই, শুধু বাড়িটি ছাড়া। অবাক করা কাণ্ড, তাহলে ওই দিন কার বাড়ী পুড়লো? আসলে সেদিন যেটা ঘটেছিলো তা হলো, আমাদের বাড়ীর এক বাড়ী পরেই সেই জমিদার মুসলিম লীগ এমপির বড়ভাই এর বাসা। বাসা দুটো বাইরে থেকে দেখতে একদম একই রকম। তো যেদিন গোয়ালন্দে মিলিটারি প্রথম প্রবেশ করে, তখন ওই জমিদার সাহেব মিলিটারিকে বলেছিল তোমরা বাজারের মেইন রোডে গেলে হাতের বাম দিকে প্রথমেই যে সাদা রঙ করা বাসাটা দেখতে পাবে সেটা পুঁড়িয়ে দিবে। কিন্তু আল্লাহর কি ইচ্ছা, ওরা যে দিক দিয়ে বাজারে ঢোকার কথা সেদিক দিয়ে না ঢুকে কোন কারনে অন্য দিক দিয়ে প্রবেশ করেছে এবং প্রথমেই যে সাদা রঙ করা বাসাটা দেখতে পেয়েছে সেটা পুঁড়িয়ে দিয়েছে। আর আশ্চর্যের বিষয় হলো, সে বাড়ীটা ছিল যিনি পোড়ানোর উপদেশ দিয়েছিলেন খোদ সেই মুসলিম লীগের নেতার বাড়ী।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে জুলাই, ২০১৩ দুপুর ২:৪০

নিষ্‌কর্মা বলেছেন: সেই ছোট বেলায় শোনা শ্লোগানগুলো সবই মনে আছে দেখছি!

২০ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ১১:২২

আব্দুল হালিম মিয়া বলেছেন: প্রায় সবই মনে আছে, ব্রাদার নিষকর্মা। থ্যাংকস।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.